হিমাদ্রিণী পর্ব-২২

0
1

#হিমাদ্রিণী – ২২
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

দীর্ঘসময় ধরে হেমাকে ট্রমা-ফোকাসড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (TF-CBT) দেওয়া হচ্ছিলো। মাশুক পূর্বে কিছুটা চিন্তিত হলেই এক পর্যায়ে এসে সে সাহস যুগিয়ে হেমার সামনে তার বাবা মায়ের মৃত্যুর করুণ সত্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। ইনট্রুসিভ মেমোরির ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত এবং বারবার ফিরে আসার পরও হেমা নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখার সক্ষমতা মাশুকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বহু আগেই।মাশুক হস্তক্ষেপ করেনি। তাকে তার মতো করে লড়াই করতে দিয়েছে। হেমা ট্রমা প্রোসেসিং খুব ভালোভাবেই আয়ত্ত করে নিয়েছে। আজকের স্বপ্নে ফ্ল্যাশব্যাক হেমার মস্তিষ্কে শকের মত কাজ করেছে। নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখার ফলে মানসিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষণ।

থানায় বসে মাশুক এর মস্তিষ্কেও ফ্ল্যাশব্যাক হলো। ভুল কোনো চিকিৎসা তাকে দেওয়া হয়নি। যা দেওয়া হয়েছে সবটাই সঠিক। তাহলে কি, হেমা আর তার রইলো না। নব্বই ভাগ সুস্থ হওয়ার পরপরই ত্যাগ করলো তাকে?

হেমাকে খুঁজবার জন্য শান্তনু চারিদিকে সার্চ চালানোর আদেশ দিয়ে দিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলে দেখা যায় সকালে বেরিয়েছে হেমা। এখন দুপুর গড়ালো। কোনো হদিস নেই। টেবিলের উপর বাজতে থাকা ফোনের দিকে নজর গেলো শান্তনুর। বললো,

-“তোর ফোন বাজছে মাশুক।”

মাশুক নিঃশব্দ, যেনো পাথরের মূর্তি। তার মুখে কোনো ভাবের সঞ্চার নেই, কোনো নড়াচড়া নেই। পুরো শরীর যেনো থমকে আছে। শুধু নিঃশ্বাসের ওঠা-নামা আর চোখের পলক ফেলা ব্যতীত অন্য কোনো সাড়া নেই। শান্তনু বুঝতে পারলো, মাশুকের এই নিশ্চুপতা এক অন্তর্গত ঝড়ের ইঙ্গিত। যে ঝড় এই শান্ত, দৃঢ় মানুষটিকে আঘাত করছে।

-“মাশুক বাড়ি থেকে কল, দরকারি কিছু হতে পারে ধর।”

মাশুক শুনেও শুনলো না। ধীরস্থির হাত এগিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে রাখলো। এক শ্রান্ত নয়নে শান্তনুর দিকে চেয়ে বললো,

-“ওকে সেফলি খুঁজে বের করতে পারবি?”

মাশুক নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য করেই হাসে। সঙ্গেসঙ্গে আবার বললো,

-“বোকা মেয়ে! আমি ওকে আটকে রাখতাম? কেনো লুকিয়ে, কিছু না জানিয়েই আমার থেকে দূরত্ব নিতে হবে। হেমা স্বাধীন। ওকে পেলে জানাস, আমি ওর মুক্তির পথে বাঁধা হবো না।”

শান্তনু জবাবে বলে উঠে,

-“তোকে দিয়ে এসব কথা আশা করিনা। তুই যা ভাবছিস সেটা নাও হতে পারে।”

-“ তোর কন্ঠস্বর বলছে তুই নিজেই শিউর না এই ব্যাপারে।”

শান্তনু বলে, -“তুই যা বলছিস সেই বিষয়ে তুই শিউর?”

-“আমার মন বলছে…”

-“পাগলের মত কথাবার্তা বলবি না।”

-“হেমা সুস্থ। হেমা এখন জানে, বুঝে কখন কি করতে হবে। সে মানিয়ে নিয়েছে ওর বাবা মায়ের মৃত্যু। কিভাবে,কেনো মৃত্যু হয়েছে সেটিও সে এখন বুঝে। সংসার বুঝে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও বুঝে। আমি তাকে দেখেছি প্রায়ই ভাবতে। কিন্তু কি ভাবে সেটি আমার কাছে খোলাসা করতে চায় না। কথা লুকাতে শিখেছে। আর আমাকে ছেড়ে যেতেও….”

মাশুকের কন্ঠস্বর অত্যন্ত দাম্ভিক শোনালো। বুকের অন্তঃস্থল থেকে যে কথাগুলো উঠে আসছে শান্তনু ঠিক ঠিক ধরতে পেরেছে। চশমার পেছনের করুণ চোখটা যন্ত্রণায় ভরা।

অবশ লাগছিলো মাশুকের। অনেক খুঁজেছে হেমাকে এতক্ষণ। শরীরের শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। থানায় এসে যেনো শ্বাস ফেললো। সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। হেমার মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় সার্চ কয়েক ঘন্টার মধ্যে শুরু হলো।

হুট করেই মাশুক উঠে দাঁড়ালো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বললো,

-“ আমি ওকে খুঁজতে যাচ্ছি। আমি জানি ও আমার কথা বুঝবে। আমাকেই বুঝে সবচেয়ে বেশি। তাকে আমি বলবো ছেড়ে যেতে চাইলে যাও। কিন্তু এভাবে না।”

-“মাশুক!” ডাকলো শান্তনু

মাশুক বললো, – “ ওর সুখ আর সেফটি অনেক ইম্পর্ট্যান্ট।”

বলে বেরিয়ে গেলো মাশুক। শান্তনু ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। থামানো যাবেনা তাকে। অযথাই সময় নষ্ট করা হবে। সার্চ টিমকে কল করলো। বললো,

-“আমি আজ রাতের মধ্যে হেমার খবর চাই। ইমিডিয়েট কাজ করো। খবরীদের কাজে লাগাও, ফাস্ট!”

________

শহরের বুকে ঘন আঁধারের চাদর নেমে এসেছে। অলিগলিতে রিকশার টুংটাং শব্দ আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত নগরী। সেই ভিড়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে চলেছে এক জোড়া ক্লান্ত পা। হেমার কোমল মুখে ক্লান্তির ছাপ, কাঁধে ভারী ব্যাগ ঝুলছে। বিধ্বস্ত শরীর, ক্ষুধায় অবশ; সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। মাথায় হাত রেখে দাঁড়ালো সে, কেঁদে কেঁদে মাথা ধরিয়েছে।

রাস্তার এক কোণে থমকে দাঁড়ালো।মনে করার চেষ্টা করলো।বুকের মধ্যে কাঁপুনি, পথ চিনতে পারছে না। সাথে ফোন নেই। এ কী? আবার কি ভুলে গেলো? নিজেকে কিছুটা সময় দিলো। এই পথ ধরেই এসেছিল। আশপাশে তাকিয়ে চিনবার চেষ্টা করলো। এখন কোথায় যাবে? সবকিছু আবছা লাগছে কেমন যেনো।

নিজেই নিজেকে বললো,- “মনে করার চেষ্টা কর!”

ঘামে ভেজা মুখ, কুচকানো শার্টে অবসন্ন দেহ নিয়ে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায় মাশুক। দরজার কাছে ছেলের এই করুণ চেহারা দেখে শান্তা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মাশুক তার হাত তুলে ইশারায় থামিয়ে দেয়। গভীর এক দীর্ঘশ্বাসে সে বলে ওঠে,

-“পাইনি খুঁজে!”

মাশুকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় বিষণ্ণতা। শান্তা বেগমও চিন্তিত। কোথায় গেলো মেয়েটা? সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়াচ্ছে। জহির সাহেব-ও এদিক ওদিক খোঁজ করে যাচ্ছেন। চিন্তিত নয় শুধু রিমা এবং মৃদুল। সুযোগ হাতছাড়া করলো না রিমা। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে ফেলে বলে উঠলো,

“এসব আগেই জানতাম আমি। গেলো তো এবার? তুমি ওর খাতির যত্ন করলে,আর তোমাকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভেগেছে।”

অকস্মাৎ ঘাড় গরম হয়ে উঠে মাশুকের, মুখমন্ডল কঠিন। চোখ থেকে চশমা খুলে ছুঁড়ে ফেললো পাশে। গাঢ় দাম্ভিক সুরে বললো,

-“আরেকটা আজেবাজে কথা বললে সম্পর্কের লেহাজ ভুলে যাবো। আপনি আমার কেউ হন না। আমার কাছে আপনার স্থান শুধু ভাইয়ের বউয়ের, এতটুকুই। আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে যদি নাক গলাতে আসেন ভালো হবেনা। অনেকবার বলেছি, এটাকে শেষ ওয়ার্নিং বলে ধরে নিন।”

রিমা রক্তচক্ষু হয়ে চাইলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। মৃদুল বাড়ি নেই। আজ আসুক তারপর সব বলা যাবে। মাশুক চেঁচিয়ে বললো,

