#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১২)
অধিকাংশ মানুষের জীবনের প্রাক্তন থাকে। এই প্রাক্তন জীবনের শেষ নিশ্বাস অবধি থেকে যায়। ঠুনকো হয়ে যায় পরবর্তী সম্পর্ক গুলো। প্রায়শই মানুষের জীবন চলে কেবল সমঝোতায়। এই সমঝোতাকেই পরম যত্নে তুলে নিয়ে বেঁচে থাকে মানুষ গুলো। অথচ ভেতরটা জ্বলতে থাকে। চাইলেই কি ছেড়ে যাওয়া যায়? মন যদি পেছনে ফিরে তাকায় তবে কি করার থাকে? এই ভুলে ভরা জীবন নিয়েই তো চলতে হয়। কেউ কি কখনো শতভাগ সৎ হয়? যদি তেমনি হতো তবে এ সমাজে ডিভোর্সের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যেত না। আবার যদি সমঝোতাকেই আগলে বেঁচে থাকত তবে সারাটা জীবন এক অতৃপ্ত অনুভূতিতে পার করতে হতো। কে কোনটা বেছে নিবে এটা তার উপর নির্ভর করছে। একেক জনের চিন্তা ধারা একেকটা পথ কে আগলে নেয়। কিন্তু দিন শেষে কোনটা সঠিক তা সময়ই বলে দেয়। ধরা বাঁধা নিয়মে জীবন চলে না। আর জীবন মানেই এক একটা ফ্যান্টাসি। দশ দিন পর আজ দিতিয়া এসেছেন রান্না ঘরে। অনেকটা সামলে নিয়েছেন নিজেকে। সত্যিই তো এভাবে আর কতদিন? তিনি প্রায় চেচাচ্ছেন। “ভাত রান্না করলে যদি ভাত থেকেই যায় তবে ভাত রান্নার কি দরকার। আজ থেকে চুলায় কিচ্ছুটি বসাব না। কলি এই কলি, সবাই কে বলে দে যদি এমন করে তো আমি চলে যাব বাড়ি থেকে। সবাই মিলে আমায় পাগল করে দিচ্ছে।”
আলমাস সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,”কি শুরু করেছ তুমি?”
“কি শুরু করব? দেখ না কি অবস্থা তৈরি হয়েছে। ভাতের হাড়ি ভরা থাকে রোজ। সব ফেলতে হয়। অকল্যাণ হচ্ছে না?”
“পরিস্থিতিটা তো বুঝো।”
“তুমি চুপ করো।”
এগিয়ে গেলেন দিতিয়া। চুল মেলে দিয়ে আবৃত্তি হাঁটুতে মুখ গুজে। দরজায় ঠক ঠক আওয়া করলেন দিতিয়া। রেসপন্স নেই মেয়েটির। চিৎকার করলেন এবার।
“কানে কি তুলো দেওয়া। শোকের পাহাড় নামিয়ে রেখেছে সবাই। বাঁচতে হবে না?”
ঘাড় ঘুরাল আবৃত্তি। দিতিয়া দেখলেন ফ্যাকাশে মুখে ও অসাধারণ লাগছে ওকে। চমকালেন তিনি। আগে কখনো এভাবে দেখা হয় নি। ধীরে মেয়েটির কাছে এলেন। মাথায় হাত বুলালেন। “দিন তো যেতেই থাকবে মা। লেখা আমার মেয়ের থেকে ও অধিক। কখনো ভুল ধরতে পারি নি ওর। এমনি লক্ষি সে। ঝগড়ার কথা চিন্তায় ও আসে নি। আমার ছেলেটা ভেঙে গেছে। তুমি একটু সামলাও। অন্তত লেখার কথাটা ভেবে।”
আবৃত্তি দেখল উন্মেষ চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমায় নি বোঝা যাচ্ছে। আলগোছে কপাল স্পর্শ করল। চুলের মধ্য হাত গলিয়ে দিল।
“খুব বিচিত্র জীবন তাই না আবৃত্তি?”
“মানুষ তো আমরা। অনুভূতির মৃ ত্যু কি আছে বলেন?”
“গত দশ দিনে আমি বুঝে গেছি। সময় আমাদের ব্যতিক্রম কিছুর সাথে পরিচয় করায়।”
“এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে। আপুর আত্মা কষ্ট পাবে তো।”
“মেয়েটা এভাবে চলে গেল আবৃত্তি।”
“শুনেন, আপনাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না আমার।”
“বসো, তোমার বোন আমায় যাতনা দিয়ে গেল। অসহ্য লাগছে সব। কখন এতটা মায়া জন্মেছে বুঝতেও পারি নি।”
“আপনি উঠেন তো।”
আবৃত্তি নিজ থেকেই উঠিয়ে দিল উন্মেষকে। ছেলেটার এমন রূপ আগে কখনো দেখে নি। ঘর গোছাল আবৃত্তি। লেখার জিনিস গুলো এক সাইট করে রাখল। উন্মেষ বলল,
“এগুলো সরিয়ে ও না।”
“সরাচ্ছি না তো।”
“হুম।”
গোসল সেরে বের হলো উন্মেষ। তারপর নামাজ পড়ল। দোয়া করল লেখা’র জন্য। ঠিক হলো ক*বর জিয়ারতে যাবে। আবৃত্তি ও যাবে সাথে। নামাজ পড়ে এসে দুজনে বের হলো। ক*বরের নিকটে যেতেই আবৃত্তির পা থমকে গেল। না চাইতে ও চিৎকার এল বুক চিরে। মেয়েটার কান্না দেখে উন্মেষের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। ওর যে খুব কষ্ট হয়। আবৃত্তি নিজেকে সামাল দিতে পারে না। উন্মেষকে সামলাতে গিয়ে নিজেই ভেঙে পড়েছে।
উন্মেষকে বেশ বেগ পেতে হলো। আবৃত্তি আজ যতটুকু মনোবল জুগিয়েছে এখানে এসেছিল সেটা পুরো ভেঙে গেছে ক*বরের কাছে যেতেই। উন্মেষ বুকে জড়িয়ে নিল। হাল্কা হাতে হাত বুলাল, “তুমি এমন ভে ঙে যাচ্ছ কেন বলো তো?”
“আপুর জায়গায় আমি কেন ম*রলাম না উন্মেষ।”
“চুপ করো আবৃত্তি। এসব বলতে নেই। আল্লাহ নারাজ হন। লেখা বড় লক্ষি। ও ভালো আছে দেখে নিও।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে। আমি ম*রে কেন যাচ্ছি না। আপুর সাথে কেন এমন হলো।”
ভেজা দুই নয়ন আড়াল করল উন্মেষ। আবৃত্তির চোখ মুছিয়ে দিয়ে চুমু খেল বার কয়েক। বেড়াল ছানার মতো গুটিয়ে রইল আবৃত্তি। মায়া বড়ো খারাপ জিনিস।
রাতের শেষ ভাগে এসে লেখার ছবিটা বের করল উন্মেষ। এটা প্রথম দিনের ছবি। যেদিন প্রথম বারের মতো যাওয়া হয়েছিল লেখাদের বাড়ি।
“তুমি আমার জীবনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে এসেছিল লেখা। ফিরে ও গেলে দীর্ঘশ্বাস হয়ে। আমি কখনো তোমায় বুঝতে দেই নি। সবটা সুন্দর ছিল। কষ্টে ছিলাম আমি তবু ভালো ছিল সব। তুমি চলে গিয়ে সবটা দীর্ঘশ্বাস ময় করে দিলে। মাঝের সময় টুকু হয়ত আমি অনুভব করি নি। পাথর ছিলাম, তবু এখন মনে হয় যা হচ্ছিল তাই হতো। তোমার শূন্যতা আজ আমায় ভোগাচ্ছে।”
নির্জন রাত্রীতে লেখার ছবিটা কে টে ফেলল উন্মেষ। এক বুক সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা আমাদের বর্তমান কে ঘৃণা করি। অতীতের জন্য ছটফট করি। আর ভবিষ্যৎের চিন্তায় জীবন নষ্ট করি। আমার কাছে সব টাই তিক্ত ছিল। তবু এখন মনে হয় তুমি থেকে গেলে ও পারতে। কষ্ট চেপে না হয় বেঁচে থাকতাম আমি।”
লেখার মৃ ত্যুর শোকটা সবে কাটাতে শুরু করেছে সবাই। কিছু দিন পূর্বেই মেয়েটির জন্য শতেক এতিম বাচ্চা খাওয়ানো হলো। মিলাদ পড়ানো হলো। ধীরে ধীরে স্বস্তি আসতে শুরু করেছে। ঠিক সেদিন ই ঘটল বিপত্তিটা। উষার পেইন উঠেছে। প্রচন্ড ব্যথাতে মেয়েটা চলা তো দূরে থাক বিছানায় বসে থাকতে ও পারছে না। এই খবর পেতেই সকলে বের হয়ে গেছে। কিছু সময় আগে ইয়াস ফোন করে জানিয়েছে উষাকে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে। সেই ঠিকানায় আপাতত চলছে সবাই। দিতিয়া কাঁদছেন বিলাপ করে। বাচ্চা মেয়ে ওনার। না জানি কতটা সহ্য করতে হচ্ছে। অন্য দিকে আলমাস সাহেব কঠোর। তিনি প্রায় ধমকে উঠলেন। “কান্না করলে কি সব ঠিক হবে? একটু বুঝাতে মেয়েকে। বয়স কি খুব বেশি ওর? ওকে বোঝাতে পারলে না এখন বাচ্চা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“আমি কি জানতাম নাকি।”
“এসব জানতে হয়! অদ্ভুত বললে।”
স্থির থাকতে পারছে না আবৃত্তি। তুমুল গতিতে গাড়ি চালায় উন্মেষ। তবে রাস্তা যেন যাচ্ছেই না। বিপদ এলে এমন টাই হয়। দীর্ঘ সময় পর হসপিটালে পৌছাল ওরা। ততক্ষণে উষাকে নেওয়া হয়েছে অপারেশন রুমে। ইয়াস মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। দেহটা কেমন নেতিয়ে গেছে। সাহস দিতে উন্মেষ হাত রাখল কাঁধে। মলিন মুখে ইয়াসের চোখ ছলছল করে। উন্মেষ বুঝে না কি করে সান্ত্বনা দিবে। ওর বুকটা যে পু ড়ে যাচ্ছে। তিন ঘন্টা পর একটা সংবাদ এল। যা সকলকে স্থির করে দিয়েছে। আবৃত্তি দু পা পিছিয়ে গেল। কান্না জুড়ে দিয়েছেন দিতিয়া। ওনার দু চোখের জল যেন আজ শুকাবেই না। ইয়াসের মা বাবার মাথায় হাত। আর ইয়াস সে তো লাপাত্তা।
ব্যলকনিতে এল উন্মেষ। সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখল আবৃত্তি এসেছে। তাই আর ধরাল না। সময় নিয়ে শ্বাস নিল।
“সব কিছু এলোমেলো কেন হচ্ছে আবৃত্তি। আমার পরিবারেই কেন দুঃখ?”
“ভেঙে পড়ছেন আবার।”
“ভাঙছি না, কেউ যেন টেনে ভেঙে দিচ্ছে আমায়।”
“উষা কে বুঝানোর দায়িত্ব তো এখন আমাদের ই তাই না?”
“কি বোঝাব ওকে। বয়সটা কত বলো।”
“এই বয়সটা খুব ই রিক্সের। সেই জন্যেই আমার বার বার চিন্তা হচ্ছিল। শেষ রক্ষাটা আর হলো না বাচ্চা টা….।”
শেষ করতে পারে নি আবৃত্তি। খুব কষ্ট হতে লাগল। ডাক্তার জানালেন উষাকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। সকলেই গেল দেখা করতে। উষা ঘুমিয়ে আছে। সাত মাসের ভরা পেটটা এখন একদম ই নিচু। হৃদয়বিদারক এ স্মৃতি উষা কি আদৌ ভুলতে পারবে কখনো?
গুমোট কান্নায় ছুটে এল আবৃত্তি। উষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। পেটে হাত রেখে বুঝে যায় বাচ্চাটা আর নেই। ওর আত্মা যেন শোক গুনতে শুরু করেছে। আবৃত্তি টেনে নিল দু হাতে। “বোন আমার, এভাবে কাঁদে না সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“বাচ্চাটা বাঁচল না ছোট ভাবি। আমি পারলাম না ওকে বাঁচাতে।”
“এভাবে বলে না। আল্লাহ কে ডাকো।”
“আমার ছোট্ট সোনা। আমার প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি। সব শেষ হয়ে গেল ছোট ভাবি। সব শেষ। আমি কেমন করে বাঁচব বলো। আমি কেন ম*রলাম না।”
খাবারের প্যাকেটটা রেখে উন্মেষ বলল,”এমন করলে কিন্তু মা র দিব উষা।”
“মে*রো ফেলো ভাইয়া। আমি ভালো মা হতে পারি নি। বাঁচাতে পারি নি আমার সন্তান কে। নরকেও ঠায় হবে না আমার।”
ঠোঁট উল্টে কাঁদে উষা। উন্মেষের দিকে ইশারা করে আবৃত্তি। ছেলেটার নত দৃষ্টিতে বোঝা যায় ইয়াসের হদিশ মিলে নি। কে জানে কোথায় গেল ছেলেটা!
সকলের ই মন খারাপ। উষার শশুড় শাশুড়ি বাড়ি ফিরে গেছেন। সেখানে বড়ো ছেলের বউ একা। মাস খানেক আগে কনসিভ করেছেন। যাওয়ার আগে অবশ্য বলল উষা কে নিয়ে যাবেন। তবে দিতিয়া বললেন বাড়ি থাকুক মেয়েটা। কিছু দিন পর না হয় যাবে। শোকের সময় কেউ আর দ্বি মত করল না। উষার মাথাটা এখন আবৃত্তির বুকে। মেয়েটি পরম যত্নে জড়িয়ে নিয়েছে। আলমাস সাহেব আর দিতিয়া আগের গাড়িতে। কিছু ফর্মালিটিস এর জন্য ওদের লেট হলো।
“কিছু খাবি উষা? হালকা লিকুইড কিছু।”
“উহু।”
“ডাবের পানি খা একটু।”
“ভালো লাগে না ভাইয়া।”
“আপনি নিয়ে আসুন তো। ডাবের পানি খেলে একটু বল আসবে।”
রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে ডাবের পানি নিল উন্মেষ। জোর করে কয়েক ঢোক খাওয়াল আবৃত্তি। উষা আবারো কাঁদছে। কথা হারিয়ে যায় উন্মেষের। কিছু দিন আগে স্ত্রী হারাল এখন বোনের বাচ্চা টা ও চলে গেল। আহারে জীবন!
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি