হৃদয়দহন পর্ব-২৫

0
60

#হৃদয়দহন (২৫)

রুবিনা’র শরীর থেকে হলুদের ঘ্রাণ আসছে। মেয়েটির সমস্ত শরীর জুড়ে হলুদ লাগানো। ও বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে। বাড়িতে তখনো গান বাজনা চলছে। চলছে উল্লাস। ও ছটফট করতে করতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। পাড়া’র শেষ মাথায় কিয়ানের থাকার কথা। ওরা পালাবে। কিন্তু কিয়ান’কে দেখা যাচ্ছে না। রুবিনা’র চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে। চাঁদের আলোয় মুক্তার মতন লাগছে জলের বিন্দু গুলো। ও কাঁদতে কাঁদতে কিয়ান’কে কল করল। ফোন বাজছে, তবে রিসিভ হচ্ছে না। রুবিনা অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিটের পর মিনিট অপেক্ষা করতে লাগল। তবে কিয়ানের দেখা নেই। এক পর্যায়ে রুবিনার হাতে টান পড়ল। মানুষটা ওর মা। মেয়ের ওপর চড়াও হলেন তিনি। ঠাস করে চড় বসিয়ে বললেন,”পাগল হয়ে গেছিস? এই সময় পালিয়ে যাচ্ছিস?”

মায়ের দেওয়া আ’ঘা’তটা রুবি’কে একটুও ব্যথা দিতে পারে নি। ও বরং কাঁদতে কাঁদতে মা নামক মানুষটিকে জড়িয়ে ধরল।

“কিয়ান আসবে মা। একটু অপেক্ষা করো, ও আসবে। আমাকে কথা দিয়েছে। আমরা পালিয়ে যাব। পালিয়ে যাব মা। সবার থেকে দূরে গিয়ে সংসার করব। কিয়ান খুব কষ্ট করেছে মা। বিশ্বাস করো মা, ও আসবে।”

টানা কথা গুলো বললেও মা নামক মানুষটি কোনো বাক্য খরচ করলেন না। রুবি মা কে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল মুছে নিল।

“ও আসবে। আমি একটু অপেক্ষা করি। ও আসবে। তুমি দেখো।”

এবার ভদ্রমহিলা বললেন,”ও আসবে না। আমি তোকে বলছি, ও ছেলে আসবে না। মায়ের আঁচল ছেড়ে বের হতে পারবে না। ও তোকে ভালোবাসে না।”

রুবি শুনল না। শুনল না মায়ের বলা কথা গুলো। দাঁড়িয়ে রইল। চাতক পাখির মতন। ওর বিশ্বাস আসবে। কিয়ান’কে আসতেই হবে। রুবি ফোন হাতে নিয়ে বসলো। বিশ্বাস নিয়ে ডায়াল করলো প্রিয় মানুষের নাম্বারটিতে।

ঘরের এক কোণে, মেঝেতে অবস্থান করছে কিয়ান। চোখ দুটো প্রাণহীন। অশ্রু নেই। তবে ব্যথা আছে। এই ব্যথাটা কিয়ানের পা দুটো আটকে দিয়েছে। সব ঠিক ছিল। প্ল্যান মতই আগাচ্ছিল। এতদিন কিয়ান অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করেছে মায়ের মতের পরিবর্তন করার। তবে মা নামক মানুষটি কোনো ভাবেই রুবিকে মানলেন না। এরপর কিয়ান’কে চুপ থাকতে হয়েছে। করতে হয়েছে অভিনয়। অপরা’র সাথে বিয়ের জন্য মতামত দিতে হয়েছে। ওরা চাইলেই আগে পালিয়ে যেতে পারত না। পালিয়ে যাওয়ার জন্যও টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়। সেটির ব্যবস্থাই করছিল কিয়ান। ছবি গুলো বিক্রি করে বেশ ভালো টাকা পেয়েছে। পালিয়ে গিয়ে ছোট্ট একটা বিজনেস করার প্ল্যান ছিল। প্ল্যান ছিল রুবিকে নিজের বধূ করার। তবে ভাগ্যে সেটি লেখা ছিল না। বাড়ির সব লোক’জন এখনো রুবিনাদের বাসায়। এই সুযোগে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বের হচ্ছিল কিয়ান। তবে মায়ের কাছে ধরা পড়তে হলো। তিনি কেমন করে যেন বুঝে গেলেন সবটা। ছেলে’কে আটকে দিলেন। দিলেন শর্ত। হয় মায়ের মুখ, না হয় রুবি’র মুখ। মা তো সবার ওপরে। এই মায়ের পায়েই তো সন্তানের জান্নাত। কিয়ান কেমন করে মায়ের মুখ’কে অস্বীকার করবে? তাই মায়ের দেওয়া কসমের কাছে হার মানতে হয়েছে। কিয়ান বসে আছে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। ফোনের স্ক্রিনে রুবি’র নাম্বার’টা ভেসে বেড়াচ্ছে। অথচ কিয়ান নিরুপায়। তার হাত পা শক্ত শিকলে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ও ছটফট করতে করতে বিছানার সাথে হেলান দিল। চোখ দুটো বন্ধ করল। ছোট ছোট করে আওড়াল,’রুবি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি তোমাকে।’

এদিকে রুবি’কে হার মানতে হয়েছে। মা তাকে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির দিকে। ওর পা চলছে। তবে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো যন্ত্র। আহারে জীবন। এই ছোট্ট জীবনে ভালোবাসার মানুষটিকেই পাওয়া হলো না। রুবি পথের মধ্যে আরো একবার কেঁদে ফেলে। ডুকরে ওঠার শব্দে মা ফিরে তাকান। হতাশ হওয়া গলায় বলেন,”কান্নাকাটি করে লাভ নেই। চোখ মুছে নে। কাউকে টের পেতে দেওয়া যাবে না।”

এ কথা বলে আঁচল এগিয়ে দিলেন তিনি। রুবি মৌন। বাধ্য হয়ে মেয়ের চোখ নিজেই মুছিয়ে দিলেন তিনি।

অনেকটা সময় পর রুবি’কে পেয়ে সবাই আবার হৈ হৈ করতে লাগল। কথা আর অপরা এত সময় রুবি’কে খুঁজেছে। তবে পায় নি। এখন পেয়ে কাছে আসতে চাইল। তবে লাভ হলো না। রুবি’র মা মেয়ের সাথেই বসে রইলেন।

এদিকে নীলা আর অয়ন সবার থেকে একটু দূরে বসে আছে। ওরা স্বাধীনতা পেয়েছে। বিয়ের কথা হলেও দুজনের দেখা হওয়া কেন যেন কমে গিয়েছে। অয়নের মনটা তখনো খারাপ। নীলা লক্ষ্য করছিল। এবার হাত খানা ছুঁয়ে দিল। এতে চাইল অয়ন। হাসল ঠোঁট প্রসারিত করে।

“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, কি যেন হারিয়ে ফেলেছ। আর তার শোকে মুখটা ওমন হয়ে গেছে।”

“কী হারাব?”

“দেখে মনে হচ্ছে। তাই বললাম।”

“হুম।”

বলে আবার মৌন হয়ে গেল অয়ন। নীলা পুরো হতাশ। সেটি বুঝতে পারল অয়ন। ও নিজেকে সামলে নিয়ে একটু কাছাকাছি হলো। নীলার কোমল হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”সুন্দর লাগছে।”

“এতক্ষণে মনে হলো?”

কণ্ঠে অভিমান। অয়ন হাসল। এক হাতে বাহু স্পর্শ করে বলল,”সেটা না। তোমায় সব সময় সুন্দর লাগে।”

“এসব মিথ্যে দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি বুঝি।”

“সত্যিই তাই? তাহলে তো আরো কিছু বোঝার কথা।”

এ কথা বলেই অয়ন দুষ্টু হাসল। এবার নীলা চোখ রাঙিয়ে বলল,”মা’র খাবে তুমি।”

“খেলাম না হয়।”

“উফ, শুধু দুষ্টুমি।”

অয়ন আরেক দফায় হাসল। হাসল নীলাও। দুজনের হাসির মাঝেও অয়ন কেমন একটা শোক অনুভব করল। কদিন ধরেই সব কেমন উলোট পালোট লাগছে। এর থেকে মুক্তি কবে মিলবে, কে জানে।

রুবি’র সাথে আলাদা কথা বলার সুযোগ না পেয়ে অপরা আর কথা বাড়ি চলে এসেছে। মেজাজ উষ্ণ। দুজনের মুখেই মেঘের ছায়া। হতাশ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কথা নিজের কক্ষের দিকে গেল আর অপরা যাচ্ছিল নিজের কক্ষে। তখনই কণ্ঠটা শুনতে পেল। ছোট্ট গিন্নি বলছেন,”তুমি বাসা থেকে বের হবে না কিয়ান। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ভয় হচ্ছে। আজ পালাতে চেয়েছ।কাল যে একই কাজ করবে না, সেটার কী নিশ্চয়তা?”

কিয়ান শান্ত গলায় জবাব দেয়,”মেনে নিয়েছি তো মা। যদি আবার পালানোর হতো,তবে আমি তো এখনই চলে যেতাম। তোমার কসমের পর আমি কিছু তো বলিনি।”

অপরা’র পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। ছোট গিন্নি সব জানেন।! তিনি মানেন নি দেখেই কিয়ান ভাই চুপ। মেয়েটির মাথা ঘুরিয়ে আসে। ও ঝোঁকের বসেই কক্ষে প্রবেশ করে। দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে দুটো চোখ ই এদিকে চায়। সবথেকে বেশি চমকান ছোট গিন্নি। তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেন।

“অপু, কখন এসেছিস? এদিকে আয়। কিয়ানের সাথে সময় কাটাতে পারিস না? দুদিন বাদেই তো দুজনের বিয়ে।”

অপু’কে এগিয়ে যেতে হয় না। ছোট গিন্নিই এগিয়ে আসেন। অপরার বাহু স্পর্শ করেন।

“ভালোই হলো। দুজনকে ভীষণ মানাবে।”

অপরা কথা বলে না। ও তাকায় মেঝেতে বসে থাকা কিয়ানের দিকে। সেটা লক্ষ্য করে ছোট গিন্নি বলেন,”এই ছেলেটাকে তো জানিস ই। কোনো কথা শুনে না। এই যে দেখ বসে আছে মেঝেতে। ওঠতে বলছি তখন থেকে….’

এ কথার মাঝেই অপরা বলে ওঠে,”কিয়ান ভাই। আপনি চুপ কেন?”

কিয়ানের কোনো হেলদোল নেই। ছোট গিন্নি ব্যস্ত হলেন,”কিয়ান, কী ব্যাপার? কথা বলো। অপু তোমার জীবনসঙ্গী হবে।”

এদিকে অপরা”র চোখ অশ্রুতে টলমল। কিয়ান ভাইয়ের জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে। এই মানুষটা শান্ত, নীরব। নিজের কষ্ট বুকে চেপে রাখে। কাউকে দেখায় না। অপরা ছোট গিন্নির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিয়ানের দিকে আগায়। যেতে যেতে ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে টুপ করে মেঝেতে পড়ে।

“কিয়ান ভাই, আপনি এমন কেন? বলেন না, আপনি এমন কেন? এত কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন! অথচ কোনো অভিযোগ নেই। কোনো শব্দ নেই হৃদয় থেকে। এত ভালো মানুষ হলে চলে বলেন। রুবিনাবু’ যে ম’রে যাবে। তাকে বাঁচাবেন না? বলেন না কিয়ান ভাই।”

ছোট গিন্নির শরীর এবার টলতে শুরু করেছে। অপরার বলা কথা গুলো চোখ দুটোয় ভয় সৃষ্টি করেছে। শ্বাসের গতি বাড়ছে ক্রমশ। কিয়ান কিন্তু কিছু বলে‍ না। অপরা চোখের জল মুছে নেয়। দাঁড়িয়ে পড়ে বসা থেকে। এদিকে ছোট্ট গিন্নির মাথার ওপরে আকাশ ভে’ঙে পড়েছে।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি