#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_৪৫
কারো বলিষ্ঠ হাতের চড় খেয়ে তুলি মুখ থুবড়ে পড়লো । আর ইস্ত্রি মেশিন টা গিয়ে পড়ল তুলির মায়ের পায়ে।
– তোদের সবাইকে নিষেধ করিনি যে মিহুর কিছু করবি না । মিহু হলো সোনার ডিম পাড়া হাস । এখন তাড়াতাড়ি এই জায়গা থেকে কেটে পড় । রুবেল মিহুকে নিয়ে গোডাউনে চল ।
রুবেল সরোয়ারের আদেশ শুনে মিহুকে নিয়ে গেল । সরোয়ার তুলি আর ওর মায়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে তার সাথে সাথে আসতে বললো ।
——-
আরফান মিহুদের বাড়িতে এসে দেখে কেউ নেই । ঘর বাড়ি একদম ফাঁকা । তার মানে মিহু এখানে নেই । কিন্তু মিহুর তো এখানেই আসার কথা । তাহলে কি মিহুকেও হারিয়ে ফেলল । না , এটা হতে পারে না । একই সাথে আল্লাহ্ ওকে এরকম বিপদে ফেলতে পারে না । আল্লাহ নিশ্চয়ই কোনো উপায় রেখেছেন । আরফান একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবলো । মিহুকে এখন ওর দাদু ছাড়া আর কারো প্রয়োজন হবার কথা না । এরমানে নিশ্চয়ই ঐ গোডাউনে আছে । কারণ মিহুর মায়ের ডায়েরিতে গোডাউনের কথাই বলা হয়েছে । রওনা দেওয়ার আগেই খেয়াল করল মিহুর ফোন নিচে পরে আছে । ফোন তুলে অন করতেই রেকর্ডিং সামনে পেল ।
গোডাউনের ভেতরে প্রবেশ করার পরে কোথায় যাবে সেটা খুঁজে পেল না আরফান । কিন্তু ওকে বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি । রুবেল নিজেই এসে ওকে নিয়ে গিয়েছে । তবে তার আগে ওর ফোন রেখে দিয়েছে ।
– ওয়েলকাম , ওয়েলকাম আরফান । আসো , বসো । তোমাকে কিসে বসতে দেই বলোতো । কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল কাজী বংশের জামাই বলে কথা । আসো তুমি এই চেয়ারে বস । বলে সরোয়ার একটা চেয়ারে আরফানকে বসতে দিল ।
আরফান না বসে দৃঢ় কন্ঠে বলল – আগে বলুন মিহু কোথায়? ওর সাথে কি করেছেন ?
– আরে কাজী বংশের জামাইদের ধৈর্য্য এত কম হলে হয়?আগে বসো । বলো কি খাবে চা কফি না লাচ্ছি ?
আরফান তার হাতের মুষ্টি বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে । সরোয়ারকে করা অপমান এবার সরোয়ার তুলে নিচ্ছে । আরফানকে কিছু বলতে না দেখে সরোয়ার নিজেই বলল
– আরে তোরা সবাই দেখছিস কাজী বংশের জামাইয়ের ধৈর্য্য । আমার মনে হয় শুধু পানীয় দিয়ে অ্যাপায়ন করাটা ঠিক হবে না । এখন এই টাইমে ভাত মাংস না খাওয়ালে চলে ? বলো কি খাবে ? গরুর মাংস? নাকি খাসি ?
– আপনাকে লাস্টবার জিজ্ঞেস করছি মিহু কোথায় বলেন ?
সরোয়ার নিজের চেহারা দুঃখের মতো করে বানিয়ে বলল – তুমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছো আরফান । ভুলে গিয়েছো যে তুমি আমার আস্তানায় আছো । এখান থেকে আমি না চাইলে তুমি বের হতে পারবে না । আরো একটা বিষয় ভুলে গিয়েছো আর সেটা হলো তুমি কিছুই করতে পারবে না । কারণ মিহু আমার কাছে আছে ।
আরফান সরোয়ারের কথায় যুক্তি খুঁজে পেল । তাই চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল । তা দেখে সরোয়ার হাসল । আরফান জিজ্ঞেস করল
– আপনি আসলে কি চান বলুন তো ? আর এতসব করার মানে কি ?
– এইত লাইনে এসেছো । শোনো তোমার সাথে মিহুর এমনি এমনি বিয়ে দেইনি । তুমি মিহুর মায়ের ডায়েরি উদ্ধার করতে পারবে দেখেই আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি । সে যাই হোক আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে প্রিয়ন্তির ডায়েরির মাঝে আমি ফর্মুলা পেয়ে যাব । তাই তোমাকে বিভ্রান্ত করতে কিছুটা বানিয়ে গল্প বলেছিলাম আর তোমার শরীরে কিছুটা পয়জন দিয়েছিলাম যাতে তুমি বিষয় টা ভুলে যাও কিন্তু না তুমি বিষয় টা আরো বিস্তারিত জেনে ফেললে । আর এইদিকে দেখো ডায়েরি তেও ফর্মুলার বিষয়ে কিছু বলা নেই । তাই তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে । আর সেটা হলো তুমি ফর্মুলা তৈরি করে দিবে অথবা প্রিয়ন্তি কোথায় রেখেছে সেটা বের করে দিবে ।
– যদি আপনার কথায় রাজি না হই ।
সরোয়ার তার অভিব্যক্তি বজায় রেখে বলল – তুমি বুদ্ধিমান । তাই তোমাকে ইঙ্গিত দিলেই বুঝতে পারবে । তোমার বোন নীলু কিন্তু এখনো আউট অফ ডেন্জার না । তাই আশা করি বিষয় টি বুঝতে পেরেছো ।
– এর ভেতরে নীলুকে কেন আনা হয়েছে? ও তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি । তাহলে ?
– ভেরি ভেরি স্যাড বিষয় টা । আমি নিজেও জানতাম না নীলু আমার এখানে আছে । জানতাম একটা মেয়ে বাড়তি আছে । তবে মেয়েটা যে নীলু সেটা যখন জানতে পারলাম ততক্ষণে সে পালিয়ে গিয়েছে । তাই বাধ্য হয়ে ট্রাকটি পাঠাতে হয়েছে । আচ্ছা এবার শুরু করো । এই একজন ওকে রিসার্চ রুমে নিয়ে যা ।
আরফানকে রিসার্চ রুমে নিয়ে গিয়ে একজন ওকে কয়েকটা ফাইলপত্র দিয়ে গিয়েছে । সেখানে প্রিয়ন্তি যে বিষয়ে রিসার্চ করেছে সব কিছু গুছিয়ে লেখা রয়েছে । আরফান কোনো উপায় না দেখে রিসার্চ করতে শুরু করল । কারণ ওকে ঐ রুমে লক করে রেখেছে । তবে একটা বিষয় বুঝলো না পুলিশ তো ওকে ফলো করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এখানে আসতে পারলো না কেন ?
——–
মিহুর জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করল । এখানে সব কিছুর রং সাদা । এখন সময় কি বা আবহাওয়া কেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । কারণ ও একটা বদ্ধ রুমে নিজেকে আবিষ্কার করেছে ।
– কেউ আছেন ? কেউ কি আমার কথা শুনতে পারছেন ?
তখন একজন রুমের দরজা খুলে বলল – আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে
– কিন্তু আপনি কে ?
– আমাকে চিনবেন না । আমি এখানে কাজ করি
মিহু তার সাথে আরেকটা রুমে গিয়ে দেখল সেখানে তুলি আর ওর মা বসে আছে । ওর মায়ের পা পুড়ে গিয়েছে । তুলি বসে বসে ওর মায়ের পা ঠিক করে দিয়েছে । মাথা তুলে মিহুর দিকে থাকাতেই
– মিহু তুই একটু সময় ওয়েট কর । তোর কি অবস্থা করব ভেবে পাবি না ।
মিহু কি বলবে কিছু ভেবে পায় না । শুধু চুপচাপ ওখানে বসে আছে ।তুলি আর ওর মা বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে ওর দাদু এসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল
– মিহু কি দাদুকে ভালোবাসে না ?
ও দাদুর হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে বলল – আপনি আমার দাদু নামের কলঙ্ক । আপনি কি করে এরকম করতে পারলেন ?
– মিহু দাদু কি তোমাকে কখনো হার্ট করেছে ? বা তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে ? তুমি একবার ভেবে বলোতো দাদু কি তার জীবন দিয়ে তোমাকে রক্ষা করেনি ?
