হৃদয়_নিবাসে_তুই
সূচনা_পর্ব
লেখনীতেঃভূমি
টাকার জন্য নিজের শরীরটাকে বিক্রি করে দিলেন আপনি অদ্রিজা?আপনাকে অন্তত তেমন ভাবিনি আমি ।কিন্তু সুন্দর লালসাগ্রস্থ শরীরের অধিকারী রূপবতী নারীকে ভালো ভাবা বোধ হয় উচিত হয়নি আমার।রাইট অদ্রিজা? ওহ, স্যরি স্যরি, মিসেস রক্তিম মাহমুদ!’
অদ্রিজা টলমলে চোখে মুখ তুলে চাইল রক্তিমের দিকে। যে ছেলেটা রোজ একেকটা মেয়ের সাথে টাইম স্পেন্ড করে, যার হাজারটা মেয়ের সাথে ইন্টিমেন্ট রিলেশন, সে ছেলেটা তাকে ভালো ভেবেছিল ভাবতেই তাচ্ছিল্যমাখা হাসল সে।শরীরে জড়িয়ে থাকা চাদরটা আরো ভালোভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ করে জড়িয়েই থম মেরে বসল সে।রক্তিমের দিকে ছোটছোট চোখে তাকিয়েই বলে উঠল,
‘ আপনার কাছে নারীর সংজ্ঞা মানে কি আমার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে রক্তিম।গতরাতের আপনার হিংস্রতাই তার জানান দিয়েছে।তাই আপনার চোখে নিজেকে সাধু ভেবে একেবারে খুশির জোয়ারে ভেসে যাব এমনটা ভাববেন নাহ।’
রক্তিম মৃদু হাসার চেষ্টা করল।কাল রাতে ড্রাংক থেকে অদ্রিজার সাথে কি করেছে তা ভেবেই শরীর শিরা উপশিরা কেঁপে উঠল তার।এক নজর অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করল তাকে। ভেজা চুল থেকে টপাটপ পানি গড়াচ্ছে। শরীরে জড়ানো চাদরও বেশখানিকটা ভিজে গিয়ে লেপ্টে পড়েছে শরীরে। শীতের সকালে এই কনকনে ঠান্ডায় ঠোঁটজোড়া ইষৎ কাঁপছে তার।গলার ডানপাশে এখনো লাল টকটকে হয়ে ভাসছে দু দুটো কাঁমড়ের চিহ্ন।রক্তিম ছোট্ট শ্বাস ফেলল।শেষ পর্যন্ত অদ্রিজা?কথাটা মস্তিস্ক কিছুতেই মানতে চাইল নাহ তার।এই পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েকে অন্য নজরে দেখে আসলে ও অদ্রিজার প্রতি তার সেই চাহনি আসে না। অদ্রিজার প্রতি আর যায় হোক শ্রদ্ধা, সম্মান কাজ করে তার।আর সেই মেয়েটিকেই কিনা নিজের চাহিদা মেটানোর খোরাক বানাল? চোখজোড়া কয়েক সেকেন্ড বন্ধ রেখেই নিজের ভেতরের অনুশোচনাটাকে ধামাচাপা দিয়ে বাঁকা হাসল সে।বরাবরের মতো নিজেকে হাস্যোজ্জ্বল রেখেই দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ উহ!রেগে যাচ্ছেন আপনি?আমি কিন্তু আপনাকে কখনো রাগতে দেখিনি।’
অদ্রিজা শান্ত চাহনিতে তাকাল।বুকের ভেতর অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে।হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় বিজন্যাসের সব পাওনা, ব্যাংক লোন মেটাতে যখন তার পরিবারের বেহাল দশা তখনই রক্তিমের বাবা রক্তিমকে বিয়ে করার প্রস্তাবটা রেখেছিল।অর্ধেক দেনা পাওনা মিটিয়েই নিজেদের বাড়িঘর বিক্রি করে পথে নেমেছিল অদ্রিজা আর তার পরিবার।অবশেষে রক্তিমের বাবার কথায় টাকার বিনিময়ে এই বিয়েটা করে নেওয়ায় ভালো মনে হয়েছিল তার।যদিও তার চাচাও পরামর্শ দিয়েছিল বিয়েটা করার। তবে রক্তিমের চরিত্র সম্পর্কে তার বাবা কিছুটা লুকিয়ে গেলেও রক্তিম লুকায়নি।প্রথমদিন থেকে বলে এসেছে সে, তাকে বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট না করতে।কিন্তু এইছাড়া যে কোন পথ নেই ওর।তিনটে টিউশনি করিয়ে বাবার অর্ধের ঋণ শোধ করা আর নিজের ছোট বোন আর মা কে হাসিখুশি রাখা কোনকালেই সম্ভব নয়।তাই তো রক্তিমের মতোই একটা খারাপ চরিত্রের মানুষকে বিয়ে করতে হলো যে কিনা নারী মাত্রই চেনে নারীর শরীর।আদৌ কি কোনকালে রক্তিম তাকে স্ত্রী হিসেবে সম্মান করবে?কখনো কি মনে জায়গা করতে পারবে?অদ্রিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রক্তিমের নারীদের প্রতি ধারণা, দৃষ্টি, ঘৃণা সবটা জানার পরেও রক্তিমের সাথে এর আগে তার যতবার কথা হয়েছে খুব নম্র, আর শালীনভাবে কথা বলেছে সে ।কখনো এটুকুও অপমান,কিংবা এটুকুও ঘৃণা নিয়ে কথা বলেনি।তবে আজ ঘৃণা হচ্ছে। চরম ঘৃণা হচ্ছে।নিজের শরীরের আনাচে কানাচে রক্তিমের স্পর্শ গুলো মনে করেই চোখ টলমল করল তার।দাঁতে দাঁত চেপে এটাকেই নিয়তি ভেবে নিয়ে চোখ বন্ধ করল সে।ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ ওটাকে রাগ বলে না মিঃ রক্তিম। ওটা তাচ্ছিল্য ছিল।রাগ সবার উপর হয় না। আপনার উপর তো নয়ই!’
কথাটা বলেই শরীরে জড়ানো চাদরটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।ইষৎ কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হতে নিতেই রক্তিম বলে উঠল,
‘ তাচ্ছিল্য কিংবা রাগ, আই ডোন্ট কেয়ার অদ্রিজা।এন্ড ইউ নো দ্যাট অদ্রিজা, আমি নারীকে কিভাবে জানি, কিভাবে দেখি।বিয়ের একমুহুর্ত আগে পর্যন্ত আমি আপনাকে বুঝিয়েছি রক্তিম মানুষটা কেমন।সে নারী বলতে কেবল নারীর লোভনীয় শরীরটায় চেনে অদ্রিজা।রক্তিমের একেক রাতের সঙ্গী একেক নারী।রক্তিম নরীদের সম্মান করতে জানে না। তাই নারীর রাগ কিংবা তাচ্ছিল্যে আমার কিছুই যায় আসে না অদ্রিজা।আপনি টাকার বিনিময়ে বিয়ে করেছেন। আর প্রতিদিন যে নারীরা আমার সাথে সময় কাঁটায় তারাও টাকার বিনিময়েই সময় কাঁটায়।সো ওদের আমি যে চোখে দেখি আপনাকেও ঠিক সেইভাবেই দেখব।এর থেকে বেশিকিছু আশা রাখবেন না অদ্রিজা।’
অদ্রিজার চোখ বেয়ে টপাটপ পানি গড়িয়ে পড়ল।কত সহজেই ঐসব মেয়েদের সাথে তার তুলনা করল যেসব মেয়েদের টাকার বিনিময়ে কেনা যায়।অথচ জীবনে রক্তিম ছাড়া আর কোন পুরুষকে নিজের শরীরতো দূর হাতও ধরতে দেয় নি সে।হয়তো সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যে এটাই রেখেছিল ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। হ্যাঁ।টাকার জন্যই তো বিয়েটা করেছে সে।এখন রক্তিমের চাহিদা মেটানোর খোরাকই তো সে।তাই তো গতকাল রাতে নিরবে সবটা সহ্য করেছে সে।কিছু বলেনি।চোখজোড়া বন্ধ করেই বার কয়েক নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠল,
‘ নারীর শরীর ছাড়া কিছু চেনেন না তাই তো?হ্যাঁ আমার শরীরটা আপনার জন্যই।আপনার সম্পত্তি।বিক্রি করে দিয়েছি আমি আমার শরীর।আমি তাতে কখনো অভিযোগ হানব না মিঃ রক্তিম।কারণ আমি টাকার বিনিময়ে নিজেকে আপনার করে দিয়েছি।এইছাড়া বেশিকিছু আমি এমনিতেও আশা করতাম না।’
রক্তিম ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। প্রখর আত্মসম্মান যার সেই মেয়েটি নিজের পরিবারের সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিল।অদ্ভুত!মেয়েরা এমন ও হয় বুঝি?ঠোঁট বাকিয়েই বলে উঠল,
‘ টাকার জন্য আজ আমার হয়েছেন।কাল অন্য কারো হয়ে যাবেন নাহ?অবশ্য নারী মাত্রই টাকা! নারীরা টাকা ছাড়া কিছুই চেনে না। এবং আমি জানি, আপনিও একদিন আমার জীবন থেকে বিদায় নেবেন। সেই দিনটা খুব শীঘ্রই হলেই ভালো হয়।’
অদ্রিজা আগের মতোই তাকিয়ে রইল।নিজেকে আজ খুব ছোট মনে হচ্ছে।খুব!রক্তিম প্রতিটা কথায় তাকে এটা বুঝাতে চাইছে সে লোভী।সে টাকার বিনিময়ে বিয়েটা করেছে।সত্যিটা তো তাই।তবুও কেন কষ্ট হচ্ছে? চোখ ভরে পানিরা খেলা করছে কেন তার?মুহুর্তেই চোখজোড়া বন্ধ করে নিল অদ্রিজা। ততক্ষনে পানি গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে।রক্তিম সেই দৃশ্য দেখেই বাঁকা হাসল।অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বলল,
‘ উহ!কান্না করছেন?কেন?আপনি রক্তিম মাহমুদ এর ওয়াইফ হয়েছেন আর এত সহজে কষ্ট ফেলে চলবে অদ্রিজা?আপনি ভাবতেও পারছেন না সামনের দিনগুলো আরো কতোটা ভয়ঙ্কর কষ্ট দিবে আপনাকে।ঠিক কতোটা কষ্ট পাবেন তা ভাবতেও পারছেন না অদ্রিজা!’
অদ্রিজা চোখ মেলে চাইল। ভয়ার্ত চাহনিতে রক্তিমের দিকে তাকাতেই রক্তিম বাঁকা হাসল।তার মুখে ফুঁ দিয়ে কপালের ছোট চুলগুলো উড়িয়ে দিয়েই আবারও বলল,
‘ মেয়েদের চোখের পানি নাকি পুরুষদের সহ্য হয় না।কিন্তু ইউ নো হোয়াট?আমার আনন্দ হচ্ছে আপনার চোখের পানি দেখে।’
অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ তবে আমারও তো দায়িত্ব আপনার আনন্দের খোরাক হওয়া!আপনার স্ত্রী হিসেবে সেই দায়িত্বটা পালন করা তো আমার কর্তব্য।’
রক্তিম এবার হু হা করে হেসে উঠল।অদ্রিজার থেকে দুই পা পিঁছিয়ে বলল,
‘ স্বামী-স্ত্রী এসব সম্পর্কে আমি বিশ্বাসী নাহ।কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না।তাই প্লিজ কখনো আমার স্ত্রী হিসেবে নিজেকে সম্বোধন করবেন না অদ্রিজা।’
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না রক্তিম। জোর কদমে পা ফেলে দ্রুতই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আর অদ্রিজা তার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইল।নারীর প্রতি তার এই ঘৃণার কারণ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলো সে।সাথে নিজের প্রতি জম্মাল একরাশ ক্রোধ আর রাগ।
.
