হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৭০+৭১+৭২

0
590

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭০)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৬০)
তালুকদার ভিলার ড্রয়িংরুমে সোফায় তাহির, হুমায়রা, ওদের বাবা-মা, নিলাদ্র, সন্ধ্যা, কুশল, তরুনিমা আর একজন মধ্যবয়সের কাজীসাহেব বসে আছেন। তাহিরের তরফ থেকে নিলাদ্র-সন্ধ্যা আর হুমায়রার তরফ থেকে কুশল-তরুনিমা বিবাহে সাক্ষীদাতার ভূমিকা পালন করে। ওদের সকলের উপস্থিতিতে ইসলামিক ও আইনি দুই পদ্ধতি অবলম্বন করেই তাহির ও হুমায়রার বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। এরপর সকলে ওদের বৈবাহিক জীবনের জন্য সুখ ও শান্তি কামনা করে মোনাজাত করে। একসাথে রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে সন্ধ্যা আর তরুনিমা দু’জনে মিলে হুমায়রাকে তাহিরের রুমে নিয়ে যায়। পারিবারিক ভাবে খুবই ছোট আয়োজনে ওদের বিবাহ হওয়ায় বাসরঘরের ডেকোরেশনও সাধারণ রেখেছে। বেলি, রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলের সুগন্ধে পুরো ঘর এক অন্যরকম সুন্দর পরিবেশে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা আর তরুনিমা হুমায়রাকে বিছানার মাঝ পর্যায়ে বসিয়ে দেয়। তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো…

—“সন্ধ্যা..তোমার মেজো ভাইয়া আর নিলাদ্র ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলো ওনারা যেনো তাহিরকে নিয়ে আসেন এখুনি।”

—“আচ্ছা ভাবী।”

এই বলে সন্ধ্যা বিছানা থেকে নেমে রুমের বাহিরে চলে যায়। তরুনিমা হুমায়রার ডান হাতের উপর হাত রেখে স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“মন খারাপ করো না হুমায়রা। আজ যেভাবে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে বৈধ সম্পর্কে আবব্ধ হয়েছো তেমনি খুব তাড়াতাড়ি তোমার ভালোবাসার মানুষটির থেকে তুমি তোমার প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা, আদর-যত্ন ও পাবে। বিয়ের সম্পর্ক অনেক পবিত্র হয়। এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালারা রহমত থাকে। তিনিই দু’জন মানুষের মাঝে ভালোবাসার অনুভূতির সৃষ্টি করেন। সর্বদা ভরসা রেখো তার উপর।”

তরুনিমার কথাগুলো শোনার পর হুমায়রার মাঝে কিছুটা ভালোলাগা ও স্বস্তি কাজ করে। হুমায়রা তরুনিমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো….

—“ইনশাআল্লাহ….তরুনিমা তোমার কথাগুলোই যেনো ঠিক হয়।”

তরুনিমা হাসিমুখে হুমায়রার মাথার উপরে ওড়না থেকে পিনটা খুলে দিয়ে সেটা ওর গলা পর্যন্ত টেনে দেয়। সেইসময় কুশল আর নিলাদ্র তাহিরকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। সন্ধ্যাও ছিলো ওদের সাথে। তরুনিমা বিছানা থেকে নেমে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিলাদ্র তরুনিমাকে দেখামাত্র তাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো….

—“ভাই…গালে কি এখনও ব্য*থা করছে!”

তাহির বললো…
—“শুধু গাল না ভাই দুই পার্শের দাঁতের মাড়ি শুদ্ধ ব্য*থা ধরে আছে।”

—“এবার হুমায়রা ভাবীকে বলে স্বইচ্ছায় দুই গালে আর দু’টো ডো*জ দিয়ে নিও তাহলে ছক্কা হয়ে যাবে।”

—“সন্ধ্যা ভাবীর থেকে ১ ডজন ডো*জ খাওয়ার শখ হয়েছে তোমার সেই কথা সরাসরি বললেই পারো!”

—“আরে কি যে বলো তুমি ভাই! সন্ধ্যা যেই পরিমাণের ভিতু সে দিবে আমায় ডো*জ এগুলা কল্পনাতেও সম্ভব না।”

—“আমিও কখনও কল্পনা করি নি তরুনিমা আমাকে পর পর চার-চারটে থা*প্প*ড় দেওয়ার মতো সাহস করতে পারবে। কিন্তু কল্পনাতেও সম্ভব না হওয়া এটা তো বাস্তবে হয়ে গেলো। শুনেছিলাম সুন্দরী মেয়েদের হাত অনেক নরম হয় কিন্তু থা*প্প*ড় গুলো খাওয়ার পর সেই ধারণাও ভে*ঙে গেছে আমার ভাই।”

—“আমি সন্ধ্যাকে ভ*য় পাই না বুঝলে ভাই!”

তাহির নিলাদ্রের এরূপ কথা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“সন্ধ্যা ভাবী…নিলাদ্র ভাই বললো আপনার নাক নাকি অনেক মোটা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আপনাকে বুঁ*চি বলেও সম্বোধন করেছে।”

তাহিরের মুখে এরূপ কথা শোনার পর নিলাদ্রের চোখের আকার স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। নিলাদ্র ওর মুখ একহাতে চেপে ধরে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের দিকে অ*গ্নী দৃষ্টি নি*ক্ষে*প করে রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে বললো….

—“আমাকে বুঁ*চি বলে সম্বোধন করা এক্ষুণি বের করছি।”

নিলাদ্র ঘন ঘন মাথা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বোঝাতে চায় সে এমনটা বলে নি। কিন্তু সন্ধ্যা নিলাদ্রের ইশারাকে পরোয়া না করে ওর হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। নিলাদ্র উচ্চস্বরে বললো…

—“কুশল…বন্ধু আমার তোর ডা*কা*ই*ত*নি বোনের হাত থেকে বাঁ*চা আমায়। তাহির ভাই…এ তুমি কি করলে! আমারে এভাবে ফাঁ*সি*য়ে দিলে! ওরে কে আছো বাঁ*চা*ও আমায়!”

নিলাদ্র আর সন্ধ্যা চোখের আড়াল হতেই তাহির, কুশল, তরুনিমা তিনজনই শব্দ করে হাসতে শুরু করে। কুশল হাসি থামিয়ে বললো….

—“বেচারাকে এভাবে ফাঁ*সি*য়ে দিলে তুমি ভাই!”

—“সে তো জোর গলায় বলছিলো সে নাকি ভাবীকে একটুও ভ*য় পায় না। তার নমুনা দেখতেই এই কাজ করলাম।”

তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো…
—“কুশল…এখন আমাদের যাওয়া উচিত। হুমায়রা অনেক সময় হলো ভিতরে একা বসে আছে।”

—“হুম ঠিক বলেছো। তাহির ভাই, বেস্ট অফ লাক।”

এই বলে কুশল তরুনিমাকে নিয়ে স্থান ত্যগ করে। তাহির একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে রুমের ভিতর প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেয়। দরজা আটকে দেওয়ার শব্দ শোনা মাত্র হুমায়রা ওর বেনারসির এক অংশ মুষ্টিবদ্ধ করে করে ধরে ঘোমটার নিচে থেকেই ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। তাহির ধীর পায়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হয়। তাহির বিছানার কাছে এসে একপার্শে বসে আরো একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বললো….

—“হিমু…তোকে আমার কিছু বলার আছে।”

হুমায়রা নিশ্চুপ হয়ে আছে। তাহির কিছুসময় নিরব থাকার পর আবারও বললো….

—“আজ আমরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবব্ধ হয়েছি তাই একজন স্ত্রী হিসেবে তোর আমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমি এটা জানি আর মানিও। কিন্তু তুই খুব ভালো করেই আমার মনের অবস্থা সম্পর্কে জানিস। হয়তো এটাও বুঝতে পেরেছিস নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হুট করে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় তোকে ভালোবাসাটা আমার জন্য খুব বড় একটা চ্য*লে*ঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কিছুটা সময় প্রয়োজন। আশা রাখছি তুই আমাকে আর আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবি।”

এই বলে তাহির বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে চলে যায়। হুমায়রা কিছুসময় নিরব হয়ে বসে থাকার পর নিজের মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে বেলকনির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে তাহির বেলকণির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি ঐ বিশাল আকাশের একঅংশ জুঈে ছোট থালার মতো অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী চাঁদের উপর স্থির হয়ে আছে। হুমায়রা তাহিরের পিছনে গিয়ে দাড়িয়ে পিছন থেকে ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। তাহির এই ১ম এতোটা কাছে হুমায়রার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে সাথে সাথেই নিজের দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। হুমায়রা তাহিরের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“এতো বছর অপেক্ষা করার ফলস্বরূপ আজ আমি তোমাকে আমার স্বামীরূপে পেয়েছি। তাই তোমার ভালোবাসা, আদর-যত্ন পাওয়ার জন্য যদি আমাকে আরো কয়েকযুগ অপেক্ষা করতে হয় আমি তা করতেও রাজি আছি তাহির। শুধু আমাকে আমার মতো করে তোমায় ভালোবাসতে দিও, যত্ন করতে দিও। আমার নিজের প্রতি এতোটুকু বিশ্বাস আছে যে আমি আমার ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে তোমার মন অবশ্যই জয় করতে পারবো। তোমার অ*ব*হে*লা, কড়া ভাষায় বলা কথা আমি একদমই নিতে পারি না। আমার বুকের ভিতরে ভিষণ য*ন্ত্র*ণা হয়। এমনিতেই তোমার ভালোবাসার অভাব আমায় দরুণ য*ন্ত্র*ণায় ভো*গা*চ্ছে এর ভিতর আমি তোমার তরফ থেকে আর কোনো বাড়তি য*ন্ত্র*ণা সহ্য করতে পারবো না। প্লিজ তুমি আমায় ভালোবাসতে সময় নাও কিন্তু অন্যান্য দিক থেকে আমায় আর কখনও য*ন্ত্র*ণা দিও না।”

তাহির শক্ত পাথরের মতো স্থির ও নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

(১৬১)
তালুকদার ভিলায় সন্ধ্যার নিজের জন্য ঠিক করে দেওয়া রুমটিতে সন্ধ্যা নিলাদ্রকে নিয়ে এসে ওকে ধা*ক্কা দিয়ে ভিতরে রেখে সে নিজেও ভিতরে প্রবেশ করে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়। সন্ধ্যার এভাবে দরজা আটকানোর শব্দ শোনা মাত্র নিলাদ্র উল্টো ঘুরে থাকা অবস্থায় নিজের দু’গালে দু’হাত চে*পে ধরে বিরবিরিয়ে বললো….

—“নিল…নিল রে…আজ তুই শেষ। তাহিরের মতো আজ তোর গালেও ১০-১২ টা ধা*লা*ই পড়বে। কিন্তু এমনটা তো হতে দেওয়া যায় না। বিয়ের আগেই জুনিয়র বউয়ের হাতে থা*প্প*ড় খেলে আমার প্রেসটিজ বলতে তো কিছুই বেঁচে থাকবে না। তাই আমি আমার গাল থেকে এইমূহূর্তে আর হাত সরাবো না কিছুতেই না। এতে যদি পৃথিবী উ*ল্টে অগুনতিকভাগ ও হয়ে যায় তবুও আমি আমার গাল থেকে হাত সরাবো না।”

সন্ধ্যা নিলাদ্রের সামনে গিয়ে কমোরে দু’হাত রেখে দাড়িয়ে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে বললো……

—“গাল থেকে হাত সরান।”

নিলাদ্র ওভাবে থেকেই দ্রুত এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। সন্ধ্যা ধ*ম*কের স্বরে বললো…

—“সরান বলছি।”

নিলাদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর দু’গাল থেকে দু’হাত সরিয়ে বুকের সাথে গু*জে নেয়। সন্ধ্যা আবারও বললো……

—“হাত দু’টো ওখানে না রেখে নিজের কানে রাখুন আর গুণে গুণে ১০০ বার উঠাবসা করুন।”

সন্ধ্যার এরূপ কথা শুনে নিলাদ্রের চোখ জোড়া স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশ বড় হয়ে যায়। পরক্ষণেই নিলাদ্র বললো….

—“এই এই তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তুই জানিস ১ এর পিঠে দু দু’টো শূন্য বসালে তবেই ১০০ হয়। আর ১০০ বার কানে ধরে উঠাবসা করলে কি আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে নাকি!”

সন্ধ্যা স্বাভাবিক স্বরেই বললো….
—“১মিনিট লেইট করলে ১০ বার করে বেশিবার কানে ধরে উঠাবসা করতে হবে আপনায়। আপনি অলরেডি ২মিনিট সময় অপচয় করেছেন তাই আপনাকে ১০০ নয় ১২০ বার কানে ধরে উঠাবসা করতে হবে।”

নিলাদ্রের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। নিলাদ্র আবারও বললো….….

—“সন্ধ্যা জান আমার, একমাত্র হবু বউ আমার, স্বপ্ন-কল্পনা- বাস্তবের অফুরত্ন শক্তি আমার। নিজের একমাত্র হবু জামাইয়ের সাথে এতো বড় অ*ন্যায় তুই করতে পারিস নাই। তুই তো আমায় ভালোবাসিস বল!”

—“১৪০ বার।”

—“এ এ…তোর মনে কি বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া কাজ করছে না! দেশে পুরুষ নি*র্যা*ত*ন মা*ম*লা সম্পর্কিত কোনো আইন নেই বলে আমার মতো নিরীহ, অবলা পুরুষের উপর তুই এতো বড় নি*র্যা*ত*ন করবি!”

—“১৫০ বার।”

নিলাদ্র বুঝতে পারে এতো কথা বলে কোনো লাভই হবে না এখন উল্টে নিজের পায়ে কু*ড়া*ল মে*রে মে*রে পায়ের অবস্থা খা*রা*প করা হবে। তাই নিলাদ্র অ*স*হা*য়ের মতো মুখশ্রী করে দুই কানে দুই হাত রেখে উঠাবসা করতে শুরু করে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে কাউন্ট করতে শুরু করে৷

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭১)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৬২)
কুশল তরুনিমাকে নিয়ে ওদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের ভিতর প্রবেশ করে। কুশল রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। তরুনিমা সামনের দিকে দু’কদম বাড়াতে না বাড়াতেই কুশল তরুনিমার একহাত ধরে টা*ন দিয়ে নিজের বুকের উপর এনে ফেলে অন্যহাত দিয়ে ওর কমোর জড়িয়ে ধরে। কুশলের আকস্মিক এমন কাজে তরুনিমা কিছুটা ভ*র*কে যায়। পরক্ষণেই কুশল তরুনিমা মুখের উপর এসে পড়া মাঝারি আকারের চুলগুলো খুব যত্নসহকারে ওর কানের পিছনে গুঁজে দেয়। কুশলের গরম নিঃশ্বাস তরুর মুখশ্রীর উপর আ*ছ*ড়ে পড়ছে। কুশল তরুর থুতনিতে নিজের শাহাদাত আঙুল ঠেকিয়ে ওর মুখটা খানিক উঁচু করে ধরে। তরু ওর চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কুশল ওর ঠোঁটের হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তরুর চোখের উপর ফুঁউউ দেয়। পরক্ষণেই তরু ধীরে ধীরে চোখ মেলে কুশলের চোখের দিকে তাকায়। কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“সেদিনের অসম্পূর্ণ চাওয়া-পাওয়ার পূর্ণতা কি আজ হতে পারে মিসেস.তরুনিমা চৌধুরী!”

কুশলের কথার ভাঁজ বুঝতে পেরে তরুনিমা ওর চেহারায় লজ্জা ভাব ফুটিয়ে কুশলের বুকে মাথা ঠেকায়। কুশল বললো…

—“ইসস..এতো সুন্দর ভাবে সম্মতি জানালে কি আর নিজেকে ধরে রাখা যায়!”

এই বলে কুশল তরুনিমাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। তরুনিমা দু’হাতে কুশলের গলা জড়িয়ে ধরে ওর বুকের উপর মাথা নুইয়ে রেখেছে। বিছানার কাছে এসে কুশল তরুনিমাকে বিছানার উপর শুইয়ে দেয়। তরু তৎক্ষণাৎ দু’হাতে নিজের মুখশ্রী ঢেকে নিজের লজ্জাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কুশল হাসিমুখে তরুর পাশে বসে ওর উপর কিছুটা ঝুঁকে হু’হাত দিয়ে তরুর মুখের উপর রাখা ওর দু’হাত সরিয়ে ওর মাথার দু’পাশে বালিশের উপর আলতো ভাবে চেপে ধরে। তরুর নিঃশ্বাসের ও হৃৎপিণ্ডের উঠা-নামার বেগ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। কুশল তরুর দু’চোখের পাতায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। এরপর তরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে ঘোর লাগা স্বরে বললো….

—“আজ দু’টো মন ও দু’টো শরীরকে মিলেমিশে একাকার হয়ে ভালোবাসার সুখময় সাগরের অতলে ডুবে যাওয়া থেকে কেও বাঁচাতে পারবে না।”

এই বলে কুশল তরুর কানের লতিতে আলতো ভাবে বাইট দেয়। তরু ওর চোখ দু’টো খিঁ*চে আরো গভীর ভাবে বন্ধ করার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে ওদের দু’জনের মিলনের যাত্রার গভীরতা বাড়তে শুরু করে। আজ তাদের ভালোবাসা পরিপূর্ণতার রূপ পায়।

(১৬৩)
ইতিমধ্যে ৬৫ বার কানে ধরে উঠাবসা করার পর নিলাদ্রের অবস্থা কা*হি*ল হয়ে যায়। ৬৬ বারের সময় নিলাদ্র বসার পর যেনো আর উঠার শ*ক্তি পায় না। ধ*প মেঝের উপর বসে পরে নিজের মাথা দু’হাতে চে*পে ধরে বললো….

—“আ…আ…আহহহ…আমার মাথা ঘুরছে। পড়ে গেলাম রেএএ।”

এই কথা বলেই নিলাদ্র মেঝের উপর ঢ*লে পড়ে যায়। সন্ধ্যা চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই নিজের ভ্রু যুগল কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে নিয়ে নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো…..

—“বে*দ্দ*প ব্য*টা কি সত্যিই সে*ন্স লেস হলো! নাকি আমাকে টুপি পড়াতে না*ট*ক করছে!”

কিছুসময় পরও যখন নিলাদ্র সজাগ হয় না তখন সন্ধ্যা চেয়ার ছেড়ে উঠে নিলাদ্রের মাথার পাশে গিয়ে বসে। সেইসময় সন্ধ্যা লক্ষ্য করে নিলাদ্রের চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেও ওর চোখের মনি দু’টো ঘনঘন নড়ছে। সন্ধ্যার আর বুঝতে বাকি নেই যে নিলাদ্র ওর শা*স্তি থেকে বাঁচতে সে*ন্স লে*স হওয়ার মি*থ্যে নাটক করছে। সন্ধ্যা ওর ঠোঁটে বাঁ*কা হাসির রেখে ফুটিয়ে নিলাদ্রের মাথার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেডের কাছে গিয়ে বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে আবারও নিলাদ্রের মাথার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর মুখের উপর গ্লাসের সবটুকু পানি ঢেলে দেয়। মুখের উপর আকস্মিক এতোগুলো পানি পড়ায় নিলাদ্র লা*ফ দিয়ে শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে দ্রুততার স্বরে বললো….

—“আরে রুমের ছাদ ফু*টো হয়ে গিয়েছে রে। কতোগুলো পানি আমার মুখে উপর এসে পড়লো।”

সন্ধ্যা ওর বুকের সাথে দু’হাত ভাঁ*জ করে রেখে নিলাদ্রের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে বললো….

—“সে*ন্স লেস হয়ে যাওয়া কোনো মানুষের চোখের মনির এতো ঘনঘন নড়াচড়া করে না তাই নেক্সট টাইম এইসব বিষয়ে সতর্ক থেকে সে*ন্স লেস হওয়ার নাটক করিয়েন কেমন!”

এই বলে সন্ধ্যা রুমের দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বাহিরে চলে যায়। নিলাদ্র সন্ধ্যার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বললো…

—“একজন প্রোফেশনাল ডাক্তার হয়েও সে*ন্স লে*স হওয়ার সামান্য অভিনয়টুকু ঠিক ভাবে করতে পারলাম না ছি: ছি: ছিহ্:।”

(১৬৪)
সকালবেলা…….
জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের সূর্যের মিষ্টি রোদ কুশলের চোখে এসে পড়লে ওর ঘুম ভে*ঙে যায়। কুশল চোখ মেলে তাকাতেই তরুকে নিজের বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। তরুর মায়া মাখানো মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায় কুশলের। পরক্ষণেই কুশলের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল লক্ষ্য করে সূর্যের আলো তরুর চোখেও এসে পড়েছে যার ফলে তরু চোখ-মুখ কুঁ*চ*কে নিয়ে ওকে এটার জানান দিচ্ছে যে ওর ঘুমের বি*ঘ্ন*তা ঘটছে। কুশল ওর ডান হাত একটু উঁচু করে ছায়া তৈরি করে তরুর চোখের উপর সূর্যের আলো আসার পথ বন্ধ করে দেয়। পরক্ষণেই তরু কুশলকে একটু শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে আবারও গভীর ঘুম ডুবে যায়।

বেশকিছুসময় পর তরুর ঘুম ভে*ঙে যায়। তরু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই ওর চোখের সামনে কুশলের হাত উঁচু করে রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করে। কুশল এতোসময় তরুর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তরুকে জাগতে দেখে কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“অবশেষে ঘুম ভাংলো আমার মনের রাণীর।”

তরু ভ্রু কুঁচকে বললো….
—“আপনি আপনার হাত আমার চোখের সামনে এভাবে উঁচু করে রেখেছেন কেনো?”

কুশল ওর হাত সরাতেই এক টুকরো রোদ তরুর চোখে এসে বিঁ*ধ*লে সঙ্গে সঙ্গে তরু চোখ-মুখ কুঁ*চ*কে বন্ধ করে ফেলে। কুশল আবারও ওর হাত উঁচু করে তরুর চোখের সামনে ধরে বললো….

—“আশা করছি তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছো৷”

তরু কুশলের বুকের উপর দু’হাত ভাঁ*জ করে থুঁতনি ঠেকিয়ে বললো….
—“কয়টা বাজে এখন?”

কুশল চোখ দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করলে তরু ঘাড় বাঁ*কি*য়ে সেদিকে লক্ষ্য করতেই দেখে দেওয়ালের উপর একটা দেওয়াল ঘড়ি টাঙানো আছে। ঘড়িতে তখন সময় সকাল ৯টা। তরু আবারও কুশলের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললো….

—“আপনি বিগত ৩ঘন্টা যাবৎ হাত এভাবে উঁচু করে রেখে ছায়া দিয়েছেন যেনো আমার ঘুমের বি*ঘ্ন*তা না ঘটে!”

কুশল স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“তোমার মায়া মাখানো ঘুমন্ত মুখশ্রীর উপরেই দৃষ্টি স্থির করে রেখেছিলাম এতোসময়। কিভাবে যে এতোটা সময় পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারি নি। আমার কাছে এই ৩ঘন্টাকে ৩সেকেন্ডের ও কম সময় বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে আজীবন ধরে দেখে গেলেও দেখার শেষ হবে না আমার বউ।”

কুশলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে তরুর চোখে খুশির অশ্রু আর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠে। তরু কুশলের বুকের উপর আবারও মাথা নুইয়ে বললো….

—“এতো ভালোবাসা…এতো সুখ…এতো যত্ন কি আমার কপালে দীর্ঘস্থায়ী হবে কুশল! আপনার এতো ভালোবাসা যে আমার মনের ভিতর ভ*য়ে*র সৃষ্টি করছে।”

কথাগুলো বলতে বলতেই তরুর দু’চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু কুশলের উন্মুক্ত বুকের উপর পড়ে কুশল তা অনুভব করতে পায়। কুশল দু’হাতে তরুকে জড়িয়ে ধরে বললো….

—“ভ*য় বা চি*ন্তা*র কোনো কারণ নেই বউ। সব রকম বি*প*দে*র সময় আমি তোমার সামনে ঢা*ল হয়ে দাঁড়াবো। কাওকে তোমার শরীরে সামান্য আঁ*চ*র কাটতেই দিবো না।”

—“আপনি আমার সামনে ঢা*ল হয়ে দাঁড়িয়ে আমায় বি*প*দ থেকে রক্ষা করবেন তাহলে আপনার সামনে কে ঢা*ল হয়ে দাঁড়াবে! আমার জন্য তো আপনি বার বার বি*প*দে*র সম্মুখীন হতে পারেন না। কোনো ভাবেই আমি আপনাকে হা*রা*তে রাজি না।”

—“আমার কিছুই হবে না। সবসময় সত্য ও ন্যয়ের পথে চলেছি আমি। তাই আমাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সৃষ্টিকর্তাই যথেষ্ট।”

তরু আর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে নেয়। কুশলও একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নেয়।

(১৬৫)
ড্রয়িংরুমে সোফায় একা একাই বসে আছে সন্ধ্যা। সেইসময় নিলাদ্র ড্রয়িং রুমে এসে সন্ধ্যার পাশে বসলে সন্ধ্যা নিলাদ্রের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে কিছুটা সরে বসে। সন্ধ্যাকে এমন করতে দেখে নিলাদ্র ভ্রু কুঁচকে নিয়ে আবারও সন্ধ্যার সন্নিকটে গিয়ে বসে কিন্তু সন্ধ্যা আবারও একই কাজ করে। এভাবে কিছুসময় চলতে থাকলে একটা সময় সন্ধ্যা সোফার একেবারে কর্ণারে চলে আসে। নিলাদ্র সন্ধ্যার উপর দৃষ্টি স্থির রেখে বললো….

—“আরেকটু সরে বসবি না এবার!”

সন্ধ্যা মুখে কিছু না বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিলাদ্র মনে করেছিলো সন্ধ্যা সত্যিই হয়তো সরে বসতে যাবে তাই সে সন্ধ্যাকে ধরার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে নিজেই সোফার পাশে ফাঁকা স্থানে প*ড়ে যায়। নিলাদ্রকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে না চাইতেও সন্ধ্যা হেসে উঠে। নিলাদ্র মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই ঘাড় বাঁ*কিয়ে অ*স*হা*য়ের মতো মুখশ্রী করে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যা ওর ঠোঁট চে*পে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে নিজের বুকের একপার্শে এসে পড়া চুলগুলোকে এক হাত দিয়ে ঝা*ট*কা মে*রে পিঠের উপর ফে*লে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নিলাদ্র উপরের দিকে তাকিয়ে বললো….

—“ইয়া আল্লাহ….বিয়ের আগেই এই মেয়ে আমার যে ক*রু*ণ হা*ল বানিয়ে ছাড়ছে বিয়ের পর না জানি আমার অবস্থা কি হবে। এসব ভাবতেও তো আমার শরীর শি*উ*রে উঠছে।”

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৬৬)
সকালের নাস্তার পর্ব শেষ করে তালুকদার ভিলার ড্রয়িংরুমে রুমে সোফায় তালুকদার পরিবারের সদস্যরা সহ কুশল, নিলাদ্র, সন্ধ্যা আর তরুনিমা। সেইসময় তাহিরের মা রেবেকা তালুকদার কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“কুশল বাবা..ভ*য়ং*ক*র এই র*ক্ত ক্ষ*য়ী প্র*তি*শো*ধের খেলার পরবর্তী পরিকল্পনা কি তোমার!”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“যার জন্য অরুনিমাকে দ*রু*ণ য*ন্ত্র*ণা সহ্য করে মা*রা যেতে হয়েছে আর তাহিরকে বিনা দো*ষে পাঁচ বছর জে*ল খা*ট*তে হয়েছে সেই হবে আমাদের প্রথম শি*কা*র।”

—“কে সেই খু*নি বাবা!”

—“রিজভী ও কামিনী চৌধুরীর একমাত্র পা*পী ছেলে
রাজবীর চৌধুরী নিজের পা*প কর্মকে ঢাকতে অরুনিমাকে খু*ন করেছিলো আর সেই খু*নে*র দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছিলো তাহিরের উপর।”

সন্ধ্যা বললো….
—“ঐ হা*রা*ম*খো*র*কে পরিকল্পনার জালে ফাঁ*সা*বে কি করে তুমি মেজো ভাইয়া!”

—“ওদের নিজেদের তৈরিকৃত ষ*ড়*য*ন্ত্রে*র জালে ওরা নিজেরাই ফেঁ*সে যাবে।”

হুমায়রা বললো….
—“ঐ শ / য় / তা / ন/ টাকে আমি নিজ হাতে শা / স্তি দিতে চাই কুশল ভাই। ওর জন্য আমার তাহির বিনা দোষে জে*ল খে*টে*ছি*লো। ওকে তিল তিল করে য*ন্ত্র*ণা দিয়ে দিয়ে মা*র*তে চাই আমি।”

হুমায়রার এরূপ কথা শুনে তাহির বললো……..
—“শরীরে নেই এক তোলা মাংস সে নাকি রাজবীরকে তিল তিল করে য*ন্ত্র*ণা দিয়ে মারবে! এটা বর-বউ পুতুল দিয়ে পুতুল খেলার মতো সহজ কাজ নয়। তাই আগে ভালো ভাবে খেয়ে শরীরে শক্তি জোগা তারপর এমন বড় বড় চা*পা মা*রি*স।”

তাহিরের এরূপ কথা শুনে হুমায়রা বুকের উপর দু’হাত ভাঁ*জ করে তাহিরের দিকে একবার রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দু’গাল ফুলিয়ে নিরব হয়ে বসে থাকে। রেবেকা তাহিরের কান টেনে ধরে বললেন……

—“সবসময় মেয়েটার পিছনে লাগা ছাড়া তোর আর কোনো কাজ নেই তাই না পা*জি ছেলে! মেয়েটা একটু সাহসিকতা দেখাচ্ছে তো কি হইছে শুনি তাই তোর ওকে এসব বলে রাগিয়ে দিতে হবে!”

—“আহহ…মা! ছাড়ো লাগছে। আমি তোমার নিজের ছেলে কোথায় তুমি আমায় সাপোর্ট করবে তা না করে ওর দল ভাড়ি করছো!”

হুমায়রা এমন দৃশ্য দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো…..
—“বেশ হয়েছে, খালা আরো জোড়ে কানটা মু*লে দাও তো। একদম ছাড়বে না।”

রেবেকা তাহিরের কান ছেড়ে দেওয়া মাত্র তাহির বললো……
—“তবে রেএএ…দেখাচ্ছি তোকে মজা।”

তাহির সোফা ছেড়ে উঠতেই হুমায়রাও সোফা ছেড়ে উঠে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যেতে যেতে বললো….

—“খালামনিইই বাঁচাও আমায়!”

তাহিরও হুমায়রার পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে শুরু করে আর উচ্চস্বরে বলে…

—“খালার বাচ্চা হিমু..আজ তোকে আমার হাত থেকে কেও বাঁ*চা*তে পারবে না।”

ওদের এমন খুনসুটি আচারণ দেখে উপস্থিত বাকিরা শব্দ করে হাসতে শুরু করে।
.
.
.
বিকেলবেলা……..
সন্ধ্যা, নিলাদ্র, কুশল, তরুনিমা তালুকদার ভিলা থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে চৌধুরী ভিলার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে নিলাদ্রকে ওর হোটেলের সামনে নামিয়ে দেয় কুশল। আরো বেশ কিছুসময় ধরে ড্রাইভিং এর পর ওরা চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তরু আর সন্ধ্যা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে আসতেই দেখে ড্রয়িংরুম পুরো ফাঁ*কা। সন্ধ্যা ফিসফিসিয়ে তরুনিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো…

—“কি ব্যপার বলো তো মেজো ভাবী! আজ অ*মানুষ গুলোর একজনও ড্রয়িংরুমে উপস্থিত নেই কেনো! কোথাও আমরা মে*রে দেওয়ার আগেই নিজেদের পা*পে*র আগুনে পু*ড়ে ছা*ড়*খা*ড় হয়ে গেলো না তো! অবশ্য এমনটা হলে ভালো হতো।”

—“সন্ধ্যা…এখন এসব নিয়ে কোনো কথা বলো না। দেওয়ালেরও যে কান আছে এটা ভুলে যেও না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর দেখা যাবে।”

—“ঠিক আছে।”

এই বল সন্ধ্যা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। সেইসময় কুশলও বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। অতঃপর কুশল আর তরুনিমাও সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজেদের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। কামিনী আর রিজভীর রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যেতে নেওয়ার সময় সন্ধ্যা ওদের রুমের ভিতর থেকে রাজবীরের কন্ঠস্বর স্পষ্টভাবে শুনতে পায়। সন্ধ্যা থেমে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে এসে দরজায় কান পেতে দাঁড়ায়। কামিনী বললেন….

—“রাজ..সোনা মানিক আমার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা কর তুই। তোর একটা ভু*ল পদক্ষেপ আমাদের সব পরিকল্পনা ভে*স্তে দিতে পারে।”

রাজবীর উচ্চস্বরে বললো….
—“তোমাদের পরিকল্পনা, তোমাদের উদ্দেশ্য তোমাদের কাছেই রাখো মা-বাবা। এসবের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। আমার এখন শুধু একটাই লক্ষ্য সন্ধ্যার বিয়ের আগেই আমার ওকে চাই এক ঘন্টার জন্য হলেও। চাই মানে চাই-ই। এর জন্য যদি কৌশলে ওকে আমায় উ*ঠি*য়ে নিয়ে যেতে হয় আমি তাই করবো।”

রাজবীরের এরূপ কথা শুনে সন্ধ্যা অনেক অবাক হয়ে যায়। রিজভী বললেন….
—“রাজ বাবা…আস্তে কথা বল। কেও শুনে ফেলবে।”

—“কে শুনতে আসবে! বাড়িতে ওরা কেও ই নেই জানো না!”

কামিনী বললেন….
—“কিন্তু বাবা এতো বড় রি*স্ক নেওয়া কি ঠিক হবে! কুশল কতোটা চালাক আর তীক্ষ্ণ চিন্তাধারার ছেলে তা তো তুই আমরা খুব ভালো করেই জানি। বিয়ের দিন সকলের চোখকে ফাঁ*কি দিয়ে সন্ধ্যাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া কি এতোটা সহজ হবে! আর তুই সন্ধ্যাকে উঠিয়ে কোথায়-ই বা নিয়ে যাবি!”

—“সেসব নিয়ে দু*শ্চি*ন্তা করার কিছুই নেই মা। সন্ধ্যাকে আমি উঠিয়ে শহর থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলের ভিতর পোড়া বাড়িতে নিয়ে যাবো। যেখানে একবার আমি নিয়ে যেতে সফল হলে কুশল কেনো ওর মতো হাজারজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি সন্ধ্যাকে খোঁজার হাজার চেষ্টা করলেও ওর অস্তিত্ত্ব কখনও খুঁজে পাবে না। এসব মেয়ে উঠিয়ে নিজের সাধ মিটানোর কাজ করতে আর তার প্রমাণ ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিতে তোমার ছেলে ভিষণই দক্ষ।”

কামিনী অবাক স্বরে বললেন….
—“তুই কি সন্ধ্যাকে মে*রে ফে*ল*বি!”

—“অবশ্যই! ওকে জীবিত ছেড়ে দিলে তো আমি ফেঁ*সে যাবো। এতো বড় বো-কা*মী কেও করবে নাকি মা! তোমার ছেলের হাতে একবার যেই মেয়ে ফেঁ*সে গিয়েছে সেই মেয়েকে ছিঁ*ড়ে খু*ব*লে খে*য়ে এই দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরের জন্য নি*শ্চি*হ্ন করে দিয়েছি।”

কথাটুকু বলেই রাজবীর স্বশব্দে হেসে উঠে। রিজভী রাজবীরের কাঁধে চা*প*ড় দিয়ে হাসিমুখে বললেন….

—“সাব্বাস…এই না হলে বাপকা বেটা!”

ওদের কথপোকথন গুলো শুনে সন্ধ্যার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। ভ*য়ে, চিন্তায় সন্ধ্যার শরীরে কাঁ*টা দিয়ে উঠছে। পা দু’টো থ*র থ*র করে কাঁ*পছে। এই মানুষ রূপী অ*মানুষগুলো আরো কতোটা জ*ঘ*ন্য*তম খা*রাপ হতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা হয়তো সম্ভব না। সন্ধ্যা আর একমুহূর্তের জন্য সেখানে না দাঁড়িয়ে কুশলের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ছু*ট*তে নিলে রাজবীরের রুমের দরজার পাশে থাকা ফুলদানীতে সন্ধ্যার হাত লেগে যায়। ফুলদানীটা সঙ্গে সঙ্গে মেঝের উপর পরে ভে*ঙে কয়েকটুকরো হয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা থামে না সে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। বাহির থেকে কিছু ভা*ঙা*র শব্দ কানে পড়তেই রাজবীর, কামিনী আর রিজভী তিনজনই কিছুটা ভ*র*কে উঠে। রাজবীর দ্রুত কদমে দরজার কাছে এসে দরজা খুলতেই দেখে ওর দরজার সামনে ওর পছন্দের ফুলদানীটা ভে*ঙে পড়ে আছে। সেইসময় রাজবীর লক্ষ্য করে ওর রুম থেকে কিছুটা দূরে জানালা দিয়ে একটা বিড়াল বাহিরে লা*ফ দেয়। রাজবীর মেঝের উপর পড়ে থাকা ফুলদানির একটা ভা*ঙা টুকরো হাতে নিয়ে রাগে ভরপুর দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ বিড়ালের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। পরক্ষনেই রাজবীর বসাবস্থা থেকে উঠে রুমের ভিতরে আসতেই কামিনী বললেন….

—“কি ভা*ঙা*র শব্দ হলো!”

রাজবীর রাগী স্বরে বললো….
—“আমার পছন্দের ফুলদানীটা ভে*ঙে ফেলেছে একটা অ*জা*ত বংশের বিড়াল। আর একবার চোখের সামনে পড়লে ওকে কু*চি কু*চি করে কে / টে নদীর জলে ভাসিয়ে দিবো।”

—“শান্ত হ বাবা। এতো অল্পতে মা*থা গরম করলে কি চলে!”
.
.
.
সন্ধ্যা দৌড়াতে দৌড়াতে কুশলের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজায় আ*ঘা*ত করে। দরজা আলতো ভাবে ভে*রা*নো থাকায় সন্ধ্যা তাল সামলাতে না পেরে দরজা খুলে মেঝের উপর উ*পু*র হয়ে পড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে ‘আহহহহ’ শব্দ উচ্চারণ করে। কুশল আর তরুনিমা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ এমন শব্দ শুনতে পেয়ে ওরা দু’জনেই তড়িৎগতিতে বেলকনি থেকে রুমের ভিতর আসতেই দেখে সন্ধ্যা নিজের বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কনুইয়ের অংশ চেপে ধরে মেঝের উপর বসে আছে। তরু আর কুশল দু’জনেই সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে যায়। তরু সন্ধ্যাকে ধরে বিছানায় এনে বসিয়ে দিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো….

—“সন্ধ্যা কি হয়েছে তোমার! দরজার ওখানে পড়ে গেলে কি করে! ইসস হাতটাও তো কতোটা ছি*লে গিয়েছে। র*ক্ত বের হচ্ছে। এক্ষুণি ড্রে*সিং করে দিতে হবে।”

দৌড়ানোর জন্য সন্ধ্যা এখনও হাঁ*পা*চ্ছে। কুশল সন্ধ্যার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তরুনিমা ওয়ারড্রবের উপর থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসে সন্ধ্যার ক্ষ*ত স্থানটা ড্রে*সিং করে বে*ন্ডে*জ করে দেয়। সন্ধ্যা কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করতেই ‘পানি…পানি’ শব্দটি দু’বার উচ্চারণ করলো। কুশল বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে সন্ধ্যাকে দেয়। সন্ধ্যা গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি পান করে। তরুনিমা সন্ধ্যার হাত থেকে ফাঁকা গ্লাসটা নিয়ে বললো….

—“এখন বলো কি হয়েছে তোমার।”

—“দরজাটা বন্ধ করে এসো মেজো ভাবী।”

তরু বিনা বাক্যে বিছানা থেকে নেমে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে আবারও সন্ধ্যার পাশে এসে বসে। সন্ধ্যা রাজবীর আর ওর বাবা-মায়ের সাথে হওয়া সম্পূর্ণ কথপোকথনগুলো কুশল-তরুনিমা বলে। তরুনিমা একহাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে কুশলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। কথাগুলো বলতে বলতেই সন্ধ্যার চোখ ভিজে গিয়েছে। পরক্ষণেই কুশল কোনো প্রতিত্তুর না করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরু কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় আর সন্ধ্যাকে সামলানোর চেষ্টা করে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……