#হৃদয়দহন (২০)
অপরা কিয়ান ভাই আর রুবিনাবু’র বিষয়ে খুব সিরিয়াস। দুজন মানুষ একে অপর’কে ভালোবাসে। এটা তো মিথ্যে নয়। যদি মিথ্যে হতো তবে ওমন ভাবে জড়িয়ে ধরত? ধরত না। ওরা যে সমাজ ব্যবস্থার মাঝে আছে, এতে করে এভাবে জড়িয়ে ধরা স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। অপরা অনেকটা নিশ্চিত এদের মনে কিছু চলছে। তবে সেটা কী? কথা গিয়েছে রুবিনা’বুর বরের বিষয়ে আরো খোঁজ খবর নিতে। এখনো আসছে না। এদিকে অপরা যে অধৈর্য হয়ে যায়। ও ছটফটে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মিনিটের পর মিনিট যায় কথা আসে না। ফলশ্রুতিতে অপরা নিজেই বের হয় রুবিনাবুদের বাড়ির দিকে। ওখানে গিয়ে দেখতে পায় কথা’র মুখটা কেমন ফ্যাঁকাশে হয়ে আছে। ও এগিয়ে এসে শুধায়,”মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?”
“রুবিনাবু কাঁদছে।”
“কাঁদছে কেন?”
“জানি না।”
অপরা আর কথা জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। রুবিনা তখনো কেঁদে চলেছে। কান্নার দমকে নাক টানছে বার বার।
“তোরে সাবধান করলাম রুবিনা। কিয়ানের সাথে আর কোনো ঘেঁষাঘেঁষি করবি না।”
এ কথায় রুবিনা একটু চটে গেল। কিছুটা চ্যাঁচিয়েই বলল,”সমস্যা কী তোমার? যার তার সাথে বিয়ে দিচ্ছ। কিছু বলতেছি?”
“সমস্যা যদি বুঝতি, তবে এই সব কাহিনী করতি না। ঐ ছেলে তোরে বিয়ে করবে?”
এ কথায় রুবিনা একটু দ্বিধায় ভুগে। সে নিজেও বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কে আছে। রুবিনার মা এবার একটু আহত ই হলেন। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন।
“তোরে পেটে তো আমি ধরছি তাই না? তোর জন্য আমার চিন্তা হয় না? এটা সত্য ছেলের টাকা দেখেই বিয়ে দিতেছি। কারণ টাকায় সুখ দেয়। আমারে দেখছ না, আজীবনের দুঃখ কপালে। কোনো শখ আহ্লাদ নাই।”
রুবিনা কিছু বলে না। মায়ের এই কথা গুলো শুনে শুনে সে বড়ো হয়েছে। টাকায় সুখ দিবে? হয়তো দিবে। বিলাসিতার মাঝে থাকলে অনেক দুঃখই থাকবে না। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ রেখে অন্য কারো কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ না। রুবিনা তো পারছে না নিজের মন কে বোঝাতে। অপরা আর কথা কান পেতে এই অবধিই শুনল। ইচ্ছে করেই এরপর আর শুনল না। ওদের দুজনের ই খারাপ লাগছে। খারাপ লাগছে রুবিনাবু’র কথা ভেবে।
“ভাইয়া কি কিছুই করবে না?”
কথার প্রশ্ন। তার ভাইটা শান্ত। সমুদ্রের পানির মতন। সব সময় রং তুলি নিয়ে বসে থাকে। উদাসীনতা চোখে মুখে। তার ভাইয়ের মন সহজে বোঝা যায় না। বোঝা যায় না বিধায় এই সম্পর্কে গোপন করতে পেরেছে। কথা ফের বলে,”অপুবু ভাইয়া কেন এখনো চুপ?”
“কীভাবে বলব বল? আসলে বাস্তবতা বড়ো কঠিন।”
“তুমি ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলবে অপুবু? আমার খারাপ লাগছে। রুবিনাবুর ওপর দিয়ে কেমন ঝড় যাচ্ছে।”
অপু’র মুখ খানা শুকনোই ঠেকল। কিয়ান ভাই তার থেকে যথেষ্ট বড়ো। তাছাড়া এমন একটা ব্যাপারে সে কীভাবে কথা বলবে বুঝতে পারছে না। দুজন মন খারাপ আর হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়িতে আজ নতুন কিছু মিষ্টি এসেছে। মেঝো মা সেসব নিয়েই ওপরের ঘরে যাচ্ছিলেন। ওদের দুজনকে দেখে বললেন,”কোথায় গিয়েছিলি দুজনে?”
অপরা’র মন এদিকে নেই। কথা জবাব দিতে বলল,”এই তো এখানেই। তোমার হাতে ওগুলো কী মা?”
“মিষ্টি। খাবি? দিব তোদের?”
কথা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে খুব। তবু ওর ইচ্ছে হলো না। ও নাকোচ করে দিতেই মেঝো গিন্নি চলে গেলেন। অপরা হতাশার মতন করে বলল,”কিয়ান ভাই আর রুবিনাবুর ভবিষ্যত নিয়ে, আমি একটুও ভাবতে পারছি না রে।”
দাদিজান এক প্রকার মিষ্টি খাবার পছন্দ করেন। তবে র’ক্তে চিনি বেশি হওয়াতে সর্বদা খেতে দেওয়া হয় না। অয়ন আজ সেই খাবারটি নিয়ে এসেছে। খাবারটি ওদের এলাকায় নারকেলি বলে পরিচিত। মূলত নারকেল, মিঠাই আর দুধ দিয়ে এই খাবারটি তৈরি করা হয়। অয়ন দাদিজানের কাছেই বসে আছে। খুব বেশি আনে নি সে। দাদিজান খেতে খেতে বলেন,”এটা কীসের জন্য দিলে দাদুভাই?”
অয়ন হেসে বলল,”তোমার ঘু’ষ এটা।”
“ঘু’ষ?”
“হ্যাঁ।”
“তা কীসের জন্য দেওয়া হচ্ছে?”
“আসলে…”
বলেই দাদিজানের নিকট হলো অয়ন। একটু মিনমিনে সুরে বলল,”কিয়ান ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছ না কেন?”
এ কথা বলে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল অয়ন। হাজার হোক, কিয়ান তো তার বড়ো ভাই। বড়ো ভাইয়ের বিয়ে না হলে, নীলার ব্যাপারে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। দাদিজান হেসে বললেন,”বুঝেছি কথা। নিজের জন্যই এসেছ তাহলে।”
“একদম ই না। আমি নিজের জন্য আসি নি দাদিজান।”
দাদিজান হাসেন। নাতির কথা তিনি বুঝতে পারেন। নারকেলি মুখে দিয়ে বলেন,”কিয়ান দাদুভাইয়ের জন্য, অপুকে ভেবেছি। তোমার কী মতামত?”
অপু’র নামটা শুনে অয়নের ভ্রু কুঁচকে গেল। ও আরেকটু খোলসা করতে শুধাল,”অপরা?”
“হ্যাঁ। ভালো হয় না?”
“কিয়ান ভাই আর অপরা? দাদিজান,কেন যেন মানতে পারছি না।”
কথাটা বলেই অয়ন হতাশার মতন করে তাকাল। দাদিজান একটু দীর্ঘ নিশ্বাসের মতন ফেলে বললেন,”আমি চাই, অপু এ বাড়িতেই থাকুক।”
“কেউ তো মানা করেনি দাদিজান। তবে….’
অয়নকে থামিয়ে দিয়ে দাদিজান বললেন,”ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হলে, এ বাড়িতে থাকতে পারবে?”
অয়ন একটু রসিকতার ছলে বলল,”ওর বর কে ঘর জামাই রাখলেই তো হয়।”
“সব কিছু রসিকতায় হয় না দাদুভাই। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন অপুকে নিয়ে চিন্তা করছি না। তবে আমি যখন না থাকব, তখনকার পরিবেশ কিন্তু ভিন্ন ও হতে পারে।”
অয়ন শুনল, বুঝল। কিন্তু কেন যেন মানতে পারল না। ও দাদিজানের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। ওমন সময় দেখা গেল এক কাপ চা নিয়ে কিয়ানের ঘরের দিকে যাচ্ছে অপরা। ও একটু স্মরণ করল। কিয়ান ভাইয়ের সাথে এর আগে এত বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল না অপরা’র। কিন্তু এখন যেন একটু বেশিই কথা বার্তা চলে তাদের।
বরাবরের মতনই রং তুলি নিয়ে বসেছে কিয়ান। অপরাকে দেখে একটু খানি হাসার চেষ্টা করল। বিকেলের এই সময়টায় মনটা কেমন চা চা করছিল। অপরা কীভাবে বুঝল? নিজের এই ভাবনাটা অন্তরে না রেখে কিয়াধ শুধাল,”চায়ের জন্য মনটা কেমন করছিল। তুমি দেখি মন পড়তে পারো অপু।”
চা কাপ নিয়ে চুমুক বসাল কিয়ান। অপরা পাশে বসল। কিয়ান সুন্দর একটা ছবি তৈরি করেছে। যেখানে একটা যুবক ছেলে’কে দেখা যাচ্ছে। হাতে বাঁশি। অপরা মন দিয়ে ছবি খানা দেখল। তারপর বলল,”ছবিটা সুন্দর হয়েছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ। আরো কিছু ছবি তৈরি হয়েছে। দেখাই তোমায়।”
কিয়ান অনেক গুলো পেন্টিং বের করে আনল। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কিয়ানের হাতের কাজ অনেক বেশি সুন্দর। অপরা সব গুলো ছবি দেখে নিয়ে বলল,”ঐ ছবিটা তো দেখালেন না কিয়ান ভাই।”
কিয়ান মাত্রই ক্যানভাসে একটা আঁচড় কেটেছিল। ঐ ছবি বলতে মেয়েটি কি বুঝিয়ে সেটি তখনো বুঝেনি। তাই ঘুরে তাকাল।
“কোন ছবি?”
“যেই ছবিটায় শুধু একটা মেয়ে’কে দেখা যায়। যা আপনি কাউকে দেখাতে চান না। লুকিয়ে রাখেন।”
কথাটা শুনে কিয়ানের চোখ মুখ কেমন অস্থির হয়ে গেল। অপরা মাথাটা নত রেখেই বলল,”রুবিনাবু’র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আপনি কিচ্ছু করবেন না?”
এ কথার পর কিয়ান বুঝে গেল, অপরা অনেক কিছুই জেনেছে। ও বিষয়টা আর লুকাতে চাইল না। বরং দরজার কাছে তাকিয়ে সর্তক হয়ে বলল,”সমস্যাটা গভীর অপু।”
“তাকে ভালোবাসেন না কিয়ান ভাই?”
কিয়ান চুপ রইল। সে ভালোবাসে। ভালোবাসে শ্যাম মুখের সেই মেয়েটিকে। অপরা এবার অধৈর্য হয়ে বলল,”রুবিনাবু খুব কাঁদছিল। তাকে হারিয়ে ফেলবেন না কিয়ান ভাই। তাকে হারিয়ে ফেলবেন না।”
কথা গুলো বলতে গিয়ে অপরা”র চোখ ভিজে ওঠল। কেন যেন অভা’গী মেয়েটার জন্য কষ্ট লাগছে। হয়তো সে নিজেও অভাগী বলে। কিয়ান অপরা’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। অস্পষ্ট সুরে আওড়াল,”তাকে হারাতে চাই না অপু। তাকে নিজের কাছে রাখতে চাই। রাখতে চাই সম্মান দিয়ে। সেই জন্যই তো এতদিন ধরে একান্তে লড়াই করে যাচ্ছি। কাউকে জানতে দেই নি।”
ঘরে ফিরে দরজা লাগিয়ে দিল অপরা। একটু জোরেই লাগাল। ফলে অয়নের কানে সেটা পৌঁছে গেল। ও এদিকেই ছিল। অপরা’র কক্ষের সামনে এসে দরজায় ঠকঠক করল। ভেতর থেকে অপরা বলল,”কে?”
“আমি। দরজা খোল তো।”
“আমার মাথা ব্যথা করছে অয়ন ভাই। পরে আসিয়েন।”
“কথা আছে। এখনই দরজা খোল।”
বাধ্য হয়েই দরজা খুলল অপরা। অয়ন হুরমুর করে ভেতরে পৌঁছে গেল। অপরা নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, অয়ন খুব করে বুঝতে পারল। তাই চোখ মুখ শক্ত করে বলল,”কান্না কাটি করেছিস নাকি?”
“না,তো। আপনার কিছু লাগবে?”
“না।”
“তাহলে?”
“এমনি এলাম।”
“অহ।”
বলেই চুপ হয়ে গেল অপরা। অয়ন পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে সহসাই বলে ওঠল,”কিয়ান ভাইয়ের সাথে তোর কী চলে রে?”
কথাটা শুনে যারপরনাই অবাক হলো অপরা। মিনমিনে সুরৈ বলল,”কিছু চলে না তো।”
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি