হৃদমাঝারে তুমি পর্ব-১৯+২০

0
430

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_১৯

সবাই ইফতারি করে রেস্ট নিচ্ছে তখন হঠাৎ করেই আরফান এসে হাজির হলো।দাদুর সাথে কথা বলার পরে আরফান মিহুকে আর নীলুকে যেতে দিয়েছে।কিন্তু ও বলেছিল ও আসতে পারবেনা।তারপর হঠাৎ করেই আরফান এসে হাজির হলো।ওকে দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করে এসেছে।ঘর্মাক্ত শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান।সবাই ছাদে বসে রেস্ট নিচ্ছিল বড়রা বাদে।আরফান এসেছে শুনে মিহু বেশ অবাক হলো।মাহিন ওকে কিছু বলবে সেটা শোনার জন্য ছাদের একপাশে বসে ছিল। আরফান আসার কথা শুনে মাহিনকে বলল

-মাহিন ভাই আমি একটু পরে আসছি।তুমি ওদের সাথে কথা বলো।

মিহুর চলে যাওয়া দেখে মাহিনের বুক কেঁপে উঠল। আরফান এসেছে শুনে মিহু তড়িঘড়ি করে চলে যাচ্ছে। এটা কিসের ইঙ্গিত?মাহিনকে পাত্তা দিচ্ছে না।মাহিন আকাশের পানে তাকিয়ে রইল

আরফান মিহুর রুমে বসে আছে।মিহু গুটি গুটি পায়ে আরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আরফান মিহুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।আরফানকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহু একটু ভয় পেয়ে গেল।তাই জিজ্ঞেস করল

-কিছু বলবেন?

আরফান মিহুর দিকে তাকিয়েই বলল-না

-তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
-কেন তাকিয়ে থাকলে অসুবিধা?
-না মানে,

মিহুর কথা শেষ করার আগেই আরফান বলল
-অসুবিধা থাকলেও কিছু করার নেই। আমি তাকিয়ে থাকবো।

মিহু আরফানের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। এ কোন আরফানকে দেখছে।যে কিনা মুখ থেকে শব্দ বের করতে কষ্ট পায় সে মিহুর সাথে রসিকতা করছে?মিহুকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরফান আবার বলল

-এভাবে তাকালেও কিছুই হবে না। আমার বৌ এর দিকে আমি তাকিয়ে থাকবো না তো আর কে তাকাবে?আর কারো তার দিকে তাকানোর অধিকার নাই।

মিহুর মনে হলো ও বুঝি কল্পনা দেখছে।যে আরফান প্রথমে বলেছিল ওকে স্ত্রীর অধিকার দিতে পারবে না সেই আরফান ওকে বৌ বলছে।আরফান বিছানায় শুয়ে পড়ল।তারপর মিহুকে ইশারায় ওর কাছে আসতে বলল।মিহু কনফার্ম হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল

-আমাকে বলছেন?

মিহুর এমন কথায় আরফান আশে পাশে তাকালো।তারপর মিহুকে বলল

-এখানে কাউকে দেখতে পাচ্ছো?
-না তো
-তাহলে তোমাকেই বলছি।

আরফানের বলা তুমি শব্দটা শুনে মিহুর মাথা ঘুরিয়ে পড়ার উপক্রম।মিহুকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরফান বলল

-এদিকে আসো

মিহুর আরফানের দিকে এগিয়ে গেলে ওকে আরফানের মাথার কাছে বসতে বলে।তারপর বলে

-আমার মাথাটা ব্যাথা করছে।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেও তো।

মিহু কাঁপা কাঁপা হাতে আরফানের চুলে হাত দিল। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাতে থাকলো।মিহুর হাত বোলানোতে আরফানের খুব ভালো লাগে।আরফান নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পরে মিহু দেখলো আরফান ঘুমিয়ে গিয়েছে।তাই হাত সরিয়ে ওর গায়ে কাঁথা টেনে দিল।তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে গেল।যখনই দরজা পেরিয়ে বাইরে যাবে এমন সময়

-তোমাকে বাইরে যেতে বলিনি তো।জানো না রোজার সময় স্বামীর খেদমত করলে দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায় ।তুমি সেই সওয়াব থেকে আমার বৌকে বঞ্চিত করছো।দিস ইজ ভেরি ব্যাড

আরফানের কথায় মিহুর পা থেমে গেল। এ কোন মুসিবতে পরল। এই দুদিন তো স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে।তাহলে আজকে এতো অস্বাভাবিক ব্যবহার কেন করছে।মিহু আরফানের দিকে তাকিয়ে বলল

-আসলে ,,,মানে

-কোনো আসলে নকলে নাই।তোমার যাওয়ার হলে তুমি চলে যাও কিন্তু আমার বৌকে তার সওয়াব আদায়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার রাইট তোমার নেই।সো এখানে চলে এসো।

মিহুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।একবার বলছে ওকে যেতে আবার বলছে তার বৌকে এখানে থাকতে।তার বৌ তো মিহুই।তাহলে কি করবে?মিহুর এমন অবস্থা দেখে আরফান একটু হাসলো।তারপর মিহুকে উদ্দেশ্য করে বলল

-আমার বৌকে বলো আমার জন্য এক সেট জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতে।আমি এখন সাওয়ার নিতে যাচ্ছি। বের হয়ে যেন তাকে এখানে কাপড় সহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।বলে আরফান উঠে সাওয়ার নিতে চলে গেল।মিহু হতভম্ব হয়ে আছে।কি বলে গেল?জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করবে কি করে?তারপর মনে পড়ল মাহিনের সাইজ আরফানের সাথে মিলতে পারে।ও মাহিনের রুমে চলে গেল

-মাহিন ভাইয়া আপনি আমাকে একবারো দেখতে যান নি। এমন কি এখন পর্যন্ত আমি কেমন আছি সেটাও জিজ্ঞেস করেন নি।

মাহিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।তখন নীলু মাহিনকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলে।নীলুর কথার কোনো উত্তর দিল না মাহিন।শুধু একবার নীলুর দিকে তাকিয়ে আবারো আকাশের দিকে তাকালো।মাহিনকে কিছু বলতে না দেখে নীলু জিজ্ঞেস করল

-আপনি কি ঐ ঘটনার জন্য নিজেকে এখনো অপরাধী ভাবছেন? এখানে আপনার কোনো দোষ নেই।তাই আপনি নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারেন

-আপনি বুঝলেন কীভাবে আমার কোনো দোষ নেই।
-আরফান ভাই জেনে ফেলেছে আসল অপরাধী কে?কিন্তু আমি তার নাম জানিনা

নীলুর কথায় মাহিন একটু ঘাবড়ে গেল।তুলি যতই অপরাধ করুক না কেন ফাস্ট অফ অল তুলি ওর বোন। ও চায় না তুলির কিছু হোক।

-নাম না জানলে বুঝলেন কীভাবে ওটা আমি না। আমিও তো হতে পারি।

-ভাইয়া বলেছে সে নাকি একজন মেয়ে।

-আচ্ছা তাহলে তোমার ভাই এটা জেনেছে কীভাবে?

-আমি জানি না।তবে ভাইয়াও নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না কোন মেয়েটা।

-যদি মেয়েটার নাম জেনে ফেলো বা তাকে চিনে যাও তাহলে তাকে কী শাস্তি দেবে

-আমি কিছুই শাস্তি দেব না কারণ আমি শাস্তি দিলে তো আর যা ঘটেছে তা ফিরাতে পারব না।তার থেকে বরং তাকে সাবধান করা ভালো যাতে ভবিষ্যতে এরকম কোনো ঘটনা না ঘটায়।

নীলুর দিকে মাহিন একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল নীলু মেয়েটা বেশ মায়াবী।এমন একটা মেয়ের সাথে তুলি এরকম খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল।নীলুর জন্য একটু খারাপ ও লাগল।তারপর নীলুকে বলল

-দেখো যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমি মনে করেছিলাম আমাকে দেখলে হয়তো তোমার খারাপ লাগবে বা তুমি আমাকে দেখে ঘাবড়েও যেতে পারো।তাই আমি যেতে চাই নি।তবে যা কিছু ঘটেছে তার কিছুর জন্য হলেও হয়ত আমি দায়ী।তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

-আরে না না আপনি একথা বলছেন কেন?

মাহিন আর কিছু না বলে নিচে চলে গেল। এতক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করছে সে আর আসবে না। তার মনে হয় খেয়াল নেই যে সে একজনকে কথা দিয়ে গিয়েছে আর তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।সে তো ব্যস্ত এখন তার আসল মানুষকে নিয়ে।তাহলে কী মাহিনের আশার প্রদীপ নিভে গেল।

মিহু মাহিনের আলমারি থেকে একসেট জামা বের করল আরফানের জন্য।তখন হঠাৎ নজর পড়ল এক কর্ণারে একটা বক্সের দিকে।বক্স টা খুলে দেখতে পেল একসেট নীল রেশমি চুরি,একটা নীল শাড়ি, একটা গাজরা,একটা কানের দুল আরো ছোট ছোট দুয়েকটা জিনিস। আর তার ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট

‘এই যে মায়া কন্যা!তোমার মুখে এতো মায়া কেন?তোমাকে দেখলেই হার্টবিট দ্রুত চলে এমন কেন বলোতো।আচ্ছা তুমি কি হবে আমার এই নাম না জানা রোগের ওষুধ? আমি তোমাকে বলতে পারছি না তাই চিরকুটে লিখলাম। আমি খুব ভালোবাসি এই মায়া কন্যাকে।হবে কি আমার তুমি?’

মিহু মাহিনের আলমারিতে নীল শাড়ি আর এই চিরকুট টা দেখে নিশ্চিত যে মাহিন কাউকে ভালোবাসে।কিন্তু কাকে ভালোবাসে? আর এই কথা মিহুর কাছ থেকে লুকালোও বা কেন।শাড়িটা হাতে নিয়ে এসব কথাই ভাবছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই মাহিন এষে পড়ে।মিহুর হাতে নীল শাড়ি দেখে জিজ্ঞেস করে

-শাড়িটা পেলি কোথায়?

-তার আগে বলো কে এই মায়া কন্যা? যাকে নিয়ে তোমার এত আবেগ।কে সেই মেয়ে যাকে তুমি এত ভালোবাসো

মাহিন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
-ভালোবাসা!ভালোবাসা না ছাই।তোর যদি শাড়িটা পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে নিয়ে যা

-কেন আমি নেবো?তুমি যার জন্য কিনেছো তাকে দাও

-শোন মিহু আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।তাকে বলার মতো কোনো কিছুই আমার নেই।কারণ সে আমাকে ভালোবাসে না

-ভালোবাসা যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে তাকে বলে দেখো।কারণ বৈধ ভালোবাসায় কখনো হার হয় না।তাকে না বলে কীভাবে তুমি ভাবলে যে সে তোমাকে ভালোবাসে না।আচ্ছা শাড়িটা আমি নিয়ে গেলাম।তোমার প্রয়োজন পড়লে বলো আমি তোমাকে সাহায্য করব।

বলে নীলু চলে গেল।মাহিনের আশার প্রদীপ নিভে গিয়ে জ্বলে উঠলো।মিহু ওকে এ কি বলে গেলো।আসলেই কি মিহু ওর হবে?ওর ভালোবাসা তো সত্যি তাহলে সত্যিই কি নীলু ওকে ফিরিয়ে দেবে না?

আরফান মাহিনের একটা পাঞ্জাবি পড়লো।আয়নার দিকে তাকিয়ে আয়নার ভেতরে মিহুকে দেখতে লাগলো।মিহুর এদিকে খেয়াল নেই।কোথা থেকে একটা নীল শাড়ি পেয়েছে সেটা নিয়ে ব্যস্ত সে।একবার এভাবে গুছাচ্ছে তো আরেকবার ওভাবে।আরফান বেশ বিরক্ত হলো।যে মেয়েটার জন্য অফিসের কাজ ফেলে এখানে ছুটে এসেছে সেই মেয়েটাই ওকে পাত্তা দিচ্ছে না।আসলে আজকে অফিসের সামনে একটা এক্সিডেন্ট হয় আর সেখানে একটা মেয়ে মারা যায়।তখন একটা ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।কারণ মেয়েটা ছিল তার সদ্য বিয়ে করা বৌ।এটা দেখে আরফানের মিহুর কথা মনে হলো।ঐ মেয়েটার জায়গায় বার বার মিহুকে কল্পনায় ভেসে উঠলো।কিছুতেই মন থেকে এটা মুছতে পারছিল না। ও তখনই বুঝে যায় খুব অল্প সময়ের ভেতরে মিহু ওর মনে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তো সব কাজ ছেড়ে ছুড়ে ও মিহুর কাছে চলে আসে।কিন্তু এই মেয়ে তো আর জানে না আরফানের মনের কথা।সে তো দিব্যি ব্যস্ত তার কর্মকান্ড নিয়ে।আরফান একটা গম্ভীর কন্ঠ করে মিহুকে ডাক দিল।মিহুর নিজের ও খেয়াল ছিল না যে আরফান রুমের মধ্যে আছে।তাই হঠাৎ আরফান ডাক দেওয়ায় ভয় পেল।ধীরে ধীরে আরফানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল

-কিছু লাগবে?
-হ্যাঁ
-কি?

আরফান ইশারা করে ওর পাঞ্জাবির বোতাম আটকে দিতে বলল।মিহুর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। এতো সহজ একটা কাজ নিজে করতে পারে না আর এর জন্য এরকম ভয় পাইয়ে ডাক দেওয়া লাগে।মিহু মুখটা ফুলিয়ে বোতাম গুলো আটকিয়ে দিল।তারপর সরে গেল। আরফান মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল আর মনে মনে ভাবলো

-মনে হয় একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে।মিহুকে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।আর মিহু তো হঠাৎ করে আরফানের এমন রুপের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবেনা।তবে আরফান মিহুর একটা কাজে বিরক্ত হলো।আর সেটা হলো অন্যের দেওয়া শাড়ি নিয়ে এক্সাইটেড হওয়া।থাক এর মজা মিহুকে কালকে দেখাবে আরফান।মিসেস আরফান বি রেডি।

#চলবে

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_২০

আজকে সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।মিহুর এই কয়েকদিনে তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি।কিন্তু যাওয়ার সময় বিদিশা ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।কারণ বিদিশারা মিহুদের সাথে সাথেই বের হয়েছে বাসায় যাওয়ার জন্য।সবাই একসাথেই গাড়িতে উঠেছে কিন্তু বিদিশারা যাবে মিহুদের উল্টো দিকে।পিয়াস ফরমালিটি রক্ষার জন্য বিদিশাকে বলল

-আবার আসবেন কিন্তু।

বিদিশা কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসল।মিহুর ও খারাপ লাগছে।কারণ বিদিশার সাথে ওর অনেক মিল আছে।বিদিশাদের গাড়ি ছেড়ে গিয়েছে।পিয়াস আরফানের গাড়িতে উঠতে নিলে আরফান বলে

-নেহালের গাড়িতে যা,আমার কাজ আছে।

পিয়াস বির বির করে বলল-কাজ তো থাকবেই তোমার।গাড়িতে তো এখন তোমার বৌ আছে তাই না।

পিয়াসকে বির বির করতে দেখে আরফান জিজ্ঞেস করল-কিছু বলেছিস?

-আরে না না কিছু বলি নি।তারপর মনে মনে বলল কান না যেন রেকর্ডার।নেহালের গাড়ির কাছে গিয়ে সামনের ছিটে বসতে নিলেই নেহাল বলে

-তুই কি কোনোদিন মানুষ হবি না?

পিয়াস হতভম্ব হয়ে বলে-আমি আবার কি করলাম?

-তোকে কি এখন বুঝাতে হবে?

-ভাই না বললে বুঝব কি করে?

-তুই পেছনে গিয়ে বস আর পিহুকে সামনে পাঠা।আসতে না চাইলেও বলবি তুই পেছনে বসবি।

-ও ও ও তাহলে এই ব্যাপার। আগে বললেই হয়

পিয়াস পেছনে গিয়ে বলল-ভাবি আপনি সামনের সিটে যান আমি আপনার সিটে বসব

পিহু সরে গিয়ে পিয়াসকে জায়গা করে দিল আর বলল-
সামনের সিটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি সরলেই তো আপনি বসতে পারবেন। গাড়িতে তো আমরা মাত্র চারজন মানুষ।

-আরে ভাবি বুঝেন না কেন? আমার ভাইয়ের পাশে না বসলে ভাই গাড়ি চালাতে পারবে না।ও তাহলে আড়চোখে আপনার দিকে তাকাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করবে।তারপর আমার অকালে প্রাণটা যাবে

-আপনার ভাইকে বলে দিবেন বিয়ের আগে যেভাবে গাড়ি চালাতো এখন ও যেন সেই ভাবে চালায়।

পিয়াসকে নেহাল বলতে বলেছে কি আর ও বলতেছে কি!নেহালের মাথাটা গরম হয়ে গেল। একেতো পিহু সামনে আসলো না আর এক পিয়াস ওর দফা রফা করে দিচ্ছে।তাই ও রাগটা কন্ট্রোল করে দাতে দাত চেপে বলল

-পিয়াস দেখতো গাড়ির পেছনের টায়ারে মনে হয় কি যেন হয়েছে।একটু চেক করে দেখতো।

পিয়াস তার সরল মনে নেহালের গরল কথা বিশ্বাস করে নিল।সে সুন্দর করে নেমে গিয়ে গাড়ির টায়ারের কাছে মুখটা নিচু করে দেখতে লাগল। আর বলল

-নেহাল কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

-দাঁড়া একটু সময় ।এখন ই দেখতে পারবি

বলে নেহাল গাড়ি স্টার্ট দিল। আর গাড়ির ধোঁয়া এসে সব পড়ল পিয়াসের মুখে।পিয়াস হকচকিয়ে গেল।তারপর বলল

-ধোকা বাজ।দেখিস তোর বউয়ের সাথে আরো ঝগড়া বাজবে।কোনো মতেই মিটবে না। আমাকে সরি না বললে।

আরফান গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করেই অন্য রাস্তায় যাওয়া ধরল। অন্য রাস্তা দেখে মিহু ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করল

-এটাতো বাড়ি যাওয়ার রাস্তা না।তাহলে এখান থেকে যাচ্ছেন কই

-তোমাকে গুম করে দেব।তাই

আরফানের কথায় মিহু একটু ভয় পেলো।তাহলে কি আরফান এর জন্য ওর সাথে ভালো ব্যবহার করেছে।যাতে ওকে বিশ্বাস করে মিহু।তারমানে ও মিহুকে স্ত্রী হিসেবে মানে নি।মিহু কান্না ভেজা কন্ঠ বলল

-আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাই না?

মিহুকে ভয় পেতে দেখে আরফান ভাবলো আরেকটু ঘাবড়ে দেওয়া যাক। ও নিজের গলাটা গম্ভীর করে বলল

-তোমার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক?

