হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
468

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৮৬)
খান ভিলায় ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন। সেইসময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে মুবিন খান চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

—“কি ব্যপার চেয়ারম্যান এতো রাতে আবার কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমার বাসায় এসেছেন?”

আমজাদ হোসেন বসাবস্থা থেকে উঠে মুবিন খানের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললেন….

—“ছোট খান…আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিলো আমার। তাই এই রাতের বেলাতেই আপনার বাসায় আসতে আমি বাধ্য হলাম।”

মুবিন খান নিজের জন্য নির্ধারিত সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো….
—“কি এমন বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে আপনার! বলুন শুনছি।”

—“ছোট খান…আপনার কথানুযায়ী আমার জমিতে কামলা খাঁ*টে এমন একজন চাষীকে পাঠিয়েছিলাম কুশল চৌধুরীকে আহত করার জন্য। সেই চাষী একটু আগে আমার কাছে এসে বললো, সে কুশল চৌধুরীর পেটে ও বুকে পরপর বেশ কয়েকবার ছু*ড়ি দ্বারা আ*ঘা*ত করেছে। কুশল চৌধুরীর গার্ডসদের হাত থেকে ধরা পড়তে পড়তে বেঁ*চে গিয়েছে সে। কুশল চৌধুরীর বর্তমান অবস্থা একদমই সুবিধার নয়। ইতিমধ্যে ওনাকে শহরে নিয়ে গিয়েছে বাঁচবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু চিন্তার বিষয় দাঁড়ালো যদি কুশল চৌধুরী এতো ক্ষ*তে*র শিকার হওয়ার পরেও প্রাণে বেঁচে যান তাহলে ঐ চাষীকে তো যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করবেন তিনি। তারপর আমাদের কাছে পৌঁছাতেও তার খুব বেশি সময় লাগবে না।”

চেয়ারম্যানের কথাগুলো শুনে মুবিন খান স্বশব্দে হেসে উঠেন। আমজাদ হোসেন অবাক চাহনী স্থির করে রেখেছেন মুবিন খানের মুখশ্রীর উপর। কিছুসময় পর মুবিন খান হাসি থামিয়ে বললেন….

—“এতোবছরের চেষ্টার পর আজ সেই দিন তবে এসেই গেলো। আমার যে কি পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে চেয়ারম্যান। আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।”

—“মানে!”

—“মানেটা খুব সহজ। আপনাকে আর কোনোরকম ভ*য় বা চিন্তা করতে হবে না। এতোগুলো বছর ধরে এই দিনটা দেখার জন্য কুশল চৌধুরীর বিরুদ্ধে কতো কতো যে ষ*ড়*য*ন্ত্র করেছিলাম তার হিসাব নেই। অবশেষে কুশল চৌধুরীকে নিজের জীবন ও মৃ*ত্যু*র সাথে ল*ড়া*ই করার পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলাম। এখন কুশল চৌধুরী পুরোপুরি ভাবে মৃ*ত্যু*পুরীতে পৌঁছে দিতে আমায় খুব বেশি বেগ পেতে হবে না চেয়ারম্যান।”

—“কুশল চৌধুরীর সাথে কি করতে চাইছেন আপনি ছোট খান?”

—“আজই আমি আমার সিক্রেট কাজ করে দেয় এমন কয়েকজন গার্ডদের শহরে পাঠিয়ে দিবো। কুশল চৌধুরীকে যেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে ওরা সেই হাসপাতালে যাবে। কুশল চৌধুরীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তারদের মোটা টাকা দিয়ে কিনে নিবে। এরপর খুব দক্ষতার সাথে কুশল চৌধুরীর জীবনের লাল বাতিও জ্বালিয়ে দিবে। যদি কুশল চৌধুরী হাসপাতাল থেকে আর জিবীত অবস্থায় বের হতেই না পারে তখন ঐ চাষীকেই বা খুঁজে বের করবে কিভাবে আর আমাদের কাছেই বা পৌঁছাবে কি করে বলুন চেয়ারম্যান! তবুও যদি ঐ চাষীর জন্য আপনার মনে চিন্তা বা ভ*য় কাজ করে তাহলে ঐ চাষীর হাতেও মৃ*ত্যু*পুরীতে যাওয়ার টিকিট ধরিয়ে দিবেন খুবই সিম্পল বিষয়।”

সেইসময় খান ভিলার মূল দরজা দিয়ে একজন সার্ভেন্ট ‘ছোটওওও খাননননন’ বলে দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করে মুবিন খানের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কমোর হেলে দুই হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে হাঁ*পা*তে শুরু করে। মুবিন খান ভ্রু যুগল কুঁচকে সার্ভেন্টটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন….

—“কি হয়েছে সাত্তার চাচা! এভাবে হাঁ*পা*চ্ছেন কেনো?”

সাত্তার নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো…
—“কু-কুশল চৌধুরী সা-সাহেব….বা-বাহিরে…!”

সাত্তার পুরো কথা শেষ করার পূর্বে কুশল নিজের গার্ডসদের ও পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে খান ভিলায় প্রবেশ করে। কুশলকে নিজের চোখের সামনে অ*ক্ষত অবস্থায় দেখে মুবিন খানের চোখ যুগল যেনো কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়ায়। চেয়ারম্যান দ্রুত কদমে মুবিন খানের পাশ থেকে সরে কুশলের পাশে এসে দাঁড়ায়। কুশল চেয়ারম্যানের শার্টের উপরিভাগ থেকে একটা বোতাম টান দিয়ে খুলে নিয়ে বাঁ*কা হেসে বললো….

—“আমার হাতে মৃ*ত্যু*পুরীতে যাওয়ার টিকিট ধরিয়ে দেওয়ার আগে নিজেই নিজের মৃ*ত্যু*পুরীতে যাওয়ার টিকিট কনফার্ম করলেন মি.মুবিন খান। অনেক বছর ধরেই আমাকে মা*রা*র ও গ্রামবাসীর ক্ষ*তি করার জন্য অজস্র কূ*ট*নৈ*তি*ক পরিকল্পনা করেছিলেন আপনি। কিন্তু কোনোবারই সফল হতে পারেন নি। প্রতিবারই যোগ্য প্রমাণের অভাবে আপনি শা*স্তি*র হাত থেকে বেঁ*চে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার আর বাঁচতে পারলেন না। নিজের করা সব অ*ন্যা*য় ও পা*প কর্মের কথা নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। আর তার যথাযথ প্রমাণ এই বোতাম ক্যমেরায় রেকর্ড করা রয়েছে। এবার এমন কোনো প্রাণী নেই যে আপনাকে উপযুক্ত শা*স্তি পাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে।”

আকস্মিক ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝে উঠতে মুবিন খানের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। পরক্ষণেই মুবিন খান উচ্চস্বরে চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“যার নুন খেয়ে দিন কাটালি তারই সাথে নে*মো*খা*রা*মি করলি! বে*ই*মা*ন, প্র*তা*রক তোকে আর প্রাণেই মে*রে ফেলবো আমি।”

মুবিন খান কুশলদের দিকে অগ্রসর হতে নিলে কুশল৷ পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“অফিসার… এরেস্ট হিম।”

কুশলের কথানুযায়ী ৪জন পুলিশ কনস্টেবল মুবিন খানকে খুব শক্ত ভাবে ধরে ফেলেন। মুবিন খান নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা নিয়ে কুশলকে উদ্দেশ্য করে রাগ নিয়ে উচ্চস্বরে বললো….

—“আজ আমাকে পুলিশের হাত তুলে দিলি কুশল চৌধুরী। কিন্তু কতোদিন আমাকে জে*ল*খানায় আঁটকে রাখতে পারবে এরা? বড়জোর ৫ বছর নয়তো ১০-১৫ বছর! কিন্তু তারপর? তারপর তো আমি মুক্তি পাবোই। জীবন শেষ নিঃশ্বাস পড়ার পূর্বমুহূর্তেও যদি আমি জে*ল থেকে বের হতে পারি তবে মনে রাখিস সেই দিনটাই হবে তোর জীবনের শেষ দিন। তোকে নিজ হাতে না মা*রা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।”

অতঃপর পুলিশ অফিসার মুবিন খানকে নিয়ে খান ভিলা থেকে বেড়িয়ে যান। কুশলের সাথে থাকা ২জন গার্ডস চেয়ারম্যানকে ধরে গার্ডসদের গাড়িতে উঠিয়ে নেন। কুশল নিজ গাড়িতে বসে খান ভিলা থেকে বেড়িয়ে নিজের বাগান বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।

(৮৭)
বাগান বাড়িতে নিজ রুমে তরুনিমা বিছানায় বসে একটু পর পর দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করছে। সেইসময় কুশল ক্লান্ত ও বি*ষ*ন্ন মুখশ্রী নিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করে বিছানার পাশে রাখা হেলানো চেয়ারের পিঠ ঠেকিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে নেয়। তরুনিমা কুশলের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। কিছুসময় পর কুশল ওভাবেই বসে চোখ মেলে তরুর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“আগামীকাল সকালে আমার ছায়াসঙ্গীকে লা*শ*বাহী খাটে শুইয়ে তার ভাড় নিজের কাঁধের উপর নিয়ে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে রেখে আসতে হবে। পৃথিবীর ভিতর সবথেকে কঠিন আর নি*ষ্ঠু*র দায়িত্বটা কাল সাবলীল ভাবে সম্পন্ন করতে হবে আমায়। ঘন্টা ২-৩ এর ভিতরেই সম্পূর্ণ প্রমাণ সহ সাদিকের খু*নে*র সাথে জড়িত সব অ*প*রা*ধীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। একজনকে ইতিমধ্যেই জে*ল বন্দী করা শেষ। আর বাকিদের যথাযথ শা*স্তি আগামীকাল সকালের ভিতরেই দেওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু বাহিরে সাদা চাদরে মোড়ানো ঐ মানুষটা আর কখনও চোখ মেলে তাকাবে না, আমাকে আর স্যার বলেও ডাকবে না। কেনো জানি না এখন বুকের বামপার্শে চিনচিনে ব্য*থা অনুভব করছি। প্রিয় মানুষগুলো ছেড়ে চলে গেলে এতোটা য*ন্ত্র*ণা কেনো হয় তরুনিমা!”

কুশলের কথাগুলো শুনে তরুর চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে। এইমুহূর্তে কুশলকে ওর ঠিক কি বলা উচিত তা তরু বুঝে উঠতে পারছে না। সম্পূর্ণ রুমজুড়ে পিনপিনে নিরবতা বিরাজ করছে, তরুনিমা আর কুশল একে অপরের দিকে শীতল দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে।

(৮৮)
অনন্যা আর কনক ওদের রুমে বিছানায় বসে আছে। সেইসময় অনন্যা কিছুটা লজ্জা ভাব নিয়ে হাসিমুখে কনককে বললো…..

—“কনক…আই এম প্রেগন্যন্ট।”

অনন্যার মুখে আকস্মিক এমন কথা শুনে কনক অনেক বেশি অবাক হয়ে ওভার রিয়াক্ট করে বললো…..

—“হোয়াট! কি বলছো টা কি তুমি? তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে অনন্যা?”

কনকের মুখে এমন কথা শুনে অনন্যার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি মলিন হয়ে যায়। অনন্যা শান্ত স্বরে বললো…

—“আমি সত্যিই প্রেগন্যান্ট কনক। আজ সন্ধ্যাতেই প্রেগন্যন্সি কি*ট দিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম পরপর ৩বার। ৩বারই রেজাল্ট পজেটিভ এসেছে। দারাও তোমাকে কি*ট গুলো এনে দেখাচ্ছি।”

অনন্যা কনকের পাশ থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার খুলে ওর ব্যবহৃত তিনটা প্রেগন্যন্সি কি*ট বের করে আবারও কনকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কি*টগুলো ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। কনক অনন্যার হাত থেকে কি*ট গুলো নিয়ে দেখে ৩টা কি*ট এই পজেটিভ রেজাল্ট এসেছে। কনক কি*ট গুলো বিছানার উপর রেখে বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক স্বরেই বললো…..

—“আমি এখন বাচ্চা নেওয়ার বিষয় নিয়ে কোনোরকম চিন্তা ভাবনা করি নি অনন্যা।”

—“চিন্তা-ভাবনা করো নি এর জন্য কি হয়েছে? এখন চিন্তা-ভাবনা করো।”

—“না, সেটা সম্ভব না।”

অনন্যা অবাক স্বরে বললো…
—“সম্ভব না মানে? কি বলতে চাইছো তুমি কনক?”

—“মানেটা খুবই সহজ। আমি এখনি আমাদের জীবনে বাচ্চা-কাচ্চার ঝামেলা চাই না। মাত্র ৭দিন হলো বিয়ে হয়েছে আমাদের। আর এখনি কিনা কন্সিভ করলে তুমি? এখন আমাদের মজা-মাস্তি করে জীবন কাটানোর সময়। বিবাহের বছর ৫-৬ যাবে তারপর এসব বাচ্চা নেওয়ার বিষয় নিয়ে প্লানিং করবো আমরা। প্রেগন্যন্সির বিষয় নিয়ে বাড়িতে ২য় কোনো ব্যক্তিকে ভুলেও কিছু জানাবে না। তুমি আগামীকালই আমার সাথে হাসপাতালে যাবে আর এই বাচ্চাকে এ্যবোশন করবে।”

কনকের মুখে এ্যবোশনের কথা শোনামাত্র অনন্যা যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। অনন্যা অবাক স্বরে বললো….

—“বিয়ের মাত্র ৭দিন হয়েছে মানে? আমরা যে ৩মাস আগেই কানাডা থাকা কালীন সময়েই বিয়ে করে নিয়েছিলাম আর একসাথে থাকতেও শুরু করেছিলাম তুমি হয়তো সেসব কথা ভুলে গিয়েছো কনক। সন্তান হলো সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবথেকে বড় রহমতের অংশ। এই ছোট্ট প্রাণটির অস্তিত্ব যে একটু একটু করে আমার মাঝে বেড়ে উঠছে তা আমি আজই জানতে পারলাম আর তুমি কি না আমাকে এ্যবোশন করার কথা বলছো? একজন মা হিসেবে তোমাকে আমি এই অধিকার দেই নি যে তুমি আমার গর্ভের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করবে।”

কনক রাগ নিয়ে অনন্যা দুই হাতের দুই বাহু শক্ত করে চে*পে ধরে বললো….
—“ভুলে যেও না তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আর তোমার গর্ভে সেই প্রাণটি আছে এই প্রাণটি আমিই তৈরি করেছি। তাই আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে ওকে বাঁচিয়ে রাখবো নাকি মে*রে ফেলবো সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এতো বেশি কথা বলো না। আগামীকাল তুমি আমার সাথে হাসপাতালে যাবে আর এ্যবোশনও করবে এটাই আমার শেষ কথা।”

অনন্যা কনকে ধা*ক্কা দিয়ে নিজের থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো….
—“আমি এ্যবোশন করবো না, করবো না, করবো না। এটা আমারও শেষ কথা। এরপর তুমি যা খুশি করতে পারো।”

এই বলে অনন্যা রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলে কনক বললো….
—“যদি তুমি এ্যবোশন না করো তাহলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।”

কনকের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে অনন্যা থমকে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ……

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৮৯)
রূপগন্ঞ্জ গ্রামের সরকারী প্রাইমারি স্কুলের বিশালাকার মাঠের বটতলায় কুশল ও গ্রামের নামীগুণি, বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ মানুষরা চেয়ারে বসে আছেন। তাদের সামনে মাঝবরাবর মাটির উপর সাদা চাদরে মোড়ানো অবস্থায় সাদিকের মৃ*ত*দেহ রাখা হয়েছে। সাদিকে মৃ*ত*দেহের একপার্শে চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন ও মেম্বার মহসিনকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাঁটু ভাজ করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যপার্শে চেয়ারম্যানের ছেলে আরিফ ও মেম্বার এর ছেলে মুরাদকেও একই অবস্থায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের থেকে কয়েকহাত দূরে একপার্শে সাদিককে ছু*ড়ি*কা*ঘা*ত করা চাষিটিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যপার্শে ধ্ব*র্ষ*ণের শিকার হওয়া সেই চাষী ও চাষীর মেয়েকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের সবাইকে ঘিরে রূপগঞ্জ গ্রামের শতাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আর তাঁদের মধ্যে যেনো কোনোরূপ বি*শৃ*ঙ্ক্ষ*লার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছে গার্ডসরা। পরক্ষণেই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের মাঝে আলতাফ নামের একজন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

—“সম্পূর্ণ ঘটনাই আমরা সকলে শুনলাম, প্রমাণ দেখলাম এবং বুঝলামও। আমজাদ আর মহসিনের ছেলেরা গ্রামের মেয়েদের উ*ত্ত্য*ক্ত করে এমন না*লি*শ চাষীদের থেকে এর আগেও আমরা বহুবার শুনেছিলাম। আর এই বিষয়ে গোপনে বৈঠকখানা বসিয়ে আমজাদ ও মহসিনকে নিজেদের ছেলেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কড়া ব্যবস্থা নিতেও বলেছিলাম। বেশ কয়েকবার সতর্ক করার পরেও বাবা হিসেবে আমজাদ ও মহসিন নিজেদের ছেলেদের কোনোরূপ শা*স*ন করেন নি যার ফলস্বরূপ মাত্র ১৫ বছর বয়সের নাবালিকা মেয়েকে ওদের ধ্ব*র্ষ*ণের শিকার হতে হয়। আল্লাহ হায়াত রেখেছিলেন জন্য মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। নিজের ছেলের কু*কর্মকে ঢাকার জন্য মুবিন খানের মতো একজন নিম্ন মানসিকতার অ*মানুষের শরণাপন্ন হয়েছিলো আমজাদ। আমজাদের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মহসিন নিজের ছেলেকে শা*স্তি*র হাত থেকে বাঁচাতে আমজাদকে ব্লাকমেইল করে। অতঃপর আমজাদ মুবিন খানের কথানুযায়ী নিজের জমিতে কাজ করে ঐ গরীব চাষিকে তার মেয়েদের ইজ্জত ন*ষ্ট করার ভ*য় দেখিয়ে কুশল চৌধুরীর মতো স্বহৃদয়বান ব্যক্তিকে হ*ত্যা করার কথা বলেন। আর কুশল চৌধুরী এই ষ*ড়*য*ন্ত্রের হাত থেকে বেঁচে গেলেও তার জায়গায় প্রাণ হা*রা*ণ তারই বিশ্বস্ত পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সাদিক। এই অ*প*কর্মের মূল মাথা মুবিন খানকে তো ইতিমধ্যে পুলিশ জেল ব*ন্দী করেই নিয়েছেন। ২-১ দিনের মধ্যে তাকে কোর্টে পেশ করা হবে। আর যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে সে উপযুক্ত শা*স্তি ও পাবে। বাকি রইলো মহসিন, আমজাদ, ওদের দুই ছেলে আরিফ, মুরাদ আর সাদিককে ছু*ড়ি*কা*ঘা*ত করা চাষীটি। এদের সকলকেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হোক। পুলিশ ওদের কর্মনুযায়ী যে শা*স্তি দেওয়ার তা দিবেই। কিন্তু আমরা গ্রামবাসীরাও এদের ছেড়ে কথা বলবো না। এইমূহূর্তে আমজাদ ও মহসিনকে চেয়ারম্যান ও মেম্বার এর পদ থেকে ইস্তফা নিতে হবে এবং এতোদিন পর্যন্ত যতোজন গরীব কৃষকের পে*টে লা*থি মে*রে মে*রে তাদের জমি নিজেদের নামে করিয়ে নিয়েছে সেই সব জমির মালিকানা সেই কৃষকদের আবারও দিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও বাকি যতোটুকু জমিজমা থাকবে তা গ্রামে বসবাসরত একেবারেই গরীব-অসহায় মানুষদের নামে করিয়ে দিতে হবে। মহসিন ও চেয়ারম্যানের বাড়ি দুইটি যথেষ্ট বড় এবং নদী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত তাই বাড়িদুটোকে বণ্যার সময় উপকূলীয় গ্রামবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। তাই বাড়ি দুটোর উপর থেকে মহসিন ও আমজাদের মালিকানা উঠিয়ে নিয়ে সরকারের নামে করে দেওয়া হবে। ভবিষতে আইনের নির্ধারণ করা শা*স্তি*র মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও যেনো মহসিন ও আমজাদ তার নিজ পরিবারকে নিয়ে ভুলেও যেনো আমাদের রূপগঞ্জ গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়েও নি*ষে*ধা*জ্ঞা জাড়ি করা হলো। শা*স্তি*র বাকি অংশটুকু এবার আপনি জানিয়ে দিন আলী আহসান সাহেব।”

আলতাফের পাশেই চেয়ারে বসে ছিলেন আলী আহসান নামের মধ্যবয়সের আরেকজন পুরুষ মানুষ। আলতাফের কথা শুনে আলী আহসান সাহেব কুশলের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। কুশল ইশারায় আলী আহসানকে শা*স্তি*র বাকি অংশটুকু শুনিয়ে দিতে বললেন। অতঃপর আলী আহসান বললেন…….

—“এবার আসা যাক শা*স্তি*র প্রথম ধাপে। সমস্ত দলিলপত্র ইতিমধ্যে তৈরি করে রাখা হয়েছে। এখন প্রতিটি দলিলে ও ইস্তফা পত্রে আমজাদ হোসেন ও মহসিনকে সাক্ষর করতে হবে।”

সমস্ত দলিলপত্র হাতে নিয়ে কুশলের হাতের ডানপার্শে দাঁড়িয়ে আছেন এবায়দুল নামের মধ্যবয়সের একজন সহকর্মী। আমজাদ হোসেন ও মহসিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডসরা ওদের হাতে বাঁধন খুলে দিলে কান্না করতে করতে সমস্ত দলিলপত্রে ও ইস্তফা পত্রে সাক্ষর দেন তারা। সাক্ষর করা শেষ করে এবায়দুল আবার সমস্ত দলিলপত্র ও ইস্তফা পত্র দুইটি নিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে দাঁড়ায়। আলী আহসান আবারও বললেন….

—“যে চারজন নাপিতকে ডাকা হয়েছে তারা সামনে এসে দাঁড়ান।”

আলী আহসানের ডাক পাওয়া মাত্র নাপিত চারজন ভি*র ঠেলে নিজেদের সরন্ঞ্জাম হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আলী আহসান নাপিতদের উদ্দেশ্য করে বললেন…

—“আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করুন।”

অতঃপর নাপিত ৪জন নিজেদের সরন্ঞ্জাম নিয়ে মহসিন, আমজাদ হোসেন, মুরাদ ও আরিফের সামনে গিয়ে বসে। বাক্স খুলে কাঁচি, ব্লে*ড বের করে মুহূর্তের মধ্যেই ওদের চারজনের মাথার সব চুল ফেলে দিয়ে নাঁড়িয়া বানিয়ে দেয়ার কাজ সম্পন্ন করে। অ*প*মা*নে, লজ্জায় ওরা চারজন মাথা নিচু করে শুধু চোখের পানি ফেলছে। এরপর ওদের চারজনের মুখে চুন-কালি মাখিয়ে গলায় ছেঁ*ড়া জুতোর মালা পড়িয়ে দেওয়া হয়। আলী আহসান সাহেব বললেন….

—“আরিফ আর মুরাদকে এবার হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই পুরো স্কুলের মাঠ হাটুতে ভর দিয়ে নাকে খড় কে*টে পার করতে হবে। প্রতি বার নাক দিয়ে খড় কা*টা শেষে বলতে হবে জীবনে আর কখনও ছোট-বড় কোনোরকম পা*প কর্মে লিপ্ত হবো না।”

পরক্ষণেই আলী আহসানের কথানুযায়ী আরিফ ও মুরাদ হাঁটুতে ভর দিয়ে পুরো স্কুল মাঠ নাকে খড় কে*টে কে*টে পার করে। অতঃপর ওদের ৪জনকে এবং ঐ চাষিকেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আলতাফ সাহেব উপস্থিত সকল গ্রাম বাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন….

—“রূপগন্ঞ্জ গ্রামে বসবাসরত ছোট-বড় সকল মানুষই তো দেখলেন নামীগুণি, অত্যাধিক টাকা-পয়সার মালিক হওয়া স্বত্ত্বেও ওরা কেউই পা*প*কর্ম করার পর উপযুক্ত শা*স্তি*র হাত থেকে রেহাই পেলো না। শা*স্তি*র পাশাপাশি নিজের বাড়ি, জমিজমা সর্বস্ব হারাতে হলো ওদের। তাই এরপর থেকে কেউ কোনোরূপ পা*প*কর্ম করার পূর্বে ওদের বর্তমান অবস্থার কথা একবার হলেও চিন্তা করবেন। কারণ ভবিষ্যতে আপনারা বা আমরাও যদি কোনোরূপ পা*প কর্ম করি তাহলে আমাদের ও শা*স্তি*র হাত থেকে কেও বাঁচাতে পারবে না। আমরা আমাদের কর্ম অনুযায়ী ইহকাল ও পরকালে যথাযথ ফল অবশ্যই ভোগ করবো।”

সেইসময় ভিড়ের ভিতর থেকে একজন মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে….
—“সকলেই তাদের কর্মানুযায়ী শা*স্তি পেয়ে গেলো কিন্তু ঐ গরীব চাষীর মেয়ের ন*ষ্ট হয়ে যাওয়া ই*জ্জ*ত তো আর সে ফিরে পাবে না। কয়েকবছর পর যখন ঐ মাইয়া বিয়ের বয়সী হবে তখন ওকে বিয়ে করবে কে?”

মহিলাটির এরূপ কথা কুশল সহ বাকি বয়োজ্যষ্ঠ সকল গুণিমাণী ব্যক্তিরাও শুনতে পারেন। গ্রাম বাসীদের মাঝে এই কথা নিয়ে ইতিমধ্যে শোরগোলও শুরু হয়ে গিয়েছে। ধ্ব*র্ষ*ণে*র শিকার হওয়া সেই নাবালিকা মেয়েটি ভ*য়ে তার বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। কুশল ওর ডান উপরের দিকে হাত উঠাতেই উপস্থিত সকলেই নিরব হয়ে যায়। কুশল সকলকে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে বললো….

—“ওর বয়স মাত্র ১৫ বছর। বিয়ের বয়স হতে যথেষ্ট দেড়ি আছে। আমাদের সকলের উচিত ওর সাথে হওয়া দূ*র্ঘ*টনাটিকে নিয়ে এতো ঘা*টা*ঘা*টি না করে ভু*লে যাওয়া। ও ভালোভাবে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তারপর যোগ্য ছেলে খুঁজে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমি নিবো। পরবর্তীতে আর কখনও যদি আপনাদের কারোর মুখ থেকে এই বিষয়ে একটাও উল্টোপাল্টা কথা বের হয় আর সেই কথা যদি আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় তাহলে তার বা তাদের উপযুক্ত শা*স্তি*র ব্যবস্থাও আমিই করবো। আলতাফ চাচা, আলী আহসান চাচা আপনারা সকলে মিলে উপযুক্ত সৎ, সুশিক্ষায় শিক্ষিত, ভালো মানসিকতার ২জন ব্যক্তিকে বাছাই করে নতুন ভাবে গ্রামের চেয়ারম্যন ও মেম্বার পদে নিয়োজিত করবেন।”

আলতাফ সাহেব বললেন….
—“ঠিক আছে, বাবা। এবার সাদিকের জানাজা করার পর ওর দাফনকার্যও যে সম্পন্ন করতে হবে।”

কুশল চেয়ার ছেড়ে উঠে সাদিকের লা*শে*র কাছে গিয়ে ওর মাথা পাশে বসে মুখের উপর থেকে সাদা চাদরটি সরাতেই দেখে ওর বুজে যাওয়া শীত মুখশ্রী ফ্যকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। কিছুসময় সাদিকের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রাখে কুশল। অতঃপর আগের ন্যয় সাদা চাদরটি দিয়ে ওর মুখটি ঢেকে দেয়। পরমূহূর্তে উপস্থিত সকল মহিলা ও বাচ্চারা স্কুল মাঠ ত্যগ করে। চারজন গার্ড স্কুলের পাশে অবস্থিত মসজিদ থেকে লাশ পরিবহনের জন্য লোহার খাটিয়াটি নিয়ে এসে সাদিকের লাশ তার উপর শুইয়ে রাখে। অতঃপর ইমাম সাহেব, কুশল ও গ্রামের সকল পুরুষ সদস্যরা মিলে সাদিকের জানাজা পর্ব শেষ করে। কুশল খাটিয়ার সামনের একপাশ নিজের কাঁধের উপর তুলে নেয়, খাটিয়ার বাকি তিন মাথা ৩ জন গার্ড নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এরপর কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে সাদিকের দাফনকার্যও সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর সকলেই নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়। কুশলও গার্ডসদের নিয়ে বাগান বাড়িতে ফিরে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৯০)
অনন্যা পিছন ঘুরে কনকের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“কি…কি বললে..! বাচ্চা অ্যবোশন না করলে তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে?”

কনক রাগের বশে কি থেকে কি বলে ফেলেছে তা সে এখন বুঝতে পারছে। কনক দ্রুত পায়ে অনন্যা কাছে গিয়ে অনন্যাকে বুঝানোর চেষ্টা নিয়ে ওর হাতের বাহু স্পর্শ করতে নিলে অনন্যা দু’কদম পিছনের দিকে পিছিয়ে গিয়ে কনকের দিকে ডান হাতের শাহাদত আঙুল উঠিয়ে বললো….

—“খবরদার….খবরদার কনক….ভুলেও আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবে না তুমি।”

—“অনন্যা আমার কথাটা শুনো আগে তুমি। আমি রাগের বশে এমন কথা বলে ফেলেছি। তুমি তো জানোই রাগ উঠলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই মুখে যা আসে তাই বলে বসি।”

—“বিয়ের মাত্র ৩মাস হয়েছে। আল্লাহর রহমতে আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি আর তুমি কিনা বাবা হয়ে নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই মে*রে ফেলতে বলছো। আর যখন আমি রাজি হলাম না তখন তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইলে! এগুলাকে রাগের বসিভূত হয়ে বলা কথা বলে কনক?”

—“অনন্যা…তুমি মাথা ঠান্ডা করো। আমরা বসে এই বিষয়ে কথা বলছি।”

—“আর বসাবসির কোনো প্রশ্নই আসছে না। আগামীকাল সকাল হতেই আমি কানাডায় আমার বাবার কাছে চলে যাবো। তোমার কাছে থাকাটা আমার সন্তানের জীবনের জন্য যে নিরাপদ নয় সেটাও আমি খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি। একজন শান্ত মস্তিষ্কের খু*নি চিন্তাধারার মানুষের সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায় না।”

এই বলে অনন্যা রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। কনক অনন্যাকে বেশ কয়েকবার পিছন থেকে ডাক দেয় কিন্তু অনন্যা কনকের ডাকগুলোকে কানে না তুলেই চলে যায়। কনক রাগে দরজার পার্শে দেওয়ালের উপর একটা ঘু*ষি দিয়ে বললো….

—“সিট।”

(৯১)
ভোর বেলা সূর্যের আলো পূর্বাকাশে উদীয়মান হতেই কুশল, তরু ও সন্ধ্যাকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছে। ওদের পিছন পিছন গার্ডসদের গাড়ি ও চলছে। কয়েকঘন্টার পথ অতিক্রম করে কুশলদের গাড়ি চৌধুরী মেনশনের ভিতরে প্রবেশ করে। তরু আর সন্ধ্যা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কুশল গ্যরেজে গাড়ি রাখার জন্য যায়। কিছুসময় পর কুশল, তরুনিমা ও সন্ধ্যা চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখে অনন্যা লাগেজ হাতে নিয়ে দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। অনন্যার পিছন পিছন কনক আসতে আসতে বলছে……

—“অনন্যা….আমার কথাটা শুনো…দেখো আমার ভু*ল হয়ে গিয়েছে। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না এভাবে।”

ইতিমধ্যে বাড়ির বাকি সদস্যরাও নিজ নিজ রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রয়িংরুমে আসতে শুরু করেছে। অনন্যা কুশলের পাশ কাটিয়ে যেতে নিবে সেইমূহূর্তে কুশল হাত বাড়িয়ে অনন্যার পথ আটকে দেয়। অনন্যা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল ওর দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে শান্ত স্বরে বললো…

—“ভাবী…আমি জানি না বড় ভাইয়ার সাথে আপনার কি বিষয় নিয়ে সমস্যা হয়েছে যার জন্য আপনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিটি বাড়ির ও পরিবারের মতো আমাদের বাড়ির ও পারিবারের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ঝগড়া-মনোমালিন্য হবে না এমন কোনো সম্পর্কই নেই। পরিবারের একজন সদস্যের সাথে অপর আরেকজন সদস্যের কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলে বা ঝামেলা হলে আমরা পরিবারের সবাই একত্র হয়ে বসে সেই বিষয় সম্পর্কে দু’জনেরই মতবাদ শুনি। তারপর বাড়ির গুরুজনদের মতামত নিয়ে যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে সেই সিদ্ধান্তেই মনঃস্থির করা হয়।”

অনন্যা কিছু না বলে ব্যগটা ওখানে রেখেই সোফায় গিয়ে বসে। অতঃপর পরিবারের বাকি সদস্যরাও সোফায় গিয়ে বসে। কুশলও নিজের জন্য নির্ধারিত সোফায় গিয়ে বসে। সায়মন রাগী স্বরে কনককে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“বিয়ের সপ্তাহ পু*ড়*তে না পু*ড়*তেই কি এমন হলো তোর সাথে বউমার যে বউমা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো কনক?”

কনক মাথা নিচু করে বসে আছে। অনন্যা নিরবে অশ্রুপাত করছে। সাগরিকা চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন….

—“দাদুভাই তোমার সাথে দিদিভাইয়ের কি বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে বলো আমাদের। না হলে তোমাদের মাঝে তৈরি হওয়া স*ম*স্যা*র সমাধান আমরা করবো কিভাবে?”

সাবরিনা অনন্যার দিকে দৃষ্টি স্থির করে শান্ত স্বরে বললেন….
—“বড় বউমা…তুমি বলো কি হয়েছে? কনক যদি বড় কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে আমার বড় ছেলে হওয়ার জন্য সে কিন্তু শা*স্তি*র হাত থেকে বেঁচে যাবে না। তুমি নির্দ্বিধায় বলো আমাদের কি করেছে কনক।”

অনন্যা অশ্রুসিক্ত নয়নে কনকের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই কনক শান্ত স্বরে বললো…

—“তোমাদের সকলের থেকেই একটা বিষয় লুকিয়েছি আমি।”

সকলের দৃষ্টি এখন কনকের উপর স্থির। কনক মাথানিচু করে রাখা অবস্থাতেই আবারও বললো….

—“৩মাস আগে কানাডাতে থাকাকালীন সময়েই আমি অনন্যাকে বিয়ে করেছিলাম। আর তখন থেকেই আমরা একসাথে থাকতেও শুরু করেছিলাম। অনন্যাকে নিয়ে বাংলাদেশে ফেরার পর ভেবেছিলাম তোমাদের সবাইকে আমাদের বিয়ে করার বিষয়টা জানাবো কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিলো যে বিয়ের সত্যটা লুকিয়ে শুধু সম্পর্ক রয়েছে এমনটা বলতেই বাধ্য হয়েছিলাম আমি। পরবর্তীতে বাবা-মাকে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে রাজি করানোর চেষ্টা করার পরেও যখন তারা রাজি হলেন না তখন বাধ্য হয়ে তরুনিমার সাথে আমার বিয়ের দিনই অনন্যাকে তোমাদের সবার সামনে এনেছিলাম। অতঃপর তোমাদের সকলের সম্মতি নিয়ে আমার আর অনন্যার ২য় বার বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। অনন্যা গতকাল সন্ধ্যায় প্রেগন্যন্সি টেস্ট করেছিলো এবং রেজাল্ট পজেটিভ এসেছিলো। বিয়ের মাত্র ৩মাস হয়েছে এখনি বাচ্চা নেওয়ার বিষয় নিয়ে আমার কোনো চিন্তাধারা ছিলো না। তাই আমি অনন্যাকে অ্যবোশন করতে বলেছিলাম। অনন্যা অ্যবোশন করতে পুরোপুরি ভাবে নারাজ ছিলো। তাই আমি রাগের বশে বলেছিলাম ও যদি অ্যবোশন না করে তাহলে আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দি………!”

কনক ওর পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই সাবরিনা কনকের গালে স্বজোড়ে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বসেন। কনক মাথা নিচু অবস্থাতেই গালের উপর একহাত রাখে। সাবরিনার এমন কাজে উপস্থিত সবাই যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সাবরিনা রাগী স্বরে বললেন…..

—“আমার ছেলে হয়েও তোর চিন্তা-ভাবনা এতোটা নি*কৃ*ষ্ট হলো কি করে কনক! তুই জানিস তুই যখন আমার গর্ভে এসেছিলি তখন তোর বাবার আর আমার বিয়ের বয়স ছিলো মাত্র ২৫দিন। যদি সেইসময় আমি বা তোর বাবা এটা চিন্তা করতাম যে তুই আমার গর্ভে আসায় আমাদের বিয়ের নতুন সময়টা ন*ষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাহলে আজ তুই জীবিত অবস্থায় আমাদের সামনে বসে এমন কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারতি না। সন্তান হলো আল্লাহর দেওয়া সবথেকে বড় রহমতের একটা অংশ। আরে নিজের চারপাশে একটাবার নজর ঘুরিয়ে দেখেছিলি! শত শত মা-বাবা নিজেদের একটা সন্তান না হওয়ার জন্য কতোটা হা*হা*কার করে! কতো শতো জায়গায় ঘুরে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। সেখানে আল্লাহ তায়ালা না চাইতেই তোকে বাবা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন আর তুই কিনা আল্লাহ তায়ালার শুকর আদায় না করে ঐ নিষ্পাপ শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মে*রে ফেলার কথা বলিস? জীবন দেওয়ার ও জীবন নেওয়ার অধিকার একমাত্র ঐ উপরওয়ালারই আছে তোর বা আমার নেই। এক্ষুণি বউমার কাছে ক্ষমা চা। আর নিজের দো*ষ শিকার কর। পরবর্তীতে আর কখনও এমন কাজ করার কথা চিন্তাও করবি না এমনটা বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ আমাদের সবার সামনে।”

কনক বসা অবস্থা থেকে উঠে অনন্যার পায়ের কাছে গিয়ে বসে ওর দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললো….

—“আমাকে ক্ষমা করে দাও অনন্যা। আমি অনেক বড় ভু*ল করে ফেলেছিলাম। তোমার গর্ভে একটু একটু করে যেই প্রাণটি বড় হয়ে উঠছে সে আল্লাহর দেওয়া সবথেকে বড় রহমতের একটা অংশ। তাই ওকে মে*রে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি অনেক বড় অ*ন্যায় করে ফেলেছিলাম। আমাকে আমার ভু*ল শুধরে নেওয়ার জন্য একটা সুযোগ দাও প্লিজ। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনও এমন কোনো কাজ করবো না যার ফলে তুমি বা আমাদের সন্তান কোনোরূপ ক*ষ্ট পাবে। আমি তোমার এবং আমাদের সন্তানের প্রতি অনেক যত্নশীল থাকবো, ওকে এই পৃথিবীর আলো দেখাবো এবং সুশিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো।”

কনককে নিজের ভু*ল শিকার করে শুধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেখে অনন্যার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক ফুটে উঠে। অনন্যা ওর দু’চোখে খুশির অশ্রু নিয়ে উপস্থিত সবার দিকে একপলক তাকায়। সকলের মুখেই স্মিত হাসি ফুটে আছে। অনন্যা শান্ত স্বরে কনককে বললো…

—“আর কখনও আমাকে আর আমাদের সন্তানকে ক*ষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তাও করবে না তুমি, কথাটি মনে থাকে যেনো।”

—“হুম…থাকবে।”

সাগরিকা চৌধুরী স্মিত হাসি দিয়ে বললেন….
—“মিয়া-বিবির মাঝের রাগ-অভিমান তো মিটে গেলো। এবার বাড়িতে নতুন অতিথি আসার আনন্দ নিয়ে আজ সন্ধ্যায় বড় করে একটা আনন্দপার্টি হয়ে যাক! কি বলো তোমরা সবাই!”

কুশল, তরুনিমা আর সন্ধ্যার মনে এখনও সাদিকের মৃ*ত্যু নিয়ে খারাপ লাগা থাকা স্বত্বেও পরিবারের বাকি সদস্যদের আনন্দ যেনো ন*ষ্ট না হয় তাই পার্টি হওয়া নিয়ে ওরা কোনোরূপ বাঁধা প্রদান করে নি।

চলবে ইনশাআল্লাহ……..