#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_১
#সাদিয়া_তাসনিম
‘ সৌহার্দ্য পঞ্চায়ত প্রধানের ছেলের সাথে মারামারিতে জড়িয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই খারাপ।রামুকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলেন মাস্টার মশাই। আপনি না গেলে তাকে আটকানো যাবে না। আমরা অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু তাকে কিছুতেই আটকাতে পারছি না।’
গগনচুম্বী চিৎকার করতে করতে তালুকদার বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে কথাটা বললো সৌরভ। কামরুল তালুকদার তখন উঠানে দাঁড়িয়ে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছিলেন।কিন্তু আচমকাই পরিচিত কন্ঠ শুনে কামরুল তালুকদার ফোনটা কান থেকে নিচে রেখে তালুকদার বাড়ির চৌকাঠের দিকে তাকাতেই সৌরভকে দেখলেন সাথে সৌরভকে বাড়ির চৌকাঠে বৃষ্টিবাদলের দিনে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে বিষ্ময়ে চোখ ছোট ছোট করে নিলেন তিনি। কামরুল তালুকদার বয়সের প্রভাবে কানে একটু কম শোনে তাই সৌরভ কথাগুলো বলার পরও যখন কামরুল তালুকদারকে কিছু বলতে দেখলেন না তখন সে কথাগুলো আবারও এক নিশ্বাসের বললো। কামরুল তালুকদার তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৌরভের মুখ থেকে কথা গুলো শুনার সাথে সাথে নিজের চোখ-মুখ কুঁচকে নিলেন।ফুরফুরে মেজাজে তার এক নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে গেলো তার। সৌহার্দ্য এখানে কখন এলো? তার তো এখন ঢাকাতে থাকবার কথা তাহলে? আর এখানে আসলেও রামুদের সাথে মারামারি কেন করছে তার সৌহার্দ্য ? কামরুল তালুকদার সৌরভের কথাগুলো শুনে আপন মনে কিছুক্ষণ ডুবে থেকে নিজের কাছেই প্রশ্নগুলো করলেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়ে হঠাৎই তার মনের কোণায় অদ্ভুত এক দুশ্চিন্তার আগমন হলো। তিনি নিজের চোখের চশমাটা নাকের উপর থেকে ঠেলে দিয়ে আবারও চোখের উপর তুলে দিয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
‘ সত্যি সৌহার্দ্য কাউকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে?’
স্কুল মাঠ থেকে একপ্রকার নিজের নিশ্বাস বন্ধ করে কোথাও বিন্দু মাত্র না দাঁড়িয়ে এক নিশ্বাসের তালুকদার বাড়িতে দৌড়ে এসে কামরুল তালুকদারের এমন প্রশ্ন শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো সৌরভ । সে নিজের মুখে একরাশ বিরক্তি টেনে ছোট ছোট করে বলে উঠলো,
‘ শুধু মাথা ফাটায়নি এতক্ষণে হাত পাও মনে হয় ভেঙে ফেলেছে ?’
কামরুল তালুকদার সৌরভের কথা শুনে নিজের হাতে থাকা ফোনটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন ঠিক তখনই সেখানে সাঁঝ এসে উপস্থিত হলো।
সাঁঝ নিজের রুমে বসেই পড়ছিলো। সাঁঝের রুমের জানালা থেকে তালুকদার বাড়ির সদর দরজা দেখা যায় সে সেখান থেকেই সৌরভকে বৃষ্টিবাদলের দিন এমন ভাবে তালুকদার বাড়িতে হাজির হতে দেখে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে আসলো।সৌরভ এভাবে বৃষ্টি মাথায় এখানে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কেন এসেছে তা জানার কৌতুহল সে কিছুতেই ধরে রাখতে পারলো না তাই নিচে এসে উপস্থিত হলো।কিন্তু নিচে এসে সৌরভের বলা তথাকথিত কথাগুলো যেনও বিশ্বাস করতে পারলো না সাঁঝ। সৌহার্দ্য ভাই কাউকে মারতে পারে?শুধু মার না মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো মার! সাঁঝের যেনও কিছুতেই সৌরভে কথা বিশ্বাস হচ্ছে না । সৌহার্দ্যের এমন রূপের বর্ণনা শুনে সাঁঝের মায়াবী দু-চোখে লেপ্টে আসলো একটা ভয়কাতুরে ভাব। ছোট বেলা থেকে সে মারামারিকে যমের মতো ভয় পায়। সাঁঝ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে নিজের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কৌতুহলী কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুমি কী বলছো সৌরভ ভাই? সৌহার্দ্য ভাই এখানে কখন আসলো? ‘
সৌরভ তার সামনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝের কথা শুনে সাঁঝের দিকে তাকালো। ভয়কাতুরে সাঁঝকে নিজের প্রশ্নের উত্তরের আশায় নিজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলো সৌরভ । সৌরভ সাঁঝের দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সাঁঝ দৃষ্টি ঘরিয়ে অন্য দিকে তাকালো তবুও সৌরভ সাঁঝের মায়াবী দু-চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। সৌরভ বরাবরই সাঁঝের মায়াবী দু-চোখের কাছে আহত তবে এখন সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। সাঁঝকে নিজের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে দেখে সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে কামরুল তালুকদারের দিকে নিক্ষেপ করে সাঁঝের করা প্রশ্নকে উপেক্ষা করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তাড়াতাড়ি আসেন মাস্টার-মশাই। আপনি বাদের আপনার সৌহার্দ্যকে আর কেউ মনে হয় না সামলাতে পারবে। জানি না ওদিকে এখন কী হচ্ছে! ‘
সৌরভের কথাগুলো শুনে কামরুল তালুকদার আর একমুহূর্তও বাড়িতে নষ্ট করলেন না। তিনি ছাতা ছাড়ায় এমন বৃষ্টিবাদলের মধ্যে শব্দযুক্ত কদমে তালুকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সৌরভও তার পিছন পিছন ছিটলো। সাঁঝ তালুকদার বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে তার দাদুভাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়লো।
সময় এখন দুপুর বারোটা ছুঁই ছুঁই, কিন্তু আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই ৷ সাঁঝ একবার তার দাদুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কামরুল তালুকদারের পিছন পিছন যাবে কিনা। কিছুক্ষণ সাঁঝ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে হকচকিয়ে উঠে সে।তারপর যখনই মনে পরলো তার দাদু ছাতা নিয়ে যায়নি তখনই দোচোখ বড় বড় করে আর কোনো কথা না ভেবে মাথার কাপড় টেনে নিজে একটা ছাতা বের করে বিদ্যুৎ বেগে আরো একটা ছাতা নিয়ে বৃষ্টি মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। বদরের মা সাঁঝের এমন কান্ড দেখে তাকে বাড়ির ভিতর থেকে বার কয়েকবার ডাকলো।সে তাকে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করলো কিন্তু সাঁঝ কী শোনে আর তার কথা! বেখেয়ালি মন নিয়ে সাঁঝ নিজের দাদুর জন্য তালুকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। সাঁঝ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই বৃষ্টির গতি বেরে গেলো। ঝুম গতিতে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির গতি বেড়ে যেতে দেখে সাঁঝ ভয় পেলো। সে এই বৃষ্টির মধ্যে মোটেও এতো দূর দৌড়ে যেতে পারবে না। তার উপর আবার বিদুৎ চমকাচ্ছে। সাঁঝ কোনো উপায় না পেয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয়-স্থানে দাঁড়ালো। মিনিট বিশেক সময় চলে যাওয়ার পরও যখন বৃষ্টি কমলো না তখন সাঁঝ বিরক্ত হয়ে উঠলো। বৃষ্টি না কমলেও বিদুৎ চমকানো কমে গেছে তাই সাঁঝ আর কোনো কথা না ভেবে দৌড়াতে লাগলো স্কুল মাঠের উদ্দেশ্যে।
সাঁঝ যখন স্কুল মাঠের কাছে এসে উপস্থিত হলো তখন স্কুল মাঠের পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ। পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের অবস্থা কেবল বেহাল।তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত পরছে। তার সাথে থাকা তার সাঙ্গপাঙ্গরা একপ্রকার মাটিতে লুটিয়ে পরে হাহাকার করছে। তাদের এমন অবস্থা দেখে সাঁঝ না চায়তেই মনে মনে খুশি হলো। এই ছেলেগুলো যে এই গ্রামের সব চেয়ে অভদ্র আর অসভ্য তা গ্রামের সকলেই জানে। এরা আজ কয়েক দিন অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। আজ এদের সৌহার্দ্যের হাতে এমন মার খেয়ে গড়াগড়ি করতে দেখে সাঁঝ মনে মনে খুশি হলে কিন্তু অপর দিকে এদের এমন অবস্থা দেখে হালকা একটু কষ্টও লাগলে তাতে পাত্তা দিলো না সাঁঝ।
সাঁঝ লক্ষ্য করলো বেপরোয়া ভঙ্গিতে সৌহার্দ্য হাতে বড় বাঁশের একটা ভাঙ্গা অংশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সৌহার্দ্যের চোখে মুখে রাগ। তার চোখ মুখের রাগ যেনও উপচে উপচে পরছে তবে কামরুল তালুকদারের জন্য যে তা প্রকাশ করতপ পারছে না।
কামরুল তালুকদার যে এতোক্ষণে পরিস্থিতিটা সামলে নিয়েছে তা ভালো করে বুঝতে পারলো সাঁঝ।সাঁঝ কী করবে ভেবে না পেয়ে কঠোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে আসলো।সে সৌহার্দ্যের কাছে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো উজ্জ্বল সাদা বর্ণের সৌহার্দ্য রাগে আগুন হয়ে আছে ।সাঁঝ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সৌহার্দ্যকে একবার আড়চোখে দেখে নিলো। তার ফর্সা ত্বক বৃষ্টির কণায় ভিজে চকচক করছে।অন্যদিকে তার চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে আছে।সাঁঝ লক্ষ্য করলো সৌহার্দ্য লাল হয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তার সামনে পরে থাকা লোকগুলোকে এক দৃষ্টিতে দেখছে। সাঁঝ সৌহার্দ্যের লাল হয়ে যাওয়া চোখের সেই দৃষ্টিতে দেখতে পেলো এক অদম্য শক্তি আর দৃঢ়তা, যেন সে এই বৃষ্টির মধ্যেও সব শেষ করে দিতে সক্ষম।সাঁঝ তার পাশে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে।তার কপালের শিরা-উপশিরাগুলো রাগের তীব্রতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস যেন তার ভেতরের উত্তাল ঝড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে সাঁঝে।সৌহার্দ্যের গায়ে থাকা সাদা শার্টটা পুরোপুরি ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে যার ফলে তার শক্তিশালী শরীরের প্রতিটি রেখাকে স্পষ্ট করে তুলেছে সকলের সামনে। ভেজা শার্টে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা তার প্রতিটি নড়াচড়ায় মুক্তোর মতো ঝরে পড়ছে নিচে। সাঁঝ সৌহার্দ্যের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো যার ফলে সৌহার্দ্যের রাগী চাউনিও সাঁঝে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হলো।
অন্যদিকে কামরুল তালুকদার সাঁঝকে এই বৃষ্টি মাথায় এখানে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুমি এখানে কেন আসলে সাঁঝ? যাও এক্ষুনি বাড়িতে যাও।’
সাঁঝ তার দাদুর কথা শুনে চমকালো। বৃষ্টি মাথাও লোকজন সাঁঝদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে৷ সাঁঝ তার দাদুভাইয়ের কথা শুনে কী বলবে বুঝতে পারে না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখুনি পুলিশ চলে আসলো। সাঁঝের সামনে পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে আর তার লোকজনকে ধরে নিয়ে যেতে।সাঁঝ পুলিশদের দেখে তাদের দিকে নিজের কথা বন্ধ করে তাকিয়ে রয়লো। কামরুল তালুকদার সাঁঝের উত্তরের আশা না করে এই বিষয়টা নিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলতে ব্যস্থ হয়ে গেলেন। তিনি সাঁঝর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলতে ব্যস্থ হয়ে পরলেন। সাঁঝ যেনও হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তাকে আর কামরুল তালুকদারের বকা খেতে হবে না কিন্তু সে কী ভাবে আবারও আড়চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকাতেই চকমকে উঠলো।সে দেখলো সৌহার্দ্য রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সাঁঝ বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
তবে পুরো কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝ এবার ঠান্ডায় কেঁপে উঠলো। সৌহার্দ্য এক দৃষ্টিতে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ তুই এখানে আসতে গেলি কেন?’
তাকে সকলে বারবার কেন একই প্রশ্ন করছে?মনে মনে ভাবলো সে। সে নিজেও জানে না, সে কেন এই বৃষ্টি মাথায় নিজের বেখেয়ালি মন নিয়ে ছুটে আসলো। বারবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ঘাবড়ে গেলো সে। কোনো উত্তর না দিয়ে সৌহার্দ্যকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে নিজের পা উঁচু করে সৌহার্দ্যের মাথায় ছাতা ধরলো। সাঁঝের এমন বোকাবোকা কাছে সৌহার্দ্য নিজের কপাল কুঁচকে নিলো। সে ভিজে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে আর এখন এই মেয়ে এসেছে তার মাথায় ছাতা ধরতে!মেয়েটা এতো বোকা কেন? সৌহার্দ্যের মাথায় ছাতা ধরে নির্ভয়চিত্তে সৌহার্দ্যের কথার প্রত্যুত্তর করে সাঁঝ বললো,
‘দাদামশাই অসুস্থ।ঠান্ডায় সমস্যা হয় তার কিন্তু সে ছাতা নিয়ে আসলো না দেখে তার পিছে এসেছি ভাইয়া। ‘
সাঁঝের কথা শুনে সৌহার্দ্য সাঁঝের দিকে তাকাতেই হঠাৎ সৌহার্দ্যের রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো। সে সাঁঝের ধরে রাখা ছাতাটা এক ঝাড়ায় ফেলে দিলো। তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ এক থাপ্পড় মেরে তোর বত্রিশটা দাঁতই ফেলে দেবো বেয়াদব। পোশাক ঠিক রেখে যখন রাস্তায় হাঁটতে পারিস না তখন বাড়ি থেকে বেরাস কেন শয়তান? ‘
আচমকা সৌহার্দ্যের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সাঁঝ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলো৷ সৌহার্দ্য নিজের কথা শেষ করে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো। সাঁঝ অপলক দৃষ্টি সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সৌহার্দ্য কী করতে চায়ছে। সৌহার্দ্য নিজের গায়ের শার্টটা খুলে সাঁঝের গায়ে জরিয়ে দিলো। শার্টটা সাঁঝের গায়ে জরিয়ে দিতে দিতে রাগান্বিত কন্ঠে আবারও বলে উঠলো ,
‘ মেয়ে মানুষের এতো বেখেয়ালি হলে চলে না সাঁঝ। তোর বেখেয়ালিতার জন্য সবসময় আমাকে দাম দিতে হয়। তুই এক্ষুনি আমার সামনে থেকে দূর হ সাঁঝ। সে রাস্তা দিয়ে এসে ছিলি সেই রাস্তা ধরে চলে যা। তোর জন্য আজ এতোকিছু হয়েছে ‘
সৌহার্দ্য আর কিছু বলতে পারলো না তার আগে সৌরভ সৌহার্দ্যকে টেনে দূরে নিয়ে গেলো। সাঁঝ সৌহার্দ্যের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে একদম চুপ হয়ে গেলো। সে কী করেছে সে নিজেই জানে না। সৌহার্দ্য এই সব কিছুতে কিসের জন্য তাকে দায় করছে? এটা সে মেনে নিতে পাচ্ছে না। সাঁঝ সৌহার্দ্যের দেওয়া শার্টটা আঁকড়ে ধরে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে তা আগেই সৌরভ সৌহার্দ্যকে চুপ করিয়ে সাঁঝের ছাতাটা নিচে থেকে তুলে সাঁঝের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নম্র স্বরে বলে উঠলো ,
‘ সাঁঝ এখন এখান থেকে চলে যাও। কারোর মেজাজ ভালো নেই, বুঝতেই তো পারছো। ‘
সাঁঝ সৌরভের কথাগুলো কানে নিলো কিন্তু এক দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে রয়লো কিছুক্ষণ। সাঁঝ একবার চারিপাশে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। সাঁঝ বাড়িতে এসে তালুকদার বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
‘ গাধী তুই এভাবে বাহিরে গিয়েছিলি এই বৃষ্টি মাথায়?’
.
.