-দ্ দে খুন

মিহু কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু গাড়ি থেমে যাওয়ার ফলে ওর কথাও থেমে গেল। আরফান গাড়ি থেকে নেমে মিহুর পাশের দরজা খুলে দিল।তারপর ওকে বলল

-নামো

মিহু নেমে দেখলো একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আরফান কি সত্যিই ওকে গুম করে দেওয়ার জন্য এনেছে। না না মিহু এগুলো বিশ্বাস করে না।মিহুর বিবেক একথা বললেও মিহুর মন বলছে অন্য কথা।

মিহুকে এমন থমকে থাকতে দেখে আরফান মনে মনে বলল-মিসেস আরফান কালকে আমাকে রেখে অন্যের দেওয়া নীল শাড়ি দেখা তাই না!আজকে আমিও দেখবো কত শাড়ি তুমি পড়তে পারো। আর কালকে আমাকে পাত্তা না দেওয়ার শাস্তি

তারপর মিহুকে আস্তে করে বলল- এখানে কিন্তু অনেক লোক আছে যাদের কাছে তোমাকে গুম করে দেওয়ার কথা ভাবছি।তাই সাবধানে থাকবে আর আমার পেছনে পেছনে এসো।

শপিংমলের বাইরে একজন ঝালমুড়ি ওয়ালাকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরফান মিহুকে বলল

-ঐ যে ওনাকে দেখছো না ঝালমুড়ি বিক্রি করে।আসলে উনি কিন্তু একজন নারী পাচার কারী।দেখেছো কীভাবে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে।একা পেলেই নিয়ে যাবে। আরো অনেক লোক আছে কিন্তু।

মিহু এতক্ষণ দ্বিধান্বিত থাকলেও এবার অনেক ভয় পেয়ে গেল।ঝালমুড়ি ওয়ালা বাদে এক বাদাম বিক্রেতাকেও তাকিয়ে থাকতে দেখলো।তার চেহারা দেখলেই ভয় পাওয়া লাগে।মিহু ভয়ে আরফানের হাত ঝাপটে ধরল। এমন শক্ত করে ধরেছে যে মনে হয় সুপার গ্লু দিয়ে আটকিয়ে দিয়েছে।

মিহু যখন আরফানের হাত ধরল আরফানের হৃদয় জুড়ে এক প্রকারের প্রশান্তি অনুভব হলো।মনে হতে লাগল এই হাত সারা জীবন ওকে ধরে রাখুক। তারপর মনে মনে নিজের প্রশংসা ও করলো।এত নাটক না করলে মিহু ওর হাত ধরত না।আরফান মলের ভেতরে প্রবেশ করল।মিহু ও ওর হাত ধরেই এগোতে লাগল।

প্রথমেই একটা শাড়ির শপে গেল।মিহুকে ফিসফিসিয়ে বলল- এখানেও কিন্তু অনেক লোক থাকতে পারে

মিহু তাকিয়ে দেখলো একজন কাস্টমার ওদের দিকে তাকিয়ে আবার শাড়ি দেখায় মনোযোগ দিল।মিহু আরফানের হাত আরো শক্ত করে ধরল ।আরফান মৃদু হেসে সেলসম্যানকে বলল

-আপনাদের স্টকে যতগুলো সাদা শাড়ি আছে সব বের করেন।

-স্যার শুধু সাদা নাকি ভেতরে অন্য রঙের কাজ থাকলেও হবে

-তাতেও হবে কিন্তু সবগুলোতে সাদা রং টা মেইন চাই।

-ওকে স্যার।কিন্তু শাড়ির কাপড় কি ধরনের লাগবে? আই মিন জামদানী,কাতান,সুতি,জর্জেট নাকি অন্য কিছু?

-যত গুলো আছে সব

সেলসম্যান একটু অবাক হয়ে বলল-সব গুলো

-হ্যাঁ

-স্যার একটু সময় লাগবে।

মিহু জিজ্ঞেস করল- এতগুলো কার জন্য কিনছেন?

– আমি শাড়ি কিনছি না দোকান দারকে ক্লু দিচ্ছি তোমাকে কিভাবে গুম করতে হবে।তারপর আরফান বাইরে বেরিয়ে একদিকে গেল।মিহুও পেছনে পেছনে গেল। আরফান একটা দরজা খুলে ভেতরে যেতে গিয়ে থেমে গেল। আরফানকে থামতে দেখে মিহু জিজ্ঞেস করল

-কি হলো থামলেন কেন?

আরফান একটা লেখার দিকে ইশারা করে মিহুকে পড়তে বলল।মিহু দেখলো এটা একটা পুরুষ ওয়াসরুম।

-হাতটা কি ছাড়বে না আমার সাথে ভেতরে যাবে?

মিহু হাতটা ছেড়ে দিল আর বলল- একটু তাড়াতাড়ি আসবেন প্লিজ

আরফান যে ঢুকেছে আর বেরোনোর নাম নেই।অনেকক্ষণ ওয়াসরুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।মিহুর মনে হতে থাকে এই বুঝি কেউ এসে ওকে নিয়ে গেল।হঠাৎ এমন সময় শাড়ির দোকানের সেলসম্যান কে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মিহু ভয় পেয়ে গেল। ও পেছন ফিরে জোরে হাটা লাগালো। আরফানকে বেরোতে দেখে দৌড়ে গিয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আর বলল

-প্লিজ প্লিজ আমাকে গুম করে দিবেন না
-দেবো না তবে একটা শর্তে
-আপনার সব শর্তে রাজি
-মনে থাকবে তো
-হ্যাঁ থাকবে

আরফান মোট ত্রিশটা শাড়ি নিল পছন্দ করে।তারপর মিহুকে নিয়ে বাড়িতে আসলো।মিহুর জন্য যে শাড়িগুলো নিয়েছে সেগুলো ওদের রুমে রেখে এসে বাকিগুলো নিয়ে এসেছে সবার জন্য।পিহু,নীলু রেবেকা সবার জন্যই শাড়ি এনেছে।নীলু জিজ্ঞেস করল

-ভাইয়া শাড়িগুলো কি উপলক্ষে আনলে
-রমজানের শুরু তাই এই উপলক্ষে দিলাম।
-খুব সুন্দর হয়েছে শাড়ি টা
-তোর জন্য আরো একটা আছে।
বলে আরফান একটা ব্যাগ দিল নীলুকে।নীলু ব্যাগটা খুলে দেখলো একটা নীল শাড়ি।খুব খুশি হয়ে বলল

-ভাইয়া এইটা আরো সুন্দর।থ্যাংকস
-এটা তোর ভাবি এনেছে তোর জন্য

-ভাবি থ্যাংক ইউ

কিন্তু নীল শাড়িটা দেখে মিহুর চক্ষু চড়কগাছ। এই শাড়িটাই তো মাহিন ওকে দিয়েছিল।আরফান কখন শাড়িটা নিল? আর নিলো ও বা কীভাবে?মিহু আরফানের দিকে তাকাতেই আরফান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মিহুকে চোখ মারল।মিহু তব্দা খেয়ে আছে। এটা কি আসলেই আরফান।

পিয়াস ঘরে ঢুকতেই ওর মা চেহারার দিকে তাকালো।তাকিয়ে দেখল কেমন কালো কালো হয়ে আছে।জিজ্ঞেস করল

-মুখে কি হয়েছে?
-কই কিছুই না
-তুই আবার মিথ্যা বলছিস
-মা বুঝলে আজকে একটা একটা

কি বলবে ভেবে পায় না।ওর মা বুঝে যায় এখানে নিশ্চয়ই নীলুদের কারো সাথে সম্পর্ক আছে।তিনি এ বিষয়ে কিছু না বলে ওকে বললেন

-তোকে আমার সেই বোন কালকে যেতে বলেছে আজকে আমাদের বাসায় এসেছিল।কালকে আমি কোন না শুনতে চাই না। আর যেন না শুনি কারো জন্য যেতে পারিসনি

-আচ্ছা
-আর

আরো কিছু বলবেন তার আগেই পিয়াসের ফোনে এস এম এস আসলো।ও এস এম এস টা খুলে দেখলো একটা আননোন নম্বর থেকে লেখা

‘মানুষ যা কাছে পায় সেটার মূল্য দেয় না।কিন্তু যখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তখনই সেটাকে পেতে চায়।কিন্তু কেন এমনটা হয়? আপনার সাথে কি এমন টা হচ্ছে? কারণ টা জেনে থাকলে জানাবেন’

#চলবে

(রি চেক করিনি।ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন)