#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৭
#Eshika_Khanom
শুভ্র রঙা শাড়ি পরিহিতি এক রমণী হেঁটে আসছে আয়াতের পানে। নূরে আলোকিত তার চেহারা। মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে। ঘন কালো চুলের মধ্যে কিছু চুল আবার আধাপাকা। নদীর পাড় ঘেষে হাঁটছেন তিনি। কিছু সময়ের মধ্যেই একদম আয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে আয়াত তার দিকে। বলার জন্যে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিক তখনই সেখানে আদ্রাফ উপস্তিত হয়। আয়াতকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি করে হেঁসে বলে,
‘ইনি তোমার শাশুড়ী, আর আমার মা।’
এই রমণী তথা আদ্রাফের মা আয়াতকে মিষ্টি হেসে বুকে জড়িয়ে নেয়। পরক্ষণেই আবার ছেড়ে দেয়। আদ্রাফ আয়াতের গালে হাত দিয়ে বলে,
‘এবার তবে আমি আসি।’
আয়াত এবার কথা বলল,
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
‘এইতো আম্মুর সাথে যাচ্ছি।’
‘ফিরবেন কখন?’
‘ফেরা হবে না।’
বলেই আদ্রাফ তার মায়ের সাথে চলতে থাকলো অন্য এক পথে। আয়াত আদ্রাফ আদ্রাফ করে ডাকতে লাগলো। দৌড়তে থাকলো তাদের পিছু পিছু। থামলো না আদ্রাফ, তবে থেমে গেলো আদ্রাফের মা। আদ্রাফ নিজের পথেই অবিচল। আদ্রাফের মা আয়াতের হাত ধরে বলল,
‘মারে আমার ছেলেকে আমার সাথে যেতে দে। ভয় নেই, তুই ওর থেকে আলাদা হবি না। কিছু সময় পর আমি এসে আবার তোকেও আদ্রাফের কাছে নিয়ে যাবো। আমরা পুরো পরিবার একসাথে থাকব।’
আয়াতের ললাটে স্নেহভরা চুম্বন এঁকে দিয়ে আদ্রাফের মাও চলতে থাকলেন। একদময় আদ্রাফ ও আদ্রাফের মা পরস্পরের হাত ধরলেন। মিলিয়ে গেলেন ও কূলের বাগানের মাঝে। হঠাৎ সেখানেই দাদীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। আয়াতের পানে স্নেহভরা হাসির বিনিময়ে প্রকৃতির মাঝেই মিলিয়ে গেল সেই প্রতিচ্ছবি।
চোখ খুলে ফেললো আয়াত। হ্যাঁ ঘামছে সে। জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। পাশেই হেলান দিয়ে নিদ্রারত আদ্রাফকে দেখতে পেল। উঠে বসল আয়াত। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো। মাথাটা চেপে ধরল নিজের। খুব যন্ত্রনা করছে। বুঝতে পারলো স্বপ্ন দেখেছে। তবে একে শুধুই স্বপ্ন বলা চলে না, এটি দুঃস্বপ্ন। আজই দাদীর কাছে থেকে জোর করে এলবাম থেকে আদ্রাফের বাবা মায়ের ছবি দেখেছিল। তাই হয়তো এমন একটা স্বপ্ন দেখেছে। আদ্রাফকে দেখে চোখে জলভরা হাসি দিল আয়াত। মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। তটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ওযু করে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে শুরু করল।
কিছুটা শারীরিক সুস্থতা অনুভব করেই ঘর থেকে বেরোলেন দাদী। আজ পুরো বাড়িটা ঘুরে হুরে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তার। এক পর্যায়ে রান্নাঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। ইচ্ছে ছিল রান্নাঘরেই প্রবেশ করবেন। তিনজন সার্ভেন্ট তখন রান্নাঘরে কাজ করছিল। সাথে একজন নার্স যেন তাদের সাথে আড্ডায় মজে ছিল। তাদেরই কথোপকথন প্রবেশ করার পূর্বে শুনতে পেলেন তিনি।
‘আদ্রাফ স্যার আর কয়দিন বেঁচে আছে কিছু জানো?’
নার্স উত্তর দিল, ‘দিনকয়েক তার শারীরিক অবনতিই হচ্ছে। এইডস যেন তার শরীরে চাড়া দিয়ে উঠেছে। অসুস্থতা লাগামহীন। বেশিদিন আর তার হাতে নেই।’
থমকে গেলেন দাদী। তবে কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। আরও কিছু কথা মনে মনে শুনতে চাইলেন। মনকে আশ্বাস দিতে থাকলেন, তিনি ভুল কিছু শুনতে পেরেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন।
একজন সার্ভেন্ট প্রশ্ন করল,
‘তার কিভাবে এইডস হয়েছে কিছু জানো?’
নার্স না বোধক উত্তর দিল। সার্ভেন্ট বলল,
‘আমি তো জানি ঐসব খারাপ কাজগুলো করলে, বা ওসবের সাথে জড়িত থাকলে এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
অপরজন বলল, ‘হতেও পারে। বড়লোকের একমাত্র ছেলে, সফল ব্যবসায়ী। টাকা তো তার হাতের কোণের ময়লা।’
নার্স প্রশ্ন করল,
‘আয়াত ম্যাডামকে কোথায় থেকে পেল? মেয়েটারও তো জীবন নষ্ট করছেন স্যার।’
তখন একজন ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
‘দেখো, স্যার আবার সেখানের থেকেই তুলে এনেছে নাকি মোটা অংকের বিনিময়ে? নাহলে কি এইডস রোগীর সাথে কেউ থাকে?’
আরেকজন বলল, ‘ভাত ছুড়লে কি আর কাকের অভাব হয়?’
চারজনের মধ্যেই হাসির রোল পড়ে গেল। কষ্টগুলো নিজের মনেই চাপা দিয়ে রাখলেন তিনি। সার্ভেন্টদের কিছুই বললেন না। রান্নাঘর থেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন সোজা আদ্রাফের ঘরে। আদ্রাফ তখন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আদ্রাফের ভাষ্যমতে, এই ঘরে নার্সবিহীন সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও আজ নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করলেন না তিনি। ঘরে প্রবেশমাত্রই দেখলেন প্রতিটি দেয়াল আয়াতের ছবি দ্বারা সজ্জিত। বিশেষভাবে অবাক হলেন তিনি। ধীরপায়ে এগিয়ে বসে পড়লেন আদ্রাফের মাথার পাশে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। আদ্রাফের কপালে নিজের ডান হাত ছোয়ালেন। সাথে সাথেই হাত সরিয়ে ফেললেন তিনি। আদ্রাফের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কারো হাতের স্পর্শে আদ্রাফ চোখ মেলে তাকাল। দাদীকে দেখে বিস্মিত হলো সে। উঠে বসে দাদীকে বলল,
‘তুমি এখানে এসে কি করছ দাদী? তুমি অসুস্থ, জানোই তো তোমার এখানে আসা ঠিক না।’
অস্থির হয়ে উঠেছে আদ্রাফ। দাদী অবাক নয়নে আদ্রাফের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখভর্তি লালচে ও কালচে র্যাশ। চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। ঘন কালো চুলও পড়তে শুরু করেছে। আদ্রাফের কপালে হাত দিয়ে বললেন,
‘তোর তো জ্বর আদ্রাফ৷ শুয়ে পড়, আমি জলপট্টি দেই।’
‘উফফ দাদী, নার্স আছে তো। তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন?’
দাদী বললেন, ‘নার্স কি তোর আপন নাকি আমি?’
‘হায় আল্লাহ কি বলছ? অবশ্যই তুমি।’
‘তাহলে আমায় করতে দে।’
বাধ্য ছেলে হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদ্রাফ। বুঝতে পেরেছে সে, আজ দাদীকে থামানো যাবে না। মনের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে, দাদী হঠাৎ এমন স্বরে কথা বলছে কেন?
দাদী কিছু সময়ের মধ্যেই এক স্বচ্ছ পাত্রভর্তি জল শুভ্র রঙের এক কাপড়ের অংশ নিয়ে হাজির হলেন। যত্নসহকারে আদ্রাফের মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলেন। অনেকটাই আরাম অনুভব করছে আদ্রাফ। তবে শুধুই জলপট্টি দেওয়ার ফল নয় এটা, দাদীর স্নেহময় স্পর্শ এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
আবেশে নিদ্রা জেঁকে ধরল আদ্রাফকে। ঘুমিয়ে পড়ল কিছু সময়ের মধ্যেই। জলপট্টি দেওয়ার ফলে জ্বরের আগ্রাসন কিছুটা কমে আসলো। দাদী মনে মনে হাসলেন আর বললেন,
‘তোকে ছোট থেকে নিজ হাতে কোলে পিঠে আদর যত্নে ভালোবাসা দিয়ে বড় করলাম। কিন্তু তোর মিথ্যেকে ধরতে পারলাম না। আমি জানি তুই কোনো খারাপ কাজে জড়িত নেই। আমি জানি তুই আয়াতকে খুব ভালোবাসিস। আমার তোর প্রতি শুধু একটা বিষয়েয় অভিযোগ রে। এতোকিছুর পরও তর সবচেয়ে আপনের তালিকায় আমি নেই দেখেই আমি তোর মিথ্যেটা বুঝতে পারলাম না। এই জ্বালা সওয়া যে বড় কষ্টের আদ্রাফ। আমি সইতে কি পারব তাও জানিনা।’
ভরা চোখে দাদী তাকালেন আদ্রাফের দিকে। কি নূরময় চেহারা! একদম মায়ের মতো হয়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন আদ্রাফের মুখখানা আজ যেন খুব বেশিই নিষ্পাপ লাগছে দিলারা জাহানের কাছে। নয়নজোড়ায় ভেসে উঠছে ছোট আদ্রাফের স্নিগ্ধ সেই চেহারা, মিষ্টি এক চাহুনী।
রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়েছে সবাই। আধার যেন নিষ্পেষিত করছে সময়কে। প্রতি ঘন্টায় যেন আদ্রাফের অসুস্থতা বেড়েই চলছে। বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে নুহাশকে বন্ধুর বিষয়ে। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছেনা। এমনিতেই এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি তারা। জানা আছে, সব চেষ্টাই বিফলে যাবে। খোদা তায়ালার কাছে যেন কয়েক বান্দা খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছে। ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করল নুহাশ। জানালো আদ্রাফের অবস্থা। ডক্টর বললেন,
‘জানেনই তো আদ্রাফের হাতে আর দিনকয়েক সময় আছে।’
নুহাশ উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘তাই বলে তো আর এভাবে বন্ধুকে ভুগতে ভুগতে মরতে দিতে পারিনা আমি।’
‘কি আর করার? অসুস্থতা এখন পুরোপুরি আদ্রাফকে ঘায়েল করে ফেলেছে। ক্বলব থেকে শুধু রুহ এর মুক্তি বাকি।’
‘ডক্টর এসব দয়া করে বলবেন না। জ্বরে আদ্রাফের গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্ঞান নেই তার। দাদী ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কিছু জানেনা এখনও। আয়াত কেঁদে কেটে সারা হচ্ছে।’
‘ইমিডিয়েটলি হস্পিটালে ভর্তি করুন। হাতে আর বেশি সময় নেই।’
ফোন কেটে দিল নুহাশ। তৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্স কল করল। ভর্তি করা হলো তাকে হাসপাতালে। আদ্রাফ যার অধীনে সে ডক্টর জলদিই সেখানে উপস্থিত হলেন। আয়াতকে আসতে দেওয়া হয়নি। ঘরে বসে আদ্রাফের জন্যেই দুয়া করছে সে। আদ্রাফের চেক আপ করা হয়েছে। আইসিউতে নেওয়া হয়েছে তাকে। প্রাণভোমরাগুলো যেন আজ মুক্তি চাইছে।
.
.
.
নতুন এক ভোরের দেখা মিলল। সময়ের পরিক্রমায় সূর্য মাথার উপর দাঁড়াতে প্রস্তুত। ঘড়ির কাঁটা দশের কাঁটায় ছুইছুই। হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত আয়াত। ভাবলো যাওয়ার আগে একবার দাদীর সাথে দেখা করে যাওয়া প্রয়োজন। যেই না ভাবা তখনই সেই কাজ করল। দাদীর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল আয়াত। দরজা ভেজানো ছিল, হালকা ধাক্কার বিনিময়েই খুলে গেল। তবে পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিল না আয়াত। জায়নামাজের উপর কাত হয়ে পড়ে আছেন দাদী। আখিজোড় বন্ধ, মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। দৌড়ে এগিয়ে গেল আয়াত তার পানে। ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠেছে সে। গায়ে হাত দিয়ে দেখ গেল, দেহ জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। আয়াতের কণ্ঠে দাদী বলে এক চিৎকারের ডাক শোনা গেল। বাড়িতে উপস্থির সকল সার্ভেন্ট সেই কামড়ায় হাজির হলো। তবে আর তো কোনো আয়োজনেই লাভ নেই, প্রাণপাখি অনেক আগেই খাচা ভেঙ্গে উড়ে গিয়েছে দূর আকাশে, অসীম এক গন্তব্যে।
#চলবে।