– দাদু তুমি এমন কেন করলে ? আমাকে মা হারা কেন করলে ?
মিহুর দাদু একটু দুঃখের মতো করে বলল – তোমাকে আমি মা হীনা করি নি
– মানে?
– বাবা হারাও করেছি ?
– তুমি এসব কি বলছো ? তুমি বাবাকে মেরে ফেললে ?
– আমি মারতে চাইনি । তোমার বাবাই আমার কথা শুনেনি । সে আরফানকে সব বলে দিতে চেয়েছিল । তাই তাকে অনেক আগেই শেষ করে দিয়েছি
– দাদু !
– এরকম করো না । তোমাকে তো সুস্থ থাকতে হবে । না হলে আরফান তো আমার কথা শুনবে না ।
– তুমি আরফানের সাথে কি করেছো ?
– কিছুই করিনি । শুধু তোমার মা একটা ফর্মুলা লুকিয়ে রেখেছে । ঐটা আরফান তৈরি করবে ।
– আমার সব কিছু কেড়ে নিয়ে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে ?
– যাতে আরফান আমার কথায় রাজি হয় । আর আমার কাজটা হাসিল হয় ।
– দাদু এসব করে তোমার লাভ হলো কি ?
– কিছুই লাভ হয় নি আবার সব ই লাভ হয়েছে । আচ্ছা চলো তোমাকে বলে দেই বিষয় টা আমাকে বিদেশ থেকে অনুমতি দিয়েছে । কারণ আমি আমার রিসার্চে অনেক এগিয়ে আছি ।
– দাদু এসবের কোনো মানে হয় ?
– তোমার কাছে মানে নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার কাছে মহা মূল্যবান কিছু । একজনের কাছে নগণ্য বস্তু অন্য জনের কাছে পরশ পাথর
– তুমি আরফানকে কিছু করবে না
– সেটাতো বলতে পারি না কারণ ওর মতি গতি কিছুই বুঝতে পারছি না ।
– তুমি আমার কসম খাও
– তোমার কসম খেয়ে লাভ নেই । কারণ তুমিও তো মারা যাবে
-মানে !
– মানে হলো আরফান যখনই ফর্মুলা দিয়ে দিবে তখনই তোমার লাইফ টাইম ফুরিয়ে যাবে ।
– তাহলে আমার সাথে এত ভালো ব্যবহারের মানে কি ?
– সহানুভূতি ছাড়া কিছুই না
তখনই বাইরের গন্ডগোল শোনা গেল । মিহুর দাদু বাইরে এসে দেখলো আরফান তার হাতে একটা ধারালো চাকু তুলির গলায় ধরে আছে ।
– সরোয়ার কাজী আপনি আমাকে কি ভেবেছেন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি ? না , আমি হাল ছাড়ি নি । আপনি এখন কোথাও যেতে পারবেন না । পুলিশ খবর পেয়েছে , তারা এখনই যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবে ।
মিহুর দাদু এক পা আগাতেই আরফান তুলির গলায় আরো জোরে চাকু ধরল । তখন মিহুর দাদু মুচকি হাসি দিয়ে বলল
– আরফান তুমি হয়ত আমাকে চিনতে পারোনি
সরোয়ারের কথার মানে বোঝার আগেই দুটি গুলির শব্দ শোনা গেল । হ্যাঁ গুলি তিনিই চালিয়েছেন তবে সেটা তুলিকে বাঁচাতে নয় তুলিকে মারতে । আরফানের হাত থেকে চাকু পড়ে গেল । আর তুলিও ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো । তুলির মা তুলি বলে চিৎকার দিয়ে ওর কাছে গেল
– বাবা আপনি একি করলেন ! তুলি তো আপনার কথা সব সময় মেনে চলতো । তাহলে ? আর আমিও তো আপনার কথাই মানতাম । আপনি ওকে মারলেন কেন ?
– তুমিও যদি মরতে না চাও তাহলে এখনই এখানকার সব কিছু গুছিয়ে আমার সাথে চলো । এখানে আর থাকা যাবে না । আর আরফান তুমি বা মিহু কেউ ই আমার কবল থেকে ছাড়া পাবে না । মনে রেখো তোমার হাতে কিছুই করার নেই । তুমি কিছুই করতে পারবে না ।
– আরফান কিছু করতে পারুক বা নাই পারুক আমি তো করতে পারি
চেনা কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই পেছনে ফিরে তাকালো । সবাই অবাক হয়ে আছে । আরফান অবাক স্বরে বলল
– আপনি ?
