হৃদয়দহন পর্ব-২১

0
53

#হৃদয়দহন (২১)

মায়ের সামনে মাথা নত করে আছে কিয়ান। ছোট গিন্নি ছেলে’কে ভালো মতন পরখ করে নিচ্ছেন। এদিকে ছেলেটি ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস ফেলে ক্লান্ত প্রায়।

“তুমি কিছু বলবে মা?”

“বলার তো অনেক কিছু আছে। তবে তোমাকে আমার সুবিধায় ঠেকছে না বাবা।”

এ কথা বলেই ছেলের দু বাহু স্পর্শ করলেন তিনি। কিয়ান সরল চোখে মায়ের দিকে তাকাল।

“তুমি আমাকে কথা দিয়েছ কিয়ান। মনে আছে তো?”

কিয়ানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ছোট গিন্নি অধৈর্য হয়ে বলেন,”ঐ মেয়েটার মাঝে কি এমন খুঁজে পেলে? রুবিনাকে কোন দিক থেকে তোমার সাথে মানায়? চয়েজ এত খারাপ কেন?”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি যদি তার মা না হতো, তবে নিশ্চিত চিৎকার করে ওঠত কিয়ান। তবে মায়ের কাছে চিৎকার মানায় না। শান্ত প্রকৃতির সে শান্ত ভাবে বলে,”সব সময় চোখের সৌন্দর্যই সব কিছু হয় না মা। মনের সৌন্দর্য’টাই আসল।”

“সামান্য জ্ঞান টুকু নেই তোমার? তোমার পাশে কতটা কালো সে, দেখেছ?”

কিয়ানের ভেতরটা খারাপ লাগায় পূর্ণ হয়ে ওঠল। ছোট গিন্নি ছেলের বাহু দুটো ছেড়ে দিয়েছিলেন, তিনি পুনরায় দু বাহু টেনে ধরে বললেন,”কসম করে বলেছ, তুমি রুবিনাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়েটা হতে দিবে।”

কিয়ান আরেক দফায় আহত হয়। তার ভেতরে একরাশ কান্না জমে আছে।

“মা, আরেকবার ভেবে দেখা যায় না? রুবি তো খারাপ মেয়ে নয়।”

“উফ, অসহ্য লাগছে। তুই আমার মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিস। অবাক লাগে, এটা আমার ছেলে! এমন পছন্দ কেমন করে হয়? অয়নের থেকে শিক্ষা নিতে পারো না?”

অয়নের কথা ওঠায় ছেলেটির কপালে ভাঁজের সৃজন ঘটল। ও প্রশ্ন করার আগেই ছোট গিন্নি আপসোসের সুরে বলে,”আমার কপাল ই খারাপ। অয়নটা বুদ্ধিমান। প্রেম করছে ডাক্তারের মেয়ে সাথে। যেমন রূপ, তেমন পরিবার। কোনো খেয়াল আছে, নীলার পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে?”

একটা ধাক্কা এসে কিয়ান’কে স্পর্শ করে যায়। ও প্রশ্ন করে,”অয়নের সাথে নীলার সম্পর্ক আছে?”

“হ্যাঁ। এটাও জানো না দেখি! আসলে ও তোমার মতন গর্দভ না। বেকুব কোথাকার। পছন্দ করেছে পাশের বাড়ির মেয়েকে। যার পারিবারিক অবস্থার কথা না ই বা বললাম, গায়ের রঙ অবধি কালো।”

নিজের ভেতর দমিয়ে রাখা খারাপ লাগাটুকু এবার বের হয়ে আসল। কিয়ান শক্তপোক্ত গলায় বলল,”ও কালো নয় মা, শ্যামবর্ণ। আর তাছাড়া কালো হলেও আমার সমস্যা নেই। ও আমার চোখে সব থেকে সুন্দর।”

কি যন্ত্রণা! এ ছেলেকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত তিনি। এত গুলো মাস ধরে ছেলেটাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। একটু বুঝতে না বুঝতেই ফের অবুঝের মতন করে। এবার ভয় ই লাগে। যদি কোনো অঘটন হয়ে যায়। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে, একটা শান্তি হয়।

নুহাশ পড়াচ্ছিল। তবে অপরা’র মনোযোগ কোথায়? তার মনোযোগ তো অন্য জায়গায়। সে ভাবছে, ভাবছে কিয়ান ভাইয়ের কথা। এই মানুষটা ভীষণ শান্ত। এই শান্ত মানুষটার মনে কি চলছে সেটা বোঝা মুশকিল। অয়ন হলে অপরা নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝে নিত। তবে কিয়ান ভাইয়ের বিষয়ে সে কিছুই ভাবতে পারছে না। ওর মাথা খোলসা হয়ে গেছে। যন্ত্রণা খেলা করছে চোখে। ওমনি স্কেলের আওয়াজে ধ্যান ফিরে এল মেয়েটির। নুহাশ ইষৎ কেশে বলল,”তুমি মনোযোগ দাও না কেন?”

অপরা জবাব না দিয়ে বইয়ের দিকে চোখ রাখে। নুহাশ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,”সমস্যা কী? এভাবে পড়া হবে?”

আজ কথা নেই। মেয়েটার পেট ব্যথা। তাই একাই পড়তে হচ্ছে অপরা’কে। নুহাশ নিজেকে ভীষণ শাসনে রেখেছে। অপরা’র প্রতি অনুভূতিটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই অনুভূতি কোনো নেতিবাচক প্রভাব যেন না ফেলে সেই বিষয়ে ভীষণ সর্তক সে। তবে কখনো সখনো মনটা কেমন করে ওঠে। নুহাশ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,”আজ তাহলে থাক।”

অপরা এখনো মনোযোগ দিতে পারছে না। সেই জন্য কথাটা বুঝে নি।

“কিছু বললেন?”

নুহাশ অবাক ই হয়। মেয়েটা অমনোযোগী ঠিক আছে। তবে আজ একটু বেশিই লাগছে না?

“তোমার কি শরীর খারাপ?”

“না তো।”

“সিওর?”

“হ্যাঁ।”

অপরা মৌন হয়ে যায়। নুহাশ হতাশ হয়। ওঠে দাঁড়ায়।

“আজ আর পড়াব না। কাল ঠিক মতন হোম ওয়ার্ক করে রাখবে।”

অপরা কেবল মাথা দোলায়। নুহাশ বের হয়ে যায়। বই পত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হয়ে দেখা যায় অয়ন দাঁড়িয়ে। তার পাশেই নুহাশ। দুজন কথা বলছে। অপরা’কে দেখে চোখ ফেরায় অয়ন।

“ঠিক আছে। আজ তাহলে যাও। কথার শরীর ঠিক হলেই এসো।”

“জি ভাইয়া।”

নুহাশ চলে যায়। অয়ন এগিয়ে এসে বলে,”তুই একটা জ্বালাতন।”

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে শুধায়,”কেন?”

“নুহাশ ও তোকে সহ্য না করতে পেরে অল্প পড়িয়ে চলে গেল। বুঝিস, কতটা গর্দভ তুই?”

“হুম।”

বলেই পাশ কাটিয়ে যায় মেয়েটি। অয়ন অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। অপরা’র মনটা একটু বেশিই বিষণ্ণ নয়?

পেটের যন্ত্রণায় কাতর কথা। অপরা গরম পানি নিয়ে এসেছে। ভাপ দিলে কিছুটা আরাম লাগবে। অপু’কে দেখে কথা বলে,”কিছু ভাবলে?”

অপু জানে মেয়েটি কি বলেছে। ওর বিষণ্ণতা আরো বাড়ে। হট ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,”মাথায় আসছে না।”

“তার মানে, রুবিনাবু’র অন্য জায়গায় বিয়ে হবে?”

বলতে বলতে কথার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়। অপরা নিজেও অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে।

“কোনো সমাধান নেই?”

“দুজন’কে এক সাথে করে কথা বলব?”

অপরা শুধায় কথা’কে। কথা বলে,”বুঝতে পারছি না কোনটা ভালো হবে। আর তো মাত্র কটা দিন।”

দুজনেই ভীষণ অসহায় বোধ করে। অপরা মিনমিনে সুরে বলে,”আমি বর‍ং একবার রুবিনাবুদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

ভাবনা মতোই রুবিনাদের বাড়িতে চলে আসে অপরা। ভিটে পাকা টিন চালের ঘর রুবিনাদের। রুবিনার ঘরটাও বেশ ছোট। তবু বেশ গুছিয়ে রেখেছে মেয়েটা। বসে আছে লম্বা চুল গুলো ছেড়ে। অপরা উঁকি দিয়ে বলে,”আসব রুবিনাবু?”

অপরা অনেক মাস ধরেই এ বাড়ি মুখো হয় না। ঐ যে তার জন্য রুবিনাবু’র বিয়ে ভাঙল, সেদিন থেকেই এ বাড়িতে আসে না সে। মেয়েটিকে দেখে ভালোই লাগে রুবিনার।

“আয়। কতদিন পর এলি আমার ঘরে।”

অপরা এগিয়ে যেয়ে রুবিনার পাশে বসে। রুবিনা তার লম্বা মসৃণ চুল গুলো হাতের সাহায্যে খোঁপা করে নেয়।

“খোলা চুলেই তো ভালো লাগছিল। তুমি জানো, তোমার চুল গুলো কত সুন্দর।”

এ কথায় রুবিনা হাসে। কিয়ান ও একই ভাবে ওর চুলের প্রশংসা করে। মানুষটা সব সময় বলে,’রুবি, তোমার চুল গুলোই আমাকে প্রথম মোহে ফেলে দেয়।’ সুন্দর সেই কথা গুলো স্মরণ করেই রুবিনার বুকটা ‘হু’ ‘হু’ করে ওঠে। দু চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে।

“রুবিনাবু।”

মেয়েটির বাহু স্পর্শ করে ডাকে অপরা। রুবিনা ঘাড় ফিরিয়ে চায়।

“কাঁদছো কেন?”

“কাঁদছি। না তো। চোখটা এমনি জ্বালা করে ওঠল।”

বলতে বলতে ওড়নার কোণে চোখ মুছে নেয় রুবিনা। অপরা মৌন হয়ে দেখে। দেখে শ্যাম রঙের রুবিনাকে। এটা সত্য হুট করেই মেয়েটি চোখে পড়ার মতন না। কিন্তু, যখন কিছু সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, তখন এই সৌন্দর্য উপলব্ধি হয়। অপরা একটু বেশিই বিস্মিত হয়ে পড়ে। হয়তো এভাবে প্রেমে পড়েছিল কিয়ান ভাই। তার থেকেও অনেকটা কম উজ্জ্বল ত্বকের মেয়েটির মাঝে।

“তোর জন্য কিছু নিয়ে আসি। কতদিন পর এলি।”

বলতে বলতে ওঠে যাচ্ছিল রুবিনা। অপরা আটকে দিল। মুখে বলল,”যেও না। বোসো একটু। আমি কিছু খাব না।”

“কেন? এতদিন পর এলি তুই। এভাবে….’

“আমি কি পর নাকি? তুমি বোসো তো।”

হার মেনে বসল রুবিনা। তবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রইল। আজকাল হুট করেই কান্না এসে যায়।

“বিয়ে নিয়ে তোমার অনুভূতি কেমন গো?”

“ভালো।”

মৃদু সুরে জবাব দেয় রুবিনা। অপরা একটু আমতা আমতা সুরে বলে,”আমি তো বিয়ে নিয়ে ভাবতেই পারি না। বিয়ের কথা মনে হলেই কেমন ভয় লাগে।”

“ভয় কেন লাগে?”

“বাহ রে, একটা নতুন মানুষ। তার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে হবে। কেমন হয়, সেটা নিয়ে একটা চিন্তা আছে না?”

তাই তো। একদম ই নতুন একটা মানুষ। যার সাথে নতুন একটা জীবন শুরু করতে হয়। এটা নিয়ে ভয় হওয়ার ই কথা। রুবিনা ও তো ভয় পায়। তবে একটু আলাদা ভাবে। কারণ এই ভয়টা নতুন মানুষটাকে নিয়ে নয়, বরং নিজের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি