#হৃদয়দহন (২৩)
অপু যখন শুনেছিল, কিয়ান ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করা হচ্ছে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। নুহাশ যাওয়ার পরও যেন থমকে যাওয়া অবস্থাটা বিরাজ করছিল। তখন ই ছোট গিন্নি এসে অপু’কে নিয়ে গেলেন। তাকে বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। বসার ঘরে অয়ন আর কিয়ান বাদে প্রায় সকলেই আছে। একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। অপু বসে আছে মৌন হয়ে। তার লজ্জা লাগছে না। খুশিও লাগছে না। সে কেবল বিস্মিত, স্তব্ধ। দাদিজান অনেক কথাই বললেন। এবার তিনি অপু’র হাত খানা ধরলেন।
“তোর কিছু বলার আছে অপু?”
অপু ছটফট করল না। শান্ত দৃষ্টিতে দাদিজানের চোখের দিকে চাইল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। এই মানুষ’টাকে ভীষণ ভালোবাসে ও। দাদিজানের চোখ যেন কথা বলছে। তিনি ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন কী? হয়তো। অপরা’কে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। মেয়েটাকে কত যত্নে লালন করেছেন। এই মেয়েটার একটা গতি না করে, ম রেও কি শান্তি পাবেন তিনি? না তো। অপরা’র কিছু বলতে হলো না। তার পূর্বেই প্রবেশ ঘটল কিয়ানের। তাকে কল করে বিষয়টা জানানো হয়েছে। সে এসেছে। একদম স্বাভাবিক ভাবে। অপু চাইল। মানুষ’টাকে দেখল একবার। সুদর্শন বটে। তবে এত নির্বিকার ছেলে মানুষ, তার ছটফটে জীবনের সাথে যায় কী? এই জায়গায় একটা দ্বিধা তৈরি হয়। কিয়ান বসে সকলের মাঝে। ছোট গিন্নির দু চোখে অনেকটা ভয় দেখা যায়। ছেলেটা হাঁটে হাড়ি না ভাঙে। যদি রুবিনার কথা বলে দেয়, তাহলে কোন্দল লাগবে। তিনি ছটফট করতে করতে কিয়ানের মাথার কাছে দাঁড়ালেন।ছেলের বাহু চেপে ধরে বললেন,”কিয়ানের অমত থাকবে না আশা করি।”
এ কথায় অপরা কিয়ানের দিকে তাকাল। এত নির্বিকার কেন? মানুষটা কি রহস্যময়? নাকি অপরা’ই ভুল। ওর ভেতরটি প্রশ্নে প্রশ্নে আন্দো’লিত হচ্ছে। এই আন্দোল’নের প্রশমন ঘটল দাদিজানের কথায়। তিনি কিয়ানের দিকে চাইলেন। করলেন সেই প্রশ্নটি।
“মতামত দেও দাদুভাই। মতামত পেলে আমরা আয়োজন শুরু করব।”
এক সেকেন্ড যায়। যায় দু সেকেন্ড। অপরার কাছে প্রতিটা সেকেন্ড ঘন্টার অনুরূপ মনে হয়। ও শুকনো ঢোক গিলে। ছটফটে নয়নে তাকায়। কিয়ান উত্তর দেয় না। অপরা উদ্বিগ্ন হয়ে কথার দিকে চায়। ছোট্ট কথা, অপরার জীবনের সাথে অনেক বেশি জড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরকার কথা জানায়। কথা মুখ লুকায়। অপু’বুর দিকে তাকানোর সাহস নেই তার। একটি ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। শান্ত বসার ঘরটায় কিয়ানের কণ্ঠ বেজে ওঠে।
“আমার কোনো সমস্যা নেই।”
অদ্ভুত! ওমন সময়েই আগমন ঘটে অয়নের। সে শুনেছে কিয়ান ভাইয়ের মতামত। দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। তবে এদের মাঝে প্রণয়ের রূপরেখা বহু পূর্বেই তৈরি হয়েছে। অথচ, অয়ন কিচ্ছুটি বুঝল না! এ ও সম্ভব? অয়নের যেন বিশ্বাস ই হতে চায় না। যে ই অপরার প্রতিটা পদক্ষেপ ওর মুখের অগ্রভাগে, সেই অপরা’র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলো ও মিলাতে পারে না। সব কি তবে বদলাতে চলেছে? এই বদলের পেছনে দায় কার। অয়নের? অনেক গুলো প্রশ্ন তৈরি হয়। অথচ উত্তর জানা নেই। বসার ঘরটায় উৎসবের আনন্দ। বরাবরেই মতনই বাড়িতে মিষ্টির অভাব নেই। আজ দোকানে স্পেশাল এক মিষ্টি তৈরি করা হয়েছে। এই আনন্দের সংবাদ পেয়েই বড়ো কর্তা কর্মচারী’কে কল করেছেন। বলেছেন কয়েক কেজি মিষ্টি দিয়ে যেতে। পাড়ায় দিতে হবে তো। এদিকে বাড়িতে দু পক্ষ তৈরি হয়েছে। এক পক্ষ বড়ো’রা। যাদের হৃদয়ে রং খেলা চলছে। আর আরেক পক্ষ ছোট’রা। যারা অনেক’টা দুঃখ নিয়ে এই রং খেলায় শামিল হচ্ছে।
কথার ভাগে মিষ্টি বিলিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে। ও মিষ্টি’র বাটি হাতে নিয়ে রুবিনা’দের বাড়ি এল। রুবিনা তখন লম্বা চুল গুলো মেলে দিয়ে বারান্দায় বসে আছে। ইষৎ কালো মুখটায় চাঁদের আলো পড়েছে। সেই জন্যই কী না ওমন সুন্দর মুখ’খানি কথা’কে আরো একবার ভাষাহীন করে দিল। কথা ছোট হলেও গভীরটা চেনে। রুবিনাবু’র চোখে গভীরতা আছে। পাতলা ঠোঁটে ভালোবাসা আছে। মুখটায় মায়া আছে। এসব দেখে কথা পিছিয়ে গেল। এ মিষ্টি সে দিতে পারবে না। এক পা পিছিয়ে গিয়ে আরেক পা পিছিয়ে যাবে, ওমন সময় রুবিনা’র ডাক।
“কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে?”
রুবিনাবু বারান্দা থেকে গেটের কাছে এগিয়ে এল। এসে দেখল কথা’র দৃষ্টিটা চঞ্চল। এই মেয়েটা’র চতুরতার কথা কে না জানে? পুরো পাড়ায় কথার প্রশংসা আছে। একই সাথে একটু বদনাম ও আছে। মেয়েটা’র কাছে প্রায় সমস্ত খবর ই থাকে। সেই জন্য পাড়ায় একটু আধটু আগুন দৃষ্টির তোপে পড়তে হয়। সব কিছু পেরিয়ে বলতে হয়, কথা’র ভেতরটা পরিষ্কার। রুবিনা অনেকটা সময় তাকিয়ে রইল। তারপর পুনরায় বলল,”ভেতরে আয়। ওখানে কেন?”
রুবিনা বাহুতে স্পর্শ করে। কথার চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে যায়। ও দ্রুত সেটা আড়াল করে নিয়ে বলে,”এই তো আসছিলাম রুবিনাবু। মিষ্টি”টা রাখো তো।”
মিষ্টির বাটি হাতে তুলে নেয় রুবিনা। দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। মিষ্টি পছন্দ কী না। বাটি থেকে একটা তুলে নিয়ে মুখে দিয়েছে মাত্র। ওমনি ঘরের ভেতর থেকে রুবিনার মা বলেন,”কথা নাকি? কি এনেছিস। মিষ্টি?”
কথা ছোট করে জবাব দেয়,”হ্যাঁ।”
“কোনো উপলক্ষ্য আছে নাকি?”
এই প্রশ্নে কথা মৌন হয়ে যায়। পায়ের কাছটা খালি অনুভব হয়। রুবিনা খেতে খেতে বলে,”কী রে। নতুন এই মিষ্টি বানানো হয়েছে নাকি? কোন আয়োজনে? অয়ন ভাইয়ার বিয়ের জন্য?”
কথার গলা শুকিয়ে আসে। তবু ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,”না। কিয়ান ভাইয়ের বিয়ের জন্য। অপু’বুর সাথে বিয়ে ঠিক হলো। আমি যাই গো।”
এই কথাটা বলে এক সেকেন্ড সময় নেয় নি কথা। দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে রুবিনা স্তব্ধ। কাঁধে মায়ের হাত খানা স্পর্শ করে যায়। তিনি হতাশ হয়ে বলেন,”মা হয়ে তোর ক্ষতি চাইনি। এবার বুঝলি তো? ও ছেলে তোকে বিয়ে করতো না। মায়ের নেউটা। সাহস আছে নাকি?”
রুবিনা কিন্তু জবাব দেয় না। তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। রুবিনার মা পুনরায় বলেন,”যাক, ভালোই হয়েছে। এবার তোর ও মন টিকবে। পরশু হলুদের আয়োজন। ঘরে যা। এই সময় বাইরে থাকতে হয় না। তুই বরং একটু রূপের চর্চা কর। আমি বেসন এনে রেখেছি।”
এদিকে কথা, বাড়ি ফিরে সোজা নিজের কক্ষে চলে এসেছে। ছোট্ট মেয়েটার হৃদয়েও দহন চলছে। অথচ বাকি’রা কেমন আছে, কে জানে।
আকাশে আজ বড়ো একটা চাঁদ ওঠেছে। ভারী সুন্দর। নীলা আর অয়ন যখন কথা বলে, তখন দুজনই আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রেমিকা যে প্রেমিকের নীরবতা অনুভব করতে পারে। তাই তো কিয়ৎকাল চুপ থেকে শুধায়,”তোমার মন খারাপ?”
এ প্রশ্নে অয়ন চমকায় না। তার আসলে মন খারাপ নয়। তবে কেমন একটা দহন অনুভব হয়।
“কী ব্যাপার। কথা বলছো না কেন?”
“মন খারাপ না। তবে….’
“তবে কী?”
“আজ’কে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম।”
“কী সেটা?”
“আমি বোধহয়, অপরার থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছি। ওকে বুঝতে পারি না।”
নীলা কিছু বলে না। অয়ন ই বলে,”জানো, আজ কিয়ান ভাইয়ের সাথে অপরা’র বিয়ে ঠিক করা হলো। আর দুজনেই রাজি।”
“এটা তো ভালো খবর।”
“ভালো, তবে আমি কেন যেন মিলাতে পারছি না। অপরা’কে আমি কতকাল ধরে চিনি বলো তো। সারাটা সময় আমার সাথেই তো থাকত। অথচ কখনো বুঝে ওঠতে পারি নি, কিয়ান ভাইয়ের জন্য ওর প্রণয় ঘটিত অনুভূতি তৈরি হয়েছে!”
নীলা এবার হেসে ফেলল। বলল,”তার মানে অপরা’র মনে যদি তোমার জন্য ও ঐ অনুভূতিটা থাকে, তাহলে সেটাও বুঝতে পারবে না।”
এ কথায় অয়ন একটু রাগ দেখানোর মতন করে বলল,”যা তা। অপরা কেন আমার জন্য অনুভূতি রাখবে।”
“রাখতেও তো পারে।”
“এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই। বাদ দাও। ভালো লাগছে না।”
অয়ন সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। নীলা কিছু সময় চুপ থেকে বলল,”আমি তাহলে রাখছি। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। কদিন ধরেই তো ঘুমাও না।”
“হুম। এক দিক থেকে ভালোই হলো। কিয়ান ভাইয়ের বিয়ে হলে, আমাদের বিয়ের আয়োজন ও শুরু হবে।”
“হ্যাঁ। আশা করছি, সেই দিনটা বেশি দূরে নয়। তুমি একটু ঘুমাও। রাখি তাহলে।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে দিল নীলা। অয়ন চোখ দুটো বন্ধ করল। চোখের পাতায় সেই ছোট্ট অপরা’র মুখটা ভেসে ওঠল। হৃদয়টা কেমন যেন ছটফট করছে। মেয়েটার সাথে তার এই দূরত্ব, তৈরি হওয়ার কথা ছিল কি?
চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি