হৃদয়দহন পর্ব-০৮

0
63

#হৃদয়দহন (৮)

রুবিনা আর অপরার দেখা হলো পাড়ার বড়ো দোকানটার কাছে। দুজনেই এসেছে কিছু জিনিস কিনতে। অপরা লজ্জায় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। ওর সংকোচ ধরে ফেলল রুবিনা। হেসে বলল,”কী রে, ওমন করে আছিস কেন?”

অপরা যে কি বলবে, বুঝতেই পারছে না। তার ভীষণ লজ্জা অনুভব হচ্ছে। রুবিনা এসে অপরার বাহু টেনে ধরল।

“ওমন মুখ করে আছিস কেন? মায়ের কথা এখনো ধরে আছিস?”

“চাচি তো ভুল বলেনি রুবিনাবু।”

“ধুর পাগল, মা তো বেশি বেশি বলেছে। তাছাড়া তুই তো ইচ্ছে করে ওদের সামনে যাস নি। ওরাই তো ওদিকটায় গেল। আর তোকে দেখল। তাছাড়া, আমাকে তাদের এমনিতেও পছন্দ হতো না।”

অপরা’র খারাপ ই লাগল। ও খপ করে রুবিনাবুর হাত খানা ধরে ফেলল,”রুবিনাবু, তুমি মনে দুঃখ রাখো নি তো?”

“পাগল মেয়ে, দুঃখ কেন রাখব?”

“আমি সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারি না। সারা টা সময় আমার মন আনচান করে।”

রুবিনা কথা বলল না। বরং হেসে অপরাকে আলিঙ্গন করল। চোখ দুটো বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল। তার মাঝে কেমন এক শীতলতা খেলা করছে। ওরা তখনো একে অপরকে আলিঙ্গন করে আছে। একটি ভরাট গলা ভেসে এল,”অপু।”

চট করেই তাকাল অপরা। রুবিনাও ওকে ছেড়ে দাঁড়াল। কিয়ান ঘেমে নেয়ে একাকার। হাতে বিস্তর জিনিসপত্র।

“এত জিনিস কেন?”

“দুদিন পর দোকানে বড়ো এক অর্ডার আছে। এগুলোর দরকার পড়বে। সেই জন্যই আনা।”

“ও, আমাকে কিছু দিন।”

অপরার হাতে দুটো মাঝারি ব্যাগ তুলে দিল কিয়ান। সারাটা রাস্তা আজ ফাঁকা। রিকশার নাম গন্ধ অবধি নেই। ওরা দুজন হাঁটতে লাগল। এক পর্যায়ে কিয়ান বলল,”রুবিনার সাথে কী করছিলে? কিছু বলেছে তোমায়?”

“না। কিছু বলে নি। বরং আমাকে সহজ হতে বলল।”

“ঠিক আছে। আর তুমিই বা ওসব ধরে কেন আছ?”

“আমার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে….’

ওকে থামিয়ে দিয়ে কিয়ান বলল,”পুরোটাই ভাগ্য। আমরা ভাগ্যের বেশি কিছুই করতে পারব না।”

“তবু, অপরাধ বোধ হচ্ছিল।”

“অপু।”

কিয়ানের দিকে সরল চোখে তাকাল মেয়েটি। এই লোকটার সহজ বাচনভঙ্গি অপরাকে মুগ্ধ করে।

“তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। এত ভালো কিন্তু ভালো নয়।”

মেয়েটি জবাব দেয় না। ওরা বাসার কাছে পৌঁছে গেছে। কিয়ান সব গুলো ব্যাগ তুলে নিল।

“পারলে একটু শরবত করে দাও তো।”

অপরা খুশি মনে চলে গেল। সম্ভবত এই প্রথম কিয়ান নিজ থেকে কিছু করতে বলল।

অয়ন দোতলা থেকে নামছিল। অপরা’র তোড়জোড় দেখে বলল‍,”কী হয়েছে রে?”

“কই কী হয়েছে?”

“এভাবে ছুটছিস কেন?”

“শরবত বানাব।”

“এভাবে ছুটোছুটির কী আছে?”

অপরা জবাব না দিয়েই চলে গেল। অয়ন দেখল কিয়ান বড়ো বড়ো ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করছে। অয়ন এগিয়ে এসে ব্যাগ গুলো খুলে খুলে দেখল।

“বড়ো অর্ডার আছে নাকি?”

“হুম। পাশের এলাকায়, বিয়ের অনুষ্ঠান আছে।”

“আরে বাহ! তাহলে তো ব্যবসায় সবুজ বাতি।”

“ভালো রোজগার হবে।”

“আমি একটা বিষয় ভেবেছি।”

“কী?”

“গ্রাজুয়েশন শেষ করে জব করব। তারপর কিছু টাকা জমিয়ে, বড়ো একটা মিষ্টির কোম্পানি দিব।”

অয়নের এহেন কথায় হেসে ফেলল কিয়ান। সে জানে ছেলেটা মজা করছে। আর এর পেছনে কোনো ব্যাখাও নেই। দু ভাই সোফায় বসেছিল। অপরা শরবত নিয়ে ফিরল। অয়নকে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে মাত্র এক গ্লাস শরতব ই বানিয়েছে।

কিয়ানের হাতে শরবতের গ্লাস তুলে নিল অপরা। তারপর অয়নের দিকে চাইল। অয়ন ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,”তাকিয়ে আছিস কেন? শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।”

এই প্রথম অপরা সরাসরি বিরোধ করে বলল,”পারব না। দাদিজানকে বলেন, আপনাকে বিয়ে করাতে। আপনার বউ এসে করবে। আমি করব না।”

কথা গুলো বলে চলে গেল অপরা। কিয়ান শরবত শেষ করে বলল,”তোদের দুজনকে নিয়ে আমার ভয়াবহ এক ভাবনা আছে।”

কিয়ানের কথায় ঘুরে তাকাল অয়ন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

“আমার কেন যেন মনে হয়, তোরা দুজন শেষমেশ সত্যি সত্যি বর,বউ হয়ে যাবি।”

অয়ন যেন মজা পেল। ও শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,”অপরা আমার স্নেহের। ওর প্রতি আমার আলাদা টান রয়েছে। ছোট থেকেই। আদরের,তবে সেটা কিন্তু বউ করার জন্য নয়।”

কিয়ান সহজ চোখে তাকাল। তার হৃদয়টা কোথাও একটা ছটফট করছে। ভেতরে অশান্তি ঠেকছে। সব কিছু নিয়েই তার ভীষণ ভয়। কেমন যেন ঘরকুনো স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নুহাশ কিছুদিন অসুস্থ হয়েছিল। সেই জন্য পড়ানো শুরু করতে পারে নি। বিষয়টির জন্য সে লজ্জিত ছিল। তবে অয়ন সেদিন কল করে সহজ হতে বলল। অসুস্থতা তো বলে কয়ে আসে না। সেটা বিষয় না, বিষয়টা হচ্ছে অপরা। মেয়েটি তখন থেকে চোখ, মুখ অন্ধকার করে আছে। যেন তাকে জোর করে বিয়ের আসরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সে শপথ করে, কবুল বলবে না। তার মুখের অবস্থা দেখে এমনটাই মনে হলো নুহাশের। এক পর্যায়ে সে মুখ খুলল,”অপু, তুমি কি আমার পড়ানোয় অসন্তোষ?”

মুখের ওপর হ্যাঁ বলা যায় কী? যদি বলা যেত, তবে অপরা নিশ্চয়ই সেটা বলে দিত। কিন্তু এখন যে সে উপায় নেই। সে বড়ো হতাশ হয়ে তাকাল। এই সময়টায় টিভিতে তার প্রিয় সিরিয়াল দেখানো হয়। বজ্জাত অয়ন’টার জন্য সব ভেস্তে গেল। নুহাশের চোখ মুখ র’ক্ত’শূণ্য হয়ে পড়ছে। সে বেশ চমকায়িত। তার জীবনের প্রথম টিউশনিতে, এমন পরিস্থিতি হবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। অপরার মুখে কুলুপ আটা দেখে ধাক্কাল কথা। চোখ দিয়ে বোঝাল উত্তর করতে। অপরা লম্বা একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,”আপনি পড়ান।”

“সেটা অবশ্যই। তবে তোমার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, একদমই আগ্রহী নও।”

“আসলে আমি একটু পড়াচোর।”

কথাটা একদম ভারহীন ভাবে বলে ফেলল অপরা। নুহাশের দু গাল রক্তিম হয়ে গেল। এহেন ছাত্রী এ জীবনে ও কল্পণা করতে পারে না সে।

পড়াশোনার পর্ব চুকিয়ে ভ্যাগা ভ্যাগা মুখশ্রী নিয়ে বের হলো অপরা। মাঝে ছোট গিন্নির সাথে দেখা হলো।

“অপু, কী হয়েছে রে?”

“যা হবার তো আগেই হয়েছে ছোট মা। কটা বেজে গেল। আমার প্রিয় সিরিয়াল।”

অপরা পারে না কেঁদে ফেলতে। তার এখন অপেক্ষা করতে হবে। আবার যখন দেখানো হবে, তখন দেখতে পারবে সে। মাঝের এত গুলো ঘন্টার কথা, স্মরণ হলেই অপরার কান্না পাচ্ছে। সে সোজা ছাদে ওঠে গেল। সেখানে স্টোর রুম আছে। যাওয়ার পথে খটখট আওয়াজ শোনা গেল। উঁকি দিতেই দেখা গেল কিয়ানকে। হাতে একটা ক্যানভাস। রংটা দেখে চট করেই সেদিনের কথা স্মরণ হলো অপরার। আরেকটু দেখবে ওমনি ওর কান টেনে ধরল অয়ন। ব্যথায় ইষৎ আর্তনাদ করে ওঠল মেয়েটি।

“লাগছে আমার।”

“লুকিয়ে কী করছিস তুই?”

“সেটাও আপনাকে বলতে হবে?”

“আলবাত হবে।”

“ছাড়েন, ব্যথা পাই তো।”

“তো, পাওয়ার জন্যই তো দিয়েছি।”

কথাটা বলে আরেকটু জোরে কান মুলে দিল অয়ন। অপরার চোখ দুটো জলে সিক্ত হয়ে গেল।

“দাদিজান কে বলব আমি। এক্ষুনি বলব।”

অয়ন এগিয়ে এসে পথ আটকে ধরল। অপরার চোখে জল।

“বেশি ব্যথা লেগেছে? আচ্ছা সরি।”

কথাটা বলেই স্নেহের হাতটি মাথায় ঠেকাল অয়ন। অপরা ও কেমন, এই সামান্য স্নেহেই গলে যায়। একদম ছোট থেকে। বিষয়টি যেন পুনরাবৃত্তি হয়। অয়ন সর্বদা তাকে মা’রবে, আর সে কান্না করবে। শেষমেশ একটু আহ্লাদ পেয়ে, অপরার মান ভাঙবে। কি এক জটিল সম্পর্ক তাদের। অয়ন পকেট থেকে চকলেট বের করল। বলল,”কথা কলিকে বলেছিস তো?”

“কী বলব।”

“ঘটনা যেন ফাঁস না করে।”

অপরার মাথায় বুদ্ধি এল। ও হেসে বলল,”সে বলেছি। তবে একটু রিস্ক আছে।”

“রিস্ক কেন?”

অপরা হাত চুলকাতে শুরু করল। অয়ন ঠোঁট কামড়ে চেয়ে আছে।

“টাকা চাই?”

“হু,হু। বেশি না পাঁচ শ।”

“পাঁচ শ! বেশি না বলছিস?”

“আপনি তো বড়োলোক অয়ন ভাই। পাঁচ শ তো হাতের ময়লা।”

কথাটা একদমই ঠিক না। অয়নের হাত খালি হয়ে আছে। সেদিন নীলার জন্য উপহার কিনে, একদমই পকেট খালি। ও তবু পাঁচ শ টাকা বের করে দিল। তারপর বলল,”মনে রাখিস কিন্তু। ঘটনা কাউকে বলা যাবে না।”

“ওকে। মনে থাকবে। কথাকে ঘু’ষ দিয়ে দিব আমি।”

অপরার মনটা ভালো হয়ে গেল। এটা সত্য অয়নের থেকে প্রায়শই সে ঘু’ষ পেয়ে থাকে। আর সেই টাকায় বেশ ভালো ভাবে ঘোরাফেরা হয় তার। পাঁচশ থেকে একশ দিবে কথাকে। আর বাকি চারশ দিয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবে। ভাবতেই অয়নের ওপর হওয়া রাগ কেমন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে।

|চরিত্র গুলো যেন আপনাআপনি চলতে শুরু করেছে। দেখি কতদূর কী হয়। সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ভালো কিছু দেওয়ার। আর যত রহস্য আসবে, সব ভেদ ও হবে। একটু সময় চেয়ে নিচ্ছি। |

চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি