হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব-৫০+৫১

0
616

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৫০
পিনপতন নিরবতার মাঝে হঠাৎ তীব্র চ’ড়ের শব্দে মুখোরিত হয়ে গেল চারপাশ।শামিম অবাক হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।আজ এতো বছরের সংসার জীবনে মিথিলা আর তার কোনদিন ঝগড়া হয়নি।মিথিলা খুবই স্বামিভক্ত একজন মহিলা।শামিম যা বলতেন তিনি তাই করতেন।আজ সেই মিথিলা নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামির গায়ের হাত তুলেছেন।তাও এতোগুলো মানুষের সামনে।শামিম সাহেব অবাক কণ্ঠে বলেন,’ এটা তুমি কি করলে মিথু?’

মিথিলার চোখে মুখে তীব্র রাগের আভা ছড়িয়ে পরেছে।ক্রোধে ফেটে পরছেন তিনি।শামিমের কথা শুনে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন,’ চুপ একদম চুপ।কোন কথা বলবি না তুই।’

শামিমের আত্মা কেঁপে উঠল মিথিলার এমন ক্রোধান্বিত কণ্ঠ শুনে।এই মিথিলাকে তিনি চেনেন না।শামিম কাঁপা গলায় বলে,’ মিথু তুমি….’

মিথিলা রাগে থরথর করে কাঁপছেন।তিনি বলেন,’ আমায় আর কিছু বলবি না তুই।তোর মতো মানুষের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।লজ্জা করছে না তোর?একটুও কি লজ্জা করছে নাহ?আরে তোর এই জঘন্য কির্তীকালাপ শুনে তো ঘৃ’নায় আমার নিজেরই ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।আরে সবাই ভাবে আমি নাকি একজন খারাপ মানুষ।কিন্তু তুই তো আমার থেকেও নিকৃষ্ট রে।এতোদিন ভালো সাজার এতো নিখুঁত অভিনয় করে গিয়েছিস আমাদের সাথে।আজ তোর এই মুখোশের আড়ালে এমন জঘন্য রূপ আছে তা জায়ান আমাদের না জানালে তো আমরা জানতেই পারতাম নাহ।কি করে পারলি রে তুই?ইরা মেয়েটা নাহয় পরের মেয়ে।তাকে শুধু স্বার্থের লোভে বিয়ে করেছিস।কিন্তু আরাবী তো তোর নিজের জন্মের সন্তান।তোর রক্ত ও?কিভাবে ওর সাথে এমন করতে পারলি? তোর আহানা তোর মেয়ে হলে তো আরাবীও তো তোর মেয়ে।তাহলে কিভাবে পেরেছিলি ওই সদ্য জন্মানো বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলার কথা বলতে?বুক কাঁপেনি তোর একবারও?এতোটা পাষাণ তোর হৃদয়।আমার তো নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছে।যে তোর মতো জা*নোয়ারকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।’

মিথিলা বেগম শেষের কথাটুক বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। কষ্টে তার বুকে চি’রে যাচ্ছে।সাথি আর মিলি বেগম গিয়ে উনাকে ধরলেন।মিলি বেগম বলে উঠেন,’ আপা শান্ত হন।কাঁদবেন না আপা।’
‘ ভাবি…ভাবি ও কি করে পারল এমন করতে।আমার কষ্ট হচ্ছে ভাবি।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমি সহ্য করতে পারছি না ভাবি।’

মিথিলা বেগম লুটিয়ে পরলেন সাথি বেগমের বুকে।সাথি আর মিলি দুজনে তাকে ধরে সোফায় নিয়ে বসালেন।আহানা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শামিমের কাছে।শামিম ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।যতো যাই হয়ে যাক না কেন?তিনি যতোই খারাপ হোক না কেন? তবে একটা চিরন্তন সত্য যে তিনি মিথিলা আর আহানাকে অনেক ভালোবাসেন।আজ সেই প্রিয়তমা স্ত্রী আর নিজের সন্তানের চোখে নিজের জন্যে এতো ঘৃনা তিনি সহ্য করতে পারছেন না।বুকে ব্যথা করছে তার।মাথাটা ভণভণ করছে।আহানার চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে।ও কান্নারত কণ্ঠে বলে,’ আগে আমি সবাইকে গর্ভে বুক ফুলিয়ে বলতাম আমার বাবা পৃথিবীর বেস্ট বাবা।শতো কোটিবার তোমার বুকে মাথা রেখে বলেছি,আই লাভ ইউ বাবা। ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।কিন্তু আজ তোমার সম্পর্কে জেনে আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।আসলে তোমার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বিধছে। আজ শুধু এটুকুই বললাম আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ বাবা।ইউ আর দ্যা ওয়ার্স্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

আহানা দৌড়ে চলে গেল।আহানা প্রতিটি বাক্য ধা’রাল ছু’ড়ির ন্যায় আ’ঘাত করেছে।তার মেয়ে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা বলে গেল।তিনি সত্যিই তো পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা।তিনি যা করেছেন একজন বাবা তা কোনদিন করতে পারেন না।শামিম সাহেব তাকালেন আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।তবে সেই দৃষ্টিতে যে এক সমুদ্র ঘৃ’না মিশে আছে তা খুব ভালোভাবে জানেন তিনি।আরাবীর মুখশ্রীটা ভালোভাবে দেখলেন তিনি।ওই ছোট্ট মুখখানটায় কি প্রগাঢ় মায়া।মেয়েটা তার দেখতে একদম ইরার মতোই হয়েছে।ইরার চেহারাটাও এমন মায়ায় পরিপূর্ণ ছিল।সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটা তার রক্ত।তার সন্তান।এই সন্তানকেই কিনা তিনি বলেছিলেন মে’রে ফেলতে।কিভাবে নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে পেরেছিলেন?আজ তার বুকটা বড্ড হাহাকার করছে।আরাবীর মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু তা যে অসম্ভব। শামিম সাহেবের বুকে ব্যথাটা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে।এতো এতো মানুষের ঘৃনিত দৃষ্টি তিনি নিতে পারছেন নাহ।পারছেন না তিনি।
_____________

জায়ান তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তমা স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে জায়ান।আরাবীর কাছে গিয়ে ওর নরম গালজোড়া স্পর্শ করল।আরাবী নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল।ওই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই কলিজাটা ধ্বক করে উঠল জায়ান।আরাবীকে এই অবস্থায় কোনোদিন দেখেনি জায়ান।এতো নির্বিঘ্ন, অনুভুতিশূন্য আর নিষ্প্রাণ হয়ে থাকার মতো মেয়ে তো আরাবী না।তবে আজ কেন ও এইভাবে আছে?মেয়েটা কি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেল?কিন্তু জায়ান তো চায় আরাবী কাঁদুক।কেঁদে কেঁদে ওর বুক ভাসিয়ে দিক।কেঁদে নিলে মনটা হালকা হয়।কিন্তু এমন নিষ্প্রাণ হয়ে থাকলে তো মেয়েটা ভীতরে ভীতরে গুমরে ম’রে যাবে।জায়ান শুকনো ঢোক গিলল।নরম গলায় বলে,’ কি হয়েছে আরাবী?’
‘ কোথায় কি হয়েছে?’ আরাবীর শীতল কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠল জায়ানের।জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
‘ কিছু বলছ না কেন?’
‘ কিছু কি বলার ছিল আমার জায়ান?’

জায়ান অবাক হচ্ছে আরাবীর এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে।আরাবী ফের বলে,’ আমার ভালো লাগছে না জায়ান।আমি রুমে যাচ্ছি।এই তামাশা শেষ হলে আপনিও এসে পরুন জলদি। ‘

এই বলে আরাবী ধীরে কদম বাড়াল কক্ষের যাওয়ার জন্যে।সিড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় মাথা ঘুরে উঠল আরাবীর।তাও নিজেকে সামলে নিল।জায়ান আরাবীর টালমাটাল পরিস্থিতি দেখে দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।এদিকে আরাবী দু ধাপ সিড়ি না পেরোতেই আবারও ওর মাথা ঘুরে উঠল।এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না আরাবী।শরীরের ভাড় ছেড়ে দিতেই ঝুকে গিয়ে বারি খায় সিড়ির রেলিংয়ে।নিচে গড়িয়ে পরার আগেই জায়ান দ্রুত আরাবীকে টেনে নিজের বুকে আগলে নেয়।আরাবীকে বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরে সিড়িতেই বসে পরে জায়ান।তারপর আরাবীর গালে হালকা চর মেরে অনবরত ডেকে চলেছে সে,’ আরাবী?আরাবী কি হলো তোমার?চোখ খুলো আরাবী?’

ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীকে এমন অবস্থায় দেখে দ্রুত এগিয়ে যান।ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন,’ জায়ান। তুমি দ্রুত আরাবীকে রুমে নিয়ে চলো।আমি দেখছি ওর চেক-আপ করে।চলো বাবা।’

জায়ান ডা.রোজির কথা শুনে দ্রুত আরাবীকে কোলে তুলে নিল।ডা.রোজি আবার বলে,’ ইফতি তুই যা জায়ানের গাড়ি থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়।’
‘ হ্যা আন্টি যাচ্ছি।’

ইফতি ছুটে চলে গেল বাহিরে।জায়ান আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।আরাবীকে নিয়ে রুমে চলে গেল।রুমে এসেই বিছানায় সুইয়ে দিল আরাবীকে।ততক্ষনে ইফতি ব্যাগ নিয়ে এসেছে।ছেলেটা হাপাচ্ছে।যেই জোড়ে দৌড়ে গিয়েছে আর এসেছে।জায়ান আরাবীর হাত ধরে বসল বিছানার পাশে।চিন্তায় ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।অস্থির কণ্ঠে ও বলে উঠল,’ আন্টি?ও এইভাবে সেন্সল্যাস হলো কেন? কোন খারাপ কিছু হবে না-কি আন্টি?ওর মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে আন্টি। দ্রুত রক্ত থামান।’

ডা.রোজি জায়ানকে শান্ত হতে বললেন।তারপর ব্যস্ত হাতে আরাবীর মাথায় আঘাতের জায়গা পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।এরপর ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে আরাবীর চেক-আপ করতে লাগল। চেক-আপ শেষ হতেই জায়ান অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে আন্টি?খারাপ কিছু?ওর জ্ঞান ফিরছে না কেন?কিছু বলছেন না কেন আন্টি?’

ডা.রোজি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ প্রেসার লো আরাবীর।রক্তশূন্যতাও আছে।আর হঠাৎ করে মানষিকভাবে আঘাত পাওয়ার কারনেই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেল।ডা.রোজির আবারও একটা কথায় যেন কলিজা শুকিয়ে আসল ওর।তিনি বলেন,’ এইগুলো ছোটো ছোটো কারন বললাম। এর থেকেও বড় কারন আছে।ওর এইভাবে অসুস্থ হওয়ার পিছনে।’

জায়ান কাঁপা গলায় বলে,’ কি হয়েছে আন্টি?কি এমন কারন?’

হঠাৎ ডা. হোসনে আরা রোজি মুঁচকি হাসলেন।হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ আরাবী মা হতে চলেছে জায়ান।আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় কারন।ইউ টু আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস।’

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৫১
কথায় আছে না দুঃখের পর সুখ আসে।তেমনটাই ঘটেছে সাখাওয়াত ভিলাতে।এতো দুঃখজনক ঘটনা জানার পর আরাবী মা হবে এই খুশির খবরটা যেন সেই দুঃখটুকুকে ছায়ার মতো ঢেকে দিয়েছে।সবার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পরছে।নূর খুশিতে চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে বলে,’ আমি ফুপি হবো।আমি ফুপি হবো।উফ,উফ,এতো খুশি লাগতেছে।’

ফাহিম সবার দিকে তাকাল।কেউ এদিকে তাকিয়ে নেই।এই সুযোগে ফাহিম নূরের কানে ফিসফিস করে বলে,’ মামিও কিন্তু হচ্ছো সেই সাথে।ভুলে গেলে?’

নূর লাফানো থামিয়ে দিল ফাহিমের কথা শুনে।তারপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল।আলিফা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।যাক ওর কথাটাই ঠিক হলো। ইফতি আলিফার সেই মনো মুগ্ধকর হাসি দেখে নিজেও হাসে।সাথি বেগম,মিলি বেগম, লিপি বেগম তিনজন মিলে কোলাকুলি করে নিলেন।নিহান সাহেব,মিহান সাহেব আর জিহাদ সাহেবের ক্ষেত্রেও একই।

‘ দাদি হবো।’ সাথি বেগম বললেন।তা শুনে
মিলি বেগম হেসে বলেন,আমিও তো দাদি হচ্ছি ভাবি।’
‘ হ্যা রে।’
‘ আমি নানু হবো।’ লিপি বলেন।

‘ আমি দাদা।মিহান তুইও।আর জিহাদ সাহেব আপনি নানা হবেন।’ বললেন নিহান সাহেব।হাসি যেন সরছেই না তার অধর থেকে।

ফাহিম আর ইফতি কোলাকুলি করল।ফাহিম বলে,’ মামা হচ্ছি।’
‘ আমি চাচ্ছু।’

নূর আর আলিফার ক্ষেত্রেও এক।তারাও আনন্দ প্রকাশ করছে।ডা.রোজি সবাইকে এতো আনন্দিত দেখে তিনি হাসি মুখে বলেন,’ তা এতো খুশির একটা সংবাদ জানালাম আপনাদের।মিষ্টি খাওয়াবেন নাহ?’

সাথি বেগম দ্রুত মাথা নারেন,’ হ্যা হ্যা এইতো আমি যাচ্ছি।নিজ হাতে বানাবো মিষ্টি।চল মিলি।’
‘ আমিও আসি ভাবি।’ লিপি বেগম বলে উঠেন।সাথি বেগম আর না করলেন নাহ।হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন।তারা তিনজন মিলে চলে গেলেন রান্নাঘরে।ডা.রোজি তাকালেন জায়ানের দিকে।তারপর মুঁচকি হেসে বলে উঠেন,’ সবাই নিচে যাই আমরা।আপাততো আরাবীকে বিশ্রাম নিতে দেই।ওর শরীর অনেক দূর্বল।’

‘ হ্যা হ্যা অবশ্যই।আসুন আন্টি। আপনার ব্যাগটা আমায় দিন।’ কথাগুলো বলে ইফতি ডা.রোজির ব্যাগটা নিয়ে নিচে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।আলিফাকেও ইশারা করল আসার জন্যে।তাই আলিফাও ইফতির পিছু পিছু যাচ্ছে।এরপর একে একে সবাই চলে গেল।সবাই চলে যেতেই ডা.রোজি উঠে দাঁড়ালেন।জায়ানের কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রাখলেন।জায়ান কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।কোন নড়চড় নেই ওর মাঝে।ডা.রোজি ধীর আওয়াজে বলতে লাগলেন,’ বাবা হচ্ছো জায়ান।এখন থেকে আরাবীর প্রতি আরোও যন্তশীল হতে হবে তোমাকে।ওর খেয়াল রাখবে ভালোভাবে।এই সময়ে তোমার সাপোর্টই ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।আর যেই পরিস্থিতিতে দিয়ে আজ ও গিয়েছে।তাতে ও অনেক কষ্ট পেয়েছে,মানুষিক আঘাত পেয়েছে।ওকে তোমাকেই সামলাতে হবে।একমাত্র তুমিই পারবে আরাবী আর তোমাদের সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনতে।তোমার হাতেই সবকিছু।আর বাদ বাকি যা হবে বাকিটা উপর-ওয়ালার ইচ্ছা।আসি তাহলে জায়ান।ওর পাশেই থেকো।জ্ঞান ফিরলে কিছু ফল খাইয়ে দিও।আর হ্যা ফলটা গ্লিসারিন যুক্ত পানিতে দশ মিনিট ভিজিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে তারপরেই ওকে খাওয়াবে।’

ডা.রোজি জায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। জায়ান ডা.রোজিকে যেতে দেখেই তাকাল আরাবীর দিকে।তারপর আবার আরাবীর পেটের দিকে তাকাল।ওর সারা শরীর কাঁপছে।জায়ান অনেক কষ্টে ওর কাঁপা হাতজোড়া নাড়িয়ে আরাবীর শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল।তারপর আরাবীর ফর্সা উদরে কাঁপা হাতটা রাখতে ওর শরীরটা ঝংকার দিয়ে উঠল।অদ্ভুত শিহরণে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে জায়ানের।এ কেমন অনুভুতি? বাবা হবার অনুভুতি কি সত্যিই এতো সুখের?জায়ান চোখ বন্ধ করল।ওর চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরল একফোটা তপ্তজল।জায়ান দুহাতে মুখ ঢেকে নিল।কিয়ৎক্ষণ এইভাবেই রইল।তারপর হুট করে আরাবীর পাশে শুয়ে পরল।তারপর দু হাতে আরাবীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।এলোপাথাড়ি আরাবীর মুখশ্রী জুড়ে অধরজোড়ার উষ্ণ স্পর্শে ভড়িয়ে দিলো।এরপর আরাবীর ঘারে মুখ গুজে দিলো জায়ান।বিরবির করে বলতে লাগল,’ থ্যাংকিউ আরাবী।থ্যাংকিউ সো মাচ।আমায় এতো বড় একটা উপহার দেওয়ার জন্যে।ভালোবাসি আরাবী।তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমার হৃদয়ের বাগানে একমাত্র ফুল হলে তুমি। আমার কাঠগোলাপ।তোমাকে আমি আমার এই বুকে আজীবন আগলে রাখব।’

একটু থেমে আবারও বলে জায়ান,’ তুমি আমার শুরু, তুমি আমার শেষ,
তুমি আমার ভালোবাসার সুখের যত রেশ।’
___________
শামিম সাহেব নিজের জন্যে বরাদ্ধ করা রুমের ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।তার পাপের ফল যে তিনি এভাবে ভোগ করবেন কোনোদিন ভাবতে পারেননি তিনি।লোভে পরে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে।দিনের পর দিন ভালোবাসার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ঠকিয়ে গিয়েছে।আরেকজনকে ভালো না বেসেও মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করে গিয়েছে।প্রতিটি মুহূর্তে তার বিশ্বাস তার ভরশা নিয়ে ছেলেখেলা করেছে।শেষ মেষ নিজের সন্তান নিজের অংশকেও মৃ’ত্যুর মুখে ফেলে দিয়েছিল।একবারও তার বুক কাঁপেনি এমন জঘ’ন্য কাজ করে।মানুষ অপরাধ করে কোনোদিন অপরাধ স্বিকার করে না।যতোক্ষন পর্যন্ত না তার প্রায়েশ্চিত্ত বোধ হয়।অনুশোচনা না হলে কেউ-ই তা অপরাধ এতো সহজে মেনে নেয় না।তিনি স্বিকার করেছেন।স্ব-ইচ্ছাতেই স্বিকার করে নিয়েছেন নিজের অপরাধ।কারন তিনি অপরাধবোধে ভুগছেন।তিলে তিলে মর’ছেন অপরাধবোধে।তাও আজ থেকে না বিগত বিশটা বছর ধরে।আর আজ থেকে এই অপরাধবোধের মাত্রা আরোও বেড়ে গিয়েছে।যখন থেকে জেনেছে আরাবীই তার সেই সন্তান।যেই সন্তানের অস্তিত্বই তিনি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।তার সেই ফেলে দেওয়া সন্তানকেই অন্য একজন সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন।এতোটা বছর বাবা মায়ের আদর,স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন।এতো ভালো একটা পরিবার দেখে বিয়েও দিয়েছেন।আর তিনি কি করলেন?জন্মদাতা পিতা হয়ে কিছুই করতে পারলেন নাহ।কিছুই না।তার দু দুটো মেয়ের চোখে আজ তিনি ঘৃ’নার পাত্র।অবশ্য সে তো ঘৃৃনারই যোগ্য।কারও ভালোবাসা তিনি ডিজার্ব করেন না।তার সবচেয়ে আদরের মেয়ে তার কলিজার টুকরো তাকে আজ ভালোবাসি বাবা বলার বদলে ঘৃ’না করি বাবা বলে গিয়েছে।আর আরেক সোনার টুকরো মেয়ের মুখে তো এখনও বাবা ডাকটাও শুনতে পাননি তিনি।আর কোনোদিন শুনতেও পারবেন নাহ।এটা তো আশা করাও তার জন্যে অপরাধ।এইসব ভাবছেন শামিম আর জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছেন।সে নিশ্বাস নিতে পারছে না।মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ বিশাল ওজনের পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।এই ওজন তিনি নিতে পারছেন নাহ।তার বুকে ব্যথা করছে প্রচন্ড ব্যথা।অশহনীয় ব্যথা।তিনি মুক্তি চান এই ব্যথা থেকে।এই যন্ত্রনা থেকে।তিনি দুহাতে বুকের বাঁম পাশটা খামছে ধরলেন।যন্ত্রণা হচ্ছে এখানটায়।এতো মানুষের ঘৃনা নিয়ে তিনি বাঁচতে পারবেন না।তিনি বেঁচে থাকতেও চাননাহ।তিনি ঘুমোতে চান।শান্তির ঘুম।চিরনিদ্রায় যেতে চান।যেই নিদ্রা কোনোদিন ভঙ্গ হবে না।যেই নিদ্রা থেকে কেউ তাকে জাগাতে পারবে না।শামিম সাহেবের বুকের ব্যথাটা আরও বাড়তে লাগল।তীব্র ব্যথায় তিনি কুকিয়ে উঠলেন।শরীর মুচড়ে উঠল।সহ্য করতে না পেরে তিনি একহাত দিয়ে ফ্লোরে থা’প্পড় মারতে লাগলেন ক্রমাগত।এতো যন্ত্রণার মাঝেও তার অধর জুড়ে হাসি। কারন সে যে জানে তার সময় এসে পরেছে চিরনিদ্রায় যাওয়ার।আস্তে আস্তে শামিম সাহেবের নিশ্বাস কমে যেতে লাগল।চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো তার।তিনি গভীর শ্বাস নিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠলেন,’ আ..আমায় ক্ষমা করো ইরা।আ..মাকে ক্ষমা করো মিথিলা।আমাকে তোমরা ক্ষমা করিও আহানা,আরাবী।ক্ষ…মা.. ক..রে দিও।’

এই কথাগুