#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_৫
#সাদিয়া_তাসনিম
সুবহা সুধীর ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে সাঁঝের রুমে চলে আসলো। মেয়েটার যে রাগ হয়েছে তা সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। আগের বার সৌহার্দ্য ভাইয়ের কাছে হেরে যাওয়ার পরে সাঁঝ এই কয়েক দিন অনেক সময় ব্যয় করে দাদাভাইয়ের কাছ থেকে ক্যারাম খেলা শিখেছে। এতো চেষ্টা করেও যখন সৌহার্দ্যকে হারাতে পারেনি তখন সাঁঝের মুখটা ছোট গিয়েছিলো মেয়েটার, তারপর আবার সাঈদ তার হেরে যাওয়ার উপর মজা করেছে যেটা সাঁঝ একদম সহ্য করতে পারেনি। সে যদি এখনও সকলের মাঝে বসে থাকতো তাহলে সাঈদ আবারও মজা করতো তাই সাঁঝ সেখান থেকে চলে এসেছে। সাঁঝ সুবহার চাচাতো বোন। তালুকদার পরিবার বিস্তৃত। সৌহার্দ্য হলো তার বড় চাচ্চু আর আমিনা বেগমের একমাত্র ছেলে। সৌহার্দ্য তালুকদার পরিবারে প্রথম ছেলে সন্তান হওয়াই পরিবারে সকলে তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। বাড়ির মেজে ছেলে হলেন রবিউল তালুকদার তার স্ত্রী হলো আসমা বেগম তাদের ঘরে ঈশিতা, তাসনিয়া আর সাঈদ। সাঈদ আর সৌহার্দ্য প্রায় এক বছরের ছোট বড়।বাড়ির সেজে চাচ্চু হলেন হাসান তালুকদার তার স্ত্রী রজনী বেগম তাদের একমাত্র মেয়ে সুবহা। এই তালুকদার বাড়িতে সুবহারা আর ঈশিতাই বর্তমানে একসাথে থাকে। সাঁঝের বাবা হুমায়ুন তালুকদার আর মা মারিয়া বেগম। সাঁঝরা দুই বোন, সাঁঝ আর লুবনা। সাঁঝের বাবা ঢাকার এক বেসরকারি কলেজের প্রফেসর হওয়াই তাকে ঢাকাতেই থাকতে হয় তবে সাঁঝের দাদা কামরুল তালুকদার তার নাতি-নাতনি পুতি-পুতনিদের অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সাঁঝকে সে সবার থেকে একটু বেশি আদর করে। সাঁঝের দাদামশাই চায় না তার এই ভরা সংসার ছোট হয়ে যাক কিন্তু কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরে তিনি আর তার কোনো ছেলেকে আটকানি বাড়ি থেকে দূরে থাকার জন্য। সাঁঝ ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে তার মা কীভাবে জার্নি করে প্রায় প্রতি সপ্তাহে খুলনা থেকে ঢাকা আসা যাওয়া করে। দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে আর স্বামী কাজের জন্য ঢাকাতে দুইদিক সামাল দিতে গিয়ে তাকে বেশি কষ্ট করতে হয়। মারিয়া বেগম চেয়ে ছিলেন সাঁঝ আর লুবনাকে তাদের সাথে ঢাকাতে নিয়ে যেতে কিন্তু কামরুল তালুকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর সেই কাজটা করতে পারেন নি।সেইজন্য তাকে একটু কষ্ট করতে হয় পরিবারের জন্য। সাঁঝের ছোট চাচ্চু আহিল তালুকদার। তিনিও একজন ভার্সিটির প্রফেসর তাকে কাজের জন্য রাজশাহীতে থাকতে হয়। বাড়িতে খুব কম আসেন তিনি। কামরুল তালুকদার আর নাসিমা তালুকদারের দুই মেয়ে। সুবহার বড় চাচ্চুর পরে হয়েছেন মালিহা বেগম তার দুই সন্তান প্রিয়া আর প্রহর। তারপরই হয়েছে রুবিনা বেগম তার মেয়ে ইধিকা যার দুইসন্তান (ঈশা, এলিজা) রুবিনা বেগমের এক ছেলে মৃন্ময় যার এক মেয়ে আয়রা, আর ছেলে আলিফ। কামরুল তালুকদার আর নাসিমা তালুকদারে সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা সানজিদা যার ছেলে হলো সাদ।
সুবহা পা টিপে টিপে সাঁঝের রুমে প্রবেশ করলো।শব্দবিহীন সাঁঝের রুমের দরজাটা খুলে পা টিপে টিপে ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো ভিতরে কেউ নেই যা দেখে সুবহা নিজের ভ্রুঁ কুঁচকে নিলো। সে ভেবে ছিলো সাঁঝ রুমে এসেছে কিন্তু সে তো আসেনি। সুবহা বাথরুমের দিকে একবার তাকালো। সে গভীর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলো সেখানে কেউ আছে কিনা কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পরে সে বুঝলো বাথরুমে কেউ নেই। সুবহা সাঁঝের কথা ভেবে একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে কিছুক্ষণ সাঁঝের রুমে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করতে লাগলো সাঁঝ কোথায় যেতে পারে। সুবহার সঠিক স্থানটা আন্দাজ করে নিজের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিয়ে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
রাত তখন সাড়ে আটটা। অন্ধকার শহরজুড়ে হালকা টিপ টিপ বৃষ্টি নেমে এসেছে। বাতাসে ভিজে মাটির মিষ্টি গন্ধ। সুবহা জানে সাঁঝ কোথায় আছে। সুবহা নিঃশব্দে ঠিক চোরের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে তার দাদামশাই-এর রুমের সামনে।তার দাদামশাই-এর রুমের দরজা খোলা কিন্তু দরজায় ঝুলে থাকা দুই টুকরো পর্দা রুমটার ভেতরটা আড়াল করে রেখেছে। সুবহা ধীরে ধীরে রুমের কাছে এসে পর্দার ফাঁক দিয়ে মাথাটা গলিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করে। চোর মতো কাজটা করতে গিয়ে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। ভেতরে বসে থাকা তার দুইজন প্রিয় মানুষ,কামরুল তালুকদার আর সাঁঝ নিজেদের মধ্যে কথপোকথন মগ্ন। সুবহা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো।
সুবহা এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কামরুল তালুকদারের সামনে অভিমানী মুখে সাঁঝ বসে আছে। তার চোখে এক গভীর ক্ষোভের ছায়া। সাঁঝ তার দাদুভাইয়ের কাছে সব অভিযোগ উগড়ে দেওয়ার পর চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে রয়লো। কামরুল তালুকদার হঠাৎ হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলেন সাঁঝের সকল কথা শুনে। সেই হাসিতে সাঁঝের অভিমানী মুখ আরো কঠোর হয়ে উঠলো। সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। সে কী এতোক্ষণ মজা করছিলো নাকি যে কামরুল তালুকদার এমন হুট করে হেঁসে উঠলেন।
কামরুল তালুকদার সাঁঝকে অন্য দিকে মুখ করতে দেখে শব্দ করে হাঁসা বন্ধ করলেন। তারপর সাঁঝের সেই অভিমানী মুখ দেখে শব্দহীন হাসলেন। তার হাতে থাকা বইটা তিনি টেবিলের ওপর রেখে ভালো ভাবে উঠে বসে বালিশে হেলান দিয়ে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো ,
‘ সব বুঝলাম, এতো প্র্যাকস্টিস করার পরও তুমি খেলায় হেরে গেছো কিন্তু আামকে বলো তো, এখানে সৌহার্দ্যের দোষটা কোথায় দাদুভাই? ওর ওপর এতো রাগ কেন তোমার?’
সাঁঝ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দাদুর দিকে তাকালো।সৌহার্দ্য দোষটা কোথায়? সে যদি হেরে যেতো তাহলে তো সাঁঝই জিততো। সাঁঝ সৌহার্দ্যের জন্য হেরে গেছে তাহলে দোষটা কার? সাঁঝ নিজের চিন্তা থেকে বের হয়ে চোখ ছোট ছোট করে তার দাদুর দিকে তাকিয়ে অভিমান মাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,
সৌহার্দ্য ভাই ছয়মাস, সাতমাস পর একবার বাড়িতে আসে। আর এসেই সবার ওপর নিজের অধিকার ফলিয়ে বেড়ায়। বিনা কারণে আমার ওপর চিৎকার করে, বকাঝকা করে। দুই দিন এসে সবার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে যায়। আর আমাকে ভিলেন বানিয়ে দেয়। আম্মু তো তখন আমাকে দেখতেও পারে না। মনে হয় আমি না, সৌহার্দ্য তার একমাত্র সন্তান।’
সাঁঝের কথাগুলো শুনে কামরুল তালুকদার প্রথমে শব্দ করে হেসে ফেললেন। তারপর স্নেহমাখা চোখে সাঁঝের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলেন ,
‘ এই জন্যই আমার দাদুভাইয়ের মন খারাপ? শোনো মা, সৌহার্দ্য এই বাড়ির বড় ছেলে। সবার মনেই ওর প্রতি আলাদা একটা টান আছে। তোমাদের সবাইকেই ভালোবাসে, কিন্তু তা হয়তো প্রকাশ করে না। আর সৌহার্দ্য তো দূরে থাকে, এখানে কম আসে। তাই যখন আসে, তখন সবাই একটু বেশিই আদর করে। এতে কি মন খারাপ করতে হয়, বলো?’