-“সরেন সামনে থেকে! এই মুহূর্তে আপনার চেহারা দেখতে ভালো লাগছে না আমার”

ঘরে ফিরে মাশুক সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভারী শ্বাস ফেলে, গ্রিলের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। আসার পথে হাত কেটে গেছে, সাদা ব্যান্ডেজে লালচে ছাপ স্পষ্ট। এই মুহূর্তে তার হুঁশ-বোধ বিলীন হয়ে আছে তার। বুকের ভেতর বারবার তীব্র চাপা ভয় শীতলতার স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। হেমা কি কোনো বিপদে পড়ল? কোথায় আছে সে? কি অবস্থায় আছে? এতক্ষণ ধরে খুঁজেও তার কোনো সন্ধান মিলল না!

চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো মাশুক। শরীর শক্তি হারাচ্ছে। দুর্বল লাগছে, আমার কি বের হওয়া উচিত তার? রাত হচ্ছে, রাতের বেলা যদি ওর কোনো সমস্যা হয়? হুট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঘুরে তাকানোর পূর্বেই পেছন থেকে জাপটে ধরায় ব্যালেন্স হারিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে যায় মাশুক। বল প্রয়োগ করে কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো মাশুকের। এক স্নিগ্ধ ঘ্রাণ নাকে এসে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেলো।বুকের দিকে শার্ট খামচে ধরে আছে দুটো হাত।

মাশুক নিজের চেতনা ফেরালো। হাত ছাড়িয়ে ঘুরে তাকায়। বুঝতে বাকি নেই তার সামনে কার প্রতিচ্ছবি ফুটতে পারে। হেমার লালচে নতজানু মুখ দেখে এক নিমিষে অন্তরের সমস্ত ভয় উধাও। দরজায় শান্তা বেগম হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনকে মুখোমুখি দেখে দরজা ভিড়িয়ে সরে গেলেন তিনিও।

মাশুক গম্ভীর গলায় শুধায়,- “কোথায় গিয়েছিলে?”

হেমা অপরাধীর ন্যায় চোখ তুলে একবার তাকালো।আবার নামিয়ে বললো,

-“পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, রাস্তা চিনতে পারছিলাম না।”

হেমার দুগাল চেপে মুখ তুললো মাশুক। ব্যথা যেনো না পায় সেদিকেও খেয়াল রেখেছে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে, “ আমি জিজ্ঞেস করেছি কোথায় গিয়েছিলে?”

-“ব…বাসায়”

মাশুকের কপালে ভাঁজ পড়লো। বললো,

-“বাসায়? কিসের বাসা? কার বাসা? আমি তোমাকে নিয়ে রাস্তায় থাকি?”

হেমা মুখ ছাড়িয়ে আবার মাথা নুয়ে ফেললো। চোখের পলক পড়ছে বারবার। ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। কেঁদে ফেলবে হয়তো। মাশুক লক্ষ্য করলো তার সবকিছু। উচ্চতায় তফাৎ। মাথা ঝুঁকে পড়ে হেমার দিকে। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললো,

-“আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছো?”

হেমা না বোধক মাথা নাড়িয়ে মুখ তুলে তাকায়। মাশুককে ঝুঁকে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো। যতবার তার দিকে ঝুঁকে এসেছে ততবারই চোখের গভীরতায় ছিলো নিদারুণ প্রশান্তি। আজ দৃষ্টি ভিন্ন। রাগী মুখ, রাগী দৃষ্টি।

-“ঢং করবে না। সোজা জবাব চাই আমি! ছেড়ে যেতে চাইছো? ভালো লাগছে না আর আমাকে? ইয়েস ওর নো, এর ঊর্ধ্বে একটা দাড়ি, কমাও যেনো অতিরিক্ত না বেরোয় তোমার মুখ থেকে।”

হেমা তড়িৎ গতিতে জবাব দেয়, -“নাহ”

হেমার বাহু চেপে মাশুক বলে উঠে, -“ তাহলে আমাকে এত অস্থির করলে কেনো? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম ভেতরে ভিতরে। তুমি জানো কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোমাকে? কাউকে কিছু না জানিয়ে, হুট করেই চলে গেছো? তুমি জানো? বুঝো আমার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু? পরিমাপ করতে জানো? আমি রাতে মিনিটে মিনিটে উঠে তোমাকে দেখি। কাজের ফাঁকে মনিটরে তোমার দিকে আমার নজর থাকে। আমি কাউকে পরোয়া না করা মানুষ ছিলাম হেমা। কারো প্রতি আমার মায়া হতো না। রোবটিক জীবন ছিলো আমার। সেখান থেকে তোমার কারণে,তোমার জন্য সম্পূর্ণ জীবন পরিবর্তন করেছি। মানুষ আমি! ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে এসবের প্রতিদান চেয়ে বসি। তোমার তরফ থেকে দৃঢ় অনুভূতি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে আছি। দিন গুনেছি তোমার সামান্য একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভে। আজ মনে হচ্ছিলো সব শেষ।”

মাশুকের চোখের কোণ বেয়ে এক শিশির বিন্দু ঝরে পড়লো। হেমা তার চোখ থেকে ঝরে পড়া বিন্দু কণাকে দেখলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে। বারংবার ফেলা উষ্ণ নিঃশ্বাস মাশুকের অন্তরের অধিরতা তুলে ধরছে।

-“শেষ না… শুরু।”

হেমা হাত দিয়ে মাশুকের সিক্ত চোখের কোণ মুছে দিলো। হাত টেনে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানার উপর রাখা বড় একটি কালো ব্যাগ। মাশুক আশ্চর্য চোখে তাকালো। জিজ্ঞাসা করলো,

-“এই ব্যাগে কি?”

-“তুমি বসো, আমি দেখাচ্ছি।”

নিজেই বসিয়ে দিলো মাশুককে বিছানায়। হাঁটু জমিনে ভাঁজ করে বসলো হেমা। ব্যাগ খুলে এক এক করে বের করতে লাগলো কিছু শাড়ি, পাঞ্জাবি, ডায়রি, খেলনা আর একটি ছবির ফ্রেম। মাশুকের বিস্ময় চরম সীমায়। প্রশ্ন করবে তার আগেই হেমা বলে উঠে,

-“আমি এগুলো নিয়ে এসেছি। আমি আবার বাবা মায়ের সবকিছু নিয়ে এসেছি।”

জিনিসগুলো পুরোনো। ময়লা পড়ে গেছে। সেখানে মনোযোগ দেওয়ার পূর্বে মাশুক প্রশ্ন করে,

-“কোন বাড়িতে গিয়েছিলে তুমি?”

হেমা উদাস নয়নে চেয়ে বললো, -“আমার বাড়ি, ছোট্ট একটা বাড়ি। যেখানে আমি আমার বাবা মা থাকতাম। জানো, আমি রাস্তা চিনেছি। হেঁটে গিয়েছি সেখানে।”

মাশুক বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললো,- “তোমার সাহসতো কম না!”

-“অনেক সাহস করে গিয়েছি…”

-“সেটা দেখতেই পারছি! এই মেয়ে আমাকে বললে আমি নিয়ে যেতাম না? পাকনামো করতে একা একা চলে গেছো! সাথে ফোন নেই, রাস্তা জানা নেই। একটু আগে বললে রাস্তা ভুলে গিয়েছিলে, এখন বলছো রাস্তা চিনেছো। স্পষ্ট বলো কি বলতে চাও।”

হেমা জবাব দেয়, -“ফিরে আসার পথে রাস্তা ভুলে গিয়েছিলাম।”

হেমার উল্টোপাল্টা কথায় মাথায় তালগোল পাকাচ্ছে। মাশুক বুঝলো না। জেরা করার ভঙ্গিতে বললো,

-“ঠিক করে বলো, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। শুরু থেকে বলবে, একটা ওয়ার্ড যেনো মিস না যায়।”

-“অস্থির হয়ে উঠেছিলাম আমি ভীষণ। ওই, ওই খারাপ দৃশ্য আমার স্বপ্নে এসেছে। আমি আমার বাড়ির রাস্তা কল্পনা করছিলাম, মাশুক। সবকিছুই আমার কাছে স্পষ্ট ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমার এখনই সেখানে যেতে হবে। ভালো লাগছিলো না,মনে হচ্ছিলো বুকে কেউ পাথর চেপে রেখেছে।”

কন্ঠ ভার হয়ে এলো হেমার। কণ্ঠের বাচ্চামো কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে তার। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে, কিন্তু কোথাও না কোথাও সেই রেশ একটুখানি রয়ে গেছে। মাশুক হেমাকে নিজের পাশে এনে বসায়। ঘুরে বসে তার দিকে। হেমা মাশুকের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। বলে,

-“তোমাকে জাগাতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু যাওয়ার আগে ভালোবাসা দিয়ে গিয়েছি।”

মাশুক অকস্মাৎ মৃদু হাসে। পরক্ষনেই প্রশ্ন করে,

-“এগুলো কি পাগলামো নয়? আমাকে ডাক দিলেই আমি উঠে তোমাকে নিয়ে যেতাম।”

হেমা ছলছল নয়নে তাকালো। ঠোঁট উল্টে যাচ্ছে তার বারবার। চোখের কোণে জমা হয়েছে অজস্র অশ্রু বিন্দু। বললো,

-“একা যেতে চেয়েছিলাম… বাবা মায়ের কাছে। কিন্তু সেখানে তাদের পেলাম না। জানো,আমাদের বাড়িটা না অনেক ছোট। গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম বাহিরে। কেউ থাকেনা এখন সেখানে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার পুরোনো সব কথা মনে পড়ছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, বাবার হাত ধরে আমি স্কুলে যাচ্ছি। মা আমাকে আইসক্রিম কিনে দিয়ে বাসায় নিয়ে আসছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন মহিলা আসলো। আমাকে জড়িয়ে হঠাৎ কান্না শুরু করেছে। আমি ভয় পেয়ে যাই।তাকে সরিয়ে পালাতে চেয়েছি। পরে সে বললো সে আমাকে চেনে,আমার বাবা মাকে চেনে। আমার হাত ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। বাড়ির চাবি ছিলো তার কাছে। আমার চাচ্চু নাকি দিয়েছে তাকে সেটা। ভিতরে ঢুকে আমার বুক কেঁপে উঠে। সবকিছু আগের মত আছে। সবকিছুর উপর শুধু ময়লা আর ময়লা। কিন্তু আমি….”

মাশুক হেমার হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। তাকে কথা বলতে দেওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আশ্বাস দিলো তাকে।বললো,

-“শুনছি… বলো তারপর কি হলো?”

সামান্য হেঁচকি তুলে হেমা বললো, -“আমি সব ছুঁয়ে দেখেছি। তারপর এক এক করে সব ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি। দেখো কি অবস্থা কাপড়গুলোর?”

মাশুক হেমার গালে হাত রেখে বলে,

-“কাপড়ের অবস্থা দেখে কি হবে? যে অবস্থায়ই থাকুক না কেনো,প্রত্যেকটা জিনিস অনেক দামি।”

কান্নার মাঝেও মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। এক এক করে সব বের করে দেখাতে লাগলো। ফ্রেমে খায়রুল সরোয়ার আর নাসিমা সরোয়ারের বিয়ের ছবি। একেবারে সাদামাটা। সেই পরিস্থিতিতে হয়তো কোনো আয়োজন করার সুযোগ হয়নি। লাল শাড়িতে সেজেছেন নাসিমা সরোয়ার,এই যা।

হেমা বললো, -“এটা দেখছো,আমার বাবার পাঞ্জাবি। তারপর এটা? আমার মায়ের শাড়ি।গোল্ডেন ঘড়িটা আমার বাবার,কানের দুল মায়ের। এই পুতুল, আমার মনে পড়ছে আমি এই পুতুল দিয়ে খেলতাম। এই রেলগাড়ি আমাকে বাবা দিয়েছিলো।”

-“সব মনে আছে দেখছি”

সরল বাক্যে হেমা বললো, – “সেখানে গিয়ে আমার সব মনে পড়েছে।”

একে অপরের চোখের দিকে চেয়ে নীরব রইলো দুজনেই। যেনো আলাপ চলছে নিঃশব্দে। হুট করেই আটকে গেলো এই স্তব্ধ আলাপচারিতায়। কিছু সময় পরেই মাশুক বললো,

-“সে যাই হোক, তুমি আজ যা করেছো খুবই বাজে একটা কাজ করেছো।আমাকে না জানিয়ে গিয়েছো। ক্ষমা পাবে না সহজে বলে দিলাম। আমার ধৈর্য দেখেছো, রাগটাও দেখা উচিত”

হেমা মাশুকের দিকে এগিয়ে আসে। মাশুকের দুহাত চেপে ধরে হেসে বললো,

-“আমাকে আবার বিয়ে করবে? আমি মায়ের বিয়ের শাড়ি পড়ে বউ সাজবো। তোমাকে জ্বালাবো না, না জানিয়ে আর কক্ষনো কোথাও যাবো না, তোমার প্রতি আমার যা যা দায়িত্ব আছে সব পালন করবো,প্রমিজ। আমার আর ভয় পেতে ইচ্ছে হয়না। সবার মত স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হয়। আমার মনে পড়েছে, মা আমাকে বলে গিয়েছিলো, লড়াই করে বাঁচতে হবে। আমার ভাগের লড়াইতো তুমি করলে। এখন তোমাকে আমি ভালো রাখবো। বলো আমাকে বিয়ে করবে?”

চলবে….