তুলির মা অস্ফুট স্বরে বলল – প্রিয়ন্তি ?
মহিলাটি সরোয়ারের দিকে বন্দুক তা করে বলল – বাহ আপনি দেখছি আমার কন্ঠস্বর শুনেই চিনতে পারলেন । আমি ভেবেছিলাম আমার চেহারার পরিবর্তন করালে বুঝি আমাকে কেউ চিনতে পারবে না । এখন দেখছি আমি ভুল ভাবতাম
– তুই বেচে আছিস কীভাবে ?
– সেটা তো তোমার বড় পুত্রবধূ জানে সরোয়ার কাজী । সে আমাকে ঠিক মতো ইন্জেকশন দিয়েছিল কিনা একমাত্র সে নিজেই জানে । সরোয়ার রাগন্বিত হয়ে তুলির মায়ের দিকে বন্দুক ধরতেই প্রিয়ন্তি সরোয়ারের হাতে একটা গুলি করে । সরোয়ার তীক্ষ্ম চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে ।
– তোমার খেল খতম সরোয়ার কাজী !
মিহু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তির দিকে । ইনি মিহুর মা ! তার মানে মিহুর মা মারা যান নি । তবে মিহুর এই অমনোযোগীতাই কাল হয়ে দাঁড়ালো । সরোয়ার একটা চাকু বের করে মিহুর গলায় ধরল
– প্রিয়ন্তি বেশ ভালোই হলো । তুই বেঁচে থেকে আমার একটি লাভ হয়েছে । ফর্মুলা আমাকে দিয়ে দে । আমি চলে যাব । আর না হলে মিহুকে মেরে ফেলব । তুই পারবি নিজের চোখে মেয়ের মৃত্যু দেখতে ?
– ওর গলা থেকে চাকু সরাও বলছি ।
সরোয়ার গলায় আরো জোরে চাকু ধরল । আর পেছনের দিকে যেতে যেতে রুবেল কে বলল – রুবেল সব জিনিস পত্র নিয়ে চল । আর কেউ এক পা এগোলেই মিহুর জান খতম !
কিন্তু কারোরই কিছু করা লাগেনি । সরোয়ারের পেটে ছুড়ি চালিয়ে দিয়েছে তুলির মা যেটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি । সরোয়ার মিহুকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তুলির মাকে বলল
– বিশ্বাসঘাতক ! এত দিন ধরে আমি কালসাপ পুষেছিলাম ।
– বাবা আপনিও তো আমার মেয়েটাকে মেরে ফেললেন । আমি কি তাহলে এই কাজ করতে পারি না ? আমার মেয়ে যেখানে সব কিছু সেখানে আপনি ওকে মেরে ফেললেন । পারলেই বাঁচাতে পারতেন । কি করেনি আপনার জন্য? আপনি যদি এরকম করতে পারেন তাহলে আমিও করতে পারি ।
সরোয়ার তুলির মায়ের গলায় ছুড়ি চালিয়ে বলল – আমি সরোয়ার কাজী । আমাকে কেউ হারাতে পারবে না । আমি কারো কাছে ধরা দেবো না । হারলে আমি নিজেই নিজের কাছে হারবো ।
তারপর ছুড়ি দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলল। প্রিয়ন্তি বলল – না তুমি এত কম কষ্টে মরতে পারো না । রেণু ফুফুর মৃত্যুর বদলা নেওয়া বাকি । আমার প্রতিটা পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর বদলা নেওয়া বাকি । কবিরের আর করিম ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেওয়া বাকি । বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল প্রিয়ন্তি ।
#চলবে
#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_৪৬
সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা প্রবাদটি যেমন ঠিক তেমনি কঠিন সময় পার হতে এক যুগ কেটে যায় কথাটিও ঠিক । তিল তিল করে সময় পেরোচ্ছে নীলুর এক্সিডেন্টের পরে । তবে সেই সময় গুলোকে যোগ করলে একটা বড় অঙ্কের যোগফল পাওয়া যাবে । সেই দিন আল্লাহ কাউকেই হতাশ করেন নি । নীলুর অপারেশন সাকসেসফুল হলেও নীলু চিরতরের জন্য কোমায় চলে গিয়েছে । কখনোই আর আগের মতো হতে পারবে না । যদি আলাদিনের চেরাগের কোনো দৈত্য এসে নীলুকে ভালো করে দেয় সেটা ভিন্ন ব্যাপার । কারণ আলাদিনের চেরাগ রূপ কথাতেই সম্ভব বাস্তবে নয় । নীলুর এক্সিডেন্টের এক মাস হয়ে গেল । মাহিন তো হাসপাতালের রুমকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেছে । এখানেই ঘুমায় আবার এখান থেকেই অফিসে যায় । আবার অফিস থেকে এখানেই ফেরে । কারণ ও ঐ বাসায় যেতে চায় না যেখান থেকে নীলুর ক্ষতি হয়েছে আর জানতেও চায় না তুলি বা ওর মায়ের সাথে কি হয়েছে ।
নীলুকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নেওয়া সম্ভব নয় । কারণ যেহেতু আরফানের কম্পানি টা নেই তাই ওর আয়ের উৎস শূণ্য । ব্যাংকে যে পরিমাণ টাকা আছে তার অর্ধেকই নীলুর পেছনে খরচ হচ্ছে । যদিও নেহাল ও সাহায্য করছে । তবে নেহালের একার আয়ে সব কিছু চালানো টা সম্ভব হচ্ছে না । আবার ঐ ঘটনার পরে মিহুও একটু হালকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সব মিলিয়ে আরফান একদম সম্বলহীন প্রায় । এদিকে পিহু প্রেগন্যান্ট । তাই নেহাল ও সব দিকে সামাল দিতে পারছে না ।
ঐদিন পুলিশ আসতে একটু দেরি করেছিল কারণ আতরের গোডাউনে ঢুকে আস্তানার মেইন দরজা খুঁজতে টাইম লেগেছিল । কিন্তু তারা আসার আগেই তুলি আর ওর মা মারা গিয়েছে । সরোয়ার বেঁচে থাকলেও হাসপাতালে নেওয়ার পরে মারা গিয়েছে।তারা বিষয় টা তদন্ত করে দেখবে আর বাকিদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে । সব কিছুর যেহেতু অবসান ঘটেছে তাই প্রিয়ন্তি চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আরফানের অনুরোধ আর মিহুর মায়া ভরা চাহনি তাকে যেতে দেয়নি ।
নেহালের আয়ে বসে বসে খাওয়াটাকে আরফানের কাছে ভালো লাগছে না । ওর নিজের কিছু করতে হবে তবে সেটা করতে টাইম লাগবে । তাই আরফান বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে কারণ ও চাচ্ছে না ওর জন্য সবাই আরো কষ্টে পরুক ।
– মিহু তোমার হলো ? আর কতক্ষণ লাগবে ? যেতেও তো টাইম লাগবে নাকি ?
সিড়ির গোড়ায় বসে গলা উচিয়ে কথা গুলো বলছিল । ভারী লাগেজ টেনে নিয়ে আসতে মিহুর টাইম লাগছে । যদিও আরফান বাকি গুলো নিয়েছে তবে এই লাগেজে ওর নিজের সব কিছু আছে সেটাই নিতে ওর কষ্ট হচ্ছে ।সিড়ি দিয়ে বহুত কষ্টে নেমে বলল
– চলুন ।
– কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
রেবেকার প্রশ্নে দুজনেই থমকে দাঁড়ায় । মিহু কাচু মাচু হয়ে বলল – মা আপনাকে তো আগেই বলেছি আমরা একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি সেখা থাকবো ।
– মানে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছো ?
মিহু উপর নিচে মাথা ঝাকালো । রেবেকা রাগন্বিত হয়ে বলল – আমি কি তোমাদের যেতে অনুমতি দিয়েছি ? তারপর উচ্চস্বরে বলল – একটা চড় মারবো । যাও নিজের রুমে যাও
মিহু আরফানের দিকে একবার তাকিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো ।
– আবার দাঁড়িয়ে আছে ? যেতে বলেছি না ।
– দেখুন মিসেস আকবর আপনি এভাবে ,,,
– চুপ । অ*সভ্য ছেলে !
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটা সদস্য অবাক হয়ে আছে । রেবেকা আরফানের সাথে এর আগে এমন অধিকার বোধ দেখিয়ে ব্যবহার করেনি । এমন কি আরফান নিজেও অবাক হয়ে আছে
– নিজের মাকে কেউ বাবার মিসেস বলে ডাকে ?
– আপনি ?
– আপনি কি ? হ্যাঁ কি বলবে ? বলবে এইতো যে আমার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই ? আগে এটা ঠিক থাকলেও এখন আর নেই । কারণ আমার রক্ত তোমার শরীরে বইছে । তাই এতদিন আমি যেটা পারতাম না সেটা এখন জোর করে হলেও পারব ।
– কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের টাকায় বসে বসে খেতে পারব না ।
– তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাও । ভাই তুমি আমাকে ভাই হিসেবেও গ্রহণ করো আবার তার টাকাকে পর পর ভাবছো ? এতদিন কি আমরা তোমার ইনকামে খাই নাই ? তাহলে এখন তুমি এরকম করছো কেন ? তাহলে কি তুমি আমাকে আপন ভাই ভাবো না ?
– নেহাল সেরকমটা নয়
– তাহলে আর কোনো কথা নয় ।সব কিছু রুমে রেখে আসো ।
তখনই পিয়াসের বাবা এসে সোফায় ঠাস করে বসে পড়ল । আরফান তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
– পিয়াসের কোনো খোঁজ পেলে ?
– না , অনেক খুজলাম কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারল না । সব কিছু ভালো ভালো কাটলেও পিয়াস আর বিদিশা যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল কেউ জানে না ।
———
৭ বছর পরে ,(কানাডার একটা আভিজাত্য হোটেল রুমে )
– ইয়াশা মামণি । এই কাগজটা পাপাকে দিয়ে আসো তো ।
মেয়েটি রুম থেকে দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে গেল । সেখানে বসে তার বাবা আকাশের তারা দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে । তখন তার ৪ বছরের মেয়েটা আধো আধো বাংলাতে বলল
– পাপা , মাম্মি গিভ ইউ দিস কাগজ ।
তখন সে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে
– মামণি ঠিক ভাবে বাংলাতে বলোতো
– মাম্মি গিভ
– না হবে না । সব গুলো ওয়ার্ড বাংলাতে বলতে হবে
– পাপা , হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অফ গিভ ,ইউ এন্ড দিজ ইন বাংলা ?
– প্রথমটা হলো দেওয়া পরেরটা তুমি আর পরেরটা এই
– ওওও । ইট মিনস মাম্মি তুমিকে এই কাগজ দেওয়া
সে হেসে দিল তার মেয়ের বাংলা বলার দক্ষতা দেখে । মেয়ের সাথে খুনশুটি করতে করতে মেয়ে তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল । তখন সে ভেতরে এসে বিছানায় ভালো করে শুয়ে দিল । তারপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজতে থাকা রমণীর দিকে তাকিয়ে বলল
– বিদিশা আমাকে কি মাফ করা যায় না ?
ঠোটে লিপস্টিক ঘষতে ঘষতে বলল – তুমি কি ভুল করেছো বলোতো যে আমি তোমাকে মাফ করবো ?
– আমি কি জানতাম সামান্য এই এগ্রিমেন্ট পেপারকে নিয়ে তুমি এত তুলকালাম বাজাবে ? আমি বলেছি তো ঐটা আমার ভুল ছিল তোমাকে বিয়ের দিন এগ্রিমেন্ট পেপার দেওয়া । তাই বলে কি প্রতি বিবাহ বার্ষিকী তে এই পেপারটা দিবে ?
– ধরে নাও এটা তোমার উপহার বিবাহবার্ষিকীতে ।
পিয়াস বিদিশার দিকে এগোতে এগোতে বলল – এক বাচ্চার মা হয়েও বিশ্বাস হয় না আমি তোমাকে ভালোবাসি?
বিদিশা ভাব নিয়ে বলল – কে যেন বলেছিল ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে ।
– আচ্ছা তোমার কি বললে বা করলে বিশ্বাস হবে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি?
– আপাতত দেশে নিয়ে চলো তারপর ভেবে দেখবো
– দেশে তো যাবই কিন্তু তার আগে ইয়াশার মাম্মির জন্য একটা সারপ্রাইজ দিয়ে
বলে বিদিশাকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে গেল । একটা গিফ্ট বক্স দিয়ে বলল – শুভ বিবাহ বার্ষিকী!
#চলবে