হৃদয়দহন পর্ব-১৫

0
61

#হৃদয়দহন (১৫)

অপরা একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভালো লাগছে না। চারপাশ কেমন নিস্তেজ মনে হচ্ছে। ও বুক ভরে দম নিল। তবে মনে হলো বিষা’ক্ত বাতাস শরীরকে একটু একটু করে খেয়ে নিচ্ছে! কি এক যন্ত্রণা এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। নীলার উপস্থিতি ওমন ভাবে প্রভাবিত করল কেন? শরীরটা কেমন লাগছে। কীসের এত ভয় তার? অপরার ভেতর থেকে যুতসই উত্তর আসে না। শুধু একবার মনে হলো নীলা তার থেকে বেশি সুন্দরী, এটাই কী ভয়ের কারণ? সহসাই মেয়েটার বুকের ভেতর আনচান করে ওঠল। কয়েকবার দম নিতেই দেখা গেল ছুটে এসেছে কথা। তার গতি দেখে ওঠে দাঁড়ায় অপরা। শুধাল,”হাঁপাচ্ছিস কেন?”

“ভারী গণ্ডগোল লেগে গেছে অপুবু। ভারী গণ্ডগোল লেগে গেছে।”

কথার বলার ভঙ্গিতেই বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করে ওঠল। এরই মধ্যে চিৎকার চ্যাঁচামেচির শব্দ কানে আসছে। অপরা আর কথা মুহূর্তেই ছুটে গেল মাঠের দিকে। এসে দেখল, মাঠের মাঝ বরাবর বেশ জটলা হয়ে গেছে। হচ্ছে চ্যাঁচামেচি। অপরা শুকনো ঢোক গিলল। নীলা আর রুবিনা ও মাঠের ভেতর চলে গেছে। দুজনকে ভয়ার্ত দেখাচ্ছে।

“সামনে চল কথা।”

কথার হাতটি ধরে এগিয়ে গেল অপরা। তার দুটো চোখ ব্যথায় কেমন একটা করছে। কাছাকাছি যেতেই অতি পরিচিত তিনটে গলার আওয়াজ শোনা গেল। কিয়ান, অয়ন আর নুহাশ। মাঝে আবার মুরাদ ও রুশানের কণ্ঠ শোনা গেল। অপরা ধৈর্য হারিয়ে বলল,”এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। ভেতরে যেতে হবে।”

অপরা এক দল বলিষ্ঠ লোক গুলোর মাঝেই নিজেকে গলিয়ে দিল। তার পেছন পেছন গেল নীলা ও। রুবিনার কপালে ঘাম জমে গেছে। ও পেছন ফিরে চাইল।
“কথা, সামনে আগাবি না তুই।”

বাক্যটি শেষেই ভীড়ে মিলিয়ে গেল রুবিনা। এদিকে ছোট্ট কথার হাত,পা কাঁপছে। আপনজন দের কথা স্মরণ হচ্ছে। প্রিয় ভাইদের এমন বিপদে, সে না এগিয়ে কী পারে? পারে না। আর তাই তো, ছোট্ট সে এগিয়ে গেল ভীড়ের মাঝে। সেই ভীড়ে কত পুরুষের ঠ্যালাঠ্যালি যে লাগল, এসবে তার ধ্যান ই নেই। তার ধ্যান শুধুই প্রিয় মানুষ গুলোর দিকে। যাদের কে বাঁচাতে নিজের জান দিতেও প্রস্তুত সে।

খেলা ভেস্তে গিয়েছে! দুই পাড়ার সংঘর্ষে মাঠের খেলা আর গড়ায় নি। তবে দুঃখের বিষয় যথেষ্ট মা’র তারাও খেয়েছে। অয়নকে সোফায় হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে, তার পাশে বসে নুহাশ আর কিয়ান। তিন জন ই আহত, তবে অয়ন একটু বেশি। বাড়ির গিন্নি’রা কান্নাকাটি শুরু করেছে। দাদিজান নিজ কক্ষ থেকে চ্যাঁচামেচি করছেন। তিনি বার বার বলছেন,”কোন বাপের বেডার, এত সাহস। আমার দাদুভাইদের আ”ঘা’ত করে।”

তারপরই ছেলেদের নাম ধরে ডাকছেন। বোঝাচ্ছেন যেই বাপের বেডা, তার চোখের মনিদের আঘা’ত করেছে, তাদের যেন পুলিশে দেওয়া হয়। মায়ের কথায় কান দিচ্ছে না বাড়ির কর্তা’রা। রুবেল গিয়েছে ডাক্তার আনতে। এদিকে একবার অপরার সাথে চোখাচোখি হলো অয়নের। মেয়েটিই,প্রথমে ভীড়ের মধ্যে ঢুকেছে। ওর ইচ্ছে করছে, ঠাটিয়ে দুটো চ’ড় বসিয়ে দিতে। কিছু সময় পর ই ডাক্তার চলে এল। নীলা ও সাথে আছে। তার চোখ ভর্তি জল। সেটি সবাই না দেখতে পারলেও, অয়ন দেখতে পাচ্ছে। তবে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। নীলার প্রতিও তার বিস্তর রাগ জমেছে। কেন যাবে, ভীড়ে? সেই ভীড়ে যদি আঘা’ত পেতে হতো, তখন কী হতো? নীলার অসহায়ত্ত্বের দৃষ্টি অয়ন কে নাড়াতে পারল না। ও ফের তাকাল অপরার দিকে। মেয়েটার কান টেনে ধরার ইচ্ছে হচ্ছে। ডাক্তার নোমান ভীড় সরাতে বললেন,”আপনারা একটু সরে দাঁড়ান। আমাকে দেখতে দিন।”

সবাই সরে দাঁড়াল। তিনি আ’হত তিন জন কে দেখতে পেলেন। এর মধ্যে, অবস্থা বেশি খারাপ অয়নের। এই ছেলেটা ছোট থেকেই এমন। সারাক্ষণ ঝামেলা করতে থাকে। তিনি বুক ভরে সমীরণ নিলেন। তারপর তিনজনের চিকিৎসা শুরু করলেন। অয়ন যখন ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলছিল, তখন সদর দরজা চেপে ধরেছে নীলা। যেন ব্যথাটা তার লাগছে, আর তাই নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

চিকিৎসা শেষ। এখন রেস্ট নেবার পালা। কড়া নির্দেশনা দিলেন ডাক্তার নোমান। অয়নের চোখ,মুখে আঁধারে নিমজ্জিত। তিনি কিছু সময় সেদিকে তাকালেন। তারপর হতাশা ভরা একটি নিশ্বাস ফেললেন।
“আমি এখন ওঠি। ওদের যত্ন নিবেন ঠিক ঠাক।”

বড়ো গিন্নি বলে ওঠলেন,”বসে যান ভাইজান। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। চা খেয়ে যান।”

“আজ না আপা। অন্য এক সময় হবে।”

নাতিদের বেহাল দশার খবর শুনে দাদিজান ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন। তাই তাকে বসার ঘরে নিয়ে আসা হলো। তিনি কথা গুলো শুনেছেন। তাই বললেন,”নোমান, সন্ধ্যায় আসছো বাপ। চা না খেয়ে যাবা না।”

বৃদ্ধার কথার বিপরীতে নোমানের কথা হারিয়ে গেল। তিনি বসতে বাধ্য হলেন। সেই সুবাদে নীলা’র ও বসা হলো। প্রথমবারের মতন এ বাড়িতে পা পড়েছে তার। ও কিছুটা খুশি মনে অয়নের দিকে চাইল। তবে অয়ন মুখ ফিরিয়ে নিল। এতে করে মেয়েটি হৃদয় কয়েক টুকরো হয়ে ফ্লোরে পড়ল। কালো হয়ে এল মুখশ্রী।

বড়ো গিন্নি অপরাকে খুঁজছেন। অথচ মেয়েটির দেখা নেই। তিনি কথাকে বললেন,”অপু কোথায় গেছে?”

“জানি না তো।”

“খুঁজে নিয়ে আয় তো।”

কথা ছুটল অপুবুকে খুঁজতে। আর তিনি গেলেন চা নাশতার ব্যবস্থা করতে। এদিকে বসার ঘরে কর্তাদের সাথে টুকটাক কথা বলছেন ডাক্তার নোমান। অবশ্য অয়ন, কিয়ান,নুহাশ চলে গিয়েছে আরো আগেই।

কথা এসে দেখল, অপরা অয়নের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। ও ডেকে ওঠল,”অপুবু।”

কণ্ঠ পেয়ে ঘুরে চাইল অপরা। অঙ্গভঙ্গি’র দ্বারা চুপ বোঝাল। কথা এগিয়ে এল। কণ্ঠের খাদ নামিয়ে শুধাল,”এখানে কী করছ?”

“পাহাড়া দিচ্ছি।”

“ওমা কেন? অয়ন ভাইকে পাহাড়া দেয়ার কি আছে?”

অপরা বিরোধ করার পূর্বেই ঘরের দরজাটি ইষৎ খুলে ফেলল কথা। এতে করে দৃশ্যমান হলো রোমাঞ্চিত দৃশ্যটি। কথা মিটিমিটি হাসল। ওর হাসি দেখে ঘরের ভেতর চাইল অপরা। দেখতে পেল, দুজন সুখী মানুষ একে অপরকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে আছে।

চা নাশতার পর্ব শেষ। অনেকটা সময় হয়ে গিয়েছে। নোমান এবার ওঠার প্রয়োজন বোধ করলেন। তাকে আর কেউ বাঁধা দিলেন না। তিনি নিজের ব্যাগ হাতে তুলতে তুলতে ডাকলেন,”নীলা।”

“অপু”র সাথেই আছে। বলে দিচ্ছি, ডেকে আনতে।”

কথাটা বললেন ছোট গিন্নি। তিনি কথাকে পাঠালেন খবর দিতে। কথা গিয়ে নীলাকে ডেকে আনল। এবার বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে চলল তারা। নীলা অবশ্য ওপরে একবার তাকাল। দেখতে পেল, অয়ন তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে সুখ ছেঁয়ে আছে।

নুহাশকে যেতে দেওয়া হয় নি। ছেলেটার এহেন অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ী তারা। তাই ভেতর থেকেও একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। যদিও অনেক বেশি আ’হত নয়। কথা আর অপরা রাতের খাবার নিয়ে এসেছে। ঘরেই খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। অপু যখন খাবার পরিবেশ করছে, তখন নুহাশ প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার দু চোখ ভরে ওঠেছে অলীক স্বপ্নে। মেয়েটার প্রতি এই অনুভূতি, তাকে কিছুটা দহন ও দিচ্ছে। হুট করেই অয়নের কণ্ঠ শোনা গেল। সে অপরাকে ডাকছে। বারান্দায় ছিল। কথা বলল,”বাকিটা আমি দিচ্ছি।”

অপরা মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। এসে দেখল অয়ন দাঁড়িয়ে।

“ডেকেছেন?”

অয়ন পেছন ফিরল। এতে করে দুজনের দৃষ্টি একত্র হলো। ছেলেটার দৃষ্টি রক্তিম হয়ে আছে। ও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”এত বেশি বুঝতে বলেছে কে? কেন অত গুলো পুরুষ মানুষের মাঝে গিয়েছিলি? কে যেতে বলেছিল তোকে?”

কম্পিত হলো অপরা’র দেহ। ও জবাব দিতে পারল না। অয়ন বেশ রেগে আছে। তবে কণ্ঠের স্বর নিচু। সহসাই মেয়েটির বাহু চেপে ধরল অয়ন। অসম্ভব রাগ মিশিয়ে বলল,”লিসেন, তুই তখন ছয় বছরের। আ’গু’নে দুটো মানুষ দ্ব গ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি চ্যাঁচামেচি করছিলাম। সেই ছোট অবস্থাতেই তাদের বাঁচানোর উপায় খুঁজছিলাম। তবে দুটো ব্যক্তি কি বলেছিল মনে আছে? বলেছিল, অপরা কে বাঁচাতে। কসম দিয়ে বলেছিল, অপরাকে বাঁচাতে। আমার তখন বয়স কত? তেরো – চৌদ্দ। ঐ টুকু বয়সে আমার ওপর দায়িত্ব ওঠে গিয়েছিল। তোকে বাঁচানোর দায়িত্ব। তবে তোকে বাঁচাতে পারলেও, দুটো মানুষকে বাঁচাতে পারলাম না আমি।”

কথাটা শেষ করে অপরার বাহু ছেড়ে দিল অয়ন। তার মাথা ভীষণ গরম হয়ে আছে। সেই দৃশ্য কল্পণা করলেই হৃদয়টা কেমন করে ওঠে। ও পুনরায় বলল,”অপরা, তুমি আমার দায়িত্ব। যা আমি কিশোর বয়সে পেয়েছিলাম। তাই মনে রাখবে, আমার দায়িত্বের শতভাগ পূরণ করব আমি। সেটা তোমার পছন্দ হোক কিংবা না হোক।”

কথা শেষ করেই চলে গেল অয়ন। আর সেদিকে তাকিয়ে অপরা’র চোখ থেকে এক বিন্দু জল নেমে এল। শুধুই মনে হলো সেদিন যদি বাবা-মায়ের ছাঁয়াটা মাথা থেকে না সরে যেত, তবে গল্পটা অন্যরকম হলেও পারত।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি