হিমাদ্রিণী পর্ব-০৫

0
2

#হিমাদ্রিণী – ৫
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

নতুন দিনের দুপুরে বাতাসটা তেমন কষ্টদায়ক নয়।সূর্যের তেজ মোটামুটি। মাশুকও আজ অনেকটা সতেজ, মনও বেশ ফুরফুরে। গাড়ি চালাতে চালাতে হেমাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।আজকাল সেই পথে যেতে খারাপ লাগে না, বরং অপেক্ষায় থাকে। গাড়িতে গান চলছে, মাশুক একটার পর একটা পাল্টাচ্ছে।কিন্তু কিছুতেই মনমতো গান পাচ্ছে না।হুট করেই কানে বাজলো পুরোনো একটি হিন্দি গান,

“কাভি কাভি মেরে দিলমে খাইয়াল আতা হে
কে জাইসে তুঝকো বানায়া গায়া হে মেরে লিয়ে
তু আবসে পেহেলে সিতারো মে
বাস র‍্যাহি থি কাহি
তুঝে জমিন পে বুলায়া গায়া হে মেরে লিয়ে”

ভালো লাগলো মাশুকের। সিগন্যাল পড়তেই গানের অর্থ বের করে ফেলে।অর্থ দাঁড়ালো ভীষণ সুন্দর,

“মাঝেমধ্যে আমার মনে একটি ভাবনা আসে,
যেন তোমাকে তৈরি করা হয়েছে আমারই জন্য।
তুমি আগে তারাদের মাঝে কোথাও ছিলে,তোমাকে পৃথিবীতে ডেকে আনা হয়েছে আমার জন্য।”

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মস্তিষ্ক যেনো গানের সেই লাইনগুলোতে হেমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলো। এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হতে থাকলো।যা মাশুককে ভাবনার গভীরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। কেন এই মিল? হঠাৎ গাড়ির হর্ন সেই ঘোর কাটিয়ে তুললো তাকে। নিজের ভাবনাকে আজগুবি মনে করে মাশুক ঝেড়ে ফেললো সব চিন্তা। গাড়ি স্টার্ট করে আবারও হেমার দিকে ছুটে চললো।

মাঝ রাস্তায় খতিব সাহেবের কল পেয়ে মাশুকের মন এক মুহূর্তের জন্য অজানা আনচান অনুভব করলো।কি হতে পারে? দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলো।

-“ডাক্তার মাশুক?আপনি কোথায় আছেন?”

-“আমি রাস্তায়।আসছি….কিছু হয়েছে?”

ফোনের অন্যপাশ থেকে হেমার চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এলো।মাশুক দ্রুত গাড়ি সাইডে এনে পার্ক করে।ফোন কানে চেপে বললো,

-“কি হয়েছে? হেমা ঠিক আছে? চেঁচাচ্ছে কেনো?”

-“সকাল সকাল উঠে আপনাকে দেখতে পায়নি।তাই অনেক রেগে গেছে।ভাংচুর শুরু করেছে রীতিমতো।”

মাশুক কপাল কুঁচকে বলে উঠে,

-“ওতো এই সময় ঘুম থেকে উঠে না”

-“জানি না আজ কিভাবে উঠলো।আপনি দয়া করে দ্রুত আসুন।ওকে সামলানো যাচ্ছে না”

অন্যহাতে গাড়ি স্টার্ট করলো মাশুক। বিগত একমাসে একটা অভ্যাস হয়েছে হেমার।মাশুকের অভ্যাস।যেনো তাকেই সর্বোপরি মানে।মাশুক খতিব সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

-“পাঁচ মিনিট লাগবে।ওকে সামলান”

-“চেষ্টা করছি”

-“আঘাত যেনো না পায়,খেয়াল রাখবেন।আসছি আমি”

গাড়ির গতি যেনো বেড়ে চললো, পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেনো পাঁচ সেকেন্ডে পাড় করার তাড়না। অন্যদিকে, হেমা হাতের কাছে যা পাচ্ছে সব ছুঁড়ে ফেলছে। তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে, চুল এলোমেলো। চিৎকার, আর্তনাদ যেন ঘরের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। খতিব সাহেব আর ফরিদা বেগম অসহায়ভাবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, সামনে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। হেমা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

-“মাশরুমকে এনে দাও!এনে দাও বলছি!”