সাঁঝ তার দাদুর কথা শুনে কিছু একটা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে। কামরুল তালুকদার সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেন সাঁঝ তার কথা কিছু বুঝলো কি না তা, কিন্তু সাঁঝের মুখের অভিব্যক্তি দেখে তিনি কিছু বুঝতে পারে না, সাঁঝের মুখ দেখে বোঝা মুশকিল হয়ে পরে তার কাছে। সাঁঝ নিজের মনে কিছু চিন্তা করে একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর চোখ ছোট করে তার দাদুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে ,
‘তাহলে দাদুভাই, আপনি ওকে এখানে আসতে নিষেধ করে দিন। ওকে আমার একদম ভালো লাগে না। বেটা খচ্চর! সবসময় আমার ওপর চিৎকার করে।’
কামরুল তালুকদার তার পুতনির এমন কথা শুনে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
‘ আচ্ছা, আমি ওকে বলে দেবো যেন তোমার ওপর চিৎকার না করে।’
সাঁঝ তার দাদুভাই -এর কথা শুনে চুপচাপ বসে থাকে কিছু বলার জন্য। সাঁঝ নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে, গলায় অভিমান চেপে বলে উঠে ,
‘ চিৎকার না করতে বলার দরকার নেই।তার থেকে ভালো আপনি বরং বলুন, সৌহার্দ্য ভাই যেন আর এই বাড়িতে না আসে। সে এবাড়িতে না আসলে আমাদের দেখাও হবে না আর আবারও উপর চিৎকারও করতে পারবে না।’
সাঁঝের কথাগুলো শুনে কামরুল তালুকদার এবার গভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন ,
‘ তাহলে বলো, এটা কীভাবে সম্ভব? এই বাড়ি যেমন তোমার, ঠিক তেমনই সৌহার্দ্যেরও। ওকে কীভাবে নিষেধ করবো আমি?’
সাঁঝ তার দাদুভাই-এর কথাগুলো শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সে তার দাদুর কথার কোনো জবাব খুঁজে পেল না। সাঁঝ উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,
‘ তাহলে সৌহার্দ্য ভাইকে শুধু বলুন, আমাকে যেন আর বকাঝকা না করে।’
কামরুল তালুকদার তার আদুরে নাতনির দিকে গভীর মমতায় তাকালেন। মুখে কিছু বললেন না। শুধু মৃদু হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সাঁঝের কথার সম্মতি দিলেন।
সুবহা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলো। সাঁঝের কথাগুলো শুনে সে বিরক্ত হলেও তা নিজের মধ্যে চেপে রাখে। সাঁঝকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সুবহা যখনই পিছন ঘুরে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য ঘুরলো তখনই সুবহার আত্মাটা কেঁপে উঠলো। সৌহার্দ্য ভাই এখানে কখন আসলো? সে কী সাঁঝে এমন সব পাগলামি মার্কা কথা শুনে ফেলেছে? এখান থেকে তো রুমের মধ্যে বলা সবগুলো কথাই সে ভালো করেই শুনতে পেরেছে তাহলে সৌহার্দ্য ভাইও কী সব শুনে নিলো? সুবহা নিজের চোখ তুলে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্যের মনের ভাব বুঝে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। সৌহার্দ্য সুবহা দিকে তাকিয়ে গম্ভীর তবে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,
‘ এখানে এভাবে পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
সুবহা সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে মৃদু কন্ঠে সৌহার্দ্যের কথাটার উত্তর না দিয়ে সৌহার্দ্যকে জিজ্ঞাসা করে উঠে,
‘ তুমি কখন এলে ভাইয়া?’
সৌহার্দ্য সুবহার কথাটা শুনে একবার নিজের হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে চোখ দেয় তারপর সুবহার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
‘ একটু আগেই।’
সুবহা সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে শুকনো ঢোক গেলে। সৌহার্দ্য ঠিক কী কী শুনেছে সুবহা তা বুঝে উঠতে চেষ্টা করে থাকে। সৌহার্দ্য সুবহা দরজা সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
‘ তুই কী ভিতরে যাবি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন দরজার বাহিরে?’
সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে সুবহা অনেকটা আমতাআমতা করে বলে উঠে,
‘ আসলে সাঁঝ আর দাদুভাই রুমে কথা বলছে তাই আমি এসেছিলাম কিন্তু আর ভিতরে প্রবেশ করিনি।’
সৌহার্দ্য সুবহার কথাটা শুনে একবার সুবহার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকায়। তারপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
‘ সামনে থেকে সর, আমি ভিতরে যাবো।’
সুবহা সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে আস্তে আস্তে সামনে থেকে সরে যায়। সুবহা সরে যাওয়ার পরেই সৌহার্দ্য দ্রুত পায়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। সুবহা সৌহার্দ্যের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। সাঁঝ এখনও সৌহার্দ্যকে নিয়ে তার দাদুর কাছে নালিশ করছিলো ঠিক তখনই সৌহার্দ্যকে রুমে ঢুকতে দেখে সাঁঝ একদম পাথরের মতো চুপ হয়ে যায়। সে হুট করে সৌহার্দ্যকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সৌহার্দ্য রুমে ডুকে একবার সাঁঝের দিকে তাকায় তারপর তার দাদুভাই-এর দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
‘ দাদুভাই আমাকে চলে যেতে হবে।’
চলবে…