#হিমাদ্রিণী – ১৯
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
-“মানুষ যখন নিকৃষ্ট হওয়ার সকল সীমা পেরিয়ে যায়, তখন তাকে মানুষ বলে গণ্য করতেও বিবেকে বাঁধে। বিবেক চেনেন?…. চিনবেন কি করে? আপনাদেরতো নেই।”
মাশুকের অন্তরে তীব্র ক্ষোভের বহ্নি জ্বলে উঠেছে। ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ এক নিমেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়েছে তার ভেতর। মনোবল টিকিয়ে রাখতে যতই চেষ্টা করুক, অন্তর্দাহ তাকে গ্রাস করছে। ফরিদা বেগম আর জব্বার সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাশুকের মনে হচ্ছে তাদের নিজ হাতে খু ন করতে পারলে শান্তি মিলবে। হেমা, তার পরিবার, এমনকি খতিব সরোয়ার। প্রত্যেকেরই যেন তার জীবন নষ্টের পেছনে দায়ী এই দুইজন। মৃত্যুও যেনো তাদের জন্য স্বল্প শাস্তি।
-“ আমি এই মেয়েটাকে কি করে সামলাচ্ছি আপনারা জানেন না। আপনাদের মধ্যে কি একটুও মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট ছিলো না? ওর বাবা মা’কে খু ন করেছেন। ওকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে পারতেন!”
মাশুকের মাঝে চাপা যন্ত্রণা,কণ্ঠস্বরেই প্রকাশ পাচ্ছে সেটি। শব্দহীন সেই আর্তনাদ যেনো বুক চিরে ক্রোধের সুরে বেরিয়ে আসছে। শান্তনু বন্ধুর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলো।কী ভয়ঙ্কর পরিবর্তন! পরিচিত মুখটি আজ অদ্ভুতভাবে অপরিচিত। মাশুকের এমন বেদনা-বিধুর, ক্ষতবিক্ষত অবয়ব শান্তনুর চোখে বিধলো। লক আপ থেকে তাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
মাশুক বললো, -“নিয়ে এলি কেনো? আরো অনেককিছু বলার ছিলো। …. তারা হেমার যত্ন করলে হয়তো আজ ও আমার সামনে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো।…..আর যদি আমি ওর জীবনে না আসতাম? তাহলে? তাহলে কি হতো শান্তনু?”
শান্তনু গলা ঝাড়া দিয়ে বললো,
-“শান্ত হ মাশুক…. তুইও কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস?”
হাতের ব্যথাটা দৃঢ় হলো। নীল হয়ে আছে। বিগত দুইদিন যাবত পুরোপুরি অপরিচিত মানুষের মতো ব্যবহার করছে হেমা। আজ তার মুখটা অব্দি দেখায়নি কাজে আসার পূর্বে। জেদ এতোটা গাঢ় হয়েছিলো যে দেয়ালে আঘাত করে নিজের হাত। মাথা কাজ করছিলো না সেই সময়। শান্তনুর কথার জবাবে বললো,
-“হ্যাঁ পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমাকেও পাগল বানানো হচ্ছে। তিলে তিলে গড়া হেমার নতুন রূপ আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অনীহা দেখাচ্ছে আমার প্রতি।”
-“মানে?” অবাক স্বরে জানতে চাইলো শান্তনু।
মাশুক অস্থিরতায় টলোমলো হয়ে প্রত্যুত্তর দিলো,
-“মানে আর কি? কথায় আছে যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। হেমার চোখে আমি এখন অপরাধী। আমি তাকে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, বন্দী করে রেখেছি তাকে।”
-“ওর মাথায় এসব কে ঢুকালো?”
উপহাস করে হেসে মাশুক বলে উঠে,
-“ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমি জানি এসব রিমা ভাবির কাজ। সঠিক প্রমাণ পাচ্ছি না।”
-“এখন কি করবি?”
অনিশ্চিত চোখে এক পলক চাইলো মাশুক শান্তনুর দিকে। ডেস্কের উপর কনুই রেখে চুল টেনে ধরে। মাথা নামায় ক্লান্ত হয়ে। সারা মুখে ভাঁজ পড়েছে। মাথা নুইয়ে রেখেই মাশুক বলে,
-“ওকে নিয়ে কোথাও চলে যাই?… একা! আমাদের দুজনের কিছু সময় প্রয়োজন। যেখানে কুপরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না। আমি ওর সাথে চব্বিশ ঘন্টা থাকবো। সেই সময় অব্দি থাকতে চাই যতদিন না আমার অভ্যাসে ও জড়িয়ে যাচ্ছে।”
-“ কয়েকদিনের জন্য ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আয়।”
মাশুক মুখ তুলে বললো,
-“শান্তনু, হেমা এমন একটা স্টেজে আছে,যেখানে তার সুস্থ হওয়ার চান্স অনেক বেশি। এই সময়ে ওকে যে যেটা বোঝাবে ও সেটা মেনে নিয়েই চলবে।”
মাশুকের অবস্থা আজ ঝড়-বিক্ষুব্ধ অরণ্যের মতো এলোমেলো। নিখুঁত সাজানো ব্যক্তির মাঝে আজ অনিয়মের ছাপ, মুখ লালচে রঙে অগ্নি-জ্বালার প্রকাশ করছে। অবিন্যস্ত দাড়িগুলো গালে লেপ্টে,আর চুলগুলো শোকার্তের মতো নুয়ে পড়েছে। যেন শব্দহীনভাবে হাঁপাচ্ছে যেনো।
শান্তনু স্মিত হেসে প্রশ্ন করে, -“খুব ভালোবাসিস হেমাকে তাই না?”
মাশুক পলকহীন হয়ে গেলো। শূন্যে জ্বলজ্বল করা নেত্রদ্বয়ের দৃষ্টি রেখে বললো,
-“বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি সম্পূর্ণটাই ওর মাঝে জড়িয়ে গেছি। আমি জানি না আমি কেনো এত ডেসপারেট ওর প্রতি।সেসব কারণ অজানাই থাকুক।আমি জানতে চাই না। কিন্তু শেষ অবধি, আমি হেমাকেই চাই।যে কোনোভাবে, যে কোনো মূল্যে।”
বাড়ি ফিরে কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছ হলো না।হেমা তো এমনিতেও কথা বলছে না, বিগত দু’দিন ধরে একটাও শব্দ শোনেনি তার কাছ থেকে। নিস্তব্ধ ঘরে এসে চুপচাপ বসে পড়লো মাশুক। হাতের ব্যথা যেন জেদের বিষের মতো পুরো হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। শার্টটা খুলে বিরক্তি নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। চারপাশের পরিপাটি ঘরটা দেখে মন বিষিয়ে উঠলো।হেমা থাকলে ঘরটা একটু এলোমেলোই থাকতো সে তো থেকেও নেই, দিনভর শুধু মায়ের ঘরেই পড়ে থাকে।
ফ্রেশ হওয়ার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। হেঁটে গিয়ে আলমারির উপর থেকে লাগেজ নামায়। হেমার কাপড় আর নিজের কাপড় এলোমেলোভাবেই লাগেজে রেখে বন্ধ করে দেয়। পরপরই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। এক পা ঝুলছে কিছুটা বিছানার বাহিরে।
শান্তা বেগম হেমার চুলে তেল দিয়ে বিনুনী করে দিলেন। তার কানের কাছে এসে বললেন,
-“ তোমার বর এসেছে ঘরে। যাও, জিজ্ঞেস করে এসো কিছু লাগবে কিনা?”
হেমা কেমন যেনো কেঁপে উঠলো। গুটিয়ে বসলো নিজেকে,নীরবে। অস্থির অনুভব করছে সে। বিগত দিনগুলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাশুকের আসা এবং যাওয়া দেখেছে। কথা বলেনি কোনো।
মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দিলো, – “যাবো না”
-“ কেনো যাবেনা?”
-“ মাশুক আমাকে আটকে রেখেছে।”
-“ কে বলেছে তোমাকে এই কথা?”
-“ওর বড় ভাবি।”
শান্তা বেগমের রাগ হলো। কিসব শেখাচ্ছে এই মেয়েকে? শান্তি নেই সংসারটায়। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন তিনিও রিমার কর্মকাণ্ডে। তিনি হেমাকে বুঝানোর সুরে বললেন,
-“মিথ্যে বলেছে ওর বড় ভাবি। মাশুক তোমাকে কত যত্ন করে দেখো না? তুমি যা চাও তোমাকে এনে দেয়,তোমাকে ভালোবাসে। ভাবি তোমাকে ভালোবাসে?”
হেমা মাথা দোলায়।বলে, -“না! আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। আমাকে সে পছন্দ করেনা। পাগল বলে”
-“আর মাশুক কি বলে?”
-“ মাশুক আমাকে পাগল বলে না।”
-“এবার বলো তো কে তোমাকে বেশি ভালোবাসে মাশুক নাকি ওর ভাবি?”
হেমা কিছুক্ষণ থেমে ভাবনার জন্য সময় নিলো। তার মনও যে ভালো নেই, অস্থিরতায় দোলাচল করছে। সেও চায় মাশুকের কাছে যেতে, কিন্তু মন যেন এক অদৃশ্য বাঁধায় আটকে গেছে। দ্বিধাগ্রস্ত হেমা কিছুতেই সহজ হতে পারছে না। শান্তা বেগমের হঠাৎ করা প্রশ্নে হেমা যেন একটু সহজ হলো। মুখ ফিরিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
-“মাশুক।”
শান্তা বেগম হেসে বললেন, – “হ্যাঁ মাশুক। ও তোমাকে আটকে রাখেনি হেমা। মাশুক তোমাকে সব খারাপ মানুষের কাছ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর তুমিই ওর সাথে কথা বলছো না?”
-“আমি কি কথা বলবো?” দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো।
-“হ্যাঁ বলবে। ওর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। তুমি জানো, মাশুক কত কষ্ট পাচ্ছে? তুমি ওর সাথে কথা বলছো না তাই ওর মন খারাপ।”
-“মন খারাপ?”
-“হ্যাঁ মন খারাপ। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। মাশুককে ভুল বুঝবে না কোনোদিন। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসবে, যত্ন করবে। তুমি একমাত্র ওর কথা শুনবে। আর কেউ বাজে কথা বললে ওদের কথায় কান দিবে না। ওরা ভালো না।”
শান্তা বেগমকে জানানো হয়েছিল, হেমার মানসিক স্বাস্থ্য এমন এক সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে যা কিছুই নতুন করে শেখানো বা বোঝানো হবে, সেটিই সে সহজে আত্মস্থ করে নেবে।
শান্তা বেগমের কথাগুলো শুনে হেমার হৃদয় হুহু করে উঠলো। দীর্ঘশ্বাসের ভারে ভারাক্রান্ত অন্তর নিয়ে, দিকবিদিক ভুলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তীব্র তাড়নায় যেন বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।
ঠোঁট কামড়ে এসে দাঁড়ায় ঘরের কাছে। নিঃশব্দ ঘর,একেবারে নীরব তমাসাবৃত। হেমা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। অল্প আলোয় চোখ ছোট ছোট করে দেখবার চেষ্টা করছে। হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে পায়। একটার পর একটা সুইচ টিপে আলো জ্বালাতে সক্ষম। ডান দিকে চেয়ে দেখলো উদোম গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাশুক। হেমার আকস্মিক কান্না পাচ্ছে। ধীরস্থির গতিতে মাশুকের পাশে গিয়ে বসে। সাহস করে উন্মুক্ত পিঠে হাত রেখে নিচু গলায় বললো,
-“মাশুক তুমি ঘুমোচ্ছো?”
জবাব এলো না। হেমা ঘাড় উঁচু করে দেখলো মাশুকের অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা মুখটা। চোখ বন্ধ। হেমা আবার বললো,
-“আমি এসেছি… তুমি কি শুনছো?”
পিঠে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করছিলো মাশুক। দ্বিতীয়দফা প্রশ্নের জবাবে ভারী গলায় ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-“হুম”
-“এইতো তুমি জেগে আছো। আমার দিকে তাকাও,আমি তোমাকে সরি বলবো।”
মাশুক সামান্য মাথা উঁচু করে বললো,
-“তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তৈরি হয়ে নাও,আমরা একটু পর বের হবো।”
হেমা আশ্চর্য হয়ে জানতে চায়, -“কোথায় যাবো আমরা?”
-“যেখানে সুখ মিলবে, আমাদের মাঝে তৃতীয় কেউ থাকবে না সেখানেই যাবো।”
______
গাড়ি চলছে,ভিতরের পরিবেশ নীরব। হেমাকে নিয়ে মাশুক আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ঝুঁকি নেয়নি। বহু বছর পর গ্রামের পথে পা বাড়িয়েছে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে একান্ত নির্জনতায়। গন্তব্য সেই ছোট্ট একতলা বাড়ি। যেখানে আজ আর কেউ স্থায়ীভাবে বাস করে না। চারপাশে পরিচিত কয়েকজন প্রতিবেশী ছাড়া তেমন কিছুই নেই। চাচা-ফুপুরা মাঝে মাঝে এসে থাকেন, মাশুকের বাবা-মাও আসে স্মৃতির প্রায়শই। জীবনের অনেক বাঁক বদলের পরও, এ বাড়ি যেন তাদের অতীতের সেই স্নিগ্ধ ছোঁয়া নিয়ে সবটুকু বেদনা-সুখ মেলে ধরে অপেক্ষা করে।
নিস্তব্ধ গাড়িতে পুরুষালি কন্ঠ ঝংকার তুলে,
-“গম্ভীরতার আড়ালে শখগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। মনের কোণে ইচ্ছেদের পুষে রেখেছিলাম। প্রিয়তমাকে নিয়ে রাতের নির্জনতায় শহরের কোলাহল পাড়ি দিবো। পূরণ হচ্ছে, তবে প্রিয়তমার বুঝবার জ্ঞান নেই।”
হেমা তাকালো মাশুকের দিকে। অন্ধকারে মুখটা অস্পষ্ট নয়। চোখে স্বচ্ছ চশমা, হাত একটা স্ট্যারিংয়ে রেখে সামনের দিকে চেয়ে আছে মাশুক। হেমার অকস্মাৎ ভীষণ ভালো লেগে গেলো মাশুকের এই স্থির চিত্র। ইচ্ছে হলো ভালোবাসা দিতে,কিন্তু পারলো না। এতটুকু বোধগম্য হয়েছে তার, মাশুক রেগে আছে। হেমা বললো,
-“আমাকে প্রিয়তমা বলছো?”
-“আর কাকে বলবো?”
-“আমি বুঝি তো!”
-“উহু! বুঝো না।”
হেমার মনে নতুন এক অনুভূতি। মাশুকের এই গাম্ভীর্য তার সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই। অনুশোচনার ঢেউ মনের মধ্যে একের পর এক আছড়ে পড়ছে।সে জানে, মাশুককে কষ্ট দিয়েছে সে। কিন্তু সমাধান কি? সেটাই তো ভেবে পেলো না। ভাবনার ভার যখন আরও গভীর, ঠিক তখনই পেটের ক্ষুধা টের পেয়ে তলপেটে চাপ দিয়ে বসে। মাশুকের চোখে সেটা ধরা পড়তেই আড়চোখে হেসে উঠলো। এক হাতে ব্যাগ পেছন থেকে এনে সামনে ধরে বললো,
-“খাবার আছে, চামচও আছে সাথে। খেয়ে নাও।”
হেমা এক গাল হাসে। তার সবকিছুতে তাড়াহুড়ো। মাশুকের রাগ ভাঙাতেও তাড়াহুড়ো। খাবার বের করছে তরতর করে। বের করে এক চামচ ফ্রায়েড রাইস মুখে দেওয়ার পূর্বেই মাশুকের দিকে তাকায়। নিজের খাবারটুকু মাশুকের মুখের সামনে ধরলো। মাশুক এক পলক তাকায়। না খেয়েই নির্লিপ্ত গাড়ি চালাতে থাকে। হেমা ধমকের সুরে বললো,
-“খাবারগুলো পড়ে যাবে কিন্তু! খাচ্ছো না কেনো?”
-“ক্ষিদে নেই”
-“ আছে! তুমি খাবে,খেতে হবে!”
খাবারগুলো পড়ে যাওয়ার চান্স আছে। মাশুক বিনাবাক্যে খেয়ে নিলো এবার। হেমা বললো,
-“গুড বয়! এবার এক চামচ আমি খাবো। তারপর তোমাকে দিবো কিন্তু আবার।”
না চাইতেও হেসে ফেললো মাশুক। হেমার নজরে পড়ার পূর্বেই হাসির রেখে বিলুপ্ত করে ঠোঁট থেকে। মুখে আগেকার গাম্ভীর্য টেনে নেয়। হেমা তীক্ষ্ণ চোখে দেখলো। ইচ্ছে হলো কামড় বসিয়ে দিতে রাগে। কিন্তু দিলো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে যেনো। করতে শিখছে ধীরেধীরে।
মাশুক আসার আগে কেয়ারটেকার চাচাকে বলে রেখেছিল যেন বাড়িটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখেন। তিনি নিখুঁতভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। হেমা আর মাশুক বাড়ির ভেতর ঢুকতেই হঠাৎ অদ্ভুত এক গুঞ্জনধ্বনি কানে এলো। মাশুক অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করলো না।কিন্তু হেমা থমকে গেলো গুটুর গুটুর সেই সুরে। আওয়াজটা ধীরে ধীরে সরে গেলো ডানদিকে। যেখানে রাতের বেলা মুরগিগুলো রাখা হয়েছে। যেনো ছোট্ট শিশুর মতো আগ্রহে হেমা ওদিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসল। যেই দরজা খুলতে যাবে তার আগেই মাশুক তার হাত ধরে আটকায়। বলে,
-“এখন ঘরে চলো। কাল দেখবে”
হেমা জেদ করেনি। বাধ্য মেয়ের মত এক দৃষ্টি মুরগিগুলোকে দেখে মাশুকের সাথে হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে বললো,
-“ তুমি রেগে আছো বলে জেদ করলাম না। আমার কিন্তু অনেক ইচ্ছে করছিলো ওদের দেখতে।”
-“ কার শেখানো এসব?”
হেমা দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে,
-“ নতুন মা শিখিয়ে পাঠিয়েছে। আমি তোমার কথা শুনবো। তোমার সাথেই থাকবো। সবসময়,সারাজীবন।”
পুরোনো আলমারিতে সারি সারি বই।যা এককালে মাশুকের দাদাজান পড়তেন। সেসব বইয়ের দিকে এক গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে হেমা।বইগুলোকে ধরে ধরে দেখতে লাগল সে। রাতের খাবার তারা সেরে এসেছে গাড়িতেই।হেমা নিজ হাতে মাশুককে খাইয়ে দিয়েছিলো।এখানে এসে মাশুক ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়লেও চোখ তার হেমার ওপর নিবদ্ধ।হেমার সেই একাগ্রতা,বইয়ের প্রতি এই নতুন আগ্রহে মাশুক তাকিয়ে আছে চুপচাপ।
হেমাকে ঘুরে তাকাতে দেখেই চোখ বুজে ফেলে মাশুক। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ঘুমের ভান ধরে কতক্ষণ থাকতে পারবে কে জানে? ইতিমধ্যে বিছানায় চড়ে বসেছে হেমা। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটানো তার জন্য নতুন কিছু নয়। ছোট চিরুনি হাতে নিয়ে মাশুকের চুলে গেঁথে দিলো। পরপর দাড়িতে। সুন্দর করে হাত এবং চিরুনির সাহায্যে সেট করেছে। মাশুক চোখ খুলে তাকায়। বলে,
-“আমাকে সাজাচ্ছো কি আরেকটা বিয়ে দেওয়ার জন্য?”
হুট করে এমন কথায় হেমার কপালে তিন তিনটে ভাঁজ পড়ে। বলে উঠে,
-“তুমিতো আমাকে বিয়ে করেছো”
-“ওহ! মনে আছে তোমার?… সেসব পুরোনো কথা,এখন আরেকটা বিয়ে করবো। তোমাকে তো আমি আটকে রেখেছি। মুক্তি দিয়ে দিবো। তুমি চলে যেও তোমার বাবা মায়ের কাছে।”
হেমা মাশুকের হাত খামচে ধরে। নখ দাবিয়ে দিচ্ছে বলিষ্ঠ হাতে। মাশুক সেখানে তোয়াক্কা করলো না। বললো,
-“ ভালো হবে তাই না, হেমা? তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওকে ভালোবাসবো, আদর করবো। আচ্ছা হেমা? ভাবির বোনকে বিয়ে করলে কেমন হয়? ঐযে অসভ্য,পঁচা মেয়েটা। যাকে তুমি একদম সহ্য করতে পারো না।”
আরো শক্ত করে নখ দাবিয়ে দিচ্ছে মাশুকের হাতে। চোখে মুখে অগ্নিঝরা ক্রোধ। চোখজোড়া বিস্ফোরিত।বারংবার নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো হেমা। বললো,
-“আমি দিবো না! বিয়ে করতে দিবো না।”
মাশুকের দৃষ্টি শীতল হয়। গভীর নয়নে চায় হেমার দিকে। হাত আপনাআপনি এগিয়ে গেলো। কোমর টেনে বুকের কাছে টেনে এনে বললো,
-“তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। আমার কাছে থাকতে চাও না। আমাকে কষ্ট দিয়েছো। তাহলে কেনো থাকবো তোমার কাছে বলো?”
হেমা দিশেহারার ন্যায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। বলে,
-“বাসি..”
-“ প্রমান দাও”
-“কিভাবে দিবো?”
-“ প্রমিস মি, আর কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না। আমার কাছ থেকে এক মুহুর্ত দূরে থাকবে না।”
হেমা চটপট বলে উঠলো,
-“ থাকবো না দূরে।”
মাদকতায় আচ্ছন্ন মাশুকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হেমার মুখাবয়বে। যেনো মগ্নমোহে হারাতে চলেছে। হালকা বেসামাল হাতটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আলতোভাবে হেমার থুতনি চেপে ধরে, মৃদু মাথা তুলে অধর ছুঁয়ে দেয়। গভীর শ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“হিমাদ্রিণী, তোমার প্রতিটি তপ্ত নিঃশ্বাস আমাকে বধ করছে। তোমার অবুঝ স্পর্শ আমার সর্বস্ব অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে। নিজেকে আটকে রেখেছি, সামলে রেখেছি। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নেই, তুমি বুঝবে আর আমি বুঝবার দায়িত্ব থেকে সরে আসবো।”
চলবে….