ফরিদা বেগম সাহস করে বললেন,

-“আসছে,আসছে”

সিঁড়িগুলো লাফিয়ে চড়লো মাশুক।এসেই অনবরত বেল বাজাচ্ছে।দরজা খোলার আগ মুহূর্তে হুট করেই অস্থির চিত্ত শান্ত হয়ে পড়ে।সে নিজে হাইপার হয়ে যাচ্ছে।হেমাকে কি সামলাবে?নিজেকে বলে উঠলো,

-“বাড়াবাড়ি হচ্ছে”

ফরিদা বেগম দরজা খুলে দেন।মাশুক জুতো নিয়েই ঢুকে গেলো ফরিদা বেগমকে উপেক্ষা করেই। সরাসরি হাজির হয় হেমার ঘরে। কেঁদেকেটে নাজেহাল। ফুপাচ্ছে বসে বসে।মাশুক এগিয়ে গিয়ে বসলো তার পাশে। মাশুককে দেখা মাত্রই হামলা চালায় হেমা। আঘাত করতে শুরু করলো তার বুকে এবং বাহুতে।মাশুক দুহাত শক্ত করে চেপে রাগী গলায় বলে উঠে,

-“কি সমস্যা, হ্যাঁ?…গতকাল কি শিখিয়েছি? ভুলে গেছো?”

মাশুকের চোখ বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে।হেমা স্থির চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে।ঠোঁট কেঁপে উঠে তার।চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রুধারা বইতে শুরু করলো।মাশুক তার তেজি রূপ বজায় রেখে বললো,

-“একদম কাঁদবে না। কি করেছো এসব?জিনিসপত্র ছুঁড়েছো কেনো? বারণ করেছিলাম?”

-“ত..তুমি আমাকে ফেলে বারবার চলে যাও।”

মাশুক ডানপাশে চেয়ে নিচু গলায় খতিব সাহেবকে অনুরোধ করে যেনো একটা তাওয়াল ভিজিয়ে দেওয়া হয় তাকে।খতিব সাহেব চলে যাওয়ার পরপরই হেমার দিকে তাকায় মাশুক।বলে,

-“আমি ফেলে যাই না হেমা।”

-“যাও!যাও!যাও! প্রতিদিন ফেলে রেখে যাও।”

জেদি গলায় জবাব দেয় হেমা।হাঁপিয়ে উঠেছে।নিঃশ্বাস ফেলছে ঘনঘন।খতিব সাহেব এসে ভেজা তাওয়াল দিয়ে গেলেন।মাশুক পা ভাঁজ করে বসে।তার কপালে তিনটে ভাঁজ পড়েছে।আলতো হাতে হেমার চুল সরিয়ে দিলো চেহারার সামনে থেকে।ভেজা তাওয়াল মুখের কাছে নিতেই সরে গেলো হেমা।মাশুক ধমকের সুরে বললো,

-“চুপচাপ বসো। কোনো নড়াচড়া করবে না।”

হেমা বিস্ময়ে বিমূঢ়, তার দৃষ্টিতে মাশুকের এই হঠাৎ রূপান্তর ধরা পড়ছে বারবার। মাশুক কি সেই মানুষ, যাকে সে এতদিন বন্ধু হিসেবে চিনেছে,তার বিড়ম্বনায় পূর্ণ মস্তিষ্কে? নাকি এটা অন্য কেউ?কেমন যেনো পরিবর্তিত মনে হচ্ছে।তার অবুঝ মন বারবার প্রশ্ন করছে, আর সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। মাশুকের এই আচরণ তার মনে সুচের মতো গভীরভাবে বিঁধে গেলো। এক মুহূর্তেই ঠোঁট বেঁকে যেতে শুরু করলো, এবং কান্না যেন তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত হয়ে আসতে লাগলো।

হেমার কান্না দেখে মাশুকের মুখ স্বাভাবিক হয়ে এলো।বললো,

-“কেনো কাঁদছো বলোতো? এসেছিতো।”

হেমা আর কোনো জবাব দিলো না।মুখ লটকে গেছে।চোখ বড়বড় করে নিচের দিকে চেয়ে আছে। চেহারা তমাসাবৃত।মাশুক চোখ বন্ধ করে ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-“তোমাকে বলেছিলাম কাউকে আঘাত করা ব্যাড হ্যাবিট?”

নিরুত্তর হেমা।মুখ নামিয়ে চুপচাপ স্থির।নারী জাতির অভিমান সবক্ষেত্রেই খাটে।তার শারিরীক এবং মানসিক অবস্থা যেমনই হোক।অভিমান সর্বাবস্থায় থাকা ম্যান্ডেটরি।

-“আমার কথা শুনবে হেমা?”

এবারও যে কাঙ্খিত উত্তর আসেনি।মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। মাশুক বললো,

-“আমি তোমাকে বলি শুনো”

হেমা নিজের অজান্তেই জিজ্ঞাসু নয়ন তুলে দেয়।আবার সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে ফেলে।হেমার পাশে থাকা অ্যালবাম টেনে সামনে আনলো মাশুক। আশ্চর্য হেমা কিছু বলেনি তাকে।অথচ এই অ্যালবাম সে কাউকে ধরতে দেয়না।মাশুক স্মিত হেসে বললো,

-“আজ যেমন আমাকে না পেয়ে তুমি কাঁদছিলে?ঠিক আমার মাও আমাকে না দেখে কাঁদছিলো।তোমার মা যদি কান্না করতো তোমাকে দেখতে না পেয়ে তুমি কি করতে?”

হেমা ফটাফট জবাব দেয়,

-“দৌঁড়ে যেতাম মায়ের কাছে।তারপর…তারপর জড়িয়ে ধরতাম।”

-“আমিও আমার মায়ের কাছে দৌঁড়ে গিয়েছি।তারপর জড়িয়ে ধরেছি।”

হেমা নাক টেনে প্রশ্ন করলো,

-“তোমার মা তোমার কপালে চুমু খেয়েছে?”

-“হ্যাঁ খেয়েছে।”

-“আচ্ছা তোমার মা আর আমার মা কি আলাদা?”

-“হ্যাঁ।”

-“কেনো?আলাদা কেনো?”

এই প্রশ্নের জবাব কি এবং কেমন হতে পারে মাশুক নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। দ্বিধায় জড়িয়ে গেলো। শব্দগুচ্ছ মেলাতে পারছে না।হেমা ফের প্রশ্ন করে,

-“বলো?”

-“আল্লাহ সবার জন্য আলাদা আলাদা বাবা মা সৃষ্টি করেছেন।”

-“কেনো করেছেন?”

মাশুক তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।তার পেশার সাথে এমন দ্বন্দ্ব যাচ্ছে না একেবারে।সময় নিয়ে বললো,

-“আচ্ছা হেমা তোমার বাবা মা যদি আমাকে ভালোবাসেন তাহলে তোমার ভালো লাগবে?”

-“না না একদম না।” উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলো হেমা।

-“ঠিক এই কারণে সৃষ্টিকর্তা সবাইকে আলাদা আলাদা বাবা মা দিয়েছেন।যেনো কারো ভাগের ভালোবাসা কম না হয়।তোমার বাবা মা তোমাকে ভালোবাসবে আর আমার বাবা মা আমাকে।”

হেমা মাথা চুলকাচ্ছে। নির্ঘাত কিছুই বুঝেনি।মাশুক সঠিক উপায়ে বোঝাতেও পারেনি।আর কত সহজ ভাষা প্রয়োগ করবে?

____

খতিব সাহেবের অস্থিরতা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে। বয়সের ভার যেন শরীরের সঙ্গে মনের উপরও চেপে বসেছে। দীর্ঘক্ষণ বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি, শরীরটা ভালো ঠেকছে না। ফরিদা বেগম বারবার খেতে ডাকলেও ওঠার শক্তি পাচ্ছিলেন না। মন এবং শরীর কোনোটাই সায় দেয়নি।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠলেন। মাশুক এসেছে।ধীরে ধীরে উঠে বসলেন খতিব সাহেব,

-“ভেতরে আসুন ডাক্তার।”

মাশুক ঘরে প্রবেশ করে। সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলো,

-“অসুস্থ মনে হচ্ছে আপনাকে”

খতিব সাহেব মাথা দুলিয়ে স্মিত হাসলেন।বললেন,

-“এ আর নতুন কি?”

-“কোনো সমস্যা আছে নাকি?”

-“বয়সের সাথে সাথে যেসব সমস্যা হওয়ার কথা সেগুলোই।”

মাশুক দাঁড়িয়ে আছে।খতিব সাহেব কথার ছলে কয়েকবার বলেছেন তাকে বসতে।সে বসেনি।দুয়েক মিনিট খতিব সাহেবের সাথে কথা বলে চলে যাবে বাড়িতে।হেমা ঘুমিয়ে পড়েছে।মাশুক বললো,

-“প্রেশার ঠিক আছে?”

খতিব সাহেব জবাবে বলেন, -“মাপি না অনেকদিন।”

মাশুক কথা বাড়ালো না।নাই আর কোনো প্রশ্ন করলো।সরাসরি তার ব্যাগ থেকে স্ফিগমোম্যানোমিটার বের করে খতিব সাহেবের সামনে এসে এক পা ভাঁজ করে বসে। ইশারায় হাত এগিয়ে দিতে বললো।যেমনটা ভেবেছিল সেটাই।ব্লাড প্রেশার হাই।

মাশুক প্রশ্ন করলো, -“ঔষধ নিয়েছেন?”

-“হ্যাঁ।”

-“চিন্তার কারণ নেই।ব্লাড প্রেশার একটু হাই।তবে বেশি না।আপনি মিসেস সরোয়ারকে বলুন আপনার পাশে পানির বোতল রাখতে।আর অতিরিক্ত লবণ এভয়েড করুন।এখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বেন।”

-“হেমা?”

-“আমি হেমার জন্য আছি। ও ঘুমিয়েছে।আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।টেনশন করবেন না।এতে আপনার ক্ষতি।একদম মাথা ঠান্ডা রাখুন।কোনো ভয় নেই,কোনো চিন্তা নেই।”

মাশুক ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ালো চলে যাবে বলে।দরজা অব্দি এগিয়ে আবার ফিরে আসে।খতিব সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

-“আচ্ছা মিস্টার সরোয়ার বলতে পারবেন হেমা এত দ্রুত কিভাবে ঘুম থেকে উঠলো?সেতো দুপুরের আগে উঠেনা।”

-“আমিও বিষয়টি বুঝতে পারিনি ডাক্তার।আমিও ভাবছি ওতো দ্রুত ঘুম থেকে উঠেনা।”

মাশুক ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা দোলায়।বলে,

-“আচ্ছা।নিজের যত্ন নিন।আমি আসি তাহলে”

মাশুক বেরিয়ে পড়েছে।দুপুরের তুলনায় রাতের আবহাওয়া সুন্দর।ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা বইছে। গাড়ির এসির বাতাস কেমন ভারী লাগছে তার কাছে। তাই এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো। ঢাকা শহরের ধুলোবালি মাখা ঠান্ডা হাওয়াও কেমন যেন তৃপ্তির স্বাদ এনে দিচ্ছে।এক মুহূর্তের জন্য ভাবলো হেমার কথা।মেয়েটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে খুব অল্পদিনে।খতিব সাহেবের ভাষ্যমত অনুযায়ী তাকে সামলানো চারটে খানি কথা ছিলো না।কিন্তু মাশুক সামলে নিচ্ছে তো।আরো বিভিন্ন বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।ঠিক তখনই ফোন বাজে। স্ক্রিনে শান্তনুর নাম ভেসে উঠলো।গাড়ির গতি স্লো হয়ে এসেছে।সামনেই ঢাকা শহরের আইকনিক জ্যাম।ফোন রিসিভ করে মাশুক।

-“হ্যাঁ বল”

ফোনের অপরপাশ থেকে শান্তনু বলে উঠে,

-“আসবি?রমনার দিকে আছি আমি।”

-“তোর ডিউটি শেষ?”

শান্তনু জবাব দেয়, -“হ্যাঁ শেষ।তোর সময় হবে নাকি তাই বল?”

-“কোনো বিশেষ কারণ আছে নাকি?”

শান্তনুর কপাল কুঁচকে যায়।ছেলেটা যা তা।বন্ধু মানুষ কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া দেখা করতে পারেনা?রেগে বললো,

-“ভেবেছিলাম আড্ডা দিবো।আসতে ইচ্ছে হলে আয়।নাহয় আমি বাড়ি গেলাম।”

-“রেগে যাচ্ছিস কেনো?”

-“আসবি?”

মাশুক আর প্রশ্ন করলো না কোনো।অনেকদিন পর আড্ডার জন্য ডেকেছে শান্তনু।এমন হয়না এখন আর।তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।বন্ধুত্ব আছে।তবে দেখা সাক্ষাত হয়না একেবারেই।মাশুক করেনা।সে একা থাকার আনন্দে মজেছে বেশ।আজ আর না করলো না।বন্ধুর কথা রেখেই বললো,

-“জ্যামে আটকে আছি।অপেক্ষা কর।”

ঢাকা শহরের জ্যাম,এর কোনো তুলনা হয় না। সত্যিই এক প্রকার অতুলনীয়! যেন সময় থেমে যায় আর মানুষ নিরুপায় হয়ে বসে থাকে ইস্পাতের কাঠামোয় বন্দী হয়ে। এক রাত জ্যামে বসে কেটে গেলে তা এই শহরের মানুষের জন্য কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। মাশুক এই জ্যামকে ভীষণ মিস করতো অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানকার জ্যাম, তা বাংলাদেশের জন্য খালি রাস্তাই বলা যায়। নিয়ম-কানুনে বাঁধা ভিনদেশ আর নিজের দেশ,যেখানে যেন সমস্ত নিয়মই শিথিল। এভাবেই মানুষ এখানে মানিয়ে নিয়েছে।এই দেশে সবাই রাজা।

স্টিয়ারিংয়ে একহাত রেখে পিঠ এলিয়ে দিলো মাশুক, চোখ বুজলো। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের দীর্ঘ জ্যামে অবশেষে কিছুটা শান্তি মিলেছিলো। ঠিক তখনই কর্কশ শব্দে আবারো বাজলো ফোনটা। কে আবারো এই শান্তি ভঙ্গ করতে এলো?

-“হ্যালো…হ্যালো ডাক্তার…”

আত্মা কেঁপে উঠলো মাশুক এর।এটাতো ফরিদা বেগমের কন্ঠ।খতিব সাহেবের ফোন থেকে ফোন করেছেন।ঘড়ির কাটায় দশটা পঞ্চাশ বাজতে চলেছে।

-“জ্বি? জ্বি মিসেস সরোয়ার বলুন..কোনো সমস্যা?”

ফরিদা বেগম কান্নারত হয়ে বললেন,

-“আমাকে একটু সাহায্য করুন ডাক্তার…”

-“হয়েছে কি? আমাকে খুলে বলুন প্লিজ।”

ফরিদা বেগমের কান্না জোর বাড়লো।মাশুকের হৃদপিন্ড প্রবলবেগে উঠানামা করছে।ফরিদা বেগম কাতর অনবরত বলতে শুরু করলেন,

-“ওনার…ফাহিমের বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছেন।আমার আশপাশে কেউ নেই।তাকে হাসপাতালে নিতে হবে।আমি কাউকে পাচ্ছি না ডাক্তার।আমাকে সাহায্য করুন দয়া করে।”

মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।চিন্তা হেমার জন্য হচ্ছিলো সেখানে খতিব সাহেব।ফেরার পথে তাকে অসুস্থ দেখেছে। তখনই বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথায়।তাই হলো।মাশুক বললো,

-“ওনাকে ঠান্ডা পরিবেশে রাখুন।কোনো পানি অথবা খাবার দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।ঠিকঠাক শ্বাস চলছে কিনা চেক করুন আমি আসছি।”

সামনের জ্যাম রাত বারোটার আগে ছুটবে না।মাশুক একেবারে মাঝামাঝি এসে আটকে গেছে। স্ট্যারিংয়ে হাত দিয়ে আঘাত করলো।ফরিদা বেগমকে আশ্বাস দিয়েছে।কিন্তু পৌঁছাতে পারবে?দ্রুত ফোন হাতে নেয়। শান্তনুকে কল করে বলে,

-“শান্ত তোকে একটা এড্রেস দিচ্ছি।দ্রুত সেখানে যা ইমার্জেন্সী পেশেন্ট।আমাদের হাসপাতালে আনবি।মুভ!ফাস্ট!”

শান্তনুও বিচলিত হয়ে পড়লো।বললো,

-“এড্রেস পাঠা।আমি যাচ্ছি।”

শান্তনুকে এড্রেস পাঠিয়ে হাসপাতালে কল করে মাশুক।তাদের ইমার্জেন্সী পেশেন্ট এর জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে খতিব সাহেবের নাম এবং সমস্ত তথ্য দিলো।হর্ন চাপলো অনবরত।কিছুক্ষন আগে এই জ্যাম নস্টালজিক অনুভূতি দিচ্ছিলো।এখন শ্বাস রোধ করছে।

_____

খতিব সাহেব স্ট্রোক করেছেন। শান্তনু দ্রুতই হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সবকিছু ঠিকঠাক হলেও অবস্থা বেশ সংকটজনক। মাশুকের মনে রাগ আর ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে।সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। রাত প্রায় পৌনে বারোটা। এখনো মাশুক হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি। হঠাৎ করেই তার মনে পড়লো হেমার কথা। সে কোথায়?ফোন মিলালো শান্তনুর নাম্বারে।বললো,

-“হ্যালো?… হ্যাঁ কি অবস্থা?”

-“অবস্থা ক্রিটিকাল।”

-“ডক্টর কিছু বলেছে?”

-“ওনারা এখনও স্পষ্ট কিছু জানায়নি।তুই কোথায়?”

মাশুক দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

-“জ্যাম! জ্যামে আটকে বসে আছি হাতের উপর হাত রেখে।”

-“চেষ্টা কর দ্রুত আসার।”

-“আচ্ছা শান্তনু ওনার সাথে কোনো মেয়ে আছে?নাকি শুধু ওনার স্ত্রী?”

-“শুধু ওনার স্ত্রী।আর একজন আত্মীয় এসেছেন।”

মাশুকের চিন্তা আরো বাড়লো।হুট করে বলে উঠলো,

-“হেমা নেই?সে কোথায় তাহলে?… শিট! ও তাহলে বাড়িতে একা।শান্ত প্লিজ ওইদিকটা সামলে নিস।আমার আসতে দেরি হবে।”

জ্যাম ছাড়লে মাশুক গাড়ি ঘুরায় হেমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।ঘেমে গেছে একেবারে।শার্টের বোতাম দুয়েকটা খুলে নিলো।মাথা দিয়ে রীতিমতো ধোঁয়া উঠছে।এসি ওন করার বিষয়টা আর মাথায় খেলেনি।

হেমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেখলো বিশাল তালা ঝোলানো।চমকে উঠলো মাশুক।হেমাকে কি আটকে রেখে যাওয়া হয়েছে? শান্তনুকে ফোন করে ফরিদা বেগমের কাছে ফোন দিতে বললো। শান্তনু ফরিদা বেগমের দিকে ফোন এগিয়ে দিলে সে কথা বলতে নাকচ করলেন। স্বামীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার অবস্থা নাজেহাল। মাশুক রেগে যায় সিঁড়ি কোঠায় দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বললো,

-“ওনাকে জিজ্ঞেস কর হেমা কোথায়?”

শান্তনু ফোন লাউড স্পিকারে দিলো।মাশুক পূনরায় প্রশ্ন করে,

-“মিসেস সরোয়ার আপনাদের বাড়ির এক্সট্রা চাবি নেই? কোথায় রেখেছেন?আমাকে দয়া করে বলুন?হেমা ঘরে আছে?”

ফরিদা বেগম কয়েক সেকেন্ড থম মেরে রইলেন।জবাব দিলেন না কোনো।শান্তনু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।বলে উঠলো,

-“বলুন? কোথায় রেখেছেন চাবি?”

ফরিদা বেগম শক্ত মুখে জবাব দিলেন, -“কার্পেট এর নিচে।”

নিচে বিছিয়ে রাখা কার্পেট তুলে চাবি পেলো মাশুক।ফোন কেটে দিয়েছে ইতিমধ্যে।দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।তন্ন তন্ন করতে শুরু করলো প্রতিটি ঘর।ঘরের আনাচে কানাচেতেও হেমা নেই।কপালে হাত পড়লো।এই রাতের বেলা কোথায় গেলো হেমা? দরজাতো বাহির থেকে বন্ধ।তাহলে?ঘরেই থাকার কথা।শেষ তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বেরিয়েছে মাশুক।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় মাশুকের।মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়লো।আবার ফোন করলো শান্তনুর নাম্বারে। শান্তনুকে কঠোর গলায় আদেশ ছুঁড়ে ফরিদা বেগমের কাছে যেনো ফোনটা দেয়। মাশুক ফরিদা বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তেজি গলায়,

-“হেমা কোথায় মিসেস সরোয়ার?”

-“আমি জানি না।”

গলার আওয়াজ বৃদ্ধি পায় মাশুকের।সমস্ত জেদ ঢেলে দিয়ে বললো,

-“আপনি জানেন মিসেস সরোয়ার!”

চলবে…