সৌহার্দ্য মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশের পরিবেশ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। তার চারপাশে জমে থাকা গ্রামের মানুষদের দৃষ্টি সে এড়িয়ে যেতে চাইলেও, তাদের চোখের শীতল দৃষ্টি তার দিকে তীব্র হয়ে পড়ছে। সৌহার্দ্য এসবের কিছুই ধার-ধারছে না। বরং আজ সে ভীষণ বিরক্ত।এমন বিরক্ত তাকে জেঁকে ধরেছে যে সে তা মুখে বলে প্রকাশ করা তার পক্ষে অসম্ভব। মনটা ভারী হয়ে আছে।কোনো অজানা অস্থিরতা তার ভেতর থেকে কামড়ে ধরছে। তার চোখ তখন দাদাজানের দিকে নিবদ্ধ। কামরুল তালুকদার চারপাশের মানুষের সাথে কথা বলছেন, পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছেন। সৌহার্দ্যের দৃষ্টি তার দিকে স্থির।সৌহার্দ্যের দৃষ্টি কামরুল তালুকদারের দিকে নিবদ্ধ ছিল ঠিক তখনই তার ফোনটি বেজে উঠলো।ফোনের শব্দ তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলো। পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করতেই তার কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর,
‘ কোথায় তুই?’
সৌহার্দ্য লক্ষ্য করলো তার মায়ের কণ্ঠে স্বাভাবিকতার আভাস থাকলেও।তার মনে যে উদ্বেগের সূক্ষ্ম ছাপ লুকিয়ে আছে তা স্পষ্ট ।সৌহার্দ্যের ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো,
‘ সানি কিছু বলেনি?’
তার মা তার কথার বিপরীতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তারপর নিজের কণ্ঠে উদ্বেগ আরও স্পষ্ট করে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ মেডিকেল থেকে সরাসরি তালুকদার বাড়িতে যাওয়ার দরকার কী ছিল?’
‘এসে সব বলছি আম্মু।’
সৌহার্দ্য তা মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে উক্ত কথাটা বললো।সৌহার্দ্যের মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় প্রশ্ন করে উঠলেন,
‘তা কয়দিনের জন্য গিয়েছিস?’
‘ কলেজ বন্ধ আছে, তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি…’
সৌহার্দ্য তার কথাটা শেষ করবে তা আগেই তার মায়ের তীক্ষ্ণ সুর ভেসে এলো।তিনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ তুই যেতে পারিস সেখান, কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একবার বললে কী ক্ষতি হতো? চিন্তা হয় না আমার?’
সৌহার্দ্য তার মাকে শান্ত করার জন্য দ্রুত শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো ,
‘ আম্মু, আমি তো এইমাত্র এসে পৌঁছালাম। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই তুমি কল করলে। আমি একটু পরেই কল দিতাম তোমাকে।’
সৌহার্দ্যের মা তার কথাগুলো শুনে এবার কিছুটা নরম হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
‘বাবা মশাই কেমন আছেন?’
‘ ভালো আছে।’
সৌহার্দ্যের কথাটা শেষ হতেই তার মা আবারও কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,
‘ অন্যরা?’
‘ সবাই ভালো আছে আমার মাজননী।’
সৌহার্দ্যের কথা শুনে তার মা একটু হাসলো তারপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ঠিক আছে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। পরে কথা বলবো। সাবধানে থাকিস বাবু।’
মায়ের উদ্বিগ্নময় কণ্ঠ শুনে সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে হালকা হাসলো। ফোনটা কেটে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তার মায়ের অস্থিরতা আর উদ্বেগের কথা ভেবেই সে এতোক্ষণ মিথ্যা কথাগুলো কত অনায়সে বলে দিলো। যদি তার মা জানতে পারেন সে এখন ঠিক কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তার মা তার জন্য চিন্তা করতো। তারপর যদি অসুস্থ হয়ে যেতে তখন? সৌহার্দ্য আর ভাবতেই পারছে না। তাই সেই মিথ্যা কথাটা বললো। মায়ের সাথে মিথ্যা বলায় মিথ্যাটা তার মনের উপর ভার হয়ে চেপে বসলো, কিন্তু মায়ের স্বস্তির জন্য সে তা বয়ে বেড়াতে প্রস্তুত করে নিলো নিজেকে।
সৌহার্দ্য ফোনটা পকেটে রেখে দাদাজানের দিকে আবার একবার তাকালো। কামরুল তালুকদার এখনো চারপাশের মানুষদের সাথে কথা বলছেন, তাদের উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করছেন।
চলবে…