হৃদয়দহন পর্ব-১৯

0
55

#হৃদয়দহন (১৯)

অপরা মাত্র কলেজ থেকে ফিরল। কাঁধে ব্যাগ, ক্লান্ত মুখশ্রী। বাড়িতে প্রবেশ করার পথে অদূরের ফুল গাছটার নিচে রুবিনাবুকে দেখা গেল। গাছের চারপাশে ইট সিমেন্টের দ্বারা পাকা করা। সেখানেই গালে হাত দিয়ে বসে আছে রুবিনাবু। সেটা দেখে অপরা আর বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল না। এগিয়ে গেল রুবিনাবু’র দিকে। উদাসীন যুবতী’র কোনো খেয়াল ই নেই। খেয়াল ফেরাতে হাত খানা টেনে ধরল অপরা। এতে ধ্যান ভাঙল রুবিনার। ছোট ছোট চোখে চেয়ে বলল,”এখন ফিরলি?”

“হ্যাঁ। তোমাকে এমন লাগছে কেন রুবিনাবু?”

“কেমন লাগছে?”

কথাটা বলেই চোখে মুখে হাত ছোঁয়াল রুবিনা। মা বলেছেন সবসময় হাসি খুশি থাকতে হবে। এমনিতেই গায়ের রংটা চাপা। মুখ ভার করে রাখলে, আরো বেশি আঁধার লাগে। তাছাড়া কদিন বাদেই বিয়ে, এখন যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে রাখতে হবে। সবটা স্মরণ করে রুবিনা দীর্ঘ শ্বাসের মতন শব্দ করল। অপরা তখন থেকে রুবিনাবু’কে দেখে চলেছে। ইষৎ বাদামি মুখখানি। চোখ দুটো স্বচ্ছ। সরু নাক আর পাতলা ঠোঁট। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলে, হৃদয়টা শীতল হয়ে যায়। অপরা কেমন একটা ধাক্কা খেল। রুবিনাবু’কে হুট করেই একটু বেশি সুন্দর লাগছে। ওর অবাক চাহনি দেখে রুবিনা হেসে ফেলল। একদম মন প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া হাসি। অপরা শুকনো ঢোক গিলে বলল,”রুবিনাবু।”

“কী?”

“তুমি অসম্ভব সুন্দর।”

হো হো করে হেসে ফেলল রুবিনা। অপরা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,”সত্যি খুব সুন্দর।”

“তাই নাকি? গায়ের রংটা দেখেছিস? কেমন কালো।”

কথাটা বলেই হাত খানা এগিয়ে দিল রুবিনা। অপরার ত্বকের রং ফর্সা। তবে অতিরিক্ত ফর্সা নয়। মেয়েটির সুন্দর ত্বকের কাছে রুবিনার ত্বক খানিকটা ফ্যাকাশে লাগে। অপরা চোখ ফিরিয়ে রুবিনা’র দিকে চায়। একই ভাবে তাকায় রুবিনাও।

“বিয়েটা ঠিক হয়েই গেল। তোদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভাবলেই কেমন লাগছে।”

সহসাই টনক নড়ে অপরা’র। তাই তো। রুবিনাবু’র তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। তার বর হবে। কিন্তু সেই বর তো কিয়ান ভাই নয়। তবে কিয়ান ভাইয়ের কী হবে? এ কথা ভেবেই অপরা’র হৃদয়টা কেমন কেঁপে ওঠে। ও বিনা বাক্যে ওঠে পড়ে।রুবিনাও অন্য মনস্ক হয়ে যায়। তার জীবনটা তার গায়ের রঙের মতনই। ভীষণ চাপা।

বাড়িতে বেশ ব্যস্ততা চলছে। দুই গিন্নি ঘেমে নেমে অস্থির। আজ কর্তা’রা বাড়িতেই খাবার খাবেন। তাদের আবার সবটা পারফেক্ট হওয়া চাই। অপরা চোখ দুটো ছোট করে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ওমনি ছোট গিন্নি বলল,”অপু, ফিরেছিস। গোসল করে আয়। একসাথে খাবার খাবি।”

অপু ক্লান্ত,ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,”পরে খাব ছোট মা।”

“কেন রে? ক্ষিধে পায় নি?”

“না।”

বড়ো গিন্নি খাবার গুলো সাজাতে ব্যস্ত। অপরার কথা শুনে বললেন,”তাহলে, একটু ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর দাদিজান তো রাগ করে আছে। কারো হাতে খাবার খাচ্ছে না।”

দাদিজানের কথা শুনে অপরা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ও প্রশ্ন করার আগেই ছোট গিন্নি বলল,”কয়েকদিন ধরে তুই নাকি তার কাছে যাস না?”

অপরা’র খেয়াল হলো। দুদিন ধরে দাদিজানের ঘরে যাওয়া হয় না। হবেই বা কেমন করে, ওর তো মন ই ভালো নেই। বুড়ির কাছে গেলেই সেটা ধরে ফেলবে। সেই জন্যই তো পালিয়ে ছিল। অথচ উপায় নেই। অপরা ছোট্ট শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায়। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পুনরায় ফিরে আসে। ডাইনিং থেকে নিজ হাতেই খাবার বেড়ে নিয়ে দাদিজানের ঘরে আসে। দাদিজান অপরার উপস্থিতি বুঝতে পারে। অথচ কথা বলে না।

“কিগো, তুমি নাকি রাগ করেছ?”

জবাব নেই। দাদিজান মুখ ফিরিয়ে রাখে। অপরা মুখ ভার করে বলে,”তুমি এভাবে রাগ করলে, আমি সত্যিই আর কখনো আসব না।”

এবার ও জবাব নেই। অপু বুঝে, অল্পতে হবে না। তাই ঠোঁট কামড়ে বলে,”ঠিক আছে। চলে যাব আমি। এই বাড়িতে কেউ আছে আমার?”

এ কথায় কাজ হয়। অপরা চলে যেতে নেয়, দাদিজান ডেকে ওঠেন। অভিমানের মতন করে অপু বলে,”না, ডেকে লাভ নেই। আমি চলে যাই বরং।”

কি একটা অভিমানের কথা। অপরা’র অভিমান ভাঙাতে দাদিজান এবার হাতখানা স্পর্শ করেন।

“ভালো লাগে না। তুমি শুধু শুধু মায়া বাড়াচ্ছ।”

“এটা কেমন হলো? রাগ দেখাব আমি, অথচ তুই দেখাচ্ছি। আর মায়া বাড়াচ্ছি বলছিস কেন?”

“তো, আমি কী সারাজীবন এ বাড়িতে থাকব নাকি?”

এ কথায় একটু মৌন হয়ে যান দাদিজান। পরমুহূর্তেই অপরার মুখখানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলেন,”কেন, চলে কেন যাবি? তুই সারাজীবন এ বাড়িতেই থাকবি।”

অপরা ভাবল দাদিজান কথাটা এমনিই বলেছেন। অথচ সে যদি জানত, দাদিজানের হৃদয়ে অন্য কিছু চলছে, তবে ওর অনুভূতি কেমন হতো?

বিকেলের দিকে কিয়ানের ঘরে উপস্থিত হয় অপরা। কিয়ান তখন শুয়ে আছে। হাত খানা কপালে ঠেকানো। চোখ বন্ধ করা। অপরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে। কিয়ান আর অয়নের চেহারায় মিল নেই। মিল আছে শুধু ত্বকের সাথে। দুজনেই ফর্সা। অপরা’র থেকেও বেশি। অপরা, ছোট করে ডাকে,”কিয়ান ভাই।”

ডাকে সাড়া দেয় কিয়ান,”অপু?”

“জি। একটু ওঠে বসেন। কথা বলব।”

কিয়ানের ললাটে ইষৎ চিন্তা দেখা দেয়। ও চট করেই ওঠে বসে। অপরা দূরত্ব রেখে বসে। তারপর বলে,”জানেন, রুবিনাবু’র বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

এই মুহূর্তে মানুষটার মুখের রঙটাই বদলে যায়। শুকনো ঢোক গিলে। অপরা ফের বলে,”এটা কোনো বিষয় হলো বলেন?”

কিয়ান একটু ভরকে যায়। অপরা’র কথা বোঝার চেষ্টা করে। ভয়ের মতন করে শুধায়,”কোনটা?”

“এই যে, রুবিনাবু’র বিয়ে হচ্ছে।”

“ও।”

এই বলে থামে কিয়ান। দৃষ্টি রাখে মেঝেতে। অপরা ফের বলে,”আমি মানতে পারছি না।”

“কী মানতে পারছো না?”

“রুবিনা’বুর বিয়ে।”

“কেন?”

শেষ কথায় একটু উদ্বেগ অনুভব হয়। কিয়ান নিজেও নিজের আচরণে অসন্তোষ হয়। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ফের বলে,”তোমার কথাটা বুঝতে পারছি না। একটু খোলসা করে বলবে,প্লিজ।”

অপরা কথা বলে না। চুপ করে থাকে। তাকিয়ে থাকে কিয়ান ভাইয়ের মুখের পানে। মানুষ’টার চেহারায় দুঃখ নেই কী? অপরা কেন যেন বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না লোকটার অনুভূতি। সেই জন্যই কী না বলে,”রুবিনা’বুর বর কে দেখেছেন? বয়স্ক, মোটা,বেঁটে। পড়াশোনাও জানে না। শুধু টাকা দেখে….”

এই পর্যায়ে অপু থামে। কিয়ানের মুখশ্রীতে দৃষ্টি ফেলে। ছেলেটার দৃষ্টি প্রাণহীন। মেজাজ ও শীতল। অপরা’র কান্না পায়। কান্না পায় রুবিনা’বুর কথা ভেবে। এদের ভেতরে কী চলছে? সেটা জানতে হবে। জানতে হবে তাকে। অপরা যখন ওঠে পড়তে নেয়, কিয়ান বলে,”দরজাটা আটকে দিও তো। আমি একটু ঘুমাব।”

এইটুকুই! আর কিছু বলার নেই? তবে কি রুবিনা’বুর প্রতি কোনো অনুভূতি নেই কিয়ান ভাইয়ের নিকট? অপরা’র ভেতর থেকে উত্তর আসে না। ও বেরিয়ে আসে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা যায় কথা’র কাছে। কথা পড়াশোনা করছিল। অপরা গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে। লম্বা করে শ্বাস নেয়। তারপর বলে,”কথা, গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। কিয়ান ভাইয়ের ভেতরটা খুবলে দেখতে হবে। কী চলছে তার মাঝে?”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি