হিমাদ্রিণী পর্ব-০৯

0
2

#হিমাদ্রিণী – ৯
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

শান্তনু সত্যিই অদ্ভুত লোক।গতকাল মাশুককে চোরাবালিতে ফেলে পালিয়ে গেলো। অথচ এখন কেনো।তাকে দুইদিন জ্বালাবে বলছে? এই অদ্ভুত কথার রহস্য কিছুতেই মাশুকের মাথায় ঢুকলো না। তার উপর ফোনটাও ধরছে না। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে।এভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে?

ছুটির দিনেও মাশুকের মাথা যেন দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু হয়েছে।ঠিক তখনই, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো দরজার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে হালকা হাসি ফোটালো মাশুক। আরে, সত্যিই তো! দরজায় দাঁড়িয়ে হেমা।

হাত তুলে ইশারা করে ডাকলো মাশুক।হেমা গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ায়।মাশুক বললো,

-“বসো।”

হেমা চুপচাপ,ঠান্ডা।যেনো তার কোনো সমস্যাই নেই।মাশুকের দিকে তাকায় বিস্ময় নিয়ে।তার পরিবর্তিত পরিধেয় অন্যরকম লাগছে হেমার। আজ শার্ট পড়া নেই।টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে আছে মাশুক।চোখে চশমাটাও নেই।কেমন যেনো দেখাচ্ছে।মাশুক প্রশ্ন করলো,

-“কি দেখছো?”

-“উম.. তুমি আজ অন্য কাপড় কেনো পড়েছো?”

-“এটা আমার বাড়ির কাপড় হেমা।কেনো ভালো লাগছে না?”

সরল হেমা উত্তর দিলো সাদাসিধে, -“না তোমাকে ভালো লাগছে।চশমা পড়ো আরো অনেক অনেক ভালো লাগবে।”

হেমার আবদার মাটিতে পড়ার পূর্বেই চশমা তুলে নিলো মাশুক।চোখে পড়ে বললো,

-“এখন?”

-“সুন্দর লাগে তোমায়।”

মাশুক স্বল্প হাসলো।হেমার রুক্ষ মুখের দিকে চেয়ে বললো,

-“খারাপ লাগে এখানে থাকতে?কষ্ট হয়?”

হেমা মাথা নামায়।বিছানার চাদরে তর্জনী আঙুলের সাহায্যে অদৃশ্য অংকনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।মিনমিন করে বলে,

-“তুমি চলে যাও তখন ভালো লাগেনা।তারপর.. আমি ঘুমোতে পারিনা,শক্ত বালিশ।আমার মাথায় অনেক ব্যথা করে।”

-“তুমি এটা আমাকে আগে বলবেতো বোকা মেয়ে!আমি আজই নতুন বালিশ কিনে আনবো।আর কিছু লাগবে?”

বাচ্চাদের মত আবদার করে বললো, – “হুম! আরেকটা কোলবালিশ লাগবে।”

মাশুক কপালে তর্জনী আঙ্গুল চেপে হেসে ফেললো।অদ্ভুত সুন্দর আবদার।বাচ্চাদের মত সুর।তবে সবটাই সুন্দর। আগলে নেওয়ার ইচ্ছে আরো প্রবল করে।মাশুক বললো,

-“আমরা আজই যাবো সব কিনতে কেমন?”

-“ওকে।”

মাশুকের নজর গেলো হেমার চুলের দিকে।এলোমেলো নাজেহাল অবস্থা।একেবারে রুক্ষ।মাশুক উঠে দাঁড়ালো। হেমাকে রেখে বাহিরে গিয়ে তেল নিয়ে এসে বললো,

-“ঐযে সামনে দেখতে পাচ্ছো?সে আমার মা।তার কাছে এই তেল নিয়ে গিয়ে বলো,যেনো তোমার চুলে তেল দিয়ে দেয়।”

-“না না। উনি আমাকে বকে দিবে। চাচীটা আমাকে বকে দিতো।উনিও বকে দিবে।”

মাশুকের মনক্ষুন্ন হলো।চাচীর কথা শুনে তারও ভালো লাগছে না।মাশুক হেমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,

-“উনি তোমার চাচী না।তোমার নতুন মা। যাও,কিচ্ছু বলবে না।”

মাশুকের প্রতিটি বাক্য যেন হেমার মনে শিকড় গেঁথে ফেলেছে। তার মুখ থেকে যা বের হয়, সেটিই যেন নিয়তি। হেমা সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে গেছে মাশুকের ইশারায়। যেন পুতুল হয়ে, তার হাতের পুতুল। মাশুক যা বলবে, হেমা তা মেনে নিতেই বাধ্য। ধীর পায়ে মাশুকের আদেশে এগিয়ে গেলো শান্তা বেগমের দিকে। চোখে অনুরাগ আর মুখে শিশুসুলভ আবদার, হেমা বললো,

-“আমার চুলে তেল দিয়ে দাও। মাশরুম বলেছে তুমি আমার নতুন মা।”

শান্তা বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন এমন কথায়।যেন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন।ছেলের নামের বিকৃতিতে হাসি আসছে।নতুন মা কথাটি শুনে মমতার প্রতিফলন ঘটলো।হাতের কাজ রেখে বললেন,

-“এসো”

হেমা এগিয়ে আসে।জানতে চায়,

-“কোথায় বসবো?”

শান্তা বেগম বুঝতে পারলেন না কি বলবেন?ওকে কি নিচে বসতে বলা উচিত হবে?যদি নিচে না বসে তাহলে তেল দিবেন কি করে?দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মাশুক এসে হাজির হয়।বলে,

-“নিচে বসো মায়ের কাছে।তাহলে তেল দিতে ইজি হবে।বুঝেছো?”

হেমা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো জায়গা। বললো,

-“এখানে?”

-“হ্যাঁ”

হেমা ঠিকঠাক জায়গায় পা ভাঁজ করে বসে পড়ে। শান্তা বেগম কিছুটা ইতস্তত বোধ করেই চুলে হাত ছোঁয়ালেন। মাশুকও বসলো তাদেরই সামনে।ভাবলো আনমনে।হেমার মত তারও পরিবারের কাছাকাছি আসতে হবে।ভিনদেশের তিক্ততা তাকে আপন মানুষগুলো থেকেও দূরে সরিয়ে নিয়েছে।কেমন যেনো খাপছাড়া হয়েছে সম্পর্ক।

হেমা বাধ্য মেয়ের মত বসে।মাশুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“কেউ বাবা মায়ের আদর পেতে কাতর,আর কেউ পেয়েও মূল্য দেয়নি।দুঃখ প্রকাশ করার মুখটাও নেই তার।”

হেমা এবং শান্তা বেগম দুজনেই তাকালেন মাশুকের দিকে। শান্তা বেগম বললেন,

-“তোকে তোর মত ছেড়েছি।তাই বলে ছন্নছাড়া হয়ে যাবি?”

-“ভীষণ বাজে সময় পাড় করেছি আমি।ভালো ভবিষ্যতের আশায় বিভীষিকায় গিয়ে পড়েছিলাম। দম বন্ধ লাগতো।নিজের দেশে ঘরে,বাহিরে আপনজন।আর সেখানে?শুধু হাহাকার।”

শান্তা বেগম হেমার চুলের দিকে মনোযোগী হলেন।ছেলের অবস্থাও বুঝেন তিনি।এতটা বছর সেখানে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।ভালো দিন,খারাপ দিন, অসুস্থতায় কাউকে পাশে পায়নি।তিনি বললেন,

-“ফিরে এসেও আমাদের আপন করে নিস নি।”

-“ভুল করেছি মা, একাকীত্বকেই চিরন্তন সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম।”

শান্তা বেগম মাথা দুলিয়ে বললেন, – “হুম”

হেমা দুজনের কথা শুনছে।জবাব দিচ্ছে না,কারণ সে কিছুই বুঝতে পারছে না।মাশুক বললো,

-“হেমাকে দেখে নিজেকে শুধরাতে চাইছি।”

-“হারানোর ভয় ঢুকেছে মনে হয়?”

