হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-২৮

0
443

হৃদয় নিবাসে তুই
পর্ব-২৮
লেখনীতেঃ ভূমি

‘ কনগ্রেচুলেশন মিসেস রক্তিম মাহমুদ ফর ইউর থার্ড মান্থ’স অফ প্র্যাগনেন্সি।’

অদ্রিজা থমকাল রক্তিমের শান্ত কন্ঠে কথাগুলো শুনে।নেহার জোরাজুরিতে সে ও সেঁজেছে।তবে এই সাঁজের কোন নির্দিষ্টি কারণ না পেয়েই এতক্ষন চুপ ছিল।হঠাৎ ঐ তাকে ছাদে আনা হলো।অদ্রিজা কোনকিছুরই কারণ খুঁজে পেল না।শান্ত গম্ভীর চাহনি ফেলে প্রসস্ত ছাদটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল কেবল।বেশ সুন্দর সাঁজানো হয়েছে।ছাদের মাঝখানটায় ইয়া বড় টেবিল।টেবিলের উপরই বড়সড় কেক রাখা।ছাদের ঠিক সেই জায়গাটায় বেলুন দিয়ে চমৎকার সাঁজানো।ছাদের বাকি চারপাশ কাঁচা ফুল দিয়ে সাঁজানো।কাঁচা ফুলের সুভাস মৌ মৌ করতেই ছাদে উপস্থিত হলো মিষ্টি মিষ্টি পিচ্চি পাখিগুলো।পিচ্চি ছেলেমেয়ে গুলোর দিকে মুগ্ধ চাহনিতে তাকাতেই আকস্মিক সামনে আসল রক্তিম।তার একটা হাত টেনে ধরেই শান্ত শীতল গলায় কথাগুলো বলল রক্তিম।অদ্রিজা বিস্ময় নিয়ে রক্তিমের দিকে তাকাল।নিজের হাতটা এক টানে ছাড়িয়ে নিয়েই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল।মুখেচোখে চাপা অনিভূতি নিয়ে চারপাশ ফিরে চাইল।সুইটহার্ট,নেহা,অত্রিয়া, দিহান, রায়মান সহ পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়ে গুলোর মুখে মিষ্টি হাসি।হাসিগুলো নজর ফেলে ভালোভাবে দেখতে দেখতেই চোখজোড়া গিয়ে স্থির হলো সেই মানুষগুলোরই পাশে থাকা আরেকজন মানুষের উপর।তার মা!এখানে?প্রথম দফায় বিশ্বাস না করলেও নিজের চোখকে অবিশ্বাস করার কারণ খুঁজে পেল না সে।বিস্ময় নিয়ে সেদিক পানে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আবার ও তার হাতটা ধরল। পকেট থেকে একটা রিং বের করেই আঙ্গুলে পরিয়ে দিতে দিতেই ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ হাত ছাড়িয়ে নিলেন কেন?আপনার হাত সত্যি সত্যি ভেঙ্গে ফেলব ভেবেছেন?’

অদ্রিজা বিরক্তি নিয়ে তাকাল।হাতটা পুনরায় ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁঝাল দৃষ্টিতে তাকাল।অনামিকা আঙ্গুল থেকে রিংটা খুলে নিয়েই রক্তিমের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিল।তীব্র রাগ আর ক্ষোভে মুখচোখ লাল করেই বলে উঠল,

‘ আপনার দেওয়া কোনকিছুই পরব না আমি।রিংটা আপনার কাছেই রাখুন।আপনার দেওয়া পায়েলটাও অনেক আগেই খুলে রেখে দিয়েছি।আপনাকে দিয়ে দিব।’

রক্তিমের হাসিমাখা মুখের চাহনির বদল ঘটল এবার।ফর্সা ধবধবে নাক, মুখ লাল হলো।চোয়াল শক্ত হয়ে এল যেন।হাঁটু গেঁড়ে বসেই অবিশ্বাসের সাথে অদ্রিজার শাড়ি সরিয়ে পায়ের পায়েলটা যে নেই তা নিশ্চিত হলো।সঙ্গে সঙ্গেই রাগটা শতগুণ বাড়ল।অদ্রিজার থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেই ছাদের রেলিংটায় জোরেসোরে এক ঘুষি বসাল।ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ ভালো করলেন না এটা!একদমই ভালো করলেন না অদ্রিজা।’

অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।বুকে হাত জোড়া ভাজ করে দাঁড়িয়েই নেহাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আমি সত্যিই অনেক ক্লান্ত নেহা।অত্রি চল, বাড়ি যাব।সুইটহার্ট?এবার বাড়ি যাই?প্লিজ!’

সুইটহার্ট মিনমিনে চোখে তাকাল। অসহায় মুখ করে একবার রক্তিম তো একবার অদ্রিজার দিকে তাকাল।কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে সবাই মিলে এই সারপ্রাইজ প্ল্যান করল।শেষ পর্যন্ত সারপ্রাইজটার যে বারোটা বেঁজে গিয়েছে তা রক্তিমের মুখচোখ দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না তার।হতাশ চাহনি ফেলেই বলে উঠলেন তিনি,

‘ যাবে?যাবে মানে?এবার থেকে তুমি এখানেই,আমার সাথেই থাকবে।একা একা আর কত বাঁচা যায় শুনি?জান তো আগে বলেইনি আমার একটা সতীন আছে।নয়তো অনেক আগ থেকেই সতীন নিয়ে সংসার করা শুরু করে দিতাম।সবটা জানের দোষ!’

অদ্রিজা ম্লান হাসল।নরম কন্ঠে বলল,

‘ সুইটহার্ট?তুমি চিন্তামুক্ত থাকো।তোমার সুখের সংসারে কোন সতীন আসবে না।সতীন নিয়ে জ্বালাময় সংসার ও করতে হবে না তোমায়।তোমার জানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যাবে কয়েক মাস পর।’

অদ্রিজার অপ্রত্যাশিত কথাটাতেই রাগটা এবার ফুলেফেঁপে উঠল রক্তিমের।চোখেমুখে এক ভয়ংকর চাহনি।কপালের রগটা ইতমধ্যেই ফুলে উঠেছে। লাল রক্তিম চেখজোড়া নিয়ে একনজর অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই হনহনিয়ে এগিয়ে এল সুইটহার্টের কাছে।গম্ভীর তীক্ষ্ণ গলায় স্পষ্টভাবে বলে বসল,

‘ সুইটহার্ট, এখানে কিছু হবে না আর।সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করো গিয়ে।আমার জন্য এক মগ কফি পাঠিয়ে দিও।খাব না আমি।আর হ্যাঁ,অদ্রিজা?’

অদ্রিজা মাথা তুলে চাইল।রক্তিমের লাল রক্তিম চোখজোড়ার দিকে তাকিয়েই মুহুর্তে শিউরে উঠল।গম্ভীর চোখমুখে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম বলল,

‘ আপনি এই বাসাতেই থাকবেন।বের হবেন তো পা কেঁটে রেখে দিব বলে দিলাম।মাইন্ড ইট!আমাকে এর থেকে বেশি রাগালে ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।’

অদ্রিজার স্পষ্ট জবাব,

‘ কি করবেন?মেরে ফেলবেন?আপনার কাছে থেকে যেটুকু নিশ্চয়তা থাকবে তার থেকে একটা উম্মাদের সাথে থাকলেও বেশি নিশ্চয়তা থাকবে রক্তিম।কি কথার ধরণ!ছিঃ!’

রক্তিম ভ্রু কুঁচকাল।অদ্রিজার মুখের দিকে কিছুটা ঝুকতেই চুলগুলো ঝুকে পড়ল কপালে।অদ্রিজার হাতজোড়া খামচে ধরেই ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠল,

‘যদি নিশ্চয়তা নাও থাকে, তবুও আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।মানলে ভালো।না মানলে সেটা আপনার বিষয়।আমার মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি।ডিসগাস্টিং!’

কথাগুলো বলেই অদ্রিজার হাতজোড়া ছেড়ে দিয়ে চলে গেল রক্তিম।চোখেমুখের সেই তীব্র রাগের আকস্মিক আক্রমনে শিউরে উঠল অদ্রিজার মন প্রাণ।একটু বেশিই কি করে ফেলেছে রক্তিমের সাথে?মস্তিষ্ক বলল, না!আত্নসম্মান নিয়ে এটুকু করা অন্যায় নয়।রক্তিমই তো বলেছিল তার আত্মসম্মান নেই, বেহায়া।তবে? আজ কেন আত্মসম্মান দেখাতে না দেখাতেই রাগে থিতিয়ে গেল তার চোখ মুখ?

.

এই বাসা থেকে শত জোরাজুরির পরও যাওয়া হয়ে উঠে নি অদ্রিজার।রাত এখন অনেক।এত রাতে বাসায় একা ফেরা যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয় তেমনই এই বাসায় থাকাটাও তার জন্য উচিত নয়।অত্রিয়া আর তার মা জোর করেই রেখে গেল এখানে।তার চাওয়ার কি কোন গুরুত্ব নেই?অদ্রিজা ভেবে পেল না।মনটা হঠাৎ ভীষণ খারাপ বোধ হলো।যুবতী মন হঠাৎ ঐ কিশোরী মনের মতো রাগ, অভিমানে জড়োসড়ো হলো।কান্না আটকানো কষ্টে ছটফট করল।তার বোন, তার বান্ধবী করতে পারল এমনটা?বাসায় পৌঁছে দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে তাদের?অদ্রিজা ভাবল!ভীষণভাবে ভাবল।মুখচোখ কালো করল।দমবন্ধকর কষ্টে কান্না আটকাল।ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাত পরল।অদ্রিজা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল দরজার দিকে।এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই চোখে পড়ল রক্তিমের ভেজা মুখ। চোখজোড়া এখনও আগের মতোই লাল টকটকে।কপালে ভাজ।মাথার কালো চুলগুলো ভেজা।মুখের খোঁচা খোঁচা ছোট দাঁড়িগুলোতেও জলের ছিটেফুটে।অদ্রিজা একনজর চেয়েই গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

‘ কি সমস্যা?এত রাতে আমার রুমের দরজায় নক করছেন কেন?আশ্চর্য!ঘুমের মধ্যে বিরক্ত করবেন না।’

রক্তিম ম্লান হাসল। ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ঠোঁট চেপে বলল,

‘ এটা আমার রুম।আপনার রুম হলো কবে থেকে?’

অদ্রিজা নড়েচড়ে দৃষ্টি ফেলল রুমে।হবে হয়তো রক্তিমের রুম।এভাবে হুট করে নিজের রুম বলে দেওয়া উচিত হয়নি তার।কাঁপা গলায় বলল সে,

‘ সুইটহার্ট বলেছে এটা আমার রুম।জিজ্ঞেস করুন গিয়ে?’

‘ জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।বিশ্বাস করি আপনাকে।’

‘ কিন্তু আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।এটা যে আপনার রুম তার কি প্রমাণ আছে?বলুন।’

রক্তিম ক্লান্ত চাহনিতে তাকাল।বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল পেঁছনে তাকাতে।সঙ্গে সঙ্গে অদ্রিজা পেঁছন ফিরে চাইল।খাটের পাশেই টেবিলটার উপর রাখা ছবিটার ফ্রেমের ভেতর সুইটহার্ট আর রক্তিমের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।রক্তিম তখন অল্প বয়সী তরুণ বোধ হয়।হ্যাংলা,পাতলা শরীর।পরনে একটা টিশার্ট।ট্যারাব্যাকা দাঁত কেলানো সেই হাসিটা মুখে।পাশেই সুইটহার্টের মিষ্টিমুখ!অদ্রিজা হতাশ হয়ে ছবিটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করল।রক্তিমের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই রক্তিম ক্লান্তি নিয়ে বলল,

‘ প্রমাণ পেয়েছেন?আমি ক্লান্ত।আপনি হয়তো আমার থেকে বেশি ক্লান্ত, তবে আমার এই মুহুর্তে ঘুমের প্রয়োজন। প্লিজ সাইড!’

অদ্রিজা সরল।চাপা কন্ঠে বলল,

‘ তাহলে আমি?আমি কোথায় ঘুমাব?আমারও ঘুম পাচ্ছে।’

রক্তিম ভ্রু কুঁচকাল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বিরক্তিসহিত বলে উঠল,

‘ প্রথমত আপনি আমার মুডটাই চেঞ্জ করে দিয়েছেন।দ্বিতীয়ত বাচ্চাদের সাথে কেক মাখামাখি, হৈচৈ করে ক্লান্ত আমি।ঐসব কিছু আপনার জন্যই এরেঞ্জ করা হয়েছিল, আপনি তা ভেস্তে দিলেন। সমস্যা নেই।আমার পিচ্চিরা অলটাইম থাকে আমাকে খুশি রাখার জন্য।তাদের সাথে এতক্ষন সময় কাঁটিয়ে এখন বোধ হয় আমার ঘুম প্রয়োজন তাই না?আপনি প্লিজ এখন নতুন নাটক শুরু করবেন না অদ্রিজা।’

অদ্রিজা তৎক্ষনাৎ রাগল।রাগে চোখমুখ আগুন করেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ নাটক?এটাকে আপনার নাটক মনে হচ্ছে রক্তিম?এটার মতো সিরিয়াস ইস্যু আর হতে পারে?আমি আপনার সাথে এক রুমে কেন থাকব?আশ্চর্য!’

রক্তিম মাথা চেপে ধরল।দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,

‘ স্টুপিড!আপনি আমার সাথে এক রুমে থাকেন নি?কি হলো? থাকেন নি?বলুন।’

অদ্রিজা স্পষ্ট জবাব দিল,

‘ থেকেছি, তখন তো সেই চুক্তি অনুযায়ী থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম।এইছাড়া কিছুই নয়।এখন তো সেই চুক্তির দায়বদ্ধতা নেই!আপনিই সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমায় রেহাই দিয়েছেন। ‘

রক্তিম কঠিন চাহনিতে তাকাল।শক্ত গলায় বলল,

‘ শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা?আরো কিছু ছিল তো!সেসবের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়েছেন?আসলেই ভালোবাসা বলে কিছু হয় না।আমি ঠিক ছিলাম।’

অদ্রিজা স্পষ্ট গলায় বলল,

‘ ঠিক। ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। সবটা বাহ্যিক!’

রক্তিম ঠোঁট টিপে হাসল অদ্রিজার কথা শুনে।মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে হালকা ঝাড়া দিয়েই বলে উঠল,

‘ভালোবাসা আপাদত বাদ।চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো আমার পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়বেন।অনেক রাত হয়েছে।সুইটহার্ট বোধ হয় জেগে নেই।আর অন্য রুমগুলোও পরিষ্কার নেই। সো এইখানেই ঘুমোতে হবে।’

অদ্রিজা শক্ত কন্ঠেই বলল,

‘ ঘুমাব না।’

রক্তিম কড়া চাহনিতে তাকাল। কপাল কুঁচকেই বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ কেন?কি সমস্যা?’

অদ্রিজা অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ ঐ যে আত্নসম্মান।আপনিই তো বলেছিলেন বেহায়ার মতো আপনার পেছনে পড়ে আছি।’

রক্তিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ ভুলগুলো কি আমার ছিল আদৌ অদ্রিজা?সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছে করেই ভুলগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আর সেই মিথ্যে ভুলের শাস্তিটাও আমায় পেতে হচ্ছে।আপনি খাটে ঘুমোন। আমি সোফায় ম্যানেজ করে নিব।’

চলবে…..