হৃদয়দহন পর্ব-৩০

0
55

#হৃদয়দহন (৩০)

মিষ্টি রোদ ওঠেছে। আকাশ আজ ঝকঝকে পরিষ্কার। শীত পড়েছে, তবে রোদের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। এক কাপ কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল নীলা। অনেক দিন পর তার মনটা ঈষৎ ভালো। এই ভালোর কারণ, তার জব হয়েছে। জীবনের টানাপোড়েন পেরিয়ে একটা চাকরি নিয়েছে সে। ভালো বেতন। তবে এই খুশিটা বেশি সময় বহাল রইল না। যখন তার মা এসে বললেন,”দুপুরে, ছেলে পক্ষ আসবে। তোকে দেখতে।”

নীলা ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। এতেই মায়ের মুখটা ঈষৎ কালো হতে দেখা গেল।

“আর কিছু বলবে?”

“এটাই বলার ছিল।”

“শুনে নিয়েছি। এবার যাও।”

“তোর বাবা, কিন্তু বড়ো আশা নিয়ে আছেন। ফিরিয়ে দিস না।”

এ কথা বলেই মা প্রস্থান করলেন। নীলা পাত্তা দিল না। ও বরং কফি কাপে চুমুক বসাল। আজকের দিন’টি নিজের মতন উপভোগ করবে সে।

বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে। তাকে নিয়েই এক প্রকার উৎসব চলছে। এদিকে অয়ন ব্যস্ত। ভীষণ ব্যস্ততার ফলে দু দণ্ড দাঁড়ানোর সময় ও নেই তার। রুবিনা এতে কিঞ্চিৎ কষ্ট পেল। তাই তো বলে ওঠল,”অয়ন ভাইয়া, আমি তো তোমার বোন নই। তাই আজ তোমার সময় হচ্ছে না।”

এ কথায় দাঁড়িয়ে গেল অয়ন। মুখে বলল,”সত্যিই কাজ পড়েছে। আমি তো বাড়িতেই থাকি। এমন তো না আর আসব না।”

“থাকো তো না থাকার মতন।”

অয়ন আরো কিছু বলতে নিচ্ছিল। সে সময়ই ছোট গিন্নি বললেন,”থেকে যা না। একদিন ই তো।”

অয়ন দ্বিধার মধ্যে পড়ল। অপরা এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। একবার দুজনের চোখাচোখি হলো। ঘরের ভেতর প্রবেশ করল কিয়ান।

“কি নিয়ে কথা হয়?”

“অয়ন ভাইয়া বলছে, আজ নাকি থাকতে পারবে না।”

কিয়ান ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ভ্রু কুঁচকে বলল,”এমনটা বললে হয়? থাকবি না কেন?”

“কাজ আছে ভাইয়া। একটু….’

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কিয়ান বলল,”কোনো একটু না। আজ তোকে থাকতেই হবে। এটাই ফাইনাল। আর অপরা, দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাবুকে তো কোলেও নিলে না।”

অপরা’কে একটু দ্বিধায় দেখা গেল। ও ছোট গিন্নির দিকে চাইল। ছয় বছর আগে, এই নারীটি তাকে বি’ষের সাথে তুলনা করেছিলেন। অনেকটা অপমান ও করেছিলেন। যদিও সেসব এখন অতীত। অপরা’র এমন দ্বিধা ছোট গিন্নিও বুঝতে পারলেন। যদিও রুবিনা’কে এখনো পুরো মেনে নিতে পারেন নি। তবু সংসার তো চলছে। তাই অপরা’র প্রতিও আর কোনো রাগ নেই। তিনি ছোট করে শ্বাস ফেললেন। তারপর কিয়ানের মেয়েকে কোলে নিয়ে বললেন,”অপু, এদিকে আয়। দেখে যা, ও কিন্তু তোর মতন ই হয়েছে।”

শেষ কথাটা বললেন ঘটনা সহজ করতে। অপরা’র দ্বিধা ভে’ঙে পড়ল। মনের ভেতরটা আরো একবার শান্তিতে ডুবল। ও এগিয়ে গিয়ে কিয়ানের মেয়ে’কে কোলে নিল।

নীলা’দের বাড়িতে মেহমানের আগমন ঘটেছে। এদিকে নীলা নেই। নীলার বাবা ভীষণ চটে গেলেন। মেহমান’দের কাছে লজ্জায় পড়তে হলো। তিনি স্ত্রী’র প্রতিও রাগ দেখালেন। তারপর মেয়েকে কল করলেন। প্রথমবার রিসিভ না হলেও, দ্বিতীয় বার রিসিভ হলো।

“কী বলবে, বলো।”

“কোথায় তুমি?”

“বেরিয়েছি।”

“তুমি কি জানতে না, আজ বাড়িতে মেহমান আসবে?”

“জানতাম।”

“তাহলে? কেন বের হয়েছে?”

“ইচ্ছে হয়েছে।”

“বললেই হলো? মগের মুল্লুক পেয়েছ?”

“ধরে নাও তাই।”

“নীলা!”

“কণ্ঠের তেজ কমাও প্লিজ। এসব আর কাজে লাগবে না। আর শোনো, আমি আর কখনো তোমার বাড়িতে ফিরব না।”

এ কথা বলেই নীলা কলটা কেটে দিল। দুটো চোখ জ্বালা করছে। ও চোখ বন্ধ করল। তারপর ই ডুবে গেল, অতীতের সেই নিষ্ঠুর দিন গুলোতে।

অয়নকে কোনো কালেই পছন্দ ছিল না নীলার বাবার। ছেলেটার চলন, বলনের চঞ্চলতা তাকে বিরক্ত করত। এলাকায় থাকার সুবাদে, ছোট থেকেই অয়ন’কে দেখে এসেছেন। মা’রামা’রি করা ছিল, নিত্যদিনের অভ্যাস। এই ছেলে’কে মেয়ের পাশে কল্পণা করা তার জন্য অসম্ভব ছিল। তবে সরাসরি বলতেও দ্বিধা লাগছিল। সেই জন্যই কী না
ডাক্তার অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ বুঝে তিনি অয়ন’দের মিষ্টির ব্যবসায় ধস নামিয়ে দিলেন। তারপর মেয়েকে বোঝালেন। বোঝালেন এখানে সে সুখী হতে পারবে না। তবে নীলা সেসব বুঝল না। ও বরং তর্ক করতে লাগল। ডাক্তার তখনই বুঝে গিয়েছিলেন মেয়েটা অনেক দূর চলে গিয়েছে। সহজে তাকে দমানো যাবে না। তাই মেয়ের দুর্বলতায় আ’ঘা’ত হানলেন। অয়ন’কে ফাঁসিয়ে দিলেন নেশার মামলা। ও নাকি ছোট ছোট ছেলে’দের নেশা পানি দিয়ে সাহায্য করে। এই ঘটনার পর নীলা অনেকটা ভেঙে যায়। ডাক্তার মেয়েকে ভয় দেখান। ভয় দেখান, অয়নের জীবনটা শেষ করে দেওয়ার। ফলে, নীলাকে পিছিয়ে যেতে হয়। অয়নের মামলা তখনো চলমান। বাবা’র কথা মতন অয়নের সাথে ব্রেকআপ করে নীলা। সে জানায়, অয়নের মতন আসামি’র সাথে বিয়ের মতন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জড়াতে পারবে না। ঘটনা সেদিন অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। রাগে আক্রোশে নীলা’কে চড় ও মে’রেছিল অয়ন। এসব নিয়ে নীলার দুঃখ নেই। ওর দুঃখ অয়ন আজও সত্যটা জানে না। অতীতের দুঃখের স্মৃতি ভাবতে ভাবতে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নীলার চোখ থেকে। সেই অশ্রু জানান দিচ্ছে, তার মনে অয়নের জন্য আজও একই রকম অনুভূতি রয়েছে।

দীর্ঘ ছয় বছরে, কোনো রকম অনুষ্ঠানেই থাকে নি অয়ন। এত বছর পর পরিবারের সাথে অনুষ্ঠানে থাকা হচ্ছে। কিয়ান আর রুবিনার প্রথম সন্তান দেখেই কী না এত আয়োজন। পাড়ার বেশ অনেক’কে রাতের খাবারের জন্য দাওয়াত করা হয়েছে। সবাই এসেছে। তাদের নিজ হাতে পরিবেশ করে খাওয়াচ্ছে কিয়ান। তবে অয়ন আড়ালেই আছে। অপরাও হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছিল। অয়ন’কে এভাবে বসে থাকতে দেখে খারাপ লাগল। ও একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,”একটু সাহায্য করেন না।”

জবাবের অয়ন বলল,”সবাই তো আছেই।”

“আপনিও আসেন।”

“দরকার হলে তখন না হয় যাব। তুমি পরিবেশন করো।”

অপরা বিষয়টা মাত্রই খেয়াল করল। অয়ন তাকে তুমি সম্বোধন করছে। তার মানে দূরত্ব আরো বেড়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ছয় বছর আগের কথা। রুবিনা আর কিয়ানের বিয়ের তৃতীয় দিন। ছোট গিন্নি রাগ দেখিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। তার রাগ ভাঙাতে যায় অপরা আর কথা। অথচ তিনি অপরা’কে ভীষণ ভাবে তিরস্কার করেন। যে মেয়েটিকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছেন, সেই মেয়ে এমন সর্বনাশ করবে, সেটি তো স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি। বেশ কয়েকদিন পর ছোট গিন্নি বাড়ি ফিরলেন ঠিকই, তবে নানান বিষয় নিয়ে বাড়িতে কলহ সৃষ্টি হলো। প্রায়দিন ই অশান্তি। অপরা’র যদিও কোনো দোষ নেই, তবু ছোট গিন্নির চোখে খারাপ হয়ে গিয়েছিল সে। এদিকে জেসমিন, যে কী না অপরা’র মায়ের ছোট বোন। অপরা’র সাথে অনেক দিন ধরেই যোগাযোগের চেষ্টা করছিল। চিঠিও দিয়েছিল। তবে অপরা সেই কথা একদম ই ভুলে বসেছিল। অপরা’র থেকে জবাব না পেয়ে দাদিজানের সাথে যোগাযোগ করে জেসমিন। দাদিজান ও বুঝতে পারছিলেন এই পরিবারে অপরা’র ভবিষ্যত নেই। নেই কোনো ভরসা। অপরা মা-বাবা কে হারিয়ে অয়ন’কে আকরে ধরে বেঁচেছিল। ছোট অপরা একমাত্র অয়নের জোড়েই মা-বাবার দুঃখটা ভুলেছিল। ওরা যত বড়ো হচ্ছিল, সম্পর্ক তত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন হচ্ছিল। অয়নের মা-বাবা ও চেয়েছিলেন অপরা’কে ছেলের বউ করতে। তবে বড়ো হওয়ার পর, অয়নের জীবনে নীলার আগমন ঘটে। অয়ন যখন নীলার হাত চেয়ে বসল, তখন সম্পর্কটা বদলের পরিকল্পনা করা হলো। কথা হলো, অপরা কিয়ানের বউ হবে। কিন্তু শেষে সেটাও ভেস্তে গেল। সব মিলিয়ে দাদিজান আহত ছিলেন। অপরা’র সাথে অনেক গুলো অন্যায় হয়েছে। কেউ অপরার জন্য চিন্তা করেনি। নেয় নি মনের খোঁজ। অথচ অপরা, বরাবরই এই মানুষ গুলোর কথা চিন্তা করেছে। তখনই দাদিজান কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঠিক করলেন, অপরা’কে এই মায়া থেকে মুক্তি দিবেন। এই মানুষ গুলো’র থেকে মুক্তি দিবেন। এখানে থাকলে, অপরা নিজেকে হারাবে। তাই তো জেসমিনের প্রস্তাবে রাজি হলেন। জেসমিন অপরা’কে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল। বোনের চিহ্ন’কে আগলে রাখার চিন্তা’কে দাদিজান সম্মান দিলেন। তারপর নিলেন কঠিন সেই সিদ্ধান্ত। অপরা’কে পাঠিয়ে দিলেন জেসমিনের কাছে। মেয়েটি যেন এই মায়া থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই জন্য শর্ত দেওয়া হলো, অপরা’র সাথে কেউ যেন যোগাযোগ না করে। এমন’কি তিনি নিজেও যোগাযোগ করবেন না। কারণ তিনি চেয়েছিলেন, অপরা এবার যেন নিজেকে ভালোবাসতে পারে। সবাই কিন্তু নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছিল। অয়ন নিজের দায়িত্ব ভুলে বসেছিল। কিয়ান নিজ ভালোবাসা বাঁচাতে গিয়ে অপরা’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করল। অথচ এই মায়াজালে পড়ে, অপরা নিজেকেই ভুলে বসেছিল। স্বার্থের এই দুনিয়া’য় ভালোবাসার আড়ালে সবাই স্বার্থপর ছিল। অথচ অপরা’র ভালোবাসার কোনো স্বার্থ ছিল না। সর্বদা এই মানুষ গুলো’র ভালো চেয়ে এসেছে সে। এতে কতবার হৃদয়ে দহন লেগেছে, সেটা কেউ কী জেনেছে?

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি