হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
436

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১২৯)
কুশলের হাতে পরপর ৪ বার থা*প্প*ড় ও একবার ঘুঁ*ষি খেয়ে মফিজুরের নাক ও ঠোঁটের কোনা দিয়া র*ক্ত ঝরছে। নিজের এমন বেহাল দশা দেখেও মফিজুর ক্ষি*প্ত কু*কু*রের মতো বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কুশলের দিকে অগ্রসর হতে নিলে কুশল ওর প্য*ন্টে*র ডান পকেট থেকে ছোট রি*ভ*ল*বারটা বের করে মুফিজুরের দিকে তাঁক করে। গা*ন পয়েন্টে নিজেকে দেখামাত্র মফিজুর থ*ম*কে যায়। কিছুটা ভ*য়ে শুকনো ঢোকও গি*লে নেয় সে। কুশল ওর হাতে থাকা রি*ভ*ল*বারটা দিয়ে মফিজুরকে ইশারা করে বললো….

—“বোস….মাটিতে হাঁটু গেড়ে বোস।”

কুশলের কথা যেনো এই মূহূর্তে মফিজুরের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না। কুশল উচ্চস্বরে ধ*ম*ক দিয়ে আবারও বললো….

—“বোসসস বলছিইইই।”

কুশলের ধ*ম*কে*র স্বরে বলা কথাটি শোনামাত্র মফিজুরের সর্বশরীর ভ*য়ে কা*টা দিয়ে উঠে। তৎক্ষনাৎ সে কুশলের সামনে হাঁটু গে*ড়ে মাঠির উপর বসে পরে। কুশল মফিজুরের কপালের মাঝ বরাবর রি*ভ*ল*বারটা ঠেকিয়ে রাগী স্বরে বললো…

—“তুই কি ভেবেছিলি আমি এই ফাঁকা মাঠে তোকে ফাঁকা আওয়াজ শুনিয়েছিলাম! তোর থেকে বহুত গুণে খা*রা*প অ*মানুষদের আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে সঠিক ঘাট দেখিয়ে দিয়েছি। সেখানে তুই তো আমার কাছে সামান্য মশার থেকেও তু*চ্ছ। তোকে নিজের পায়ের নিচে ফেলে পি*ষে ছি*ন্ন-বি*ন্ন করে দিতে আমার ২মিনিট ও সময় লাগবে না।”

মফিজুরের নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অনুনয়ের স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“দ-দয়া করে আমাকে প্রাণে মা-মার-বেন না সাহেব, দ-দয়া করুন আমার উপর। আমার প্রাণ ভি-ক্ষা দিন সাহেব।”

সেইসময় তরুর পিছন থেকে ঝর্ণা ঘাড় বাঁ*কি*য়ে ওদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা জোর গলায় বললো….

—“বাবাকে ছে*ড়ে দাও গো সুন্দর চাচ্চু। বাবাকে আর মে*রো না। মা*র*লে যে অনেক ব্য*থা লাগে। খুব য*ন্ত্র*ণা করে। বাবাকে আর য*ন্ত্র*ণা দিও না গো সুন্দর চাচ্চু। ও সুন্দর চাচ্চী তোমার এই মানুষটাকে বলো না বাবাকে যেনো আর না মা*রে।”

রাসেল ও ওর বোনের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো…
—“মে*রো না গো বাবাকে। উনি আমাদের জন্ম দিয়েছেন। ভালো হোক কিংবা খা*রা*প বাবা হিসেবে তো ওনাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ওনার আদর-স্নেহ পাওয়ার মতো এতো ভালো ভাগ্য নিয়ে আমরা দু’জনের কেউই এই পৃথিবীতে আসতে পারি নি। তাই নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি আমরা। এখন বাবা আমাদের যতোই আ*ঘা*ত করুক না কেনো আমাদের আর ততোটা ক*ষ্ট হয় না।”

ছোট্ট মেয়ে ঝর্ণা আর ছেলে রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে কুশল ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দু’জনকেই একপলক দেখে নেয়। মফিজুরও অবাক নয়নে নিজের মেয়ে ও ছেলের দিকে তাকায়। মফিজুর মনে মনে হয়তো ভাবছে….

—“জন্মের পর থেকে যাদের আমি একটাবারের জন্য নিজের কোলে বসিয়ে আদর করি নি৷ উঠতে-বসতে, কোনো কারণ ছাড়াই যাদের শরীরে আ*ঘা*তের পর আ*ঘা*ত দিয়েছি। পঁ*চা-বা*সি খাবার ছাড়া একবেলা টাটকা ভালো খাবার খেতে দেই নি আজ সেই ছেলে-মেয়েরাই আমাকে মা*র খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে অনুরোধ করছে! আমার য*ন্ত্র*ণা ওরা সহ্য করতে পারছে না! আমার প্রতি ওদের ঘৃ*ণা, রা*গ হওয়ার জায়গায় স্নেহ মায়া কাজ করছে! ওদের ছোট্ট মনটাকে আমি আ*ঘা*ত করতে করতে বিঁ-ষি*য়ে দিতে পারি নি!”

কুশলের কথায় মফিজুরের ভাবনায় ছে*দ ঘটে। কুশল বললো….
—“থু*তু ফেল এখন নিজের উপর। তোর মতো কা*পুরুষের ঘরে জান্নাতের দু’টো নূর জন্ম নিয়েছে দেখে ভিষণ আ*ফ*সো*স হচ্ছে আমার। তুই তো ওদের বাবা হওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখিস না। থু*তু দে নিজের উপর, থু*তু।”

কুশলের বলা কথাগুলো শুনে মফিজুর লজ্জায় মাথানত করে ফেলে। অনুশোচনার আ*গু*নে দ*গ্ধ হয়ে যাচ্ছে এখন সে। নিজের অজান্তেই মফিজুরের চোখযুগল থেকে নোনাজল পড়তে শুরু করে। কুশল ওর রি*ভ*ল*বারটা পুনরায় পকেটে ভরে নেয়। বেশকিছুসময় ধরে ওদের চারপাশ জুড়ে ঝিঁঝি পো*কা*র ও পেঁ*চা*র ডাক ছাড়া কোনো মানবের শব্দ শোনা যায় না। সেইসময় রাসেল নিজের বুকের ভিতর সাহস সন্ঞ্চয় করে ওর বাবা মফিজুরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো…

—“বা-বাবা, বাড়িতে ফিরবে না! মেলা রাইত হইয়া গেলো যে। এখনও না ফিরলে মায় আবার তোমাকে ঝা*র*বো। আমাদের জন্য তুমি মায়ের ঝা*রি খাইবা তা তো হয় না কও!”

রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শোনামাত্র মফিজুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ছোট্ট শিশু রাসেলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে দেয়। এই ১ম নিজেকে নিজের বাবার বুকের সাথে আ*ষ্টে*পৃ*ষ্টে জড়িয়ে থাকতে দেখে রাসেল খুশি হবে নাকি নিজের বাবাকে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখে তাকে শান্তনা দিবে তা বুঝে উঠতে পারছে না রাসেল। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে ঝর্ণার ভ*য় ও কে*টে যায়। সে তরুর পিছন থেকে সরে সামনে এসে দাড়িয়ে ওদের বাবা-ছেলের উপর দৃষ্টি স্থির করে। সেইসময় মফিজুর নিজের আরেকহাত মেলে ধরে ইশারায় ঝর্ণাকে নিজের বুকে আসতে বলে। ঝর্ণা একপলক তরু আর কুশলের মুখের দিকে তাকায় ওরা দু’জন ও ঝর্ণাকে ওর বাবার কাছে যেতে বললে ঝর্ণা এক ছুটে ওর বাবার বুকের উপর হা*ম*লে পড়ে। মফিজুর দু’হাতে নিজের দুই ছেলে-মেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন….

—“এই অ*ধ*ম বাপটাকে ক্ষমা কইরা দে তোরা। তগো আমি অনেক ক*ষ্ট দিছি। বা’জান, আম্মা’জান আমার কলিজা টুকরা তোদের মূল্য আমি এতো কাল বুঝি নাই।আমি আর কখনও তোদের শরীরে এক চুল পরিমাণও আ*ঘা*ত করবো না কথা দিলাম আজ থাইকা। সবসময় তগো যত্নে যত্নে রাখবো৷ তগো সৎ মায়ের বা*র*ন্ত স্বভাও ও আমি ছু*টা*ই*য়া দিমু। হেয়ের লাইগাই আমি তগো সাথে মেলা অ*ন্যা*য় কইরা ফেলছি। নিজের র*ক্ত*কে আ*ঘা*ত করে পরনারীর কথা মাইনা চলছি। আজ থাইকা আর এসব হইবো না। তগো তিনবেলাই ভালো খাবার খাইতে দিবো আমি। আমার চোখ খুলে দিয়েছিস তোরা।”

মফিজুরকে নিজের ভু*ল বুঝে নিজের ছেলে-মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের আপন করে নিতে দেখে তরু আর কুশলের মুখশ্রী জুড়ে তৃপ্তিদায়ক খুশির ছাপ ফুটে উঠে। পরমুহূর্তেই কুশল একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরস্বরে বললো….

—“জীবনের এই ২৮ বছর বয়সে এসে দাঁড়িয়ে কখনও নিজের বাবাকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে মন হালকা করতে পারলাম না। কো*মা*য় থাকার পূর্বের সময়ে কখনও বাবা আমাকে এভাবে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে আদর করেছিলেন কিনা, আমার জন্মদায়িনী অ*ভা*গি*নী মা আমাকে স্নেহ-মমতা দিয়েছিলেন কিনা সেসবের কিছুই মনে নেই। এতোটাই নি*র্ম*ম ভাগ্যের অধিকারী আমি যে নিজের জন্মদায়িনী মায়ের মুখশ্রী পর্যন্ত আমার স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে! প্রকৃত ও মি*থ্যে সম্পর্কগুলোর মাঝের তফাৎগুলো আজ চোখের সামনে স্বচ্ছ পানির মতো ভাসছে। যারা আমার মায়ের খু*নি, যারা বাবার জীবন থেকে ২০ টা বছর যারা কে*ড়ে নিয়েছে, যারা আমার স্মৃতি থেকে আমার জন্মদায়িনী মায়ের মুখশ্রীটুকুও মুছে ফেলেছে তাদেরই কিনা গত ২০টা বছর ধরে নিজের মা-বাবা, চাচা-চাচী বলে সম্বোধন করে এসেছি! এসব ভেবেই ক*ষ্টে, ঘৃ*ণা*য় আমার সর্বশরীর রি রি করে উঠছে তরুনিমা।”

কুশলের কথাগুলো শুনে তরুনিমা কোনো প্রতিত্তুর করার ভাষা খুঁজে পায় না। কুশলের ডান হাত নিজের দু’হাত দ্বারা জড়িয়ে ওর কাধের উপর মাথা রাখে। বেশকিছুসময় পর ঝর্না আর রাসেল মফিজুরের বুক থেকে মাথা তুলে তার সামনে সোজা হয়ে দাড়ায়। অতঃপর ঝর্ণা ওর বাম হাত দিয়ে আর রাসেল ও ডান হাত দিয়ে মফিজুরের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনাজলে ভিজে থাকা গালদ্বয় যত্নসহকারে মুছে দেয়। ওদের তিন জনের মুখশ্রী জুড়েই ফুটে আছে আনন্দের ছাপ। পরক্ষণেই ঝর্ণা তরুর সামনে আর রাসেল কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকায়। মফিজুর বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঝর্ণা ওর মিষ্টি কন্ঠে বললো….

—“সুন্দর চাচ্চী… জানো! তুমি আর সুন্দর চাচ্চু দু’জনেই অনেক ভালো।”

এই বলে ঝর্ণা তরুর পেট জড়িয়ে ধরে তরু হাসি দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাসেল বললো….

—“আপনাদের জন্য আজ আমরা আমাদের বাবাকে প্রকৃত বাবার রূপে ফিরে পেলাম। আপনাদের জন্য আমি আর আমার বোন বাবার আদর কতোটা মধুর হতে পারে তার স্বাদ অনুভব করতে পারলাম। বোন ঠিকই বলেছে আপনারা দু’জনের অনেক অনেক ভালো।”

এই বলে রাসেল ও কুশলের পেটের উপরের অংশ জড়িয়ে ধরে। মফিজুর বললো….

—“আপনেদের কারণে আমি আমার ভু*ল গুলো শুধরাইয়া নিতে পারছি। আপনেরা আমার পা*পে*র বোঝা কমাইয়া দিয়েছেন। তাই এই অ*ধ*ম গরীবের বাড়ির ভিটায় পা রেখে যদি আপনেরা দু’মুঠো খাবার খাইতেন তয় নিজেরে মেলা ধইন্ন মনে করতাম সাহেব।”

রাসেল আর ঝর্ণা তরু ও কুশলের পাশে দাড়িয়ে একস্বরে বললো….
—“হুম..হুম..চলো না গো আমাদের বাড়িতে তোমরা। তাহলে আমরা অনেক খুশি হবো।”

বাচ্চাদের এই আবদার ফেলার শক্তি কুশল বা তরু কেওই করে উঠতে পারলো না। ওরা দু’জন একে-অপরের দিকে একপলক দেখে বললো….

—“ঠিক আছে যাবো আমরা।”

ঝর্ণা বললো….
—“সুন্দর চাচ্চু..! তোমার কাছে একটা যন্ত্রটা আছে না? ঐ তো যেটা দিয়ে তুমি বাবা ভ*য় দেখালে! ওটা আমাকে দিয়ে যাবে!”

ছোট্ট ঝর্ণার মুখে এরূপ কথা শুনে ওরা ৪জন অনেক অবাক হয়। কুশল ঝর্ণার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো…
—“ঐ যন্ত্রটা দিয়ে তো খেলা করা যায় না মা। আমি তোমাকে ঐ যন্ত্রটা তো দিতে পারবো না কিন্তু ঐ যন্ত্রের মতো একটা খেলনা যন্ত্র দিতে পারবো। সেটা দিয়ে তুমি খেলো কেমন!”

ঝর্ণা বললো….
—“খেলার জন্য তো লাগবে না আমার।”

—“তাহলে কি জন্য চাইছো শুনি!”

ঝর্ণা একপলক ওর বাবা আর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবারও কুশলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বললো….

—“আমাদের বাড়িতে একজন কু*চু*টে বুড়ি আছে। ঐ বুড়িটা আমার বাবাকে সবসময় ঝা*রি*র উপর রাখে জানো! আমাকে আর ভাইয়াকে দিয়ে সব ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। একটু ভু*ল হলে বাবার কাছে উল্টোপাল্টা বলে আমাদের প্রতিদিন মা*র খাইয়ে নেয়। তোমার ঐ যন্ত্রটা দিয়ে তুমি যেমন বাবাকে ভ*য় দেখিয়ে ভালো বাবা বানিয়ে দিলে তেমনি আমিও ঐ যন্ত্রটা দিয়ে ঐ কু*চু*টে বুড়িকে ভ*য় দেখিয়ে ভালো মা বানিয়ে দিবো।”

ছোট্ট মেয়ে ঝর্ণার মুখে এতো গোছালো কথাগুলো শুনে কুশল আর তরু বেশ অবাক হয়। মফিজুর কিছুটা লজ্জা বোধ করে মাথা নিচু করে ফেলে। পরক্ষণেই কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“তোমাকে কিছুই করতে হবে না পাকনি বুড়ি। তুমি আর তোমার ভাইয়া যেনো এখন সনসময় ভালো থাকতে পারো তার সব ব্যবস্থা করে তবেই আমি আর তোমার ভালো চাচ্চী খা*ন্ত হবো।”

ঝর্ণা অনেক খুশি হয়ে কুশলের গালে একটা চুমু দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। কুশল হাসি দিয়ে ঝর্ণাকে নিজের কোলে রাখাবস্থাতেই উঠে দাড়ায়। তরু মফিজুরকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“চলুন তাহলে আপনাদের বাড়িতে যাওয়া যাক। রাসেল বাবা…আমার কাছে এসো আমার হাত ধরো।”

তরুর ডাক শোনামাত্র রাসেল খুশিমনে তরুর হাতের বামপার্শে এসে দাঁড়িয়ে ওর বাম হাত শক্ত করে ধরে। অতঃপর ওরা মফিজুরের সাথে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৩০)
কুশল ও তরু, ঝর্ণা-রাসেল আর মফিজুরের সাথে ওদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিলো। বেশ কিছুসময় পর ওরা সকলেই সঠিক গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। মফিজুর ওর বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে ওদের উদ্দেশ্য করে বললো….

—“সাহেব-ম্যম কিছু মনে কইরেন না। আপনেরা কিছুক্ষণ এইখানেই দাঁড়াইয়া থাকেন। আমি ঝর্ণা আর রাসেলকে নিয়া বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে দেখি বাড়ির কি অবস্থা।”

তরু কিছু বলতে নিবে সেইসময় কুশল তরুর হাত ধরে ওকে থামিয়ে দেয়। মফিজুর একবার লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে টিনের দরজাটা ঠেলে খুলে ঝর্ণা আর রাসেলকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। কয়েকসেকেন্ড পুরো পরিবেশে পিন-প*ত*ন নিরবতা বিরাজ করে। পরমুহূর্তেই বাড়ির ভিতর থেকে একজন মহিলার রূ*ক্ষ্ণ-রাগী কন্ঠে বলা কিছু কথা বাহির পর্যন্ত ভেসে আসে, যা কুশল-তরুর কানকে এড়োয় না। মহিলাটি বলছেন….

—“আগের বউটা যখন নিজে ম*র*ছিলো তখন নিজের সাথে এই আ*প*দ দুইটারে মা*ই*রা ফে*ল*তে পারে নি! প্রত্যেকদিন প্রত্যেকটা বেলা এই আ*প*দ দুইটার জন্য আমার সংসারে অ*শান্তি ছাড়া ভালা কিছুই হয় না। কি লো মু*খ*পুড়ি এতো কম বয়সেই নিজের লাইগা না*গ*র জুটানোর ধা*ন্দা*য় নাইমা পড়ছোস নাকি! আর নিজের ভাইটারে সাথে নিছোস কি লাইগা? রাইতের আন্ধারে তুই তোর নাগরের লগে রা*শ*লী*লা করবি আর তখন তোর এই দা*ম*ড়া ভাই পাহাড়া দিবো নাকি!”

মহিলাটি এরূপ কথা বলা মাত্র খুব জোড়ে একটা থা*প্প*ড়ে*র শব্দ ভেসে আসে। তরু কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“ঝর্ণা-রাসেলকে আজকের পর আর মা*র খেতে হবে না এমনটাই তো বলেছিলেন আপনি! ওদের সৎ মা যে একজন ভিষণ খা*রা*প মানসিকতার মহিলা তা ওনার কথা গুলো শুনেই বোঝা শেষ হয়েছে আমার। একটু আগেই তো থা*প্প*ড়ের শব্দ শোনা গেলো, নিশ্চয়ই ঐ মহিলা ওদের শরীরে আবার আ*ঘা*ত করছে। আপনি ভিতরে চলুন। আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।”

তরুকে অস্থির হতে দেখে কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“শান্ত হও তরুনিমা। থা*প্প*ড়ে*র শব্দ ভিষণ জোড়ে হয়েছে। যদি এই থা*প্প*ড় ঐ মহিলা ঝর্ণা বা রাসেলকে দিতো তাহলে পুরো পরিবেশ এখন এতোটা নিরব হতে থাকতো না। মফিজুরকে তার নিজ দায়িত্ব এবার সঠিক ভাবে পালন করার সুযোগ দাও। আজ যদি মফিজুর নিজে ঐ মহিলাকে উচিত শিক্ষা না দেয় তাহলে বোঝা যাবে সে ঝর্ণা আর রাসেলকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। তখন যে পদক্ষেপ গ্রহন করা সঠিক হবে সেটাই গ্রহন করবো আমি। নিশ্চিন্ত থাকো।”

কুশলের এরূপ কথাগুলো শুনে তরু শান্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই ওরা ভিতর থেকে মফিজুরের বলা কথাগুলো শুনতে পারে আর এইসব শব্দ শুনে শুনেই পুরো পরিস্থিতিকে আন্দাজ করে নিতে শুরু করে ওরা। মফিজুরের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রয়োগ করা একটা থা*প্প*ড় খেয়েই মফিজুরের ২য় স্ত্রী রুমানা মাটির বারান্দা থেকে ছি*ট*কে আঙিনার উপর এসে পড়ে৷ থা*প্প*ড়ে*র বেগ এতোটাই জোড়ে ছিলো যে কিছুসময়ের জন্য রুমানার কান ও মাথা একসাথেই যেনো তালি লেগে গিয়েছিলো। রুমানার ঠোঁটের কোনায় দাঁত লেগে কে*টে গিয়ে র*ক্ত ঝরতেও শুরু করেছে। রুমানা নিজের ডান হাতের শাহাদত আঙুল ঠোঁটের সেই কাঁ*টা স্থানে স্পর্শ করতেই মুখ দিয়ে ‘আহহ’ শব্দ উচ্চারণ করে ঘাড় বাঁ*কি*য়ে মফিজুরের দিকে বললো….

—“তুমি আমাকে মা*র*লে?”

মফিজুর রাগী স্বরে বললো…
—“তোর মতো ঘৃ*নি*ত মানসিকতার মহিলাকে যে এখনও আমি জিবীত রেখেছি এটা ভেবেই তুই শুকুর আদায় কর।”

—“কি হলো তোমার এই টুকু সময়ের ভিতর বুঝতে তো পারছি না। একটু আগেই তো ওদের বাড়িতে দেখতে না পেয়ে ক্ষি*প্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলে। এই আ*প*দগুলো তোমার উপর কি এমন জাদু-টো*না করলো যে তুমি আমার শরীরে হাত উঠালে আর আমাকে এমন খা*রা*প কথা শুনাচ্ছো!”

মফিজুর রাগে রিরি করতে করতে রুমানার কাছে এসে ওর মাথার পিছনের অংশের চুলগুলো নিজের পাঁচ আঙুলের ভাঁ*জে নিয়ে ঝাঁ*কা*তে ঝাঁ*কা*তে বললো….

—“খবরদার…আর একবার যদি আমার ছেলে-মেয়েদের আ*প*দ বলে সম্বোধন করেছিস তাহলে এই হাত দিয়ে তোর মাথায় থাকা সব চুল আমি টে*নে টে*নে উ*প*রে ফেলবো। তোর এই নোং*রা মুখ বস্তা সেলাই করার মুরাল দিয়ে আজীবনের মতো সেলাই করে দিবো।”

মফিজুর এতোটাই জোরে জোরে রুমানার মাথার চুলগুলো টে*নে টে*নে কথা বলছে যে রুমানার মাথা য*ন্ত্র*ণা*য় ছিঁ*ড়ে আসছে যেনো। ওদের থেকে কিছুটা দূরে গুঁ*টি-সু*টি হয়ে রাসেলের একহাত ধরে দাড়িয়ে আছে ঝর্ণা। রুমানা আ*র্ত*না*দে*র স্বরে বললো…

—“আমার ভিষণ ব্য*থা লাগছে গো…ছাইড়া দাও আমারে।”

মফিজুর বললো…
—“সামান্য এইটুকু সময়ের ব্য*থা*ই সহ্য করতে পারছিস না! এতোগুলো বছর ধরে যে তোর উ*ষ্কা*নী মূলক কথাগুলো শুনে আমি আমার ঐ নিষ্পাপ ছোট ছেলে-মেয়ে দু’টোর শরীরে অগনিত আ*ঘা*ত করে এসেছিলাম ওরা সেগুলো কিভাবে সহ্য করেছে হ্যা! আজ তোরে মা*র*তে মা*র*তে আমি শেষ করে ফা*লা*মু। আর এতেই তোর উচিত শিক্ষা পাওয়া হইবো।”

এই বলে মফিজুর রুমানার চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বারান্দার পাশে থাকা কাঠ-খড়ির মাচা থেকে একটা কিছুটা মোটা ও আকারে লম্বা কাঠ হাতে উঠিয়ে নিয়ে আবার রুমানার দিকে তেঁ*ড়ে আসতে নিলে ঝর্ণা কিছু না ভেবে একছুটে ওর বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বসে তার একপা নিজের ছোট ছোট হাত জোড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে মি*ন*তি*র স্বরে বললো….

—“মা*ই*রো না বাবা…এই লাঠি খান দিয়া মা*র*লে ভালো মা ম*ই*রা যাইবো। এহন থাইকা কেও কাওরে আর মা*রা চলবো না বাবা। আমরা একলগে মিলেমিশে থাকবার চাই৷ দোহাই বাবা…মা*ই*রো না তুমি ভালো মায়েরে। তারে বরং বুঝাইয়া কও, দেখবা ভালো মা ঠিক বুঝবো। আমাগো উপর আর কোনো অ*ত্যা*চা*র করবো না কখনও।”

ঝর্ণাকে এভাবে নিজের বাবার পায়ে পড়ে না মা*রা*র জন্য মি*ন*তি করতে দেখে রুমানা যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সে মনে মনে হয়তো ভাবছে….

—“যে বাচ্চা মেয়েটাকে একটু আগেও আমি অনেক বা*জে ভা*ষা*য় কথা শুনাইলাম। তার চরিত্রে পর্যন্ত ক*ল*ঙ্কে*র দা*গ লাগানোর চেষ্টা করলাম। এতো গুলো বছর ধরে দিন নাই রাত নাই খা*রা*প ব্যবহার আর অ*ত্যা*চা*র করে আসলাম আজ কিনা সেই মেয়েটাই আমাকে মা*রে*র হাত থেকে বাঁচাতো তার বাপের পা ধইরা মি*ন*তি করতেছে!”

মফিজুরের কন্ঠে ভেসে আসা কথা রুমানার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই সে ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে। মফিজুর উচ্চস্বরে রুমানাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“দেখ.. ভালো করে দেখ এই দৃশ্য। যে তুই এ বাড়িতে পা রাখার পর থেকে একটা বেলা এই মাসুম বাচ্চাগুলোকে শান্তিতে থাকতে দিস না আজ সেই মাসুম বাচ্চাই তোকে বাঁচানোর জন্য আমার পা ধরে মি*ন*তি করছে। তোর মন ও মস্তিষ্কের উপর থাকা নি*কৃ*ষ্ট মানসিকতার কালো চাদরটা সরিয়ে ফেল। আর তওবা পাঠ কর৷ নিজের এ যাবতে করে আসা সকল পা*প কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভি*ক্ষা চা। আর এই নিষ্পাপ শিশু দু’টোকে অমানুষের মতো অ*ত্যা*চা*র করার ষ*ড়*য*ন্ত্র করে আসার জন্য ওদের থেকেও ক্ষমা চেয়ে নে। আর কখনও ওদের কোনোরূপ ক*ষ্ট যদি দিয়েছিস তাহলে আজ যেই জীবন তুই ভি*ক্ষা পাইলি এরপর আর তা পাবি না। এরপর এই দুনিয়ার কোনো শক্তি তোকে আমার হাতে খু*ন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে না। এই কথা নিজের মাথার ভিতর খুব ভালো করে ঢুকিয়ে নে।”

রুমানা ওর নিজের করা ভু*ল গুলোর জন্য ইতিমধ্যেই অনুতপ্ত বোধ করতে শুরু করেছে। বেশ কিছুসময় পেরিয়ে যায়। রুমানা মাথানিচু করে রেখে ওভাবেই বসে আছে আঙিনায়। মফিজুর জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগকে অনেকটাই কন্ট্রোলে এনেছে। ঝর্ণা মফিজুরের বাম পায়ের পাশে নিজের দুই হাঁটু একত্র করে তারউপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে রুমানার উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। পরক্ষণেই রুমানা কাঁদতে কাঁদতে নিজের দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরে বললো….

—“বুকে আমার মানিকরা! আয় বুকে আয়!”

ঝর্ণা আর রাসেল রুমানার ডাক শুনে ওদের বাবা মফিজুরের দিকে তাকায়। মফিজুর স্মিত হেসে ইশারা করলেন রুমানার কাছে যাওয়ার জন্য। মফিজুরের ইশারা বুঝতে পেরে রাসেল আর ঝর্ণা আর ২য় কিছু না ভেবে যে যেখানে যে অবস্থায় বসে বা দাঁড়িয়ে ছিলো না কেনো সেখান থেকেই এক ছুটে রুমানার বুকের উপর হা*ম*লে পড়ে। রুমানা দু’হাতে ওদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ওদের থেকে ক্ষ*মা চায়। আর কখনও ওদের সাথে কোনরূপ খা*রা*প আচারণ করবে না। ওদের কখনও ক*ষ্ট পেতে দিবে না, মায়ের আদর-স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবে সবসময় এইসব বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পরিস্থিতি শিথিল হয়েছে দেখে মফিজুর হাসিমুখে মূল দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে কুশল আর তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“সাহেব-ম্যম আপনেরা এখন ভিতরে আসুন। আমাদের পারিবারিক যা ঝামেলা ছিলো সব মিটাইয়া নিছি আমরা। এখন আর কোনো স*ম*স্যা হইবো না। আসেন ভিতরে আসেন।”

মফিজুরের এরূপ কথা শুনে তরু কিছুটা অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হয়। কুশল তরুর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বললো….

—“ভিতরে যাওয়া যাক তাহলে।”

কুশলের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখে তরুর ঠোঁটেও হাসির রেখে ফুটে উঠে। অতঃপর ওরা দু’জনে একসাথে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। আঙিনার উপর দু’হাটু ভাজ করে বসে ঝর্ণাকে নিজের এক পায়ের উপর বসিয়ে রেখেছে রুমানা। আর রাসেল অন্যপাশে বসে আছে। সেইসময় কুশল আর তরুকে মূল গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে রুমানা নিজের মুখশ্রী জুড়ে কিছুটা অবাক ভাব স্পষ্ট রেখে ওদের দিকে তাকায়। ঝর্ণা রুমানার কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একছুটে তরুর কাছে গিয়ে তার পেট জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললো….

—“সুন্দর চাচ্চু-সুন্দর চাচ্চী..! আমাদের মা এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখন থেকে আর মা*র*বেন না, আমাদের অনেক অনেক আদর-যত্ন করবেন বলে প্রতিজ্ঞাও করেছেন। তোমার ঐ যন্ত্রটা আমার আর লাগবে না গো সুন্দর চাচ্চু।”

তরু ঝর্ণার কথা শুনে হাসিমুখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মফিজুর বললো….

—“রুমানা…আজ আমার আর তোমার ভু*ল ভা*ঙা*নোর পিছনে সবথেকে বড় অবদান যারা রেখেছেন তারা হলেন এই সাহেব আর ম্যম। আজ ওনাদের সম্মুখীন যদি না হতাম তাহলে হয়তো কখনও আমাদের ভু*ল গুলো আমাদের চোখে ধরা পড়তো না। আর আমরা আজীবন এই নিষ্পাপ শিশু দু’টোকে অ*মানুষের মতো অ*ত্যা*চা*র করে যেতাম। তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ও কোনো মুখ আমাদের থাকতো না।”

তরু বললো….
—“ছি: ছি: এভাবে বলে আমাদের লজ্জায় ফেলবেন না। আপনারা আপনাদের ভু*লগুলো বুঝতে পেরেছেন বাচ্চা দু’টোকে আপন করে নিয়েছেন এটা দেখেই আমাদের মনে ভিষণ শান্তি কাজ করছে৷”

মফিজুর হাসিমুখে রুমানাকে বললো….
—“কি গো..এখনও ঐখানে বইসা রইছো যে! যাও রান্নাঘরে যাও। ভালো ভালো কিছু খাবার রান্না করবো। সাহেব আর ম্যম কি না খাইয়া আমাদের বাড়ি ছাড়বো নাকি!”

রুমানা বললো….
—“এ মা…না..না..কি যে বলো তুমি! আমি এক্ষুণি যাচ্ছি রান্নার ব্যবস্থা করতে।”

এই বলে রুমানা আঙিনা থেকে উঠে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যান। মফিজুর বললো….

—“ঝর্ণা-রাসেল যাও সাহেব-ম্যমরে ঘরের ভিতরে নিয়া যাইয়া বসতে দাও। আমার একটু বাহির যাওন লাগবো। আইসা পড়মু একটু পরই আবার।”

এই বলে মফিজুর বাহিরে চলে যায়। ঝর্ণা আর রাসেল তরু ও কুশলকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৩১)
মফিজুরের রুমে বিছানার উপর কুশল আর তরু বসে আছে। ঝর্ণা তরুর পাশে বসে আছে। সেইসময় ওদের পাশের রুম থেকে কারোর কাশির শব্দ ভেসে আসলে তরু শান্ত স্বরে ঝর্ণাকে প্রশ্ন করলো….

—“ঐ রুমেই কি তোমার দাদু আছেন ঝর্ণা?”

ঝর্ণা উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়। তরু আবারও বললো….

—“তোমার ভাইয়াকে ডেকে আনো তো একটু, বলবে আমি ডাকছি।”

—“আচ্ছা সুন্দর চাচ্চী।”

এই বলে ঝর্ণা এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিয়ে বাহিরে চলে যায়। কুশল বললো….

—“হঠাৎ রাসেলকে ডাকতে বললে যে!”

—“আমাদের ওদের দাদুর সাথে কথা বলা উচিত। ঐ স্কুলের পাশে থাকা বট গাছটির রহস্য এখনও আমাদের সামনে খো*লা*শা হয় নি। ঐ রহস্য জানার জন্য আমার মন ভিষণ খ*চ*খ*চ করছে কুশল। তাই এই মূহূর্তে ওদের দাদুর সাথে কথা বলা যাবে কিনা তা জানতেই রাসলকে ডাকতে বললাম৷”

তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে কুশল একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললো। পরক্ষণেই রাসেল আর ঝর্ণা একসাথে রুমের ভিতর প্রবেশ করার পরপরই তরু ওদের দাদু মুজাহিদ সাহেবের সাথে কথা বলার বিষয়টা রাসেলকে বললে রাসেল বললো….

—“আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি আমরা ঘরের এই হাতাগোণা ৪জন মানুষ ব্যতিত দাদু বাহিরের কারোর সাথে কথা বলতে চানই না। যদি বাহিরের কেও তার সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে আসতেন তাহলে তাদের সাথে অকারণেই উগ্র আচারণ করতেন। তবুও আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপনাদের সাথে বলতেও পারেন।”

রাসেলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে তরু কুশলের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো….
—“চলুন একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।”

—“হুম চলো।”

তরু আর কুশল দু’জনেই বিছানা থেকে নেমে একসাথে ঝর্ণার দাদু মুজাহিদ সাহেবের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।

(১৩২)
হসপিটালের মূল দরজার পাশে নিজ গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে তাহির। তাহিরের পাশেই জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে হুমায়রা। তাহির নিজের সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো….

—“ঐদিকে ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? ডাক্তার. নিলয়কে এখানে রেখে আমার সাথে চলে যাওয়ার জন্য মন মানছে না তাই তো!”

তাহিরের এমন বাঁকা ভাষায় বলা কথাগুলো শুনে হুমায়রা তাহিরের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রাখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পরক্ষণেই কোনো প্রতিত্তুর না করে সোজা হয়ে বসে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় সে। তাহির ও আর কিছু না বলে গাড়ি স্টাট করে। গাড়ি চলে থাকে তার গতিতে তালুকদার ভিলার উদ্দেশ্যে। বেশ লম্বা সময় ধরে গাড়ি চলছে। গাড়ির ভিতর পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তাহির ঘাড় বাঁকিয়ে হুমায়রার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে সে ঘুমিয়ে গিয়েছে। জানালা খোলা থাকায় শীতল হাওয়া এসে হুমায়রার আলসে ছোট চুলগুলো ওর চোখ, নাক এর উপর ফেলে রেখেছে। তাহির ওর বামহাত এগিয়ে দিয়ে হুমায়রার চোখ ও নাকের উপর এসে পড়ে থাকা চুলগুলো খুব যত্নসহকারে সরিয়ে ওর কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। এরপর হালকা পাওয়ারে এ.সি অন করে দেয়। তাহির গাড়ি চালাতে চালাতে বললো….

—“জানি না আমি বুঝতে পারছি না আমার হয়েছে টা কি! তোর পুরো অধিকার আছে তুই যেকোনো ছেলের সাথেই মিশতে পারিস কথা বলতে পারিস যা খুশি করতে পারিস। কিন্তু তুই যখন ঐ ডাক্তার নিলয়ের বাহুডোরে আবব্ধ ছিলি! ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলি তখন আমার বুকের ভিতরটা যেনো হিংসার আগুনে জ্ব*লে পু*ড়ে খাঁ*ক হয়ে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো ঐ ডাক্তারকে ওখানেই মাটির নিচে পুঁ*তে ফেলি। তোর উপর ও ভিষণ ভিষণ রাগ লাগছিলো। তাই তোর সাথেও যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছি। উল্টো-পাল্টা কথা শুনিয়ে ফেলেছি। আর এসব আমি কেনো করছি! তার কারণ কি! তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তোর এই ঘুমন্ত মায়া মাখানো মুখশ্রী আমাকে কেও তোর দিকে এতো টানে! এতো এতো প্রশ্নের উত্তর আসলে কি আমি জানি না। আমাকে ক্ষমা করে দিস হিমু।”

(১৩৩)
কুশল আর তরু মুজাহিদ সাহেবের রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে মেঝের উপর একটা চাটাই বিছানো তার উপর পাতলা একটা তোশক রাখা। সেই তোশকের উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ৬০+ বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তি মুজাহিদ সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। একটু পর পরই খুক খুক খুক খুক করে কাঁশি দিচ্ছেন। ঝর্ণা ওর দাদুর মাথার কাছে গিয়ে বসে ওর দাদুর কপালের উপর হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে হাসি মুখে ঝর্ণার দিকে তাকালেন। ঝর্ণা বললো….

—“দাদু..দাদু..তোমার সাথে ঐ যে দাড়ানো সুন্দর চাচ্চু আর সুন্দর চাচ্চী স্কুলের পাশে থাকা বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন দেখো…!”

ঝর্ণার মুখে এরূপ কথা শোনা মাত্র মুজাহিদ সাহেব থ*ম*কা*নো দৃষ্টি নিয়ে কুশল আর তরুর দিকে তাকায়। তার মুখশ্রী জুড়ে চি*ন্তা আর ভ*য়ে*র ছাপ স্পষ্ট হয়। পরক্ষণেই তরু কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মুজাহিদ সাহেব উচ্চস্বরে রাগ নিয়ে বললেন….

—“চলে যান…এইমূহূর্তে এখান থেকে চলে যান আপনারা…আমি আপনাদের সাথে কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে চাহ না। বেড়িয়ে যান আমার ঘর থেকে। দ্রুত…!”

ওনাকে এতো বেশি উত্তেজিত হতে দেখে কুশল, তরু সহ ঝর্ণা-রাসেল ও অনেক অবাক হয়। মুজাহিদ সাহেব তরু বা কুশলকে কোনো কথা বলার সুযোগ ই দিচ্ছেন না।অনরগল ভাবে একটা কথাই বলে যাচ্ছেন যে তিনি ওদের সাথে কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে চান না। কুশল আর তরু যেনো এখান থেকে চলে যায়। কুশল শান্ত স্বরে তরুকে বললো….

—“আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত তরুনিমা। যেহেতু উনি আমাদের সাথে কোনো রূপ কথা বলতে চান না তাই ওনার শারিরীক অবস্থার কথা চিন্তা করে কথা বলার জন্য কোনোরূপ জোর না করাই সঠিক হবে।”

তরু মুখ মলিন করে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিবেন কুশল। আপনার মায়ের কবর খুঁজে পাওয়ার শেষ আশার আলো আমি আপনার মনে জাগিয়ে দিয়ে তা কাজে লাগাতে না পেরে আপনার ক*ষ্টে*র পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলাম।”

কুশল তরুর কথা শুনে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…
—“চলো..যাওয়া যাক।”

এই বলে কুশল আর তরু মুজাহিদ সাহেবের রুম থেকে বের হতেই ভিতর থেকে ঝর্ণার ‘দাদুউউউ’ বলে চি*ৎ*কার করার আওয়াজ ভেসে আসে। কুশল আর তরু আবারও তড়িৎগতিতে রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখেন মুজাহিদ সাহেব কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। কুশল দ্রুত তার কাছে গিয়ে ঝর্ণাকে তরুর কাছে দেয়। অতঃপর মুজাহিদ সাহেবের বাম হাতের কবজি ধরে পালসের গতি চেক করে বললো….

—“পালস খুব ধীর গতিতে চলছে। রাসেল দ্রুত একটা ছোট ধা*রা*লো ছু*ড়ি এনে দাও আমায়।”

কুশলের কথা শোনামাত্র রাসেল দৌড়ে ওর দাদুর রুম থেকে বের হয়। কুশল মুজাহিদ সাহেবের বুকের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে ওনার ফতুয়ার বোতাম গুলো খুলে ফেলে। এরপর নিজের দু-হাত একত্র করে বিসমিল্লাহ বলে ওনার বুকের উপর হালকা ও জোড়ে দুই ভাবেই চা*প দিতে শুরু করেন। পরপরই রাসেল একটা ছোটো ছু*রি এনে কুশলকে দিলে কুশল ছু*রি*টা নিয়ে মুজাহিদ সাহেবের বুকের বামপাশে ছোট্ট করে একটা ছিদ্র করে দিয়ে আবারও তার বুকের উপর হাত দিয়ে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। পরক্ষণেই মুজাহিদ সাহেব খুব জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে কাশতে শুরু করেন। কুশল এবার ওনার পালস চেক করে দেখে এখন স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। তরু অবাক ও মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে। কুশল ওর পাশে থাকা ছোট কাঠের জলচৌকির উপর রাখা মাটির কলসী থেকে অল্পপরিমাণে পানি গ্লাসে নিয়ে মুজাহিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…

—“পানিটুকু খেয়ে নিন ভালো লাগবে।”

তিনিও বিনাবাক্যে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে বললো…

—“আমি গাড়ি থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আসছি। ওনার কা*টা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিতে হবে।”

এই বলে কুশল রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ঝর্ণা তরুর কাছ থেকে সরে ওর দাদুর পাশে গিয়ে বসে বললো….

—“জানো দাদু…সুন্দর চাচ্চু জাদু করে তোমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন। সুন্দর চাচ্চু আর সুন্দর চাচ্চী দু’জনেই খুব ভালো গো। ওনারা আমাদের বাবা-মাকে পুরোপুরি ভাবে বদলে দিয়েছেন। জানো দাদু…আজ প্রথম বাবা-মা দু’জনেই আমাকে আর ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ো নিয়ে আদর করেছিলেন। তুমি ওনাদের সাথে খা*রা*প ব্যবহার করো না গো। তাহলে আমি আর ভাইয়া দু’জনেই তোমার উপর ভিষণ মন খারাপ করবো।”

ছোট্ট ঝর্ণার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে মুজাহিদ সাহেব অনুতপ্ততা ও অনুশোচনার দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন….

—“আমাকে ক্ষেমা কইরা দে মা.. না জাইনা, না বুইঝা তগো লগে খুব খা*রা*প ব্যবহার কইরা ফেলছি৷”

তরু বললো….
—“ছি:ছি: চাচা..আপনি এসব কি বলছেন! আপনার আমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আমাদের থেকে বয়সে যথেষ্ট বড়। তাই এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমাদের ল*জ্জি*ত করবেন না।”

তরুর কথা শেষ হতে না হতেই কুশল ফাস্ট এইড বক্স হাতে নিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করে মুজাহিদ সাহেবের পাশে এসে বসে ওনার বুকের বাম পার্শে ছু*রি দ্বারা ছি*দ্র করা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দেয়। মুজাহিদ সাহেব বললেন…

—“এই শেষ বয়সে আইসা আমার প্রাণ বাচাইয়া তোমাগো কাছে ঋণী কইরা দিলা বা’জান! এই ঋণ আমি কেমনে শো*ধ করতাম।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“একজন মানুষ হিসেবে নিজের সাধ্যের ভিতরে যতোটুকু করা সম্ভব হয়েছে আমি ততোটুকুই করেছি চাচা। প্রাণ দেওয়ার ও নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা৷ আমরা তো শুধু উছিলা।”

তরু বললো….
—“চাচা..যদি কিছু মনে না করেণ তাহলে আমাদের ঐ বিশাল বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার পিছনের আসল কারণ টা বলবেন!”

তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে মুজাহিদ সাহেব একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন….

—“ঐ বটগাছের গোড়ায় প্রতিদিন পানি দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ আছে তা হলো আমার করা মহা পা*পে*র বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করা।”

তরু অবাক স্বরে বললো….
—“মহা পা*প..! মানে টা ঠিক বুঝলাম না চাচা।”

—“এখন যেই জমির উপর স্কুল আছে ঐ জমির মালিক যিনি ছিলেন তার হয়ে ঐ জমিতে আমি চাষাবাদ করতাম।”

আজ থেকে ২০ বছর আগে বিকেলের সময়ে……..

জমিতে হাল বয়ার জন্য মুজাহিদ লাঙল নিয়ে যাচ্ছেন। কিছুসময় পর কাঙ্ক্ষিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে পরেন তিনি। মুজাহিদ সামনে লক্ষ্য করতেই দেখলেন ওনার জমির মালিক তৎকালীন সময়ের পাহাড়তলী গ্রামের মেম্বার জব্বার সাহেব একজন পুরুষ ও একজন মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। ওনাদের পাশেই মাটির উপর কাওকে শুইয়ে রাখা অবস্থায় দেখতে পেলেন মুজাহিদ। পরক্ষণেই লাঙল টা সেখানেই ফে*লে রেখে ওনাদের কাছে যেতেই দেখলেন যাকে মাটির উপর শুইয়া রাখা হয়েছে তিনি একজন মহিলা। যার সর্বশরীর র*ক্তে ভিজে একাকার অবস্থা হয়ে আছে। মুজাহিদকে দেখা মাত্র ঐ পুরুষ ও মহিলাটি ভরকে উঠলেন। জব্বার সাহেব মুজাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“মুজাহিদ…তুই যখন এখানে এসেই পড়েছিস তবে একটা কাজের কাজ করে দে।”

মুজাহিদ অবাক ও ভী*ত গ্রস্থ হয়ে বললেন….
—“মালিকা এনারা কেডা? আর এই মহিলাই বা কেডা? এনার এমন বা*জে অবস্থা হইলো কি করে? আপনেরা এইনে কি করতে আইছেন!”

মুজাহিদকে এতো প্রশ্ন করতে দেখলে অন্য পুরুষটি জব্বার সাহেবের হাত ধরে তাকে একটু সাইডে এনে বললেন….

—“দেখ জব্বার এটা অনেক সেন্সিটিভ বিষয়। আমি চাই না আমরা আর তুই ব্যতিত এই বিষয়ের কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী থাকুক। তাই এই ব্যডাকেও মে*রে এখানেই পুঁ*তে ফেলাটাই উত্তম হবে।”

জব্বার সাহেব বললেন….
—“একে মা*র*তে হবে না স্যার। এ আমার অনেক পুরোনো আর বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক। বহু বছর ধরে আমার জমিতে কামলা খে*টে নিজের রুজিরোজগার করছে। এর মুখ কিভাবে সারাজীবনের মতো বন্ধ করতে হয় তা আমার খুব ভালো ভাবেই জানা আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আর দেখুন আমি কি করি।”

—“যদি কোনো সমস্যা হয়েছে তবে এর ফল কিন্তু তোর জন্য হবে না সেটা ভালো ভাবে নিজের মাথার ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে যা করার কর।”

এই বলে পুরুষ লোকটি মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে মুজাহিদের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই জব্বার সাহেব মুজাহিদের কাছে এসে ওর হাত ধরে টেনে অন্যপাশে এনে দাঁড় করিয়ে বললেন…..

—“নিজের বউ-বাচ্চা, বাবা-মায়ের জীবন তোর কাছে কতোটা মূল্যবানরে মুজাহিদ!”

জব্বার সাহেবের মুখে এরূপ প্রশ্ন শুনে মুজাহিদ অবাক স্বরে বললো…
—“এ আপনি কেমন প্রশ্ন জিগাইতাছেন মালিক! আমাট বউ-বাচ্চা, বাবা-মায়ের পরাণের মূল্য আমার কাছে আমার পরাণের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান।”

—“তাহলে এখন একটা কথা নিজের মাথার ভিতর খুব ভালো ভাবে ঢুকিয়ে নে।”

—“কোন কথা মালিক!”

—“আজ এই মূহূর্তে দাড়িয়ে তুই এখানে যা যা দেখতাছিস তা ভুইলা যাবি। এখানে কি করা হইতাছে তা তুই ভুইলা যাবি। কারা উপস্থিত ছিলো এখানে তাদের তুই জীবনে কখোনই দেখিস নি এটা ভেবেই মুখে কু*লো মে*রে থাকবি আজীবন। যদি কখনও কারোর সামনে আজকের এই ঘটনার সামান্য তম কথাও মুখ ফ*স*কে বের করেছিস তাহলে তোর পুরো গুষ্টিকে আমি এই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিমু বইলা দিলাম।”

জব্বার সাহেবের শেষ কথা টুকু শোনামাত্র মুজাহিদ ভী*ত গ্রস্থ হয়ে দু’কদম পিছনের দিকে পিছিয়ে যান। মুজাদিহ ইতিমধ্যে এতোটুকু খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে যে আজ এখানে এনারা নিজেদের করা বড় পা*প ঢাকার পরিকল্পনা করছেন। মুজাহিদকে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জব্বার সাহেব আবারও বললেন….

—“এখন সং*য়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ঐ জায়গায় কবর খুঁ*ড়ে দে। এই লা*শটাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দা*ফ*ন করে ফেলতে হবে।”

জব্বারের এরূপ কথা শুনে মুজাহিদ মহিলাটির লা*শে*র উপর দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….

—“আজ কতো বড় পা*প এর বোঝার ভাগিদার আমাকে হতে হচ্ছে আমি জানি না। মালিকের কথা না মানলে যদি সত্যিই উনি আমার পরিবারের মানুষদের মে*রে ফেলেন তখন কি হবে!”

এসব নানান চিন্তাভাবনা করতে করতেই একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুজাহিদ ঐ পুরুষ ও মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে কো*দা*ল হাতে নিয়ে খু*ড়*তে শুরু করে। কিছুসময়ের মধ্যেই কবর খোঁ*ড়া*র কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর উনি ক*ব*রের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াতেই পুরুষ লোকটি মুজাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

—“লা*শ*টিকে উঠিয়ে দ্রুত দা*ফ*ন করে দে।”

মুজাহিদ পুরুষ মানুষটির দিকে একপলক দেখে জব্বারের দিকে একপলক দেখে। পরক্ষণেই মহিলাটির লা*শে*র পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….

—“আমারে মাফ কইরা দিয়েন আপামনি।”

এই বলে মুজাহিদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহিলাটিকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে কবর খোঁ*ড়া জায়গাটিতে শুইয়ে দিয়ে তার দাফনকার্য সম্পন্ন করে। মুজাহিদ মহিলাটির কবরের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। সেইসময় পুরুষ লোকটি মুজাহিদের পিছনের দাঁড়িয়ে ওর মাথার সামনের অংশের চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে ওর গলায় ধা*রা*লো একটা ছু*রি ঠেকিয়ে বললো….

—“নিজের ও নিজের পরিবারের সবার জীবন বাঁচানোর হলে নিজের মুখ আজীবনের জন্য ব*ন্ধ করে রাখিস। যদি ভুলেও কখনও আজকের এই বিষয় সম্পর্কে ৫ম কোনো ব্যক্তির কাছে তুই মুখ খুলিস তাহলে তোর আর তোর পরিবারের সবার পরিণতি ঠিক কতোটা ভ*য়া*ব*হ হবে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”

এই বলে লোকটি মুজাহিদের গলা থেকে ছু*রি*টি সরিয়ে ওকে ধা*ক্কা প্রয়োগ করে। মুজাহিদ মাটির উপর লু*টি*য়ে পরে। লোকটি জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“আজ থেকে এই জমিতে কোনো প্রকার চাষাবাদ হবে না। এই চা*ষা*কে চাষ করার জন্য অন্য কোনো জমি দিয়ে দিস জব্বার।”

এই বলে পুরুষ লোকটি উপস্থিত ঐ মহিলাকে নিয়ে স্থান ত্যগ করেন। জব্বার মুজাহিদকে একপলক দেখে সেও স্থান ত্যগ করে। মুজাহিদ মাটিতে পরে থাকা অবস্থাতেই নিরবে চোখের পানি ফেলতে শুরু করেছে৷

…..………………………….বর্তমান…………………………….

মুজাহিদ সাহেব তার অতীতের কথাগুলো বলতে বলতে চোখ থেকে নোনা জল ফেলছে। কিছুসময় নিরব থাকে পুরো পরিবেশ। মুজাহিদ সাহেব আবারও বললেন….

—“ওনাকে দা*ফ*ন দেওয়ার ১০ দিনের মাথায় গ্রামে ম*হা*মা*রী শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ছোঁ*য়া*চে রোগ কলেরা পাহাড়তলী গ্রামের এমন কোনো ঘর বাকি ছিলো না যে সে ঘরে প্রবেশ করে নি। চারদিকে একের পর এক মানুষের মৃ*ত্যু দেখা আর স্বজনদের আহাজারি শুনতে শুনতে সকাল থেকে রাত আর রাত থেকে সকাল হতে শুরু করলো। তখন পাহাড়তলী গ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিলো না, আর না ছিলো কোনো ভালো ডাক্তার বা চিকিৎসালয়। একমাসের মাথায় আমার স্ত্রী, আমার ২ছেলে, ১মেয়ে ও আমার বাবা-মা কলেরায় আ*ক্রা*ন্ত হয়ে মৃ*ত্যু বরন করেছিলেন। একে একে নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে মৃ*ত্যু*র কোলে ঢ*লে পড়তে দেখে কি যে কঠিণ য*ন্ত্র*ণা হয়েছিলো বুকের ভিতর সেসব মনে পড়লে আজও আমার বুকটা হাহাকার করে উঠে। পাহাড়তলী গ্রাম এর অর্ধেকের বেশি মানুষ সেবার মা*রা গিয়েছিলো। আমার পরিবার বলতে কেও ছিলো না এই পৃথিবী জুড়ে। যখন সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পরেছিলাম তখন আমার মনে অনুশোচনার আ*গু*ন দা*উ*দা*উ করে জ্ব*ল*ছিলো। ১মাস আগে আমি নিজের পরিবারের প্রা*ণ বাঁ*চা*নোর কথা চিন্তা করে অন্যদের করা পা*প*কে ঢাকার কাজে সহযোগিতা করেছিলাম আর সেই পা*পে*র ভাগিদার হওয়ার ফল হিসেবে আল্লাহ আমার থেকে আমার পুরো পরিবারকে একমুহূর্তের মধ্যেই কে*ড়ে নিলেন। পরবর্তীতে আমি যখন ঐ মহিলার ক*ব*রের কাছে গিয়েছিলাম তখন তার ক*ব*রের পাশে ১৫ বছর বয়সী একজন ছেলেকে সাদা চাদরে মোড়ানো আরেকজন নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলাম। বাচ্চাটির কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিলো। ছেলেটি অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাটির কান্না থামাতে পারে নি। চারপাশে তাকিয়ে আর কোনো মানুষের চিহ্ন আমি খুজে পাই নি। পরমূহূর্তেই আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলেছিলো, ‘তার নাম মফিজুর, কলেরায় তার বাবা-মা মা*রা যাওয়ায় তার চাচা-চাচী তাদের বাড়িভিটের সামান্য সম্পত্তিটুকু নিজেদের নামে লিখে নিয়ে তাদের বের করে দিয়েছে। অপরিচিত হওয়ায় গ্রামের কেওই তাদের আশ্রয় দেয় নি তাই ওরা এই মাঠে এসে বসেছে। ওদের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার ভিষণ মায়া কাজ করে। আমি বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই সে কান্না থামিয়ে দিয়েছিলো। তখন আমি ভেবে নিয়েছিলাম আমার মতো নিঃস্ব ব্যক্তিকে হয়তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই মাসুম শিশুটি ও তার ভাইকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব দিলেন। এরপর আমি মফিজুর আর সেই বাচ্চাটির ভরোণপোষণের দায়ভার নিজের উপর তুলে নেই । কিছুদিন পর আমি আবারও ওনার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম ওনার কবরের উপর থেকে থেকে কচি বটগাছের একটা চাড়া বের হয়েছে। এরপর থেকে রোজ ঐ বটগাছের গোড়ায় পানি দিতে যেতাম আমি। প্রতিদিন ওনার কাছে ক্ষ*মা চাইতাম। আর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন এই গাছের গোড়া আমি শুকিয়ে যেতে দিবো না।”

মুজাহিদ সাহেবের মুখে সম্পূর্ণ ঘটনাগুলো শুনে কুশল স্তব্দ হয়ে বসে আছে। তরু ওর ফোন থেকে কামিনী আর রিজভীর ছবি বের করে মুজাহিদ সাহেবের সামনে ফোনটা ধরে শান্ত স্বরে বললো…

—“চাচা..দেখুন তো একবার ভালো করে.. ঐদিনের ঐ পুরুষ আর মহিলাটি এনারা দু’জন ই ছিলেন কিনা!”

তরুর কথানুযায়ী মুজাহিদ সাহেব চোখ ছোট ছোট করে ফোনস্ক্রিণের থাকা কামিনী আর রিজভীর ছবি দেখে। কিছুসময় পর বললেন….

—“হুম..হুম…এরাই..এরা দু’জনেই উপস্থিত ছিলো সেদিন।”

মুজাহিদের মুখে এরূপ কথা শোনামাত্র তরুর আর বুঝতে বাকি রইলো না ঐ বট গাছের নিচেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কুশলের মা। তরু ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল কিছু না বলে বসাবস্থা থেকে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরুও কুশলের পিছন পিছন চলে যায়।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…………