হৃদয়দহন পর্ব-০১

0
99

#হৃদয়দহন (১)
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি

অপরার তখন নয় বছর। স্বভাবে খানিক’টা বোকা। কোথা থেকে যেন ছুটে এসে বলল,”অয়ন ভাইয়া,আমি তোমাকেই বিয়ে করব।”

বন্ধুরা পাশেই ছিল। শুনেতে পায়নি। শুনে ফেললে রক্ষা নেই। আমি ভাবছি এই টুকু মেয়ে বলে কি! নিচু হলাম। আশে পাশে বন্ধুরা আছে বিধায় ফিসফিসিয়ে বললাম,”আমাকেই বিয়ে করবি?”

“হুম।” সহজ সরল উত্তর। আগ্রহ জাগে। একটু দূরে সরিয়ে আনলাম ওকে। অপরার এক বদ অভ্যেস রয়েছে। নখ কামড়ানো। যা আমায় বিরক্ত করে। টেনে সরিয়ে দিলাম হাতটা। ফের মুখে তুলতেই চোখ রাঙালাম। এবার দমে গেল। নম্র,ভদ্র বাচ্চাদের মতো করে তাকাল। গাল দুটো ফোলা ফোলা। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়। আগ্রহ ধরে রাখতে পারছি না।
“আমাকেই কেন বিয়ে করবি?”

“তোমাকে বিয়ে না করলে আমি খেলতে পারব না।”

“খেলতে পারবি না! ওমা বিয়ের সাথে খেলার কি সম্পর্ক?”

ছোট্ট অপরা হাত উঁচু করে ইশারা করল। দেখলাম আমাদের পাশের বাড়ির নীলাকে। হাসছে মুখ টিপে। বিষয়টা বুঝতে পারলাম। সমবয়সী নই আমরা। তবে এক সাথে খেলতাম আগে। এখন কথা অবধি হয় না! এমনটা হলো আমি স্কুল বদল করার পর। দু বছর আগে ক্লাস নাইনে ভর্তির সময় বাবা স্কুল চেঞ্জ করে দিলেন। কারণ সেই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ নেই। তখন নীলা সেভেনে পড়ছে। এরপর গত দুবছরে আমাদের কথা হয়নি। কেন হয়নি জানি না। হয়তো চোখের আড়াল হতেই মনের আড়াল হয়ে গিয়েছিলাম। তবে দু বছর পর আজকের ঘটনায় মনটা কেমন করে ওঠল। আমার সতেরো বছরের হৃদয়ের দহনটুকু আরো বৃদ্ধি পেল। তবু সাহস করে কথা বলা হলো না। আর তারপর কেটে গেল অনেক গুলো বছর। এখন আমি অনার্স শেষ বর্ষে। ভালোই চলছে পড়াশোনা। এরই সাথে যেটা বেশি চলছে তার নাম দহন। ছটফট কিংবা চিত্ত চেরা আবেদন। হৃদয় মাঝারে একটি ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের নাম নীলা।

গল্পটা এখান থেকেই শুরু। অপরা এবার কলেজে উঠেছে। হৈ চৈ চলছে বাড়িতে। সবাই ভেবেছিল এই বুঝি পা ফঁসকে যাবে ষোড়শী অপরার। রেজাল্ট দেওয়ার আগ মুহূর্ত অবধি প্রায় সকলেই সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ‘মন খারাপ করিস নারে অপরা। এবার চাঁদ না উঠলেও সামনের বছর ও যে চাঁদ উঠবে না এ কথা তো সত্য নয়।’ কেউ কেউ বলল ‘এটা কোনো বিষয় নাকি! দেখলি না কি সব ভাইরাল হলো। কত বছরের পর বছর পড়াশোনার পেছনে লেগে থেকে শেষে উত্তীর্ণ। তাছাড়া আদু ভাই ও তো সর্বশেষ প্রমোশন পেয়েছিল। তুই ও পাবি।’

এসব নানান জল্পনা কল্পনার মাঝে অপরা চুপ। শুকনো তার মুখ। অয়ন বসেছিল ফোন নিয়ে। রেজাল্ট পাওয়ার সাথে সাথে জানাল। সকলে বিস্মিত! তাদের বোকা, ব্রেনে গোবর বোঝাই থাকা অপরা নাকি পাশ করেছে। শুধু কি পাশ! একটুর জন্য এ গ্রেটটা মিস হয়ে গেল। হরেক রকমের মিষ্টি আনা হলো। পুরো বাড়িটাই এখন অপরার কব্জায়। এত সময় চুপ ছিল রেজাল্টের টেনশনে। এখন ফুরফুরে তার মেজাজ। একটু নাচতে পারলে শান্তি মিলত। পাড়ার কাকিদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে কোমর দুলিয়ে চলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে সে ইচ্ছে পূর্ণ হলো না। দেখতে দেখতে অপরার কলেজের এডমিশন ও হয়ে গেল। অয়নের কলেজেই! অয়নের কলেজ আর ভার্সিটি এক সাথেই। একটুর জন্য সিট পেল অপরা। নাক ছুঁই ছুঁই বলা চলে। ওর রোল হলো সবার শেষে। এই নিয়েও এক বিস্তর হাসি ঠাট্টা। অপরা তখনো চুপ। মাঝে সাঝে নাক ফুলায়। ক্ষোভ থেকে নয় বরং এটা ওর সহজাত।

জুনিয়রদের নবীনবরণে কি পরবে এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ল চব্বিশ বছর বয়সী টগবগে যুবক অয়ন। একের পর এক পাঞ্জাবি সরিয়ে রাখছে। কোনোটাই মিলাতে পারছে না। চা দিতে এসেছিল অপরা। অয়ন খেয়াল করল।

“শোন, এদিকে আয় তো।”

অপরা এগিয়ে এল। মুখটো রাখল ফুলিয়ে। তা দেখে অয়ন বলল,”প্যাঁচার মতো তাকিয়ে আছিস কেন! আজ না তোর নবীণবরন?”

“হুম।”

“যাবি কখন! সেজে গুজে বের হতেই তো তিন ঘন্টা।”

“এই তো যাচ্ছি।”

পাঞ্জাবি গুলো দেখে রাগ হচ্ছে অয়নের। সে বলল,”দেখ তো কোনটাতে আমায় বেশি মানাবে আইমিন খুব হট লাগবে। মেয়েদের লাইন যেন লাগে।”

মাথা ঝাঁকাল অপরা। একটু লক্ষ্য করেই একটা সি গ্রীন কালারের পাঞ্জাবি বের করল। ভীষণ সুন্দর এটা। অয়নের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,”এটা আপনাকে খুব ভালো মানাবে।”

হেসে ফেলল অয়ন। অপরা অবশ্য এর কারণ জানে না। সে ঠায় দাঁড়ানো। কিছুই বোধগম্য হলো না। দেখল দুই একবার নাড়াচাড়া করে পাঞ্জাবিটা রেখে দিয়েছে অয়ন।

“তোর চয়েজ কি রে! ব্র্যান্ড সেন্স দেখছি খুব ই খারাপ।”

অপরা কথা বলল না। সে মুখ গোমড়া করে চলে এল। ঘটনাটা দিনের মধ্য ভাগের। নতুন বান্ধবীরা খুব রিকোয়েস্ট করল শাড়ি পরার জন্য। অপরা নিজেও শাড়ি পছন্দ করে বেশ। সময় কম। চটপট শাড়িটা আয়রন করল সে। তারপর রেডি হলো পাঁচ মিনিটে। চোখের নিচে হাল্কা কাজল আর ঠোঁট রাঙাল হাল্কা রঙে। গায়ের রঙ টা অধিক সুন্দর হওয়ায় বেশি প্রসাধনীর দরকার হয় না। একটু মাশকারা দিতেই চোখের পাপড়ি গুলো কেমন বড়ো দেখায়। পুরো মুখের নকশাই বদল!

নীলা,ভার্সিটির সেরা সুন্দরীদের একজন। নিজেকে সাজাতে পছন্দ করে। দেখলেই মনে হয় ‘ইস কি গোছানো মেয়েটি।’ সাথে আপসোস ও হয় ‘ওমন সুন্দর মেয়ে নাকি প্রেম করে না! বিশ্বাস করা যায় কি আদৌ?’ যায় না। তবে এমনটাই হয়েছে। একুশ বছরের এই যুবতী এখনো সিঙ্গেল ট্যাগ নিয়ে ঘুরে ফিরে। নীলাকে প্রপোজ করা প্রতিটি ব্যক্তিই হৃদয় হাতে করে প্রত্যাখ্যান হয়ে বাড়ি ফিরেছে। জুনিয়র ছেলেগুলো হা হয়ে দেখে। মাঝে সাঝে শোনা যায় আপসোসের সুর ‘সিনিয়র আপু গুলো এত সুন্দর হয় কেন! কপাল পো’ড়া!’

প্রতিবারের মতো আজও সেটা কানে এল নীলার। হেসে জবাব দিল।

“প্রায় সকলেরই কপাল পো’ড়া। জুনিয়রদের জন্মগত ক্রাশ হয় সিনিয়র। আর নিজের ক্লাসের মেয়েগুলো ওদের কাছে পেত্নি! তাই আর প্রেম হয়ে ওঠে না। শেষমেশ কপাল হাতে আপসোস করতে হয়।”

শেষ বাক্যে নীলার ঠোঁটটা একটু বেশিই প্রসারিত হলো। জুনিয়র ছেলে গুলোর বুকের বাঁ পাশে হাত। মনের ভেতর ঝড় তুলে দিল সিনিয়র আপুর কণ্ঠটা!

অয়ন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। নীলার এত লেট হচ্ছে কেন! মেয়েটি আজ আসবে তো? এই যে দু মাইল দূরে গিয়ে ফুল আনল। টকটকে তাজা গোলাপ। এসব তো বৃথা যাবে তবে। মনমড়া হয়ে এল। বসল, শব্দহীন। নীলা যখন আসে তখন একটার কাছাকাছি। প্রায় আধ ঘন্টা লেট! বুকের ভেতর উত্তেজনা কাজ করছে। নীলার কলেজ ছিল ভিন্ন। তবে ভার্সিটি এক। গত দু বছরে একটা সাধারণ বন্ধুত্ব হয়েছে। যেমনটা ছিল সেই ছোট্ট সময়ে। অয়নের হাতের ফুল দেখে নীলা বলে, “গোলাপ! স্পেশাল কিছু?”

বিলম্ব করতে চায় না অয়ন। সরাসরি বলে,”আই লাভ ইউ নীলা।”

মুক্তো ঝরার মতো হাসি ঝরে নীলার। এতে অয়নের ভয় হয়। মেয়েটি ওকে ফিরিয়ে দিবে না তো! বন্ধুরা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। টান টান উত্তেজনা। এই বুঝি প্রত্যাখ্যান হবে শত নারীর ক্রাশ অয়ন! অথচ ঘটনা ঘটল উল্টো। নীলা ব্যাগ থেকে ফুল বের করে বলল, “আমিও ভালোবাসি অয়ন।”

চারপাশ থেকে আওয়াজ আসতে লাগল। সকলেই বাহবা দিচ্ছে। অয়ন এতটা আশা করে নি। তবে এটা কনফার্ম ছিল নীলার মনে ওর জন্য সফট কর্নার আছে। পুরো দুপুরটা এক সঙ্গে কাটাল ওরা। নবীনবরণ হলো বিকেলে। অন্যদিকে বন্ধুদের যন্ত্রণায় হাজার খানেক ছবি তুলেছে অপরা। মানুষ ইদানীং ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল!

ফেরার পথে অপরা দেখল অয়নের বুকে মাথা গুঁজে আছে নীলা। লজ্জায় লাল হয়ে এলো মুখ। অয়ন ভাইয়া নীলাপুর সাথে প্রেম করছে!

অয়নের ফিরতে লেট হলো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে জল। অপরার নাম্বারে কল করল সে। দু বার কল করার পর ফোন রিসিভ করল মেয়েটি। ঘুমে জড়িয়ে আসা কণ্ঠ।

“হ্যালো।”

“অপরা,ফোন ধরিস না কেন? দরজা খুলে দে জান। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে।”

“কোন দরজা?”

ঘুমে ঘুমে জবাব দিল অপরা। আর এতেই অয়নের রাগ বেড়ে হলো আকাশচুম্বী।

“ঠাটিয়ে মা র ব গালে। বললাম না বাইরে দাঁড়িয়ে। দু মিনিটের মধ্যে নিচে নামবি।”

কিছুটা সজাগ হলো অপরা। অয়ন ভাই এত রাতে! তখনই মনে পড়ল নীলাপুর সাথে দেখেছিল আজ। হয়তো ঘুরাঘুরি করে ফিরতে লেট হলো। হাই তুলে অপরা। চোখের ঘুম সরিয়ে বেরিয়ে আসে। অয়ন সবে ফোন তুলেছে। মেজাজ গরম। ওমনি করে কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ এল। অপরা জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে। অয়ন বলল,

“এতক্ষণ লাগে!”

কাচুমাচু করছে অপরা। অয়ন ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,”কোথায় ছিলি?”

“আমার ঘরে,ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“তুই ঘুমেই থাক। যা দরজা লাগা।”

গরম লাগছে। সাথে পেটে ক্ষুধা। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে অয়ন বলল,”খাবার গরম কর। ক্ষুধায় পেটের ভেতর দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে।”

বিনাবাক্যে খাবার গরম করে এনে দিল অপরা। অয়ন হাত মুখ ধুয়ে এসে বসল। ভাত বাড়ার সময় অপরা বলল,”ডালের সাথে লেবু দিব নাকি আচার?”

ফোনে কিছু করছে অয়ন। খুব সম্ভবত চ্যাটিং। অপরা ফের বলল,”অয়ন ভাইয়া।আচার খাবেন নাকি লেবু?”

“আচার ই দে।”

বয়াম এনে দিয়ে চলে যেতে নিলেই অয়নের গলা “ঐ”

“হু?”

“এগুলা কে সরাবে? বোস, খাওয়া শেষ হলে যাবি।”

এবার রাগ হলো অপরার। লোকটা পেয়েছে কি! মগের মুল্লক নাকি শ্বশুরবাড়ি? অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বসতে হলো তাকে। অয়ন খেল সময় নিয়ে। দু একবার এটা সেটা এনে দিতে ও হলো। ঘুমে টলে যাচ্ছে অপরা। অয়নের ধমকে উঠে দাঁড়াল। সটান হয়ে রইল কিছু সময়। নিজের প্লেট অবধি নিল না অয়ন। হাত ধুয়ে এসে সোজা নিজের ঘরের পথে চলে যাচ্ছে। এদিকে অপরার হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলার উপক্রম! অয়নের এটো প্লেটের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো ছেলেটা বুয়ার মতো খাটাল তাকে!

চলবে….