দিহান ক্লাসের সবগুলো নোটস নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে লাগল। পেছন থেকে নেহা শতবার ডাকলেও কোন জবাব দিল না সে। কোকড়ানো চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা।লম্বা চওড়া শরীরে চেইকের শার্ট।হন্তদন্ত হয়ে তিনরাস্তার মোড়ে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই পেঁছন থেকে দৌড়ে আসল নেহা।দিহান মিনমিনে চোখে তাকিয়েই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিল।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
‘ কি সমস্যা তোর?আমার পিছু পিছু ছুটে চলেছিস কেন তুই?’
নেহা দু পা বাড়িয়েই জোরে জোরে শ্বাস ফেলল।এলেমেলো চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে মুখে এলেমেলো হয়ে লেপ্টে আছে।চুলগুলো কানে গুঁজে নিয়েই বলে উঠল,
‘ তুই বলেছিলি তুই দ্রিজাকে ভালোবাসিস?পুরো ক্লাসে বিশ্রী এক গল্প চলছে।তোর আর দ্রিজার নাকি রিলেশন ছিল।রিলেশনের কথা দ্রিজার পরিবারে জানাজানি হতেই নাকি ওর বিয়ে হয়ে গেল।তাই তো বিয়েতে কাউকে বলেনি।আরো কতোকিছু।এগুলো কতটুকু সত্য দিহান?আমি জানি এসব মিথ্যে।সবটা মিথ্যে।’
দিহান বিরক্তিতে কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে নিল।তারপর বলল,
‘ তো?’
নেহা আবারও বলল,
‘ তো?তো মানে?দ্রিজার শ্বশুড়বাড়ি বা ওর স্বামী কারোর কানে এই কথাটা গেলে ওরা কি ভাববে জানিস?বুঝতে পারছিস তুই?অথচ আমরা সবাই জানি দ্রিজা কেমন মেয়ে।ও তো তুইছাড়া কোন ছেলের সাথে কোনদিন কথাও বলেনি দিহান।’
দিহান ছোট্ট শ্বাস ফেলল।তারপরই ঠোঁট টেনে হাসল।নেহার দিকে একনজর তাকিয়েই বলল,
‘ কথাটা দ্রিজা নিজেই বলেছে সবাইকে।ওকেই জিজ্ঞেস করব এসবের মানে কি।আমি ওখানেই যাচ্ছি।বন্ধুমহলে সবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে বিরক্তি হয়ে গিয়েছি তাই তোর সাথে একটু বিরক্তি নিয়ে কথা বলেছি।এইছাড়া কিছু না।দ্রিজাই যেহেতু বলেছে সেহেতু ওর জন্য তোর এত চিন্তা করা লাগবে না নেহু।’
দিহানের কথাটা শেষ হতে না হতেই নেহা বলে উঠল,
‘ আমিও যাব দিহান।দ্রিজার থেকে শুনতে চাই আমিও সবটা।’
দিহান ক্লান্ত চাহনিতে তাকাল।মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চারটে টিউশনি করে আবার কোচিং করাতে হয়। পুরোটা সময় তার ব্যস্ততার মাধ্যমেই কাঁটে।তবুও মুখে চোখে তার কখনো এটুকু ক্লান্তির চাপ দেখা যায় নি।কিন্তু আজ দেখাচ্ছে, বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।হয়তো আকস্মিক ভাবে ভালোবাসার মানুষটার অন্য কারো হয়ে যাওয়াে খবর শুনেই।ছোট্ট শ্বাস ফেলেই নেহার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ আমি একা যেতে চাইছি নেহু।তুই পরে দেখা করে নিস।তাছাড়া আমি সবটা জানলে তোকে অবশ্যই জানাব। ‘
প্রতিউত্তরে নেহার থেকে কোন উত্তরের প্রত্যাশা না রেখেই কয়েক পা বাড়িয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল দিহান।একটা রিক্সা ডেকে নিয়েই রওনা দিল নিজের গন্তব্যে।মনে তার হাজার প্রশ্ন।এভাবে একদিনে অদ্রিজার বিয়ে। এখনও মস্তিষ্ক বিশ্বাস করতে চাইছে না কথাটা।কিছুতেই না।মাথায় যখন একঝাঁক চিন্তা ঠিক তখনই নিজের মোবাইলটা বেঁজে উঠল।দিহান হাতের মোবাইলের দিকে তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ওপাশের মানুষটা অদ্রিজা জেনেও কলটা রিসভ করতে মন চাইল না তার।কিছুতেই না।অন্যদিন হলে ঘটনাটা অন্যকিছু ঘটত।অদ্রিজার কল পাওয়া মাত্রই কথা বলার তীব্র আকাঙ্খা ফুরাতে কল রিসিভ করে প্রথমেই সেই বলত।কিন্তু আজ মন চাইল না কল ধরতে।অদ্রিজার প্রতি জম্মেছে তার রাশি রাশি অভিমান, ক্ষোভ!যা ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে।আর বিষিয়ে তুলছে তার মনটাকে।
.
তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নয়টা।নিজের মোবাইলে মায়ের পনেরো টা মিসড কল দেখেই মৃদু শ্বাস ফেলল অদ্রিজা।এই বাসায় সে ছাড়াও তিনজন মানুষ।অথচ কেউ কারোর সাথে তেমন কথা বলে না।রক্তিমের বাবাকে অফিসে যাওয়ার আগে রক্তিমের মায়ের সাথে হালকা কথা বলতে দেখেছিল সে।তারপর রক্তিমের বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলাকে আর কথা বলতে দেখেনি সে।প্রয়োজন ছাড়া বোধ হয় কথাই বলে না ভদ্রমহিলা।অন্যদিকে রক্তিম।তাকেও তার বাবা মায়ের কারোর সাথেই টু শব্দও করতে দেখেনি সে।বাবা মায়ের সামনে তাকে রোবট সমান কোন যন্ত্রই মনে হচ্ছিল অদ্রিজার।অদ্ভুত!এই বাসাটাই অদ্ভুত।বাসার মানুষজনগুলোও বেশ অদ্ভুত।প্রয়োজন ছাড়া এরা একে অপরের সাথে কথা বলে না।আর না অদ্রিজার সাথে কথা বলেছে কেউ।পুরোদিনটা কেমন জানি নিস্তব্ধতায় কেঁটেছে তার।দিনশেষে মায়ের কল দেখে কিছুটা খুশি লাগলেও পরমুহুর্তেই খুশিটা নিভে এল।কল রিসিভড করেই হালকা গলায় বলে উঠল,
‘ আম্মু স্যরি।খেয়াল করিনি তুমি যে এতগুলো কল দিয়েছো।’
ওপাশ থেকে তার মা বোধ হয় হাসল।তারপরই বলল,
‘ তুই আর তোর চাচা এমনভাবে হুট করে বিয়েটার সিদ্ধান্ত নিলি কাউকেই তো বলা হলো না।দিহান এসেছিল তোকে খুঁজতে।না পেয়ে চলে গেল।তোর বিয়েতে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় বোধ হয় ও।না বলাতে বোধ হয় রাগ করেছে রে।’
অদ্রিজার চোখজোড়া আবারও টলমল করল।বুকের ভেতর উতলিয়ে উঠল অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস।যে মানুষটা তাকে এতটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল একটা সময় নিজের করবে বলে তার অনুভূতির মূল্য সে দিতে পারে নি।আর না রাখতে পেরেছে তার প্রতিজ্ঞা।চারটা বছর পরও দিহান কোনদিন তার হাতটা পর্যন্ত ধরেনি আর বিয়ের রাতে রক্তিম তার সাথে এটুকু কথা তো দূর, অনুমতি না নিয়েই শরীর স্পর্ষ করল।অদ্ভুত!সব পুরুষ বোধ হয় এক হয় না ভেবেই অদ্রিজা টপাটপ পানি ফেলল চোখ থেকে।মৃদু কন্ঠে ” ওহ” কথাটা বলেই কল কাঁটল। সামনের আয়নায়টায় নিজেকে পরখ করতে করতেই চুলগুলো হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল।গলার কাছে কাঁমড়ের দাগগুলো চুল দিয়েই ঘেরা ছিল।চুল সরাতেই তা স্পষ্ট চোখে পড়তেই হুমড়ে বসে পড়ল সে ফ্লোরে।কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠল,
