#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৩৪)
স্কুলের পাশে থাকা সেই বটগাছের গোড়ায় মাটির উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কুশল। কুশলের পাশেই নিরব হয়ে বসে ওর উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে তরুনিমা। কিছুসময় পর কুশল শোয়াবস্থায় থাকাকালীনই গাছের চারপাশের মাটি ও ঘাসগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে আর ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“জানো তরুনিমা আমার মনে হচ্ছে আমি এই মাটির উপর শুয়ে নেই, আমি যেনো আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। এই ঘাস আর ভেজা মাটি থেকে যে গন্ধ আমার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে আমার শরীরের ভিতর পর্যন্ত যাচ্ছে! আমার মনে হচ্ছে আমি মা মা গন্ধ অনুভব করছি। মায়ের শরীরের গন্ধ বুঝি এমন মিষ্টি হয়! আমার মা তো এই এই মাটির নিচেই ঘুমিয়ে আছেন তাহলে এই মাটির সাথে তো আমার মায়ের শরীরের গন্ধও মিশে আছে বলো!”
তরুনিমা এইমূহূর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তরুনিমা হয়তো মনে মনে চিন্তা করছে….
—“যে মায়ের অস্তিত্ব তার স্মৃতি থেকে চিরতরের জন্য মুছে গিয়েছে সেই মায়ের জন্যই কতো টান, কতো মায়া, কতো কষ্ট অনুভব করছেন কুশল। সত্যিই নাড়ির টান কেও কখনও ছি*ন্ন করতে পারে না।”
(১৩৫)
হাসপাতালের বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসে মুখশ্রী জুড়ে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট রেখে মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে সন্ধ্যা। নিলাদ্র সন্ধ্যার সামনেই চেয়ারে বসে লম্বা সময় ধরে ওকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সেইসময় একজন নার্স ট্রে তে করে খাবার নিয়ে ওদের কেবিনে প্রবেশ করে। নিলাদ্রকে ওভাবে চেয়ারে বসে থাকতে আর সন্ধ্যাকে বেডের উপর বসে থাকতে দেখে নার্স কিছুটা কনফিউজড হয়ে গিয়েছেন হয়তো। নিলাদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে নার্সের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাত থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আপনার কি কিছু বলার আছে!”
নার্স নিলাদ্রের প্রশ্নে কি প্রতিত্তুর করবেন তা বুঝে উঠতে না পেরে তোতলানো স্বরে বললেন…
—“আ-আব-আ জ্বি না।”
—“কিন্তু আমার বলার আছে।”
—“জ্বি বলুন, স্যার।”
—“আমরা তো দু’জন মানুষ আছি এখানে তাই এই এক বাটি স্যুপ দিয়ে আমাদের হবে না। আপনি কাইন্ডলি আরেক বাটি স্যুপ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।”
সেইসময় সন্ধ্যা শান্ত স্বরে বললো….
—“যে এক বাটি স্যুপ এনেছেন উনি তা আপনি খেয়ে নিন। আমি খাবো না কিছু।”
নিলাদ্র নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“আপনাকে যেটা বললাম আপনি সেটা করুন।”
সন্ধ্যা আবারও কিছুটা তেজী স্বরে বললো….
—“বললাম তে আমি খাবো না। তাই আর আনার কোনো প্রয়োজন নেই।”
—“আপনাকে তো আনতে যেতে বললাম আমি।”
নার্সটি দ্বিধায় পড়ে বললো…
—“কিন্তু স্যার..ম্যম তো বলছেন উনি খাবেন না।”
নিলাদ্র চোখ রাঙিয়ে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স বললো….
—“জ-জ্বি-জ্বি স্যার…আমি এক্ষুণি আরেক বাটি স্যুপ নিয়ে আসছি।”
এই বলে নার্সটি কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। নিলাদ্র খাবারের ট্রে টা বিছানার এক পার্শে রাখে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো…
—“বললাম না আমি খাবো না…একটা কথা একবার বললে আপনি বুঝ…!”
সন্ধ্যা পুরো কথা শেষ করার আগেই নিলাদ্র সন্ধ্যার দুই ঠোঁটের মাঝ বরাবর নিজের ডান হাতের শাহাদাত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“খাওয়া নিয়ে মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ যদি বের করেছিস তাহলে এইযে বেডের পার্শে রাখা ট্রে টার উপর বাঁ*কা সুই আর সুতো রাখা দেখছিস! এগুলো দিয়ে তোর মুখ সারাজীবনের জন্য সেলাই করে দিবো।”
নিলাদ্রের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে সন্ধ্যা শুকনো ঢো*ক গিলে নেয়।
(১৩৬)
তালুকদার ভিলার মূল গেইট দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে তাহির। পার্কিং সাইডে এসে গাড়ি ব্রেক কষতেই হুমায়রার ঘুম ভেঙে যায়। হুমায়রা একপলক তাহিরকে দেখে আবার গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরটা দেখে বুঝতে পারে যে ওরা বাড়িতে এসে পড়েছে। হুমায়রা মুখে কিছু না বলে সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। তাহির ও নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নামে। লম্বা সময় ধরে বসে থেকে ড্রাইভিং করায় তাহিরের বুকের বাম পার্শে গু*লি লাগা ক্ষ*ত স্থানটিতে চি*ন-চি*নে ব্যথা করতে শুরু হওয়ায় সে নিজের ক্ষ*ত স্থানের পাশে আলতো করে হাত রেখে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। হুমায়রা বিষয়টা লক্ষ্য করতেই তাহিরের কাছে এসে বললো….
—“এই জন্যই বলেছিলাম আর কয়েকটা দিন হাসপাতালে থাকতে। ক্ষ*ত স্থানটা একটু শুকিয়ে যেতো তারপর চলে আসলে কি যে মহাভারত অ*শুদ্ধ হয়ে যেতো ওনার! সবসময় নিজে যা বুঝবে সেটাই সঠিক বাকিরা সেই বিষয়ে হাজার কথা বলতে বলতে শ*হী*দ হয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসবে না। তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে আর সরানো যাবে না। বাড়িতে ফিরবে বলছে মানে ফিরতেই হলো। এখন যে য*ন্ত্র*ণা করছে! ক*ষ্ট টা কার হচ্ছে শুনি! নিজের ভালো একটা পা*গ*ল ও খুব ভালো ভাবে বুঝে কিন্তু এই মহাশয় তা বুঝে না।”
তাহির বললো….
—“এবার একটু নিঃশ্বাস নে তুই..এতো কথা এক সাথে একজন মানুষ বলতে পারে কি করে! বা*চা*ল কোথাকার।”
হুমায়রা তাহিরের দিকে তাকিয়ে রাগে দাঁত কি*ড়*মি*ড় করছে। তাহির আবারও বললো…
—“এখন কি এখানেই দাঁড়িয়ে আমাকে চি*বি*য়ে চি*বি*য়ে খাওয়ার পরিকল্পনা করছিস নাকি আমাকে ভিতরে যেতে একটু সাহায্যও করবি!”
তাহিরের মুখে এরূপ কথা শুনে হুমায়রার যেনো মনে হচ্ছে রা*গে দুঃ*খে এখানেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে কান্না করতে। হুমায়রা নিজের রা*গ*কে নিজের মাঝেই দ*মিয়ে রেখে তাহিরকে ধরে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
(১৩৭)
চৌধুরী মেনশনে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন সায়মন, সাবরিনা, কামিনী আর রিজভী। সেইসময় কামিনী বললেন…
—“মেজো ভাইয়া..মেজো ভাবী..! তোমরা কি কুশল আর সন্ধ্যাকে সারাজীবন ধরে নিজেদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছো! যদি তেমনটাই ঠিক করে থাকো তাহলে সে কথা আমাদের সরাসরি বলে দাও। তারপর আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা আমাদেরই চিন্তা করতে হবে!”
সাবরিনা বললেন….
—“হঠাৎ নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এতো উতালা হয়ে উঠছিস কেনো তুই ছোট!”
—“দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তোমাদের এই ভালো মানুষি রূপ দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পরেছি। বুদ্ধি খাটিয়ে তো কুশলকে নিজেদের ছোট ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিলে। সেই হিসাব অনুসারে সিংহভাগ সম্পত্তির মালিকানাও কনকের মাধ্যমে তোমরা পেয়ে গেলে। এরপর কুশলের ভাগও তোমরাই নিয়ে নিবে। বাকি অবশিষ্ট টুকু রেখেছো আমার ছেলে রাজবীরের জন্য! যদি এই সামান্য অংশই আমাদের পেতে হয় তাহলে ২০ বছর আগে তোমাদের সাথে হাত মিলিয়ে ওতো বড় একটা কাজ কেনো করেছিলাম আমরা!”
—“ছোট…কি বলতে চাইছিস তুই তা সরাসরি বল। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁ*চি*য়ে কথা বলার তো কোনো মানে দেখছি না।”
—“এভাবে কথাগুলো না বললে তো আবার তোমাদের মনে করিয়ে দিতে পারতাম না যে ২০ বছর আগে এই স্থানেই ঠিক কি কি ঘটেছিলো।”
সায়মন কিছুটা রাগ নিয়ে রিজভীকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“রিজভী…তোর বউ কি একটু বেশিই বলে ফেলছে বলে তোর মনে হচ্ছে না!”
রিজভী বললেন…
—“আমার কাছে তো বেশি বলছে বলে মনে হচ্ছে না মেজো ভাই, বরং এটা মনে হচ্ছে যে কামিনী আজ উচিত কথা গুলোই বলছে।”
সায়মন কিছু বলতে নিলে সাবরিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন….
—“আহা..সায়মন! মাথা ঠান্ডা করো তুমি। এখানে আমরা নিজেদের লোকজনই আছি৷ নিজেদের মাঝে এইসব সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করার বিষয় নিয়ে কথা কা*টা-কা*টি করলে কি চলে বলো! ছোট কি বলতে চায় ওকে বলতে দাও। ছোট… বল তুই কি বলবি।”
কামিনী বললেন…
—“যা বলার সহজ ভাষায় সরাসরিই বলছি আমি।”
—“হুম বল।”
—“যেহেতু সম্পত্তির ভাগ সঠিক ভাবে পাওয়ার জন্যই ২০ বছর আগে আমরা এই জায়গায় র*ক্তে*র খেলা খেলেছিলাম তাই এখন আমরা চাই চৌধুরী পরিবারের সম্পূর্ণ সম্পত্তিকে সমান ভাবে ২ ভাগ করতে। এক ভাগ কনক পাবে আরেকভাগ আমার ছেলে রাজবীর পাবে। এর জন্য তোমাদের কি উচিত তা নিশ্চয়ই ভে*ঙে বলতে হবে না!”
—“তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস কুশলকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে তাই তো!”
কামিনী ওর বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“হুম পথের কা*টা*কে যতো তাড়াতাড়ি উ*ফ*রে ফেলা যাবে ততো তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছেতে পারবো।”
কামিনীর কথা শেষ হতেই পিছন থেকে একটি পুরুষালী কন্ঠে ‘মামনি’ ডাক ভেসে আসে। ওরা সবাই মূল দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫৯)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৩৮)
পরেরদিন সকালবেলা….
কুশল আর তরুনিমা ঝর্ণাদের থেকে বিদায় নিয়ে পাহাড়তলী গ্রাম থেকে বেড়িয়ে পরে। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো…
—“নিলাদ্র ভাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন কিভাবে? তার পরিচয় বা কি দিবেন সে বিষয়ে কিছু ভেবেছেন কি!”
কুশল গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রতিত্তুর করলো…
—“নিলাদ্রকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার একটাই রাস্তা খোলা আছে।”
—“কি রাস্তা!”
—“সন্ধ্যার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে নিলাদ্র ওর নতুন পরিচয় নিয়ে নতুন পরিবারের সাথে বাড়িতে আসবে। আর এই সম্বন্ধ পাঁকা করে দ্রুত সন্ধ্যা আর নিলাদ্রের বিবাহকার্য সম্পন্ন করতে হবে।”
—“নতুন পরিবার মানে!”
—“আমাদের দুইজন মধ্যবয়সের পুরুষ-মহিলা ও ২জন আমাদের বয়সী পুরুষ-মহিলার প্রয়োজন। যাদের নিলাদ্রের পরিবারের সদস্য হিসেবে বাড়ির সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে।”
—“কিন্তু এমন বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের হুট করেই কোথায় পাবেন!”
—“সেটাই তো চিন্তার বিষয়।”
তরু কিছুসময় নিরব থেকে চিন্তা করে বললো….
—“আচ্ছা তাহির আর হুমায়রার সাথে যদি এই বিষয়ে কথা বলি তাহলে কেমন হয়!”
তরুর মুখে এরূপ কথা শুনে কুশল ঘাড় বাঁকিয়ে তরুর দিকে একপলক দেখে বললো…
—“মন্দ বললে না তো কথাটা। কিন্তু ওরা কি এমনটা করতে রাজি হবে!”
—“কথা বলার পর কি সিদ্ধান্ত নেয় ওরা দেখা যাক তা।”
—“আচ্ছা।”
লম্বা সময় ধরে ড্রাইভিং করার পর গাড়ি তার নিজ গন্তব্যে অথ্যাৎ কুশল নিলাদ্রকে ভর্তিকৃত ক্লিনিকের সামনে এসে গাড়ির ব্রেক কষে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“তুমি ভিতরে যাও, আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।”
তরু গাড়ি থেকে নেমে ক্লিনিকের ভিতরে চলে যায়। কুশল গাড়ি পার্ক করতে যায়।
(১৩৯)
তালুকদার ভিলার ড্রয়িংরুমের আসবাবপত্র পরিষ্কার করছিলো কাজের মেয়ে মিনু। সেইসময় মূল দরজা দিয়ে হুমায়রার সাহায্য নিয়ে তাহিরকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে মিনু ওর হাত থেকে কাপড়টা ফেলে দিয়ে বললো…
—“ওরে আল্লাহ..ছোট মালিকের এ কি দ*শা হইছে! বড় মালকিন…বড় মালিক দেইখা যান ছোট মালিকের কি স*ব্বো*না*শ হইয়া গেছে।”
মিনুকে এভাবে চিল্লিয়ে তাহিরের বাবা-মাকে ডাকতে শুনে তাহির মিনুকে ধ*ম*ক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মিনু চুপ হয়ে যায়। নিচতলায় নিজ কক্ষে বিছানায় বসে ছিলো তমিজ ও রেবেকা তালুকদার। মিনুর উচ্চস্বরে বলা কথাগুলো শোনামাত্র হ*ন্ত*দ*ন্ত হয়ে তাহিরের বাবা-মা দু’জনেই তাদের রুম থেকে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ান। হুমায়রা তাহিরকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর পাশেই বসেছে মাত্র। রেবেকা তাহিরের দিকে অগ্রসর হতে হতে অস্থির স্বরে বললেন….
—“কি হয়েছে আমার সোনা মানিকের! কি স*র্বো*না*শ হলো!”
রেবেকা তাহিরের হাতের বাম পার্শে এসে বসতেই তাহির বললো….
—“আহহ..মা! শান্ত হও, এতো অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয় নি আমার।”
—“অস্থির হবো না মানে! তোর বুকের বাম পার্শে এমন ব্য*ন্ডে*জ করা কেনো! কি হয়েছে সত্যি করে বল আমায়।”
—“তেমন কিছুই না মা। ছোট একটা গু*লি এসে লেগেছিলো বুকের বাম পার্শে।”
গু*লি লাগার কথা শুনে রেবেকা বেগম স্ত*ব্ধ হয়ে যান কয়েক সেকেন্ড এর জন্য৷ তমিজ তালুকদার বললেন….
—“গু*লি! গু*লি লাগলো কিভাবে?”
রেবেকা তালুকদারের চোখজোড়া ইতিমধ্যেই নোনাজলে টইটম্বুর পুকুরের মতো হয়ে গিয়েছে। তিনি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“এতো বড় একটা দূ*র্ঘ*ট*না ঘটে গেলো আর তোরা আমাদের কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না! হুমায়রা বললো তোরা শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিস। সেখানেই ২-৩ দিন থাকবি, ঘোরাঘুরি করবি। নেটওয়ার্ক প্রবলেম অনেক তাই কল দিলে তোদের না পেলে যেনো চিন্তা না করি। সেইসব তাহলে মি*থ্যে ছিলো! তুই সেইসময় জীবন-মৃ*ত্যু*র সাথে লড়াই করছিলি!”
তাহির একপলক হুমায়রার দিকে তাকায়। হুমায়রা বি*ষ*ন্ন মুখশ্রী করে বসে আছে। তাহির শান্ত স্বরে বললো…
—“হিমু মি*থ্যে বলে নি মা৷ আমরা শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলাম ঠিকই। সেখানে কিছু দ*স্যু*র দল গ্রামের মানুষদের উপর হা*ম*লা করেছিলো। আর সেসব ঝা*মে*লা মিটাতে গিয়েই আমি গু*লি বি*দ্ধ হয়ে যাই। এরপর হিমু সহ গ্রামের মানুষরাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। অপারেশন করে গু*লি টা বের করা হয়েছে। এখন আমি সুস্থ আছি, শুধু ক্ষ*ত স্থানে হালকা ব্য*থা আছে। কয়েকদিন এর ভিতর সেটাও সেরে যাবে।”
তাহিরকে এতো সুন্দর ভাবে বানিয়ে মি*থ্যে বলতে দেখে হুমায়রা বেশ অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। অতঃপর আরো বেশ কিছু সময় বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটিয়ে হুমায়রার সাহায্য নিয়ে তাহির নিজের রুমে চলে আসে। রুমে প্রবেশ করতেই হুমায়রা বললো….
—“মি*থ্যে বললে কেনো?”
—“সত্য বলে ঝা*মে*লা বাড়ানোর থেকে মাঝেমাঝে মি*থ্যে বলে পরিস্থিতি সামলে নেওয়াই ভালো।”
তাহির এর কথায় হুমায়রা হালকা ভাবে ভেং*চি কা*টে।
(১৪০)
তরুনিমা নিলাদ্রের কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে নিলাদ্র আর সন্ধ্যা বেডের উপর পাশাপাশি বসে আছে। তরুনিমাকে দেখামাত্র সন্ধ্যা বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো…
—“মেজো ভাবী তুমি একা আসলে যে মেজো ভাইয়া কোথায়? আর তোমরা আমাদের কাওকে কিছু না বলে হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিলে গত কাল রাতে!”
তরুনিমা সন্ধ্যার দিকে অগ্রসর হতে হতে চিন্তা করে…
—“এখন যদি সন্ধ্যাকে বলি যে আমরা মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম তাহলে মেয়েটার মন আবারও বি*ষ*ন্ন হয়ে যাবে। সেখানে যাওয়ার জন্য ছ*ট*ফ*ট ও করতে পারে। তাহলে কি বলবো ওকে এখন!”
তরু সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়াতেই সন্ধ্যা আবারও একই প্রশ্ন করলে তরু বললো….
—“তোমার ভাইয়াকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে কিছুটা দূরে একটা নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম আমরা। সেখানেই সারারাত কাটিয়ে দিয়েছি। তোমার ভাইয়াও এসেছেন। পার্কিং সাইডে গাড়ি রাখতে গিয়েছেন। আচ্ছা এখন এসব কথা ছাড়ো। আমি আর তোমার মেজো ভাইয়া মিলে একটা পরিকল্পনা করেছি৷”
সন্ধ্যা অবাক স্বরে বললো…
—“কিসের পরিকল্পনা!”
নিলাদ্র ওদের দিকেই দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরুনিমা নিলাদ্রকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে করা পরিকল্পনার কথা ওদের জানায়। সন্ধ্যা বললো…
—“তাহির ভাইয়ার গু*লি লেগেছিলো। উনি তো এখনও সুস্থ হন নি। আর সুস্থ হলেও আবারও আমাদের জন্য এতো বড় রি*স্ক নিতে কি ওনারা কেও রাজি হবেন!”
তরুনিমা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…
—“তাহির আর হুমায়রার সাথে একবার সামনা-সামনি এই বিষয় নিয়ে কথা বলে দেখি। যদি একান্তই ওরা রাজি না হয় তাহলে আমাদের অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।”
সেইসময় কুশল নিলাদ্রের কেবিনে প্রবেশ করলে তরুনিমা কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“তাহিরকে এখুনি কি একবার কল করবো!”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“না এখুনি না। কয়েকদিন যেতে দাও, তাহির কিছুটা সুস্থবোধ করুক। এরপর এই বিষয়ে ওর সাথে কথা বলা যাবে। আপাতত নিলাদ্রের থাকার জন্য আমি শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা হোটেলে রুম বুক করে দিয়েছি। সেখানেই ও সৌহার্দ্যের পরিচয়ে থাকবল কিছুদিন।”
কুশলের কথায় ওরা তিনজন ই সম্মতি জানায়। কুশল আবারও বললো….
—“এবার আমাদের বাড়িতে ফেরা দরকার। আর তোমরা দু’জন একটা বিষয় খুব ভালো ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে রাখো। বাড়ির কারোর সামনে সন্দেহজনক কোনো আচারণ করবে না তোমরা। আগে যেমন ভাবে চলাচল করতে সবার সাথে নরমালি কথা বলতে তেমন ই থাকবে। ওরা যদি একবার বুঝতে পারে যে আমরা ওদের সব সত্য জেনে গিয়েছি তাহলে ওরা যখন তখন আমাদের যে কারোর বড় ধরণের ক্ষ*তি করে বসবে। আমি চাই না আমাদের সামান্য তম বো*কা*মী*র জন্য পা*পী*রা সতর্ক হয়ে যাক।”
সন্ধ্যা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….
—“ঠিক আছে।”
কুশল নিলাদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“নিলাদ্র তুইও চল আমাদের সাথে। তোকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরবো।”
এরপর সন্ধ্যা নিলাদ্রের হাতে হাতে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যগে গুছিয়ে দেয়। গোছগাছ শেষ করে কুশল নিলাদ্রকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার সব ফর্মালিটি সেরে নেয়। অতঃপর ওরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পরে।
(১৪০)
চৌধুরী মেনশনে ড্রয়িংরুমে সোফায় রিজভী, কামিনী, সাবরিনা, সায়মন বসে থাকা কালীন সময়ে মূল দরজার দিক করে পুরুষালী কন্ঠে ‘মামনি’ ডাক শোনামাত্র ওরা সবাই সেদিকে তাকায়। দীর্ঘ ৫ বছর পর কামিনী ও রিজভীর ছেলে রাজবীরকে নিজেদের চোখের সামনে দেখামাত্র ওরা সবাই অনেক বেশিই অবাক হয়ে যায়। ওরা সবাই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কামিনী হাসিমুখে দুই হাত বাড়িয়ে রাজবীরের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….
—“আরে আমার সোনা ছেলে…কতোবছর পর দেশে ফিরলি বাবা! আয় আমার বুকে আয় মানিক আমার।”
এই বলে কামিনী রাজবীরকে দু’হাতে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। কিছুসময় পর রাজবীরকে ছেড়ে ওর পাশেই দাঁড়ায় কামিনী। সাবরিনা হাসিমুখে রাজবীর এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ওর নজর কাটিয়ে দেওয়ার মতো ভ*ঙ্গি*মা করে বললেন….
—“বাড়ির রাজপুত্র অবশেষে বাড়িতে ফিরলো। কিন্তু তুই এভাবে সারপ্রাইজ দিবি তা তো আমরা কেও ভাবতেই পারি নি।”
রাজবীর ওর শার্টের কলার্ট দু’হাতে টেনে দিয়ে বললো…
—“ভাবনার বাহিরে কাজ করাই তো রাজবীর চৌধুরীর বিশেষ ট্যলেন্ট মামনি।”
রিজভী বললো…
—“হয়েছে..হয়েছে..রাজবীর বাবা তুমি অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো। তাই এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো কিছুসময়। তোমার মা আর মামনি সেইসময়ের ভিতর তোমার পছন্দের সব খাবার তৈরি করে ফেলবেন।”
—“ঠিক আছে বাবাই।”
এই বলে রাজবীর সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।
কয়েক ঘন্টা পর………
সবেমাত্র খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে গল্পের আসর নিয়ে বসেছে সাগরিকা, সাবরিনা, কামিনী, সায়মন, রিজভী আর রাজবীর। সেইসময় কুশল, তরু আর সন্ধ্যা মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। কুশলকে দেখা মাত্র রাজবীর সোফা ছেড়ে উঠে কুশলের কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো….
—“হেই ব্রো..কেমন আছো তুমি!”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“ভালো আছি, তুই কেমন আছিস।”
—“এই তো বিন্দাস আছি।”
এই বলে রাজবীর সন্ধ্যার দিকে কেমন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ওর গাল টেনে দিয়ে বললো…
—“কি রে তুই তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস। আর অনেক সুন্দর ও হয়ে গিয়েছিস।”
রাজবীরের এমন দৃষ্টি ও কাজ সন্ধ্যার একদমই ভালো লাগে না। সন্ধ্যা জোর পূর্বক হাসি দিয়ে বললো…
—“আমি অনেক ক্লান্ত বোধ করছি। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হবো। পরে তোমার সাথে কথা হবে ভাইয়া।”
এই বলে সন্ধ্যা রাজবীরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কদমে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। বাকিরাও সন্ধ্যার এমন আচারণকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। রাজবীর তরুনিমাকে দেখে বললো…
—“উনিই বুঝি আমাদের ভাবী! তো ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে না ব্রো!”
কুশল স্মিত হাসি দিয়ে বললো…
—“ও তোর মেজো ভাবী তরুনিমা চৌধুরী। আর তরুনিমা ও রিজভী চাচার একমাত্র ছেলে রাজবীর চৌধুরী।”
তরুনিমা শুরু থেকেই রাজবীরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। রাজবীর শহুরে স্টাইলে হ্যন্ডশেক তরুর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে বললো….
—“হ্যলো ভাবী!”
তরু তা উপেক্ষা করে হাসি দিয়ে বললো…
—“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
তরুর এমন কাজে রাজবীর কিছুটা লজ্জার মাঝে পরে যায়। পরক্ষণেই নিজের হাত গু*টিয়ে নিয়ে সালামের উত্তর দেয় সে। তরু মনে মনে চিন্তা করে….
—“এনাকে কোথায় যেনো দেখেছি আমি। কিন্তু কোথায় দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।”
#চলবে ইনশাআল্লাহ…….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬০)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৪১)
গভীররাত……
তরু আর কুশল দু’জনেই নিজরুমে একই বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সেইসময় কুশলের পানি পিপাসা পাওয়ায় ওর ঘুম ভেঙে যায়। কুশল শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা পানির জগ থেকে গ্লাসে ডেলে নিয়ে পানি পান করে। পানি পান করা শেষ করে কুশল গ্লাসটি আগের স্থানে রেখে তরুর দিকে তাকাতেই দেখে তরু চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই কেমন অদ্ভুত মুখ ও অঙ্গভঙ্গীমা করছে। মানুষ ঘুমিয়ে থাকাকালীন কোনো স্বপ্ন দেখলে যেমন করে ঠিক তেমন। কুশল লক্ষ্য করে তরুর সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে। আশ্চার্য বিষয় রুমে এ.সি চলা সত্ত্বেও সে ঘেমে গিয়েছে।কুশল তরুর গালে আলতো করে চা*প*ড় দিয়ে ওর নাম ধরে সম্বোধন করে ওকে জাগানোর চেষ্টা করে। কিছুসময় ধরে ডাকাডাকির পর তরুর ঘুম ভে*ঙে যায়। তরু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। পরক্ষণেই নিজের পাশে কুশলকে বসে থাকতে দেখে তরু আর কিছু না ভেবেই শোয়াবস্থা থেকে উঠে কুশলের কোলের উপর বসে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ তরুর এমন কাজে কুশল কিছুটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সে তরুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এভাবে পেরিয়ে যায় বেশকিছুসময়। কুশল অনুভব করে ওর বুকের বামপার্শে টি-শার্টের অংশ ভিজে ভিজে লাগছে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“শান্ত হও তরুনিমা। তুমি হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো! ভ*য় পেও না আমি আছি তোমার কাছে।”
কুশলের এরূপ কথা শুনে তরু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। কুশল তরুকে শান্ত করার চেষ্টা নিয়ে বললো….
—“কান্না করো না৷ কি হয়েছে বলো আমায়! কি স্বপ্ন দেখেছো তুমি! বলো..।”
তরু কুশলের বুকের বাম অংশের টি-শার্টে নাক ঘষতে ঘষতে বললো….
—“আমি আজ স্বপ্নে বড়পুকে দেখেছি। আমি দেখেছি বড়পু আর আমি একটা খুনসুটি করতে করতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেনো যাচ্ছি। সেইসময় কোথায় থেকে যেনো একজন মুখোশ পড়া লোক এসে বড়পুর হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে জোরপূর্বক। আমি বড়পুর অন্য হাত ধরে তাকে আটকানোর চেষ্টা করি কিন্তু আমি সেই লোকটির শক্তির সাথে পেরে উঠি না। বড়পুকে আমার থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে ঐ লোকটি আমার সামনেই বড়পুর পেটে আর বুকে ধা*রা*লো ছু*রি দিয়ে আ*ঘা*ত করে পরপর বেশ কয়েকবার। এমনটা দেখে আমি বড়পুকে ঐ লোকটির হাত থেকে বাঁচাতে ওদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে আমার জায়গা থেকে একচুল পরিমাণ নড়তে দেয় নি। ঐ মুখোশধারী লোকটি সেখান থেকে চলে যায়। বড়পু আমার চোখের সামনে য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে থাকে, আমার দিকে সাহায্য চেয়ে নিজের র*ক্ত মাখা হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও বড়পুর কাছে যেতে পারি নি। আমি পারি নি। আমার চোখের সামনে বড়পু ক*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা*য় ছ*ট-ফ*ট করতে করতে নি*স্ত*ব্ধ হয়ে গেলেন। আমার কলিজা ফে*টে যাচ্ছিলো বড়পুকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু আমি পারি নি।”
তরুনিমা কান্না করতে করতে নিজের স্বপ্নে দেখা সম্পূর্ণ ঘটনা কুশলকে বলে। কান্না করতে করতে ইতিমধ্যে তরুর হিঁ*চ*কি উঠে গিয়েছে। কুশল তরুর মনের বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারছে। কুশল তবুও তরুকে শান্ত করার যথাযথ চেষ্টা করছে। বেশ কিছু সময় পর তরু কিছুটা শান্ত হলে কুশল বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো…..
—“তরুনিমা এই পানি টুকু খেয়ে নাও।”
তরুনিমা কুশলের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কুশলের হাত থেকে সামান্য পরিমাণ পানি পান করে। তরু এখনও শক্ত হাত কুশলকে জড়িয়ে ধরে আছে। কুশল বুঝতে পারে তরু যথেষ্ট ভ*য় পেয়েছে। তাই কুশল তরুকে নিজের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে না। অতঃপর কুশল তরুকে নিজের বুকের উপর রেখেই শুয়ে পরে তরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুসময় পর কুশল লক্ষ্য করে তরু ঘুমিয়ে গিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তরুর ফর্সা মুখশ্রী হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ এর নিচের অংশ আর গাল দু’টো স্বাভাবিক এর তুলনায় হালকা ফুলে উঠেছে। কুশল তরুর মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরুকে দেখতে দেখতেই কুশলও ঘুমিয়ে যায়।
সকালবেলা….
তরুর ঘুম ভে*ঙে যায়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে কুশলের বুকে আ*ষ্ঠে-পৃ*ষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে তরু। কুশল শক্ত ভাবে তরুকে জড়িয়ে ধরে থাকায় তরু একটুও নড়চড় করতে পারছে না বিধায় সে কুশলের বুকের উপর থুতনি রেখে ওর মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করতেই দেখে ওর সামনের দিকের কিছু চুল একটু লম্বা হওয়ায় তা কপাল পেরিয়ে চোখের উপর এসে পড়েছে। তরু কিছুসময় ওভাবে কুশলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হালকা ভাবে ফুঁ দিয়ে ওর চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তরুর এমন কাজে কুশলের ঘুম ভে*ঙে যায়। কুশলকে নড়তে দেখে তরু আবারও ওর বুকের উপর মাথা নুইয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভা*ন ধরে। কুশল চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সে তরুকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তরু ঘুমিয়ে আছে ভেবে কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“বুকের ভিতরটা ভিষণ অ*শান্ত হয়েছিলো। এই অ*শান্ত বুকে তুমি মাথা রাখায় ভিষণ শান্তি অনুভব হচ্ছে আমার তরুনিমা। ধীরে ধীরে তোমার প্রতি অনেক দূর্বল হয়ে পড়ছি আমি। এখন ভ*য় হয় যদি শ*ত্রু*রা তোমার কোনো ক্ষ*তি করে দেয় তখন আমার কি হবে! এই পৃথিবীতে তুমি ব্যতিত আর কেও নেই যে আমাকে আমার সবরকম পরিস্থিতিতে শান্তি দিতে পারে। তোমার প্রতি সৃষ্টি হওয়া এই অনুভূতিগুলোর নাম যদি ভালোবাসা হয় তবে হ্যা আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তরুনিমা। অনেক অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে আমি কখোনই হারাতে চাই না। সারাজীবন এভাবেই আমার বুকের মাঝে আগলে রাখবো তোমায়।”
কুশলের মুখে এই প্রথম ভালোবাসার কথা শুনে তরুর হৃৎস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বে*ড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি তরু কুশলের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকার কারণে কুশলের হৃৎস্পন্দনের উঠানামার ফলে হওয়া ধুক-পুক শব্দও সে শুনতে পারছে। অজান্তেই তরুর ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
(১৪২)
গোসল শেষ করে তোয়ালে দিয়ে ভে*জা চুলগুলো মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নিজের বিছানার উপর রাজবীরকে আধশোয়া হয়ে বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যা কিছুটা ভ*র*কে যায়। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে জামার উপরে নিজের শরীরের উপরের অংশ ঢেকে নিয়ে বললো….
—“ছোটো ভাইয়া…এতো সকাল সকাল তুমি আমার রুমে কি করছো!”
সন্ধ্যার কন্ঠস্বর শুনতেই রাজবীর ঘাড় ঘুরিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যার ভেজা চুলগুলো দিয়ে টপটপ করে পানি মেঝেতে পড়ছে। ঘাসের উপর পরা শিশির বিন্দুর মতো ওর মুখে ও গলায় বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। জানালা দিয়ে আসা সকালে মিষ্টি রোদ সন্ধ্যার মুখশ্রীর উপর পড়ায় জমে থাকা সেই বিন্দু বিন্দু পানিগুলো জ্বল জ্বল করছে। রাজবীর একদৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজবীরকে এভাবে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যা ভিষণ ইতস্তত বোধ করে। পরক্ষণেই সন্ধ্যা বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রাজবীরের পায়ের কাছে রাখা নিজের ওড়নাটা নিতে ধরলে রাজবীর ওর কাজে বি*ঘ্ন ঘটিয়ে নিজে ওড়নাটা নিয়ে নেয়। সন্ধ্যার এবার ইতস্ততার মাত্রার পেরিয়ে রাগ লেগে যায়। তবুও সন্ধ্যা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে বললো….
—“ছোটো ভাইয়া..ওড়নাটা দাও আমায়। এসব বিষয়ে মজা করা আমার একদমই পছন্দ না।”
রাজবীর সন্ধ্যার ওড়নাটা নিজের হাতে পেঁ*চা*তে পেঁ*চা*তে বাঁকা হেসে বললো…..
—“ছোট বেলায় তো আমার সামনে দিব্যি ওড়না ছাড়াই ঘুরে বেড়াতি তাহলে এখন কি সমস্যা!”
সন্ধ্যা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“আমি এখন আর ছোট নেই। ভালোয় ভালোয় বলছি ওড়নাটা দাও।”
—“তুই চাইলে এখনও থাকতে পারিস আমার কোনো সমস্যা নেই।”
রাজবীর এর এমন নোং*ড়া মানসিকতার রূপ দেখে সন্ধ্যার রাগে ঘৃণায় সর্বশরীর তির তির করে কাঁপতে শুরু করে। অতঃপর সন্ধ্যা রাজবীরের থেকে ওড়না নেওয়ার আর কোনোরূপ চেষ্টা না করে ওয়ারড্রবের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার খুলে অন্য আরেকটি ওড়না বের করে নিজের শরীরকে ভালোভাবে ঢেকে নিয়ে রাজবীরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো….
—“আমরা মেয়েদের বড় হওয়ার পরও যখন ওড়না ছাড়া ঘুরলে তোমাদের মতো ছেলেদের কোনোরূপ স*ম*স্যা হবে না তখন নিজের হাতে থাকা ঐ ওড়নাটা এবার নিজের শরীরেই ভালোভাবে জড়িয়ে রাখো। এতে যদি সামান্য পরিমাণ লজ্জা-ভ্রম তোমাদের মতো মানসিকতার ছেলেদের ভিতর জন্মায় তাহলে ওড়নাটি নিজেকে ধন্য মনে করবে।”
এই বলে সন্ধ্যা দ্রুত কদমে ওর রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যার বলা এরূপ কথাগুলোর মানে বুঝতে রাজবীরের কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায়। মানে বুঝে উঠা মাত্র রাজবীর রাগে উচ্চস্বরে ‘আআআআহহহহহ’ বলে নিজের হাতে থাকা ওড়নাটা মেঝের উপর ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে বললো….
—“সেদিনের পুঁ*চ*কে মেয়ে আমাকে এতোবড় অ*প*মা*ন মূলক কথা শুনিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো! এই রাজবীর চৌধুরীকে অ*প*মা*ন করার ফল কতোটা খা*রা*প হতে পারে সে সম্পর্কে তো তোর কোনো ধারণাই নেই রে সন্ধ্যা। যেই শরীরকে ঢাকার জন্য তোর এতো চেষ্টা সেই শরীরের অবস্থা আমি…..!”
এতোটুকু বলেই রাজবীর স্বশব্দে হেসে উঠে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