-“এসব কথা বলবে না, মা।ভালো লাগেনা।তুমি হেমার প্রতি মনোযোগী হও।আমার চেয়ে বেশি ওর তোমাকে আর বাবাকে প্রয়োজন।”

হঠাৎ করেই হেমা মাথা নুয়ে শান্তা বেগমের কোলে শুয়ে পড়লো। শান্তা বেগম চমকে উঠলেন।এক মুহূর্তের জন্য যেন বুঝতেই পারলেন না কী ঘটলো। মাশুকও সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠিত হয়ে এগিয়ে এলো। ভয় তাকে সবসময় তাড়া করে।আবার কিছু হলো নাতো?

মাশুক হেমার মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকলো। দেখে বুঝতে পারলো, মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্তা বেগমের হাতের কোমল তেল মালিশে আরামের জোয়ারে হারিয়ে গিয়ে তার চোখ লেগে এসেছে।

শান্তা বেগম এবার ছেলের দিকে চাইলেন।তার দৃষ্টিতে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মাশুকের চোখে তখনো উদ্বেগ।কিন্তু সঙ্গে একধরনের শান্ত স্বস্তিও।

______

-“আরেহ! আরেহ! কি আশ্চর্য? আমার কলার চেপে আছিস কেনো?”

ছেলেমানুষী ফিরে এসেছে দুই বন্ধুর মাঝে, যেন পুরনো দিনের মতোই। মাশুকের মাথায় রাগ চেপে আছে।রাগের বশে ধানমন্ডি লেকে দাঁড়িয়ে শান্তনুর কলার চেপে ধরেছে।দীর্ঘ ত্রিশ ঘণ্টা পর শান্তনুর দেখা মিলেছে। দেখা মাত্রই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো শান্তনুর ওপর, যেন সব ক্ষোভ মিটিয়ে দিতে চায়। শান্তনু হাসতে হাসতে সরে যাচ্ছে, বলছে,

-“শালা, তোর সাহস তো কম না! ইন্সপেক্টর শান্তনু মজুমদারের গায়ে হাত দিচ্ছিস? এখনই হাজতে নিয়ে যাবো, কিন্তু!”

তার হাসির মাঝেও বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন।আর মাশুকের রাগও যেন সেই হাসির তালে আরও জ্বলে উঠছে। বলে উঠলো,

-“শাট আপ শান্ত! কি লুকাচ্ছিস এক্ষুনি বলবি।নাহয় তোকে আমি লেকের পানিতে ডুবিয়ে মা রবো”

-“আরেহ ডক্টর সাইকো রিল্যাক্স! এতো অধৈর্য হচ্ছেন কেনো?”

হেমা একরাশ বিস্ময় নিয়ে এই দুজনকে দেখছে।মাশুক তাকে শিখিয়েছে কাউকে আঘাত করা উচিত না।অথচ নিজেই ভুলে গেলো?আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে জ্ঞানী ভাবভঙ্গিতে বলে উঠলো,

-“এই তোমরা এত বড় হয়ে মা রা মা রি করছো কেনো?”

শান্তনু আরো সুযোগ পায়।সেই সুযোগের যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করে বলে উঠলো,

-“দেখেছো হেমা মালিনী?তোমার মাশরুম আমাকে মারছে।”

হেমা খানিক রাগান্বিত হয়ে মাশুকের দিকে তাকায় এবং বলে,

-“ওকে মারছো কেনো?হুম?”

মাশুক পকেট থেকে টিস্যু বের করলো,কিন্তু হেমার কথার জবাব দিলো না।আলতো হাতে ঠোঁটের আশপাশে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিয়ে ফিরে আসে শান্তনুর দিকে।হাত টেনে একটু দূরে নিয়ে এসে বললো,

-“কি লুকাচ্ছিস দ্রুত বল!”

-“মাত্র ত্রিশ ঘন্টা হয়েছে ব্রো আরো আঠারো ঘন্টা পর জানাবো।”

মাশুক তেজি গলায় বলে,- “ভালো হচ্ছেনা কিন্তু!”

শান্তনু ছোট ছোট তেরছা চোখে তাকিয়ে বলে,

-“এতটা পাগল হয়েছিস হেমার জন্য?”

-“হয়েছি!”

-“আহারে! কেনো হয়েছিস?”

মাশুকের মনে যেন এক অগ্নিকুণ্ড দাউদাউ করে জ্বলছে। শব্দগুলো তার ঠোঁটের কিনারে এসে আছে, সে আর আটকাতে পারছে না। তার চোখ-মুখে ফুটে ওঠা তেজে স্পষ্ট। ভেতরের উত্তাল ঝড় তাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।হৃদয়ের গভীর উতলা ঢেউ তাকে অধৈর্য্য করে তুলছে। দ্বিধা বাদ দিয়ে বলতে লাগলো,

-“ওর আমাকে নয়,আমার ওকে প্রয়োজন।হিসেবটা অল্পদিনে ঘুরে গেছে।বেনামী, বৈধতাহীন সম্পর্কে আমি ওর যত্ন নিতে পারি না,ওর চোখে চোখ রাখতে পারিনা,ওকে আমার কাছে রাখতে পারিনা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে বৈধতা ছাড়া আমি ওর সঠিক চিকিৎসাটুকু করতে পারবো না।সেখানে হাজারখানেক বাঁধা।ওকে বোঝাতে পারছি না বিয়ে কি!বুঝলেও আমায় মেনে নিবে কিনা,সে আরেক ভয়।সব মিলিয়ে আমি গতকাল অনেক সময় মেডিটেশন করেছি।আমারই এখন মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।বুঝতে পারছিস তুই?”

মাশুকের কথাবার্তা শুনে মনে হলো,সে একেবারেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। শান্তনু কিছুসময় একঘেয়ে বন্ধুটির দিকে চেয়ে দেখলো।এত কথা কোনো কালেই বলেনি।আজ বলেছে।সিদ্ধান্ত নিলো তাকে আর জ্বালানো উচিত হবেনা।পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে দিলো তার হাতে।মাশুক আশ্চর্য হয়ে বললো,

-“এটা কি?”

-“পড়ে দেখ,আর আমাকে মাফ কর।”

সাদা কাগজটিতে কিছু লিখা।মাশুক চশমা ঠিক করে পড়তে শুরু করলো,

-“ডাক্তার মাশুক,জানি না আপনি এই লিখাটুকু কখনো পড়তে পারবেন কিনা? চারিদিকের পরিবেশ বিবেচনা করলে না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।কিন্তু আমি লিখছি,জানি না বেঁচে থাকবো কিনা। প্রচন্ড খারাপ আমার শরীর।জীবনের শেষ মুহূর্তে ভুলগুলো আমাকে শেষ করছে।যদি মরে যাই আমার হেমাকে দেখে রাখবেন।আমার হেমাকে আশ্রয় দেবেন।দোহায় লাগে আপনার।আমি আপনার চোখে হেমার জন্য মায়া দেখেছি।আমি অল্পদিনে বুঝেছি ওকে আপনি ছাড়া কেউ ভালো রাখতে পারবে না।আমি আমার ভাই ভাবীর আমানত সামলে রাখতে পারিনি।আমি যদি কখনও মরে যাই?আর আপনি এই লেখাগুলো পড়েন আমার আমানত আপনাকে দিলাম।লজ্জা লাগছে তবুও বলি আমি চেয়েছি আপনি হেমাকে বিয়ে করেন,কিন্তু একটা পাগল মেয়েকে বিয়ে করে কোন সুস্থ মানুষ নিজের জীবন নষ্ট করবে?তাই আপনার উপর ছেড়ে দিলাম।কিন্তু আপনার কাছে একটা আবদার করলাম ডাক্তার।আমার বাচ্চাটাকে অন্তত মাথার ছাদ দিয়েন।ওকে একটু ভালো রাখেন।সরাসরি কথাগুলো বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।সেসব লজ্জার কথা।….আর কিছু কথা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত।পরিবারের প্রেমে সেই কথাগুলো অব্যক্তই রেখে গেলাম।হাত জোড় করছি হেমাকে বাঁচান।আমার মনে হচ্ছে আমার সময় ফুরিয়ে আসছে।”

হাতের লিখাগুলো প্রচণ্ড এলোমেলো।হয়তো ভীষণ খারাপ অবস্থায় লিখেছেন।মাশুক স্তব্ধ হয়ে গেলো।জীবনে হুট করে এমন কিছু ঘটে যায় যা সুখ আর কষ্ট দুটো একসাথে নিয়ে আসে।ভাগ্য! ভাগ্যে বিশ্বাসী মাশুক।অন্তর যা চাইছিলো সেটির মঞ্জুরি নিজে হেঁটে এসেছে।কিন্তু তার ফলে যে খতিব সাহেবকে হারাতে হলো?

মাশুক শান্তনুর দিকে চাইলে সে বললো,

– “এর অর্থ খুবই সহজ।খতিব সাহেব নয় ওনার স্ত্রী আর স্ত্রীর ভাই হেমার বাবা মায়ের খুনের সাথে জড়িত।”

-“এখন?” মাশুক প্রশ্ন করলো।

শান্তনু বলে, – “এখন কি?তোমার জনেমানের আইসক্রিম শেষ পর্যায়ে।এবার চল তোদের বিয়ে করাই।”

মাশুক এলোমেলো ভাবে চোখের পলক ফেলে এরূপ কথায়।কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে,

-“তুই এটা কোথায় পেলি?”

-“সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম।তাদের বাড়ি সার্চ করেছি।ওনার ছেলের আর ছেলের মামার কুন্ডলি বের করতে মানুষ লাগিয়েছি।সেসব আমার হাতে ছেড়ে দে।কাজী ডাকবো?”

_____

বিয়ে সমাজের রীতি, ফুল সমতুল্য এক নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব নেওয়ার মহৎ দায়।একে অপরের হাত ধরে জীবন পাড়ি দেওয়া, নতুন পথে পা ফেলার প্রতিশ্রুতি। মাশুকের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও তার অন্তর গভীর এক আনন্দে টইটুম্বুর। মায়ের নীরব সম্মতি, বাবার চোখের সেই শান্ত-স্নেহময় আশ্বাস যেন তার আত্মাকে পূর্ণ করেছে। তিনি নিশ্চয়ই তার জীবনসঙ্গিনীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে মৃদুল ও রিমার মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। তাদের এই সিদ্ধান্তে কোনো আনন্দ নেই, বরং চাপা বিরক্তি।

মাশুক হেমাকে কিছুটা আলাদাভাবে প্রশ্ন করলো তারই ভাষায়,

-“তুমি আমাকে চাও সারাজীবনের জন্য?”

হেমা নির্বোধের মতো প্রশ্ন করে,- “তুমি আমার সাথে থাকবে না?”

-“থাকবো…তুমি চাও আমি থাকি?”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ চাই…”

-“আমাকে ভালো লাগে?পছন্দ হয়?”

হেমা ভীষণ আগ্রহী গলায় মাশুকের মুখ ছুঁয়ে বললো,

-“তুমি খুব সুন্দর..তোমাকে আমার ভালো লাগে”

মাশুক হুট করে হেমার হাতটা সরিয়ে দিলো।বললো,

-“এখন আমায় ছুঁতে পারবে না।”

হেমা হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে,- “কেনো?”

-“আমাকে স্পর্শ করতে হলে তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে।বিয়ে ছাড়া যদি তুমি আমায় স্পর্শ করো?হুটহাট জড়িয়ে ধরো সেটা একটা ব্যাড হ্যাবিট।বিয়ে অর্থ বুঝো হেমা?”

-“বুঝাও!” হেমা অদ্ভুত জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলো।

-“বিয়ে অর্থ হচ্ছে আমি সম্পূর্ণটা তোমার।তুমি চাইলে আমাকে ছুঁয়ে দিতে পারবে।বিয়ে করলে আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো।তোমাকে ছেড়ে যাবো না কখনো।তুমি আমার কাছে যেকোনো আবদার করতে পারবে।”

হেমা শুনলো।তার মন বলছে এটা সে চায়। মাশুককে সে চায়।অন্তর চিৎকার করতে শুরু করলো নীরবে।মাশুক বললো,

-“করবে বিয়ে?”

-“তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনাতো বিয়ে করলে?”

মাশুক হেমার সঙ্গে তার নরম কন্ঠ বজায় রেখে বললো,

-“কক্ষনো যাবো না।আমি তোমাকে কি বুঝিয়েছি?নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করতে শিখিয়েছি না?বলো তোমার মন কি চায়?আমাকে চায় নাকি একা থাকতে চায়?”

-“আমি তোমাকে চাই। প্লীজ আমাকে তোমার কাছে রাখো।নাহয় ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।আমার বাবা মাকে মেরেছে।ওরা আমার কাছেও আসতে চায়।আমাকে লুকাও তোমার কাছে। প্লীজ! প্লীজ!”

অনেক সময় পর শান্তা বেগমের মুখে এক টুকরো হাসির আভা ফুটে উঠলো।তবু কোথায় যেনো মনের গভীরে রয়ে গেছে একরাশ দ্বিধা। জহির সাহেবের চোখের নীরব আশ্বাসে সেই সংশয় কিছুটা হলেও লাঘব হয়। হেমার মুখে খুশির ঝিলিক।যদিও তার মস্তিষ্কের সীমিত ধারণক্ষমতা আছে, তবু সে মাশুককে চায়, সবসময়ই চায়। কাজী সাহেবের কবুলের সাথে সাথে সে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিলো সবার উদ্দেশ্যে।যেনো পুরোটা না বুঝলেও সে এই মুহূর্তে খুশি। শান্তনু নিঃশব্দে আইনি সব দিক সামলে নিয়ে তাদের নতুন পথচলাকে নির্ভার করে দিলো।কাজী সাহেব সংকোচে ছিলেন।এই বিয়ে কি জায়েজ হবে?কিন্তু হেমার অভিভাবকের সম্মতি এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় এখানে কোনো ভুল নেই।মাশুকের পালা এলে মাশুক গম্ভীর দৃঢ় সুরে বলে উঠলো,

-“শর্ত লিখুন কাজী সাহেব”

মাশুকের এমন কথায় উপস্থিত সকলেই বিস্মিত। বিয়ে করছে আবার কেমন শর্ত?কাজী সাহেব মাশুকের দিকে চেয়ে বললো,

-“জ্বি বলুন”

-“হেমার বর্তমান মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং তার চাচা খতিব সরোয়ারের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে আমি সজ্ঞানে হেমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছি। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব আজ থেকে আমার। তবে শর্ত এই যে, ভবিষ্যতে সে যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং আমার সাথে জীবন অতিবাহিত করতে না চায়, সে ক্ষেত্রে আমি তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য থাকবো। এই বিষয়ে আমি পূর্ণ সম্মতি প্রদান করলাম।”

মৃদুল তেঁতে উঠে।ছোট ভাইয়ের বাড়াবাড়ি নিতে পারছে না সে একেবারেই। চট করে তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,

-“তোর ঢং শুরু থেকে দেখছি…বিয়ে ছেলেখেলা নাকি? করলি আর ছাড়লি।”

মাশুক ভাইয়ের কথায় কান দিলো না।কাজী সাহেবকে বললো বিয়ের কার্যক্রম শুরু করতে।দ্রুততম সময়ে কবুল বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।সইটুকু করতে স্বল্প সময় নিয়েছে। হেমা মাশুকের দিকে চেয়ে বললো,

-“বিয়ে কি হয়ে গেছে?”

হেমা ঠোঁট চেপে হেসে তাকিয়ে আছে মাশুকের দিকে।সে উত্তরের অপেক্ষায়।মাশুক বললো,

-“হুম”

বিয়ের কার্যক্রম অতিরিক্ত সাদামাটা। শান্তা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলের দিকে এগিয়ে এলেন।আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-“তোর নিয়ত ভালো বলে বিরুদ্ধে যাইনি।কিন্তু আমার মায়ের মন।ছেলেকে খারাপ হালতে দেখতে পারবো না।সেদিকে খেয়াল রাখিস।ভালো থাক দুজনেই”

বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। রাতের খাওয়া শেষে শান্তনু বিদায় নিলো।আর হেমার জন্য নিয়োগ করা নার্সও তার দায়িত্ব শেষ করে হেমার কাপড়গুলো মাশুকের ঘরে গুছিয়ে রেখে চলে গেলো। আজ থেকে নার্সের নাইট ডিউটি নেই। হেমা খাওয়া দাওয়ার পর শরীরে এক অলসতা অনুভব করছে।যেনো ক্লান্তি তার সমস্ত সত্তায় ছেয়ে গেছে। সে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমের দিকে যেতে চাইলো। ঠিক তখনই, মাশুক তার হাত টেনে ধরে বললো,

-“কোথায় যাচ্ছো?”

তার হাতের উষ্ণতা হেমার মনোযোগ ফেরালো। মাশুকের চোখে গভীর দৃষ্টি।যেনো এক অজানা আহ্বান লুকিয়ে আছে। হেমা বুঝলো না।এগিয়ে এসে বললো,

-“আমার না ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।আমি ঘুমাই?”

মাশুক বলে,- “এসো আমার সাথে।”

হেমাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে মাশুক।হেমার লাগেজটা পাশে সরিয়ে রাখলো।হেমার বাহুতে দুহাত চেপে তাকে বসিয়ে দিয়ে বললো,

-“আজ থেকে এটা তোমার ঘর।”

হেমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,- “কিন্তু এখানেতো তুমি থাকো।তোমার ঘর আমি নিবো না। পরে তুমি আমাকে বকে দিবে।”

মাশুক হেসে জবাব দেয়,- “বকবো না।এটা এখন শুধু আমার না আমাদের ঘর।তুমি এখানেই থাকবে আমার সাথে।বিয়ে করেছি ভুলে গেছো?এখন থেকে প্রতি মুহূর্ত তুমি আমার সাথে থাকবে।”

হেমা এদিক ওদিক চোখ ফেরায়।মাশুকের ঘর চেয়ে চেয়ে দেখলো।ঠিক ওই ঘ্রাণটা আবারো আসছে।হেমার প্রিয় ঘ্রাণ।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে এই সুবাস নিজের মধ্যে ধারণ করে।মাশুক দরজা বন্ধ করে এসে হেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-“শুয়ে পড়ো।”

হেমা কোনো বাক্য ব্যয় না করেই কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে।মাশুক তার পাশে এসে বিছানায় পিঠ এলাতে চাইলেই হেমা লাফিয়ে উঠলো।বললো,

-“তুমি এখানে ঘুমোচ্ছো কেনো?”

মাশুক সোজা হয়ে বসলো। বিস্ময়ভূত দৃষ্টি হেমার দিকে। এ আবার কোন নতুন জ্বালা?মাশুক প্রশ্ন করে,

– “কোথায় ঘুমাবো?”

-“না না।আমি তোমার সাথে ঘুমোবো না।তুমি অন্য কোথাও যাও।ভালো লাগেনা।আমি একা ঘুমোবো বিছানায়।তুমি অন্য কোথাও যাও।”

মাশুক ভেবেছিলো হেমা হয়তো এই বিষয়টিকেও স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। অবুঝ হলেও একটি পুরুষের সঙ্গে একই সাথে থাকা হেমার কাছে অস্বস্তিকর। মেয়েটি কেমন যেনো অস্থির হয়ে উঠছে, চোখেমুখে তার ছাপ স্পষ্ট। মাশুক পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সে নরম স্বরে বললো,

-“আচ্ছা, তুমি বিছানায় ঘুমাও। আমি নিচে শুয়ে পড়ছি, কেমন?”

হেমা রাজি হয়।আরাম করে শুয়ে পড়ে।মাশুক বাধ্য হয়ে জমিনে শুয়ে পড়লো।ঠিক হেমার দিকে। বাতি নেভায় নি। হেমা অন্ধকারে ঘুমোতে পারেনা বলে।হাতের পিঠ কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুঝতেই হেমা উঁকি দিয়ে বললো,

-“তুমি কি ভয় পাচ্ছো একা?ভয় পেলে আমাকে ডাকবে কিন্তু।”

চলবে…