‘ আমি তো চাইনি এমন কাউকে।আমি তো চাইনি এমন কাউকে যে কিনা মন বলতে কিছুই বুঝে না।শুধু শরীরই তার কাছে সব।প্রতিদিন কত মেয়ের সাথে সে সময় কাঁটায় আমি জানি না।তবে আমি তো এমন কাউকে চাইনি। তবে আমার সাথেই কেন এমন সৃষ্টিকর্তা?আমার ভাগ্যে এমনই কেউ কেন?কেন আব্বু মারা গেল।কেন? কেন তুমি ছেড়ে গেল এভাবে আমাকে আব্বু?আমি ঐ লোকটাকে কোনদিন ভালোবাসতে পারব না।কোনদিনও নাহ।তবুও তার সাথে আমাকে সংসার করতে হবে।তবুও তার সাথে আমার পুরোটা জীবন জড়িয়ে।’
.
ওয়াশরুমের দেওয়ালে রক্তিমের রক্তের ছাপ।দেওয়ালে একের পর এক ঘুষি দিতেই ব্যস্ত সে।হাতের রক্ত গড়িয়ে দেওয়াল রাঙ্গা হলো, নিচে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ল তবুও ক্ষান্ত হলো না রক্তিম।নিজের সবটুকু রাগ নিজের হাতের উপর দিয়েই মেটাচ্ছে।চোয়াল শক্ত করেই দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলল সে।যা স্পষ্ট বোধ হলো না অদ্রিজার মস্তিষ্কে। রক্তিমের মায়ের কথা অনুযায়ীই খাবার দিতে এসেছিল সে এই রুমে।রুমে ডুকে রক্তিমের অদ্ভুত এই কাজ দেখেই হতবাক হলো সে। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ রক্তিমের দিকে।লোকটা কি এমনই?অদ্ভুত?নিজের হাতকে নিজেই এভাবে ক্ষত বিক্ষত করছে, ব্যাথা কি লাগছে না?অদ্রিজা দু পা এগুতে নিতেই মুখের সামনেই ওয়াশরুমের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে নিল রক্তিম।চিৎকার করে বলে উঠল,
‘ আপনি আমার রুমে?আমার রুমে কাউকে আমি এলাউ করি না। এটা বলে নি আপনাকে মিস্টার এন্ড মিসেস মাহমুদ?’
অদ্রিজা পা জোড়া স্থির করে দাঁড়িয়ে গেল।এই রুমটা রক্তিমের তার জানা ছিল না।স্বাভাবিক ভাবেই ভেবে বসেছিল গতকালে যে রুমে সে আর রক্তিম ছিল ওটাই রক্তিমের রুম।সে তো কেবল রাতের খাবারটা দিতেই এসেছিল রক্তিমের আম্মুর কথা অনুযায়ী।এই রুমে ডোকা যে নিষেধ আছে তা তো জানত না।ছোট ছোট শ্বাস ফেলেই বলল সে,
‘ না বলে নি।আমি জানতাম না আপনার এই নিষেধাজ্ঞার কথা।আর এটাও জানতাম না যে এটা আপনার রুম।আমি তো ভেব…….’
অদ্রিজা বাকিটা বলতে পারল না।ভেতর থেকে বেরিয়ে আসল রক্তিম। চুলগুলো ভেজা।টপাটপ পানি গড়াচ্ছে কপালে।ধবধবে সাদা, লম্বা চওড়া শরীরে কোমড়ে একটা তোয়ালে প্যাঁচানো কেবল।চোখজোড়া অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে তার।চোয়াল শক্ত রাখা সেই মুখটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। অদ্রিজা সেই মুখচাহনিতে একনজর তাকিয়েই দ্রুত নজর সরাল।চোখ নামিয়ে রক্তিমের হাতের দিকে তাকিয়েই কেঁপে উঠল সে।রক্ত এখনো গড়াচ্ছে।টপাটপ করে পড়ছে ফ্লোরে।সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠল অদ্রিজা,
‘ আপ্ আপনার হাত।’
রক্তিম বাঁকা হাসল।হাত থেতলে গেছে।রক্তগুলো টলেমলে হাতে খেলা করছে। হাতটা একঝাড়া দিতেই রক্তের ছিটে পড়ল দেওয়ালে। দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,
‘ কেয়ার নিচ্ছেন নাকি?’
অদ্রিজা মুখ কালো করল।মৃদু স্বরে বলে উঠল,
‘ আপনার খাবারটা দিতে এসেছিলাম।’
‘ গুড।টেবিলের উপর রেখে চলে যান।আর শুনুন?আর কখনো এই রুমে ডুকবেন না।সুযোগ পেলেও ডুকবেন না। কখনোই নাহ।মনে থাকবে?’
অদ্রিজা মাথা নাড়াল যার অর্থ তার মনে থাকবে।দু পা পিঁছিয়েই খাবারটা টেবিলে রাখতে রাখতেই পুরো রুমে একনজর চোখ ঘোরাল সে।পুরো রুম এলোমেলো।ফ্লোরটাও জামাকাপড়ের অগোছাল স্তূপে পরিপূর্ণ।জানালার পর্দায় ময়লা জমেছে।জমেছে বিছানা ছাদরটাতেও ময়লা।গভীরভাবে পুরো রুমটা ভালোভাবে দেখতে দেখতেই কল বাঁজল রক্তিমের। রুমে অদ্রিজার উপস্থিতিটা পুরোপুরি ভুলে বসেই সে কল রিসিভড করে বলে উঠল,
‘ হ্যালো বেইবি।হাউ আর ইউ?’
পুরো বাক্যটা কান পর্যন্ত পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ঘুরে তাকাল অদ্রিজা। রক্তিমের চাহনিতে তার বিশেষ একটা প্রভাব পড়ল না।সে নির্বিকার ভাবে কথা বলতেই থাকল ওপাশের তার কোন এক প্রেমিকার সাথে। পুরো রুমে যে অদ্রিজা নামের কোন একটি মেয়ে তার কথাগুলো পুরো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছে তার বিশেষ একটা পাত্তা দিল না সে।বরং রুমে যে আদৌ কেউ আছে তাই বেমালুম ভুলে বসে প্রেমালাপ শুরু করল।প্রায় বিশ মিনিট পর নিজের কথা শেষ করেই ফোনটা ছুড়ে মারল নোংরা বিছানা ছাদরের একপাশে।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করে বলল,
‘ বলেছিলাম না চলে যেতে?কথা কানে যায়নি আপনার?’
অদ্রিজা কেঁপে উঠল।এতক্ষন অন্য একজনের সাথে শান্ত ভঙ্গিতে প্রেমালাপ করা লোকটাই হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।লাল টকটকে চোখ জোড়ায় কঠোর নজর নিক্ষেপ করতেই ইষৎ কেঁপে উঠল অদ্রিজা।ঠোঁট চেপে কিছু বলার আগেই রক্তিম আবারও চেঁচিয়ে বলে উঠল,
‘ বলেছিলাম আমার রুমে কাউকে এলাউ করি না। আপনি জোরপূর্বক ডুকে পড়েছেন।আমি আপনাকে তাও কিছু বলিনি।আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তাকে কতটুকু সাফার করতে হতো তা আপনার জানা নেই। ‘
অদ্রিজা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।রক্তিমের হঠাৎ চেঁচানোতেই কিছুটা ভয় পেয়েই ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলল সে।দুই এক মিনিট নিরব থাকার পরই কথা বলার সাহস পেল সে।তারপর চারদিকে আরেক নজর তাকিয়েই মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনার হাতটা ব্যান্ডেজ করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন রক্তিম।আমি ফার্স্ট এইড বক্…..’
চলবে??….