#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪৩
রাশফিয়া পিটপিট করে চোখ খুলতে চোখ যেয়ে ঠেকলো ঘুরতে থাকা সিলিংফ্যানের দিকে। কোথায় আছে, কি হয়েছে ওর সাথে কিছুই জানা নেই রাশফিয়ার শুধু মনে পড়লো শেষ বারের মতো আবছা আলোয় ভেসে ওঠা আরফির বিধ্বস্ত মুখশ্রী। আরফির কথা মনে পড়তে রাশফিয়া দুর্বল নেত্রে চারপাশে তাকাতে অনুভব করলো ওর হাত কারো হাতের মুঠোয়। রাশফি চোখ তুলে হাত ধরে রাখা ব্যক্তির দিকে তাকাতে বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো।
আরফি বেডের সাথে হেলান দিয়ে ওর হাতটা অতি সপ্তপর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। হাতে চলছে স্যালাইন। রাশফিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে আরফির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে আশপাশের তাকাতে চোখে পড়লো বেডের থেকে কিছুটা দূরে সোফার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আছে তাজ আর তাজে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ফারিসতা। সবাইকে অবলোকন করে রাশফিয়ার দুই চোখের কার্নিশ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভাবতে পারেনি এই প্রিয় মুখগুলো আবার দেখার সুযোগ হবে।
আরফির হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতে রাশফিয়ার জ্ঞান ফিরতে দেখে একটা কথাও না বলে রাশফির হাত ছেড়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে আস্তে করে ফারিসতাকে ডাক দিলো। আরফির ডাকে তাজ ফারিসতা দু’জনেই চোখ খুলতে আরফি সোফায় বসতে বসতে ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলল, ওর জ্ঞান ফিরেছে দেখো কিছু প্রয়োজন হয় কিনা।
রাশফিয়ার জ্ঞান ফিরেছে শুনে ফারিসতা তড়িঘড়ি করে উঠে রাশফিয়ার পাশে বসে এখন শরীর কেমন লাগছে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এমন একটা কাজ করার জন্য বকা দিতেও ভুললো না। সবশেষে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে ফিরে পেয়ে ফারিসতার খুশি উপচে পড়ছে যেনো৷ ফারিসতা রাশফিয়াকে উঠতে সাহায্য করে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে বলল, কিছু খাবি এনে দিবো?
রাশফিয়া দু দিকে মাথা নাড়িয়ে না বলে ঠোঁট উল্টো ফারিসতার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ওঁকে একটু আসতে বলনা।
ভাইয়া খুব রেগে আছে। সবাইকে কতটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তুই জানিস? আমিও তোর উপরে খুব রেগে আছি এমনটা করায়। শুধু তুই এখন অসুস্থ দেখে কিছু বললাম না।
কিছু বলবি না বলেও তো কত কিছু বলছিস। সেই কখন থেকে বকে চলেছিস।
বকার কাজ করলে বকবো নাতো কি করবো? বোস তুই আমি দেখি ভাইয়াকে ম্যানেজ করতে পাড়ি কিনা বলে ফারিসতা আরফির কাছে এসে আরফিকে বোঝাতে যাবে তার আগেই আরফি উঠে রাশফিয়ার কাছে যেয়ে হঠাৎ সজোরে ওর গালে চড় বসিয়ে দিলো।
আরফির কাজে চমকে উঠে ফারিসতা বিচলিত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে ফারিসতাকে থামিয়ে দিয়ে তাজ ফারিসতার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেলো। ফারিসতা নিজের হাত ছুটানোর জন্য মোচড়া মুচড়ি করতে করতে বলল, রাশফিয়া অসুস্থ আর ভাইয়া ওকে মারলো আর আপনি আমাকে নিয়ে এসেছেন ছাড়ুন আমা…
হুস… ফারিসতার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাজ ফারিসতাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওদের আলাদা সময় দেওয়া দরকার তবেই সব ঠিক হবে। আর আরফি নেহাত দুর্বল একটা ছেলে এই জন্য একটা থাপ্পড় দিয়েছে এমন কাজ করার জন্য। আরেকটু হলেতো নিজেও মরতো সাথে আমার বন্ধুটাও মারতো। ওর জায়গায় আমি হলে একটা না দশটা লাগাতাম দুই গালে তারপর হতো কথা।
ফারিসতা চোখমুখ খিঁচে বলল, কসাই বলি কি আর সাধে?
তোমার জন্য কসাই এই ঠিক আছে।
****
সকাল আটটা বাজে সবাই নাস্তা শেষ করে ঢাকা ব্যাক করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে যাবে তখন কতগুলো গার্ড নিয়ে রাশফিয়ার বাবা হোটেলে ওদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো।
হঠাৎ অপরিচিত কতগুলো মুখ দেখে তাজ আর আরফির ভ্রু কুঁচকে গেলো অন্যদিকে রাশফিয়া ঘাবড়ে আরফির পিছে লুকালো। তাজ সামনে দাঁড়ানো লোকদের উদ্দেশ্যে ভ্রু কুঁচকে বলল, কি চাই?
তাজের প্রশ্নে রাশফিয়ার বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলো কি চাই মানে? আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছিস আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? ভালোয় ভালোয় বলছি আমার মেয়েকে আমার কাছে দিয় দে।
এই লোক রাশফিয়ার বাবা শুনে আরফি ক্ষিপ্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে তাজ আরফিকে থামিয়ে দিয়ে রাশফিয়ার বাবার সামনে দু কদম এগিয়ে গিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
লিসেন একেতো নিজের মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করে জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন আবার সেই মুখে এত জোর নিয়ে নিজের মেয়েকে আবার নিতে আসছেন। জাস্ট অবাক হচ্ছি আপনার সাহস দেখে। আপনি বাবা হলেও আপনার কোনো রাইট নেই ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার। নিজের ভালো চাইলে এখান থেকে কেটে পড়ুন আর নাহলে ভুলে যাবো আপনি রাশফির কিছু হোন।
আমিও ভালোয় ভালোয় বলছি আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে আর নাহ…
পথিমধ্যে থামিয়ে দিয়ে আরফি তেড়ে গিয়ে বলে উঠলো, আর নাহলে কি করবি? আমরা তোকে ভয় পাই? এই আমি আরফি তালুকদার তোর সামনে এই মুহূর্তে তোর মেয়েকে বিয়ে করবো দেখি তুই কি করতে পারিস।
এই ছেলে মুখ সামলে কথা বলো। তোমার মতো বেয়াদব ছেলের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো প্রশ্নেই আসেনা। আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও আর নাহলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।
ডাকুন না আপনাকে আমরা আটকে রেখেছি? পুলিশ এসে ওর বাপকে একটু সালাম করে যাক।
ফারিসতা এবার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, আপনি পুলিশ ডাকেন আর আমরা বরং কাজী আনার ব্যবস্থা করছি কেমন?
রাশফিয়ার বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ডাকে আর তাজ কাউকে ফোন করে কিছু বলতে মিনিট বিশের ভিতরে কয়েকজন লোক একজন কাজি আর কিছু শপিং ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো
তাজ একটা শপিং ব্যাগ আরফির হাতে দিয়ে বলল, বিয়ে করবি ব্যাটা শেরওয়ানি না পড়লে হয় নাকি? যা এটা পড়ে আয়।
আরফি স্মিত হেঁসে একবার রাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আরফি যেতে তাজ আরেকটা ব্যাগ ফারিসতার দিকে বাড়িয়ে দিতে ফারিসতা তার ভিতর থেকে তাজা গোলাপের দুইটা ফুলে মালা বের করে একটা রাশফিয়াকে পড়িয়ে দিয়ে আরেকটা আরফি আসতে আরফির দিকে বাড়িয়ে দিলো।
এদিকে পুলিশ নিয়ে রাশফিয়ার বাবা কিছুক্ষণ পর পুলিশ নিয়ে আসলে পুলিশ রুমে প্রবেশ করে আরফি আর তাজকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো। পুলিশের থতমত মুখ দেখে রিয়াজ শিকদার বলল, অফিসার কোনো সমস্যা?
পুলিশ অফিসার রিয়াজ শিকদারের কথা কানে না তুলে উল্টো তাজকে সালাম দিয়ে তাজের সাথে হাত হ্যান্ডশেক করলো তা দেখে রিয়াজ শিকদারের মুখ হা হয়ে গেলো। তিনি বিদেশ থেকে সপ্তাহ খানেক আগে ফিরলো তাই তাজ আরফিদের সম্পর্কে অবগত নেই। এতক্ষণ ভেবেছিলো পুলিশ এনে একটু ভয় দেখালে এমনি তার মেয়েকে তার হাতে তুলে দিবে। যে করে হোক রাশফিয়াকে ওনার চাই আর নাহলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে কিন্তু এখন বুঝতে পারলো সেই মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া আর সম্ভব না কারণ তার সামনে থাকা দুই তাগড়া যুবক যে ক্ষমতাবানের উপরেও ক্ষমতাবান যুবক যে পুলিশ ও সালাম দিচ্ছে ভাবতে ঢোক গিললেন তিনি।
সব না জেনে এমন আসার জন্য পুলিশ তাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলো। পুলিশরা যেতে আরফি রিয়াজ শিকদারের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
এইটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলে নাকি শশুরমসাই?
আরফির কথায় জবাব দিতে পারলো না রিয়াজ শিকদার। কল্পনাও করতে পারেনি এইটুকু দুইটা ছেলের এত দাপট যে পুলিশ ও এদের কাছে ক্ষমা চেয়ে পালায়। কাদের সাথে পাঙ্গা নিতে এসেছে ভাবতে তিনি ঘামতে লাগলো। রাশফিয়ার উপরে এই পর্যন্ত যত অন্যয় করেছে তার জন্য যদি এখন তাকে সায়েস্তা করে ভাবতে কলিজা শুকিয়ে যেতে লগলো।
***
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আরফি আর রাশফিয়ার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।
রিয়াজ শিকদার একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। এসেছিলো মেয়েকে উঠিয়ে নিতে আর শেষে কিনা মেয়ের বিয়ের সাক্ষী তাকে দিয়ে দেওয়ালো এরা তাতে তার নাক কান সব কাটা গেলো। তার ভাবনার মাঝে আরফি রিয়াজ শিকদারের সামনে এসে তার হাতে আরফি নিজের আর তাজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, নিজ দায়িত্ব খোঁজ নিয়ে দেখবেন আমরা কে। শুধু মাত্র রাশফিয়ার বাবা দেখে আপনাকে ছেড়ে দিলাম। ওর উপরে এতটা বছর ধরে যেই অত্যাচার করে গিয়েছেন তার প্রতিটি অত্যাচারের বদলা নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে শুধু ছেড়ে দিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। আপনারা বাবা-মা হয়েও এতটা নিকৃষ্ট স্বার্থপর হলেও ও আপনাদের মতো নিকৃষ্ট না এই জন্যই তো এত অত্যাচারের পর ও এখনো ও আপনাদের বাবা-মা হিসেবে ভালোবাসে। আপনাদের অসম্মান হলে কষ্ট পেলে সবার আগে ও এই পাবে। আজকের পর থেকে ওঁকে এইটুকু কষ্ট আমি পেতে দিবো না তাই সসম্মানে আপনাকে ছেড়ে দিলাম। তবে আর কখনো যদি রাশফিয়ার আশপাশেও আপনি আসার চেষ্টা করেন তাহলে সেই সম্মানের কথা আমি ভুলে যাবো। ভালো থাকবেন এ বলে রাশফিয়ার হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতে রাশফিয়া আরফিকে থামিয়ে দিয়ে রিয়াজ শিকদারের সামনে যেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে রিয়াজ শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
বাবারা কেমন হয় আমি জানিনা। বাবা থাকতেও কখনো বাবার স্নেহ পাওয়ার ভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি কিন্তু সবার কাছে শুনেছে বাবারা নাকি হয় একটা সন্তানের বটগাছ। যেই গাছটা সবসময় তার সন্তানকে আঁকড়ে ধরে থাকে যাতে তার সন্তানের গায়ে একটা ফুলের টোকা না লাগে। কিন্তু আপনারা আমাকে ফুলের টোকা লাগার থেকেও আগলে না রেখে উপহার দিয়েছেন বিষাক্ত কাঁটা। যেই কাঁটার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করেছেন আমাকে প্রতিটা মুহূর্ত। সবাইকে খুব গর্ব করে বলতে দেখেছি, ওরা বলতো আমার বাবা মা সবচেয়ে সেরা। এমন বাবা-মা সবার হোক আর আমি বলি কি জানেন? এমন বাবা-মা আল্লাহ এই পৃথিবীতে আমার শত্রুকেও না দেক। ভালো থাকবেন আর হ্যা আমার আশেপাশেও কখনো আপনাকে আর আপনার ওয়াইকে দেখতে চাইনা এ বলে আরফির হাত শক্ত করে ধরে সেখান থেকে চলে গেলো।
একটা সময় খুব করে কান্না করতাম অন্য পাঁচটা সন্তানের মতো নিজের বাবাকে কাছে পাইনি এই জন্য কিন্তু এখন শুকরিয়া আদায় করি আপনাদের মতো নিকৃষ্ট বাবাদের পাশে পাওয়ার চেয়ে এতিম হয়ে বাঁচা অনেক ভালো কথাটা বলে ফারিসতার তাজের দিকে তাকিয়ে বলল চলুন।
তাজ ফারিসতার জ্বলন্ত মুখশ্রীটা নীরবে অবলোকন করে মুচকি হাসলো। সবসময় এই মেয়েটাকে দেখেছে বাবার ভালোবাসা পাওয়ার খুব কাঙ্গাল। সবসময় খুব করে আফসোস করতো কেনো ও অন্য পাঁচটা সন্তানের মতো বাবার ভালোবাসা পেলো না। অবশেষে মেয়েটা বুঝলো এমন স্বার্থপর বাবাদের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে এতিম থাকা ভালো। কিন্তু ও ওর স্নিগ্ধ ভালোবাসাকে কোনো আকাঙ্খা নিয়ে বাঁচতে দিবে না। সব একে একে আকাঙ্খা পরিপূর্ণ করে দিবে ভাবতে ফারিসতা হাত আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলো তাজ।
তাজের সাথে পা মিলিয়ে সামনে কদম দিতে দিতে ফারিসতার মুখে ফুটে উঠলো স্নিগ্ধ হাসির রেখা। ভাবতে অবাক হয় ফারিসতা একটা সময় এই তাজ ছিলো ওর সবচেয়ে বড় শত্রু আর আজ এই ছেলেটাই যেনো ওর বেঁচে থাকার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে। যেই ছেলেটা সবসময় বটবৃক্ষ হয়ে ওকে আগলে রাখে। এই ছেলেটার জন্য আজ ও পরিপূর্ণ। ওকে এত সুন্দর পরিপূর্ণ একটা পরিবার উপহার দিলো। উপহার দিলো বাবার অভাবটা ঘুচে দেওয়ার জন্য আরেকটা বাবা। বাবা নামক যেই বটগাছের ছায়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মেয়েটা কাঙাল ছিলো সেই মেয়েটার মাথার উপরে এখন শুধু একটা বটগাছ না দুই দুটো বটগাছ আছে ভাবতে ফারিসতার হৃদয় জুড়ে ছেয়ে গেলো ঠান্ডা শীতল হাওয়া।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন
#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪৪
সেদিনের পর কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাস। দিন যত যাচ্ছে তাজ ফারিসতার ভালোবাসা খুনসুটিগুলো আরো ভালোবাসাময় হয়ে উঠছে। এরি ভিতরে ফারিসতাদের ফার্স্ট সেমিস্টারের এক্সাম শেষ হয়ে গেলো। সাফওয়ান আর আদরিবার বিয়ের দিন ও ঘনিয়ে আসছে। সামনে বিয়ে আসছে তাই সবার ব্যস্ততা আরে বেড়ে যাবে এই জন্য ফারিসতা তাজের কাছে বায়না ধরলো আজ সন্ধ্যার পর ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।
অর্ধাঙ্গিনীর বায়না পূরণের জন্য তাজ হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে যখন বের হবে তখন প্রবেশ করলো ফারজানা বেগম। এই টাইমে ফারজানা বেগম হসপিটালে আসায় অবাক হলো তাজ। তাৎক্ষণিক তাজ নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, আসসালামু আলাইকুম মা।
তাজের মুখে মা ডাক শুনে স্মিত হাসলো ফারজানা বেগম। কেনো যেনো তাজের মুখে যতবার মা ডাকটা শোনে ততবার ঠোঁটে কোনে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। ফারজানা বেগম মুচকি হেঁসে সালাম এর উত্তর দিয়ে বলল, কি অবাক হচ্ছো আমাকে এখানে দেখে?
ফারজানা বেগমের প্রশ্নে তাজ মাথা চুলকিয়ে হালকা হেসে বলল, একটু হয়েছি। বসুন না তারপর কথা বলছি এ বলে তাজ চেয়ার টেনে দিতে ফারজানা বেগম বসতে বসতে বলল, তুমিও বসো। একচুয়েলি ইম্পর্ট্যান্ট কিছু কথা তোমায় বলার প্রয়োজন মনে করছিলাম তাই এখানে আসা।
তাজ ওর চেয়ারে বসে বলল, সেটা বুঝতে পেরেছি। এনি প্রবলেম মা? আমাকে নিরদ্বিধায় বলতে পারেন।
ফারজানা বেগম জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে শুরু করল,
আসলে বাবা কেথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ফারিসতার বাবার সম্পর্কে তুমি খুব একটা অবগত না। ফারিসতার সাত বছর বয়সে তার সাথে আমার বিচ্ছেদ হয়ে যায় এরপর থেকে তার সাথে আর কোনো রকম আমার যোগাযোগ হয়নি। তবে সপ্তাহ খানেক আগে তাকে আমি দেখি। সেদিন বিকেলে অফিস ছুটি হওয়ার পর যখন আমি অফিস থেকে বের হই তখন বৃষ্টি নামছিলো যার জন্য রাস্তাঘাট একদম ফাকা ছিলো। বাসায় ফেরার জন্য কোনো রিকশা পাচ্ছিলাম না তাই একটু হেঁটে সামনে যেতে তখন চোখ পড়লো কয়েকটা মুখোশধারী লোক একটা মেয়েকে জোরজবস্তি করে করে গাড়িতে ওঠাতে চাচ্ছিলো তখন সেখানে কিছু মানুষ চলে আসায় ওরা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। ঘটনাটা দেখে কেনো যেনো আমার মনে সন্দেহ জাগলো। কয়েকমাস আগে নারী পাচারের জন্য নাহির খানদের ধরতে পারলেও আসল কালপ্রিটকে এখনো ধরতে পারোনি। ওই মেয়েটাকে ওভাবে গাড়িতে ওঠাতে চাওয়ায় আমার মনে কেনো যেনো সন্দেহ জাগে হতেও পারে এরা সেই কালপ্রিটের অন্তর্ভুক্ত তাই আমি একটা সিএনজি নিয়ে ওঁদের গাড়ি ফলো করে একটা গোডাউনে পৌঁছাতে দেখলাম কেউ একজন ওই ছেলেগুলোর উপরে খুব জোরে চ্যাচাচ্ছে। সেই লোকের কণ্ঠস্বর হুট করে আমার কেনো যেনো খুব পরিচিত মনে হলো। আমি তার মুখ দেখার জন্য লুকিয়ে তাঁদের কাছাকাছি অবস্থান করতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফারিসতার বাবা আফজাল আকন্দের মুখশ্রী।
তাদের চ্যাচামেচি কথা শুনে কিছুটা বুঝতে পেরেছি আমার অনুমান ঠিক কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আফজাল আকন্দ এই কাজের সাথে জড়িত। ওখানে চারেদিকে ওদের অনেক মানুষ ছিলো তাই আমি বেশিক্ষণ সেখানে না থেকে ওখান থেকে চলে আসি। ওখান থেকে আসার পর আমি বিষয়টা শিওর হওয়ার জন্য আরো কিছুদিন ওদের ফলো করি এতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি এই কালোবাজারি কাজে মেইন কালপ্রিট আফজাল আকন্দ। আমার মনে হয়েছে বিষয়টা তোমাকে জানানো প্রয়োজন কারণ তোমরা ওদের ধরার জন্য কয়েকমাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছো তাই ওরা সুযোগ বুঝে আমাদের পরিবারের উপরে অ্যাটাক করতে পারে। এখন যেহেতু বুঝতে পারছো কারা এই কালোবাজারি কারবারের সাথে লিপ্ত তাই ওদের ধরার জন্য যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করো। রক্ষা করো আমাদের দেশকে। যত দিন যাবে ওদের দল তত বড় হবে। নাহির খানদের হারিয়ে এখন ওরা অনেকটা দুর্বল। এটাই এখন মোক্ষম সুযোগ ওঁদের ধরার।
ফারজানা বেগমের সম্পূর্ণ কথা শুনে তাজ কিছুটা রেগে বলল, কথাগুলো আমাকে প্রথমে কেনো জানালেন না? আপনি একা একা এত রিস্কি কাজ কেনো করেছেন? যদি ওদের হাতে ধরা পড়ে যেতেন তাহলে কি হতো ভাবতে পারছেন? আমাকে ছেলে হিসেবে মানেন তাহলে ভরসা করে ছেলেকে শুরু থেকে কেনো বললেন না মা? আপনার একদমি উচিত হয়নি একা একা এই ইনভেস্টিগেশন করা। আপনার কিছু হলে ফারিসতার কি হতো সেটা একবার ভাবলেন না? আমি সত্যি খুব রাগ করেছি আপনার কাজে।
তাজের রাগে ফারজানা বেগম মৃূদু হেঁসে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাজের পাশে দাঁড়িয়ে তাজের কাঁধে হাত রেখে বলল,
জন্ম মৃত্যু সবটাই সৃষ্টিকর্তা অনেক আগেই লিখে রেখেছে। আমি না থাকলে আমার বাবা যে আমার মেয়েকে আগলে রাখবে তা আমি জানি তাইতো আজকাল নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে পাড়ি। আফজাল আকন্দ যে এমন নিকৃষ্ট কাজের সাথে জড়িত হতে পারে কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি তাই তাকে সেদিন দেখে মাথা ঠিক ছিলো না। তাই মাথায় আসেনি তোমাকে জানানোর কথা। টেনশন নিও না ওরা কেউ আমাকে দেখেনি আর আমি একদম ঠিক আছি দেখতেইতো পারছো।
তাজ আর কথা না বাড়িয়ে গম্ভীর মুখে ফারজানা বেগমকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হলো। ফারজানা বেগম একা যেতে চাইলে তাজ যেতে দিলো না। নিজের গাড়িতে ফারজানা বেগমকে উঠিয়ে ড্রাইভারকে সাবধানে যেতে বলে তাজ একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে গেলো। পথিমধ্যে আরফিকে ফোন করে জানিয়ে দিলো সবাইকে নিয়ে ক্লাবে যেতে ও বিশ মিনিটের ভিতরে আসছে। তাজ বাসায় পৌঁছে সবে রুমে প্রবেশ করতে ফোন বেজে উঠলো। তাজ পকেটে থেকে ফোন বের করে তিফাজ চৌধুরীর ফোন দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো।
ফারিসতা বসে বসে গল্পের বই পরছিলো তখন ফোনের সাউন্ড পেয়ে পিছু ঘুরতে তাজকে দেখে ঠোঁটের কোনো হাসি ফুটে উঠলো। ফারিসতা হাসি মুখে সোফা থেকে উঠে তাজের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাজের হাত থেকে এপ্রন নিতে নিতে বলল, আসার আগে ফোন করলেন না যে? ফোন করলে আগে রেডি হয়ে থাকতাম।
তাজ ইশারায় ফারিসতাকে চুপ থাকতে বলে ফোন রিসিভ করে আরেক হাত দিয়ে ফারিসতাকে টেনে নিয়ে একপাশ থেকে বাহুডোরে আগলে নিলো। তাজ ফারিসতাকে বাহুডোর আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হ্যালো বলতে ওপাশ থেকে তিফাজ চৌধুরী বিচলিত হয়ে বলে উঠলো,
ফারিসতার মা এক্সিডেন্ট করেছে।
তিফাজ চৌধুরীর কথা শ্রবণ হতে ফারিসতার মাথায় হাত বুলায়ে দিতে থাকা হাতটা সহসা থেমে গেলো। তাজ একবার ফারিসতাকে অবলোকন করে কণ্ঠে খাদে নামিয়ে বলল, কি বলছো? আমিতো কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভারকে দিয়ে ঠিক ভাবে পাঠিয়েছিলাম।
মালবাহী ট্রাক এসে গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। ড্রাইভার সহ ফারিসতার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করছি তুমি জলদি চলে আসো রাখছি আমি এ বলে তিফাজ চৌধুরী ফোন কেটে দিলো।
তিফাজ চৌধুরী ফোন কাটতে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো তাজের। তাজ চট করে তাকালো ফারিসতার দিকে যে ওর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ফারিসতার গভীর চোখের চাউনি দেখে তাজের মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো।
তাজের হাসিখুশি মুখটা হুট করে এমন শুকিয়ে যেতে দেখে ফারিসতার মুখের হাসিও বিলীন হয়ে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। ফারিসতা যথাসম্ভব নিজেকে সামলে তাজের উদ্দেশ্যে বলল,
কি হয়েছে? এরকম লাগছে কেনো আপনায়? কাকে ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়েছেন?
ফারিসতার প্রশ্নে তাজের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। কিভাবে এই মেয়েটাকে বলবে ওর মা এক্সিডেন্ট করেছে? মেয়েটা এই খবর শুনলে নিজেকে সামলাতে পারবে? ওতো খুব ভালো করে জানে এই মেয়েটার জীবনে ওর মা কি জিনিস। কিভাবে সামলাবে মেয়েটা? ওতো বলেছিলো কখনো ফারিসতার চোখে এক ফোটা পানি ঝড়তে দিবে না, কোনো কষ্ট ওকে স্পর্শ করতে দিবে না তাহলে কেনো নিজের কথা রাখতে পারলো না? এই মেয়েটার চোখের এক ফোটা অশ্রুও যে ও সহ্য করতে পারবে না।
কি হলো কথা বলছেন না কেনো?
ফারিসতার ঝাঁকানিতে তাজের হুঁশ আসলো। তাজ জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ফারিসতার দুই গালে আলতো করে হাত রেখে ধেয়ে আসা গলায় বলল, আমার কথা মন দিয়ে শোনো। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজের শক্তি হারাবে না। তুমি যথেষ্ট স্ট্রং একটা মেয়ে তাই কোনো পরিস্থিতিতে আমি তোমাকে ভেঙে পড়তে দেখতে চাই না। আমি সবসময় দেখতে চাই আমার ফারিসতাকে স্ট্রং রূপে দেখতে। একটা জায়গায় তোমায় নিয়ে যাবো কোনো প্রশ্ন করবে না।
তাজের এমন কথায় ফারিসতার অস্থির মন আরো অস্থির হয়ে পড়লো। মনের ভিতর হানা দিতে লগলো একের পর এক শঙ্কা। ফারিসতা অস্থির চিত্তে বলে উঠলো, কিছু কি হয়েছে? বলুননা কি হয়েছে।
তাজ ফারিসতার প্রশ্নের জাবাব না দিয়ে ফারিসতাকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে চলো আমার সাথে এ বলে ফারিসতাকে ছেড়ে দিয়ে ওর হাত মুঠোয় নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে নামতে লাগলো। নিচে নামার প্রতিটি কদমে ফারিতার বুকের ভিতর অজানা আশঙ্কা বার বার কেঁপে উঠছে। তাজের কথার কোনো মানেই বুঝতে সক্ষম হলো না মেয়েটা। কি ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা বলেছে উনি? ভাবতে ভাবতে তাজের সাথে নিচে নামতে তাজের কথায় হুঁশ আসলো।
যেয়ে গাড়িতে ওঠো আমি আসছি এ বলে ফারিসতার হাত ছেড়ে দিলো।
ফারিসতা তাজের দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়ে কোনো প্রশ্ন না করে ধীর পায়ে বাহিরে চলে গেলো।
ফারিসতা যেতে তাজ তাহমিনা বেগমের কাছে যেয়ে ফারিসতার মায়ের এক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে জানালো সবাইকে নিয়ে আস্তে ধীরে হসপিটালে যেতে। আপাতত ও ফারিসতাকে নিয়ে যাচ্ছে। এখন সবাই এক সাথে গেলে ও আরো ভয় পেয়ে যাবে এ বলে তাজ তাহমিনা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে ফারিসতাকে নিয়ে বাইকে উঠে বসে বাইক নিয়ে ছুটলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। চারেদিকে মাগরিবের আজান পড়েছে সবে তাই রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা। তাজ ফারিসতাকে শক্ত করে ধরে বসতে বলে বাইকের স্প্রীড একটু বাড়িয়ে দিলো কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলো না হুট করে কোথা থেকে একটা ট্রাক এসে সজোরে বাইকে ধাক্কা লাগিয়ে দেওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগে বাইক সহ ছিটকে এক মাথায় যেয়ে পড়লো ফারিসতা আরেক মাথায় যেয়ে পড়লো তাজ।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন
হ্যাপি রিডিং…