#হিমাদ্রিণী – ২
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
জ্বর বেড়েছে মাশুকের। রাত এগারোটা বাজলো বাড়ি ফিরতে ফিরতে। এত অসুস্থতার মাঝেও সারাদিন রোগী দেখেছে। তার মধ্যে একটা বিশেষ রোগী তাকে বেশ বিব্রত করেছিল।কখনো তার স্পর্শে,আবার কখনও আঘাত দিয়ে। সম্মানে লেগেছে ব্যাপারটা। তারমধ্যে মেয়েটি তাকে বাড়ি ফিরতে দিচ্ছিলো না। শার্ট টেনে ধরে রেখেছিল। নাজেহাল করেছে অবস্থা। বাড়ি ফিরে খানিকটা লজ্জা পেল সে ঘটনাটা মনে করে। তারপর সোজা গোসল করল।মাথা ঠান্ডা না হলে কিছুতেই আর আরাম পাচ্ছিল না।
খাবার টেবিলে পরিবারের সকলে। বাবা,মা,বড় ভাই এবং ভাবি।ভাবি হাতে হাতে খাবার সার্ভ করছেন। মা সাহায্য করছেন তাকে।মৃদুল ছোট ভাই মাশুকের মুখের দিকে চেয়ে বললো,
-“তোর মুখটা লাল টমেটোর মত দেখাচ্ছে কেনো?”
মাশুক সোজাসাপ্টা জবাব দিলো, – “জ্বর”
শান্তা বেগম হুট করেই বিচলিত হয়ে পড়লেন। খাবারের প্লেট রেখে ছেলের দিকে এগিয়ে আসেন।কপালে হাত রেখে বললেন,
-“ভীষণ জ্বর দেখছি।…আগে বলিস নি কেনো?”
জহির সাহেব মাশুকের দিকে চেয়ে বলেন,
-“এই জ্বর নিয়ে গোসল করেছো কেনো? ঔষধ নিয়েছো?”
-“হুম” জবাব আসে মাশুকের তরফ থেকে।
মৃদুলের স্ত্রী রিমা বললো,
-“কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে সর্দিও আছে।দ্রুত খেয়ে নাও আমি আদা চা করে দিবো।”
জরুরি কথার প্রতিউত্তর আসে যেন নির্বিকার, সংক্ষিপ্ত, গুরুত্বহীনভাবে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর মাশুকের মুখ থেকে কথাগুলো যেন পা টিপে টিপে বেরোয়।একেকটি শব্দ যেন ভারী বোঝা। রিমা ঠাট্টা করে বলে ফেলে কখনো কখনো, ‘বড়ো ভাইয়ের মুখ চলে বুলডোজারের মতো, আর ছোটো ভাইয়ের শব্দগুলো যেন কচ্ছপের গতি নিয়ে ধীরে ধীরে আসে।’
শান্তা বেগমের চোখ গেলো মাশুকের হাতের দিকে। আঁচড়ের দাগ দেখে দ্বিতীয়দফা চমকান।সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
-“হাতে দাগ এলো কি করে?”
এতক্ষণ পর মাশুকের নজর উঠলো।এতক্ষণ নির্বিকার খেয়ে যাচ্ছিলো।হাতের দাগটা কি বেশি বোঝা যাচ্ছে?গোসলের সময় জ্বলেছে অনেক। ভেবে চিন্তে জবাব দিলো,
-“পার্কিং লটে যাওয়ার পথে রুক্ষ দেয়ালের সাথে লেগে দাগ পড়েছে বোধহয়।”
সাবলীল কথার ভঙ্গি। মিথ্যেটাও এমনভাবে বললো,যেনো সেটাই সত্যি।সবাই বিশ্বাসও করে নিলো।মৃদুল আবার মুখ খোলে।বলে,
-“আর ক’টাদিন অস্ট্রেলিয়া থাকলে পি.আরটা পেয়ে যেতি।অযথা চলে এসেছিস।”
প্লেটে অল্প খাবার অবশিষ্ট।একের পর এক প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে ফেলছে।অসুস্থতা থেকে এক লাফে চলে গেলো অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপে।বরাবরই তার অপছন্দের টপিক।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাশুক বললো,
-“এক কথা বারবার বলতে ক্লান্ত লাগেনা?”
-“নাহ লাগেনা।”
-“আমার শুনতে ভীষণ ক্লান্ত লাগে।”
মৃদুল বিতর্কের ভঙ্গিতে বলে,
– “খারাপের জন্যেতো বলি না।ভালোর জন্য বলি।এই দেশে কি আছে?সেখানে তোর ভালো ভবিষ্যত হতো।”
-“নিজ দেশের রাস্তার ধুলোবালিও ভালো”
-“এসব আবেগী কথাবার্তা”
হাত ঝেড়ে ফেললো মাশুক। এমনিতেই শরীর ভালো নেই তার মধ্যে একই কথা বারবার।বিরক্ত প্রায়।চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বললো,
-“দুটো বছর ভিনদেশে অচেনা মানুষের ভিড়ে থেকে দেখো।পাগল হয়ে যাবে!চকচক করলেই সোনা হয়না।বিদেশ জায়গাটা দুর থেকেই সুন্দর।”
হনহন করে রুমে চলে যায় মাশুক। জোরে দরজা বন্ধ করেছে।পানিটা পর্যন্ত খেলো না।রেগে গেলো রিমা।স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“এমনেতেই ওর শরীর ভালো নেই। কাজ থেকে ফিরেছে।তোমার এখন এই কথাটা তোলার দরকার ছিলো? জানোইতো ছোট মানুষ ওর মাথা গরম।”
মৃদুল রিমার দিকে চেয়ে বললো,
-“ও ছোট? আটাশ বছরের দামড়া ছেলে।”
-“আমি বাড়ির ছোট সদস্য বুঝিয়েছি মৃদুল।তুমি বড়,একটু বুঝে শুনে কথা বললেও পারো।”
-“আমাকে না ওকে বোঝাও।এমন গরম মেজাজ নিয়ে তার পেশায় টিকে থাকা মুশকিল।”
____
-“আমি আজ শাক দিয়ে ভাত খেয়েছি।তোমরা কি খেলে?”
জবাব এলো,
-“আমরাও শাক দিয়ে ভাত খেয়েছি মা।”
হেমার চোখে-মুখে আনন্দের আলো যেন বিদ্যুতের ঝলকানি হয়ে ফুটে উঠলো। এমন এক অপরিসীম সুখে ভরেছে তার মন। যে তা ভাষার সীমায় বাঁধা অসম্ভব।কেমন করে সে এই আনন্দের গভীরতা প্রকাশ করবে তা তার নিজেরও অজানা।
-“তোমরা আর আমি সেম সেম।”
জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মাশুক নির্বিকার দৃষ্টিতে হেমাকে দেখলো। বুকের ওপর হাত গুঁজে ভেতরের দৃশ্যের দিকে স্থির তাকিয়ে রইলো। খতিব সাহেবের মুখে চিন্তার গভীর ছায়া। দুজনেই চুপচাপ দেখছে মেয়েটিকে। যে এক নির্জীব অ্যালবামের সাথে কথা বলে চলেছে।তারাও যেন জবাব দিচ্ছে তার কথার।জীবনের সমস্ত অনুভূতি ওই ছবির পাতাগুলোর মাঝে আটকে আছে মনে হলো।
মুখ খুলে মাশুক।বলে,
-“আমি আপনার অনুরোধে এই কেসটা হাতে নিয়েছি।কিন্তু আপনারা হাতে হাত রেখে বসে থাকবেন তা হবেনা। আপনাদের এখানে একটা বড় রোল আছে।”
খতিব সাহেব মাশুকের দিকে চাইলেন।কথার অর্থ বুঝেননি তিনি।প্রশ্ন করলেন,
-“কি বলতে চাইছেন?বুঝিনি।”
-“যেহেতু আপনার বড় ভাই এবং ভাবি ছিলেন হেমার বাবা মা সেহেতু আপনাদের এখন থেকে ওর বাবার মায়ের প্রতিচ্ছবি হতে হবে।সহজ ভাষায় বললে তাদের নকল করতে হবে।তারা যেভাবে হাঁটতো,কথা বলতো,কি পরিধান করতো।সবটা কপি করতে হবে।তাদের ছায়া রূপে আবির্ভাব ঘটবে আপনাদের হেমার জীবনে।”
-“এতে ফলাফল কি হবে?”
-“বীজ রোপণ করার সাথেসাথে ফলের আশা করা বোকামি।হেমার মেন্টাল কন্ডিশন এমন যে ওকে যে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারবে।আপনারা করুন।এই বিভ্রান্তির মাধ্যমে ওর মনে হবে ওর বাবা মা মারা যায়নি। ও যা দেখেছে,যা জেনেছে সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো।ধীরে ধীরে যখন ওর মানসিক অবস্থা উন্নতি হতে থাকবে তখন আমরা পরবর্তী ধাপে এগোবো।”
মাশুক তার সোজাসাপ্টা কথা সেরে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। খতিব সাহেবের করুণ অনুরোধেই হাসপাতালের ব্যস্ততা শেষে হেমার কেসটা নিজের হাতে নিয়েছে সে। ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই ফরিদা বেগম ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। কণ্ঠে বিরক্তির তীক্ষ্ণ সুর ভেসে উঠল,
-“আমি তো আগেই বলেছিলাম, এই মেয়েটাকে পাগলা গারদে পাঠাও। কিন্তু তুমি ঝামেলা তুলে এনে আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দিলে!”
খতিব সাহেব কোনো কথা বাড়ালেন না, নিঃশব্দে সরে গেলেন সেখান থেকে। তার স্ত্রী হেমাকে আজকাল পছন্দ করেন না কেনো যেনো। তাদেরও একজন সন্তান আছে।হেমার থেকে তিন বছরের ছোট। সেই ছেলে এখন দূরদেশে, কানাডার বিস্তীর্ণ ভূমিতে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে।
-“হেমা কি খবর?”
মাশুক ধীর পদক্ষেপে হেমার দিকে এগিয়ে গেল। গতরাতের ঘটনা বারবার মনে ভাসতে লাগল।খতিব সাহেব এবং তার স্ত্রী কত কষ্টে সামলেছিলেন তাকে। এই আসবাবহীন ঘরে কেবল একটাই প্রাণের স্পন্দন, আর সেটি হেমা।চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কুশন, কলম, কাগজ। মাশুককে দেখামাত্রই হেমার চোখে আগুন জ্বলে উঠল। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে পড়ে গেল গত রাতের মুহূর্তগুলো। তড়িঘড়ি করে হেমা তার অ্যালবাম লুকিয়ে রাখল কাপড়ের নিচে আর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কুশন, কাগজ, কলম একাধারে ছুড়তে লাগল মাশুকের দিকে।
মাশুক নিজেকে বাঁচিয়ে নেয় ওই আসন্ন সামান্য আঘাত থেকে। হেমা চিৎকার করে বললো,
-“তুমি তুমি!…কেনো এসেছো?আমার সাথে গল্প না করে পালিয়েছো।”
-“শুনো হেমা।আমি সরি,দেখো…”
-“আসবে না একদম আমার কাছে আসবে না।”
হেমা জেদ করে বসে রইল। কিন্তু মাশুক তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। সে জানে হেমার এই আক্রমণাত্মক মনোভাব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তার অতীতে মেরে রক্তাক্ত করার হিস্ট্রি আছে।এটি ভয়াবহতার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।এই ক্রোধের আগুন নিভিয়ে তাকে শান্ত করতে হবে। নাহলে পরিস্থিতি আরেকটি বিপর্যয়ে গড়াবে।
ফুঁসতে থাকা হেমার সামনে এসে হাসিমুখে বসলো মাশুক। বললো,
-“তুমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলছিলে?”
-“তোমাকে কেনো বলবো?”
-“আচ্ছা বলতে হবেনা।কিন্তু আমি শুনে ফেলেছি।দেখো তুমি প্রতিদিন তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলো,দেখা করো।ঠিক তেমনি আমার বাবা মা আছে।আমি যদি আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা না করি তারা কষ্ট পাবে না বলো?”
বিশালাকৃতির চোখজোড়া এভাবেই চেয়ে থাকে ক্ষণেক্ষণে।বুঝতে হয়তো একটু সময় নেয়।তারপর ভেবে চিন্তে জবাব দেয়। হেমা নাক ফুলিয়ে প্রশ্ন করে,
-“তারা তোমাকে না দেখলে কাঁদে?”
-“হ্যাঁ”
হেমা ঠোঁট উল্টে মাথা নামিয়ে রাখে।কি যেনো ভাবে আনমনে। দূর থেকে কাগজ,কলম নিয়ে আঁকাআঁকি শুরু করলো।কলম দিয়ে কাগজে অযথা দাগ কাটছে।
মাশুক নোট করলো,গতকাল হেমা বলেছিলো তার বাবা মা নেই।আজ তাদের সাথে কথা বলছে?যদিও সবটাই তার হ্যালুসিনেশন তারপরও মুখ ফুটে বলা এবং বোঝার মধ্যে আমূল তফাৎ।
মাশুক ঘড়ি দেখে।এটা তার ঔষধের সময়।বিগত সাতদিন তাকে নাকি ঔষধ খাওয়ানো যায়নি।
মাশুক পকেট থেকে একটি সাদা রঙের টফি বের করলো। হেমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“টফি খাবে?”
হেমার অভিমান হয়েছে। মাশুক কেনো তার সাথে গল্প না করেই চলে গিয়েছিলো? সে তো বলেছিল, মাশুক তার বন্ধু। তবু কেন এমনটা করলো কাল? কিন্তু টফির দিকে তাকিয়ে হঠাৎই লোভ হলো হেমার। মলিন মুখে একবার টফির দিকে আরেকবার মাশুকের দিকে তাকালো। মাশুকের হাত থেকে টফি নিতে গেলে, সে দ্রুত হাত সরিয়ে ফেলে। হেমার মুখে এক অসম্পূর্ণতার ছাপ ফুটে উঠল।মাশুক বললো,
-“আরেকটা টফি আছে।আগে সেটা খেতে হবে।”
-“দুটো টফি?”
-“হ্যাঁ।”
কথার ছলে ঔষধ বের করেছে।একটি পানির বোতল এনেছে সাথে। ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“এটা পানি দিয়ে খাও, কারণ এটা তেতো।আর এইযে আরেকটা টফি সেটা মিষ্টি।”
-“তেতোটা খাবো না।”
-“তাহলে মিষ্টিটাও পাবে না।”
হাতের কলম শক্ত করে চেপে ধরে হেমা। অতিরিক্ত বল প্রয়োগে কলমটি ভেঙে গেলো।রাগের মাথায় মানুষের দেহের শক্তি বৃদ্ধি পায়। হেমার ক্ষেত্রেও তাই।কলম ভেঙে হাতে কালি মাখোমাখো হয়ে গেছে।মাশুক ভরকে উঠে।বলে,
-“হেমা?…তুমি এটা কেনো করলে?দেখি কলম পাশে রাখো।”
-“তুমি আমার কথা শুনো না কেনো?”
-“তুমি আমার কথা শুনলে আমিও শুনবো।নাও জলদি এটা খাও।”
হেমা জেদ ধরে বললো, -“খাবো না”
-“তাহলে আমি চলে যাই?ভেবেছিলাম তোমার সাথে আজ নতুন করে গল্প করবো।”
হেমা হাত খামচে ধরে ফেলে মাশুকের।নীল শার্টে মুহূর্তেই কালো কালি লেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে নিজের সংযমটুকু টিকিয়ে নেয় মাশুক।আঘাত করা,শার্ট টেনে কুঁচকে ফেলা এখন এই প্রিয় শার্টটিও নষ্ট করলো।কিন্তু টু শব্দ করার মত তার উপায় নেই।
-“যাবেনা, যাবেনা প্লিজ।”
-“যাবো না।আগে এটা খাও”
হেমা নাক মুখ কুঁচকে গিলে নিলো ঔষধ।মাশুক উপলব্ধি করলো মেয়েটি সঙ্গ চায়।পাশে থাকার জন্য কাউকে প্রয়োজন তার।নাহয় এক দেখায় কারো সাথে এই ধরনের পেশেন্টরা সচরাচর মিশে না।
মাশুক তার ব্যাগ থেকে ওয়েটটিস্যু বের করে।বললো,
-“দেখি হাত দাও।তোমার হাতে কালি লেগেছে।”
-“ছিঃ! কি বিশ্রী কালো রং!”
মাশুক নিজের অজান্তেই স্মিত হাসে হেমার কথার ভঙ্গিতে।তারপর খুব দ্রুতই মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক করে বললো,
-“কালো রং সুন্দর…”
-“এই এই কি বললে তুমি?”
-“নাহ কিছুনা।আমি তোমার হাত ক্লিন করেছি।এখন কি করবে জানো?”
হেমা তার কথার বিপরীতমুখী প্রশ্ন করে,
-“মিষ্টি টফি দাও আগে”
মাশুক টফিটা এগিয়ে দিলো তার দিকে।তারপর বলতে লাগলো,
-“এখন এই যে টিস্যুগুলো দেখছো?সেগুলো ডাস্টবিনে ফেলে আসবে।কেমন?আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো।”
বাইরে যাওয়ার কথা শুনতেই হেমার মুখমণ্ডলে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ফুটে উঠে। তার চোখের ঝিলিক ম্লান হয়ে এলো।আর শরীরটা যেন হঠাৎই আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিলো হেমা যেন এক অদৃশ্য শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরছে। ভয়ের ছায়া কি তাড়া করছে তাকে? বাইরে যাওয়ার নাম শুনেই কেনো এমন শীতল আতঙ্কে কাঁপছে সে? যেন বাইরের জগৎ তার জন্য এক অজানা ভয়াবহতার প্রতিশব্দ।
-“কি হলো?”
নরম স্বরে জবাব আসে, -“যাবো না বাহিরে”
-“কেনো?”
-“বাহিরে গেলে ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”
মাশুকের কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়ে। খতিব সাহেবের কথাগুলো মনের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।আর সবকিছু যেন আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হেমাকে একসময় স্টোর রুমের কাবার্ডে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।বাইরে আসতে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো অবশ্যই? সেই নিষেধাজ্ঞার ভয়ই কি আজও তার মনে গেঁথে আছে? মাশুক লক্ষ্য করে, এই ঘরে কোনো জানালা নেই। একটিমাত্র জানালা থাকলেও সেখান থেকে কোনো আলো প্রবেশ করে না। ঘরের ভেতরটা যেন এক স্থবির অন্ধকারে বন্দী।যেমন হেমার মনও আটকে আছে কোনো এক অদেখা শৃঙ্খলে।
মাশুক প্রশ্ন করে, -“তোমার সূর্যের আলো পছন্দ নাকি বৃষ্টি?”
-“আমার কালো আঁধার ঘরে থাকতে ভালো লাগে।আমি রোদে যাবো না। বৃষ্টিতেও যাবো না।”
বিস্মিত নয়নে তাকায় মাশুক।পরক্ষণেই বলে,
-“আমি কে?তোমার বন্ধু তাই না?”
-“হুম”
-“আমার সূর্যের আলো ভীষণ পছন্দ”
হেমা মিইয়ে থাকা মুখে মৃদু স্বরে বললো, -“হুম”
-“তোমার বন্ধুর সূর্যের আলো পছন্দ।যাবে আমার সাথে সূর্যের আলো দেখতে?আমার ভয় করে একা যেতে”
হেমা অকস্মাৎ মুখে হাত রেখে হেসে ফেলে।বলে,
-“তুমি এত বড় একটা লোক হয়ে ভয় পাও?”
-“হুম ভীষণ”
-“কিন্তু আমি যাবো না।”
-“চলো প্লিজ।আমি একা বাহিরে গেলে যদি ওরা আমাকেও মেরে ফেলে?তুমি থাকলে আর কিছু করতে পারবে না।চলো হেমা।”
হেমা দীর্ঘক্ষণ ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন।যেন মনের ভেতরে এক কঠিন দ্বন্দ্ব চলছে। আর মাশুক তার ভাবুক মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।প্রতিটি প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মস্তিষ্কে টুকে নিচ্ছে।হেমার মুখে কখনো মাধুর্য, কখনো অদ্ভুত হিংস্রতার ছাপ ফুটে ওঠে। ফর্সা ত্বকের ওপর ছোপ ছোপ দাগ। ঘন পাপড়ির চোখগুলো মাঝে মাঝে পিটপিট করে ওঠে,পাতলা ঠোঁটে ছড়িয়ে আছে গোলাপি আভা। কখনো সে ঠোঁট কামড়ে ধরে, আবার কখনো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন এক অন্তহীন শূন্যতার খোঁজে।
হেমা দৃষ্টি তুললো মাশুকের দিকে। ঝটপট উল্টো ঘুরে বসলো।বললো,
-“তুমি ভয় পেও না।আমি তোমার সাথে যাবো।….দেখি আমার চুল বেঁধে দাও।আমার চাচীটা সুন্দর করে চুল বাঁধতে পারেনা।মাঝেমধ্যে মা এসে বেঁধে দিয়ে যায়।”
মাশুক চুল বাঁধবে? তাও মেয়েদের চুল? এ কাজ তো তার একেবারেই অজানা। নিজের অজান্তেই গভীর এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। জীবনে প্রেম এসেছিল একবার, কিন্তু প্রেমিকার চুলে হাত ছোঁয়ানোর সৌভাগ্য কখনও হয়নি। ভিনদেশের টানাপোড়েনে সেই প্রেমের কোমলতা হারিয়ে গেছে।যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে পুরোনো স্মৃতির পাতায়। কিন্তু এখন সেসব নয়,এই মুহূর্তে তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।কিভাবে হেমার চুল বাঁধবে? তার অনভিজ্ঞ হাত কি পারবে সেই চুলের জট ছাড়াতে?
হুট করে উঠে গেলো হেমা। আশ্চর্য হয়ে গেলো ঘরের বাহিরে তার দৌঁড় দেখে। ঘুরে চেয়ে রইলো দরজার দিকে।তুফানের গতিতে গিয়েছে আর ফিরেও এসেছে হাতে চিরুনি নিয়ে।মাশুকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“চুল বেঁধে দাও প্লীজ।”
যদি কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এই ধরনের আবদার করত, তাহলে মাশুকের গলায় নিঃসন্দেহে এক ধমক শুনতো।কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অসহায় মাশুক কপালে আঙুল চালিয়ে নিজের অস্বস্তি লুকানোর চেষ্টা করল। ঢোক গিলে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল হেমার চুলের দিকে।যেন এক অনভিজ্ঞ যোদ্ধা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে।
-“আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।আমাকে আইসক্রিম কিনে দিবে?”
মাশুক মহাব্যস্ত।চিরুনি নিয়ে যুদ্ধ করছে। দুহাতে চুল একত্রিত করতে গিয়ে হেমার কথা কানে তোলা হলো না। হেমা তড়িৎ গতিতে মুখ ঘুরায়।বলে,
-“এই ছেলে! আইসক্রিম খাবো বলেছি”
-“হ্যাঁ! দিবো।তুমি সোজা হয়ে বসো”
খতিব সাহেবের অনুমতি নিয়ে মাশুক হেমাকে পাশের পার্কে নিয়ে গেল। তবে বাইরের পরিবেশে এসে হেমা আরও কুঁকড়ে গেল।তার ভেতরের শঙ্কা ও অস্বস্তি বাড়তে লাগল। আলোর দেখা মেলে না সহজে। অনেকদিন পর সূর্যের কিরণ চোখ ধাঁধিয়ে তুলছে।মানুষের কোলাহল অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। মাশুকের পিঠের দিকের শার্টের অংশ শক্ত করে খামচে ধরে খুব ধীর গতিতে হাঁটছে সে। সামনে একটি দোলনা চোখে পড়তেই থমথমে স্বরে, তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল,
-“আমাকে দোলনায় চড়াবে?”
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত অসহায়ত্ব মিশে ছিল, যেন একসময়কার ছেলেমানুষি খুঁজে পেতে চাইছে। মাশুক বললো,
-“অবশ্যই।এসো”
হেমা দোলনায় ধীরে ধীরে দুলছে।ভেতরে ভেতরে এক অজানা ভয় তাকে কাবু করতে চাইছে।তবুও সে সাহস সঞ্চয় করে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। মাশুক পাশেই দাঁড়িয়ে।বুকে হাত ভাঁজ করে নিরবে হেমার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। তার কাজই তো হেমার আচরণ লক্ষ রাখা। হঠাৎ হেমা দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত মাশুকের পেছনে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে সামনে একদল পুরুষের দিকে ইশারা করে বলল,
-“দেখো, ওই খারাপ লোকগুলো আসছে! তারা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে বাঁচাও!”
চলবে…