হৃদয়দহন পর্ব-২৬

0
54

#হৃদয়দহন (২৬)

অয়ন’দের বাড়িটা একদম ই নিস্তব্ধ। সবাই চুপ করে আছে। একটু আগে যে সত্য তারা জেনেছে, এরপর কেউ আর কথা বলতে পারে নি। সবাই যখন শান্ত হয়ে থাকে, তখন কারো কথা বলতে হয়। কথাটা শুরু করলেন অয়নের বাবা। তিনি কিয়ানের কাছে এগিয়ে গেলেন। ভাতিজা সুর্দশন বটে। তবে এই চেহারার সাথে এত শান্ত ব্যক্তিত্ব মানায় না। একটু তেজ থাকলে, আজকের দিনটি দেখতে হতো না।

“অপরা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলবে না। তবু বলছি, তুমি সত্যিই রুবিনাকে পছন্দ করো?”

কিয়ান মৌন। অয়ন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে। ওর মাথার ওপর আকাশ ভে’ঙে পড়েছে যেন। সব কেমন লাগছে।
“বলো কিয়ান।”

কিয়ান কিছু বলতে পারলো না। তার পূর্বেই ছোট গিন্নি চ্যাঁচিয়ে ওঠলেন।

“কীসের কি। এটা সত্য না। রুবিনার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে কেউ নাটক বাড়াবেন না। কিয়ান, চুপ করে কেন?বলো, রুবিনাকে পছন্দ করো না।”

পুরুষ মানুষ মেরুদণ্ড’হীন হলে চলে না। তবে মায়ের জন্য সন্তান সব রকমই হতে পারে। কিয়ান ও তার ব্যতিক্রম নয়। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কত কথাই না সে মেনে নিয়েছে। ছোট গিন্নির দুটো চোখে জলের ধারা নেমেছে। কিয়ানের বাবা সব কিছু দেখছিলেন। এবার একটু রেগে গেলেন। এগিয়ে এসে ঠাস করে ছেলের গালে চ’ড় বসালেন। পুরো বাড়ির লোকের সামনে! এমনটা কখনোই হয় নি, যা আজ ঘটে গেল। ছোট কর্তা রেগে অস্থির।

“অসভ্য ছেলে। কোনো কথা বলছে না। ভাইজান প্রশ্ন করেছে, সেটার উত্তর কোথায়? দিনকে দিন বিগড়ে যাচ্ছ তুমি। তোমার পিঠের চামড়া তুলে নিব বেয়াদব।”

তার অগ্নি কণ্ঠে সবাই কম্পিত, বিস্মিত। এবার দাদিজান বললেন,”কিয়ানের থেকে দূরে সরো তুমি। এভাবে কি প্রমাণ করতে চাও?”

“মা, তুমি…..’

“হ্যাঁ, আমি। তোমার বউয়ের জন্য এতদিন চুপ ছিল কিয়ান। চেয়েও কিছু করতে পারে নি। সেটা বুঝো না?”

এই পর্যায়ে ছোট গিন্নি বলে ওঠলেন,”আপনি আমাকে দোষ দিচ্ছেন মা?”

“কেন?দোষ তুমি করো নি?”

ছোট গিন্নি জবাব দিতে পারলেন না। ওনার দুটো চোখ পুনরায় অশ্রু দ্বারা সিক্ত হলো। এবার বড়ো কর্তা কিয়ানের বাহু টেনে ধরলেন।

“তোমাকে কত ভালোবাসি, সেটা জানো কিয়ান? কখনো বলতে পারবে, অয়নের জন্য একটা কিছু এনেছি,অথচ তোমার জন্য আনি নি। এই বাড়ির সন্তান’রা কখনো আলাদা নয়। সবাই এক। সবাইকে ভালোবাসি। তবে কেন জানালে না?”

কিয়ানের মাথাটা নেমে এল। চোখ দুটো অস্থির। পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারলে বেঁচে যেত। তবে সেটি সম্ভব না। ও শান্ত সুরে বলল,”দুঃখিত চাচ্চু।”

“যা হবার তা হয়েছে। এখন বলো, রুবিনাও কি তোমায় পছন্দ করে?”

কিয়ান মৌন। বুকের ভেতর বাতাস টেনে নেওয়ার প্রয়াস করছে। এদিকে সবাই উত্তরের অপেক্ষায়। ছোট গিন্নি মেঝেতে বসে পড়েছেন। তার এত দিন ধরে করে আসা পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। ও মেয়েটা তার ছেলের বউ হতে চলেছে! ঐ কুৎসিত মেয়েটা। এটা মেনে নেওয়া যায়? যায় না। তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তবে ছেলে তাকাচ্ছে না। আর তাকাচ্ছে না বিধায় পুনরায় কসম দিতে পারলেন না তিনি। আর কিয়ান ও বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা কষ্ট’টা বের করে দিয়ে বলল‍,”আমরা দুজন ই একে অপর’কে পছন্দ করি।”

ব্যাস। এরপর আর কথা থাকে না। সবটা স্বপ্নের মতন ঘটতে থাকে। তখনই রুবিনা’কে ডেকে আনা হয়। কিয়ানের সাথে বিয়ে নিয়ে রুবিনাদের বাড়ির লোকের সমস্যা থাকার কথা নয়। তাই তারাও রাজি হয়ে যান। আর তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মীয় রীতি’তে কিয়ান আর রুবিনার বিয়েটা হয়ে যায়। এই বিয়ে’তে কিয়ান আর রুবিনার পর, সবথেকে বেশি খুশি হয়, অপরা আর কথা। ওরা দুজন কত চেষ্টাই না করেছে। অবশেষে, দুজন ভালোবাসার মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে। জীবন বোধহয় এমনই। কখনো বা তীরে এসে তরী ডুবে যায়, আবার কখনো বা, মাঝ নদীতে ডোবার কথা থাকলেও তরী ঠিক ই ভাসতে থাকে।

অপরা কফি কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। হুট করেই অতীতের দীর্ঘ ঘটনাগুলো স্মরণ হয়ে গেল। ও চোখ মেলে চাইল। বরফ পড়তে শুরু করেছে। বারান্দায় কিছু এসে জমেছে। কফিটাও পুরো শীতল হয়ে গেছে। ও ওঠে গিয়ে পুনরায় এক কাপ কফি বসাল। কফি হতে হতে ভাবল কত সহজেই ছয়টা বছর কেটে গেল। অপরা এবার গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। ভালো রেজাল্ট হয়েছে। গত ছয়টা বছর ভীষণ পরিশ্রম করেছে কী না। কফি তখনো পুরো হয়ে ওঠে নি। কলিং বাজল। অপরা গিয়ে দরজা খুলতেই ছত্রিশ বছর বয়সী একটি নারীকে দেখা গেল। বেশ সুন্দরী। শরীর জুড়ে উলের লাল রঙের একটি জ্যাকেট। দু হাত ঘঁষতে ঘঁষতে ভেতরে প্রবেশ করল সে।

“হুট করেই বরফ পড়তে শুরু করেছে। কি একটা অবস্থা। হিটার জ্বালিয়েছ?”

“উফ, ভুলে গিয়েছি।”

“কি যে করো তুমি। শরীরে ঠাণ্ডা নেই?”

অপরা মৃদু হেসে হিটার জ্বালিয়ে নিল। বর্তমানে তারা জাপানের কিয়োতো শহরে অবস্থান করছে। সাধারণত কিয়োতো শহরের শীত হয় মৃদু। তবে এবার হুট করেই বরফ পড়তে শুরু করল। সবটাই জলবায়ুর প্রভাব। নারীটির নাম জেসমিন। নামটা যেমন সুন্দর, তেমনই দেখতে সুন্দর সে। একদম ফুলের মতন। জেসমিন উলের জ্যাকেট’টা খুলে নিয়ে হিটারের সামনে বসল। উষ্ণতা পেয়ে তার মুখে হাসি এসেছে। অপরা গিয়ে কফি নিয়ে আসল। দুজনের ভাগেই হাফ কাপের একটু বেশি করে পড়ল।

“দুঃখিত, তোমার জন্য বানাই নি। তাই পুরো কাপ পেলে না।”

কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে জেসমিন বলল,”কোনো ব্যাপার না। তুমি যে তোমার থেকে শেয়ার দিলে এতেই আমি খুশি।”

“তোমার কাজ কেমন যাচ্ছে?”

জেসমিনের রেস্তোরাঁর ব্যবসা রয়েছে। ভালো ইনকাম। কফি কাপে চুমুক বসিয়ে একবার নাক টানল। বোঝা যাচ্ছে ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে।

“ভালো। কফিটা বেশ উপকারে দিবে। সর্দি লেগেই গেল।”

“নুডলস বানাতে চেয়েছিলাম। খাবে?”

“হ্যাঁ,বানাও তাহলে। আমি হাত মুখ ধুঁয়ে আসি।”

জেসমিন কফি কাপ হাতে নিয়েই চলে গেল। অপরা পুনরায় কিচেনে এল। এসে নুডলস বের করে সিদ্ধ বসাল। কয়েক মুহূর্ত পর জেসমিন এসে পড়ল।

“বাকিটা আমি করি। তুমি বরং,টুকটাক কিছু গুছিয়ে নাও। আমরা কাল ঘুরতে যাব।”

কথা মতন ঘরে ফিরল অপরা। কক্ষটা অগোছালো হয়ে আছে। হালকা হাতে সেটা গুছিয়ে নিয়ে ব্যাগ প্যাকিং করে ফেলল। ততক্ষণে জেসমিনের রান্নাও শেষ।

“অপরা, এদিকে আসো। খাবার পরিবেশন করা হয়েছে।”

“আসছি।”

অপরা হাতে করে চিলি অয়েল নিয়ে ফিরল। নুডলসের সাথে চিলি অয়েল ওর খুব পছন্দের। খাবার খেতে খেতে ওরা গল্প করল। জেসমিন এক পলক অপরা’কে দেখে নিয়ে বলল,”কী ভাবলে?”

“কোন বিষয়ে?”

“এখন কি করবে। গ্রাজুয়েশন তো শেষ।”

“ভাবছি তোমার সাথে রেঁস্তোরায় জয়েন করব।”

জেসমিন সবে নুডলস মুখে দিয়েছিল। খাবারটা চিবুতে চিবুতে বলল,”সিরিয়াসলি? তুমি না বললে, বিজনেস করতে চাও না। জব করবে।”

“হ্যাঁ। জব ই তো। তোমার রেঁস্তোরায় জব করব। দিবে না?”

“উফ, তুমি আমাকে পর করে রাখতে চাও।”

“মোটেও না।”

“বুঝি আমি।”

“ঠিক আছে। জব করব না। তবে জয়েন করব।”

এবার জেসিমনের মুখে হাসি ফুটল। অপরা ততক্ষণে জেসমিনের গা ঘেঁষে নিয়েছে। দুজনের বয়সের ফারাক প্রায় তেরো। অথচ আচরণ অনেকটাই বন্ধুর মতন।

পরেরদিন খুব ভোরে ওরা রওনা দিল। দুজনেই শরীরে মোটা মোটা জ্যাকেট জড়িয়েছে। অপরা’কে বেশ মজার দেখাচ্ছে। তাই জেসমিন হেসে ফেলল। এতে অপরা মুখ গোমড়া করে বলল,”তোমার সাথে কথা বলব না।”

“উফ, অপরা। রাগ কোরো না। এসো এদিকে।”

জেসমিন হাত বাড়িয়ে অপরাকে কাছে টেনে নিল। দুজন হেঁটে লোকাল ট্রান্সপোর্টে ওঠে পড়ল। গাড়ি চলছে। জেসমিন আর অপরা গল্প করছিল। ওমন সময় জেসমিন মুখ ঢেকে ফেলল। ইষৎ আর্তনাদের মতন করে বলল,”উফ, অসহ্য। এই মাথা নষ্ট ছেলেটা আবার।”

অপরা মাথাটা কিছুটা উঁচু করল। বাস স্টপ থেকে যে লোকটি ওঠেছে তার নাম তোমো। প্রায় দিন ই জেসমিনের রেঁস্তোরায় আসা যাওয়া করত। বয়স ও ত্রিশের আশেপাশে। অপরা’র সাথেও একবার দেখা হয়েছিল। কথা বলে আন্তরিক মনে হয়েছে।

“এভাবে লুকাচ্ছ কেন?”

“তুমি জানো না, এ ছেলে কতটা যন্ত্রণার।”

অপরা ফ্যাল ফ্যাল করে চাইল। একটু বুঝে নিয়ে বলল,”সে কী করেছে?”

“বলতে পারব না। আপাতত চুপ করে বোসো তো। আর আমাকে আড়াল করে রাখো।”

কথা মতন চুপ করে বসে রইল অপরা। জেসমিন মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে। তবে তোমো অপরা’কে এক দেখাতেই চিনে ফেলল। ফলশ্রুতিতে এগিয়ে এল কথা বলতে। ভদ্রতার খাতিরে কথা বলল‍ অপরাও। কয়েক সেকেন্ড পর তোমো বলল,”ওটা কী মিস জেসমিন? তিনি ওভাবে মুখ লুকিয়ে আছেন কেন?”

জেসমিন এবার খোলস থেকে বেরিয়ে এল। হাসার চেষ্টা করে বলল,”আমার আসলে ঠাণ্ডা লাগছিল।”

এ কথা বলে জেসমিন মুখটা শক্ত করে ফেলল। আর তোমো অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এ নারীটিকে যত দেখে ততই অবাক হয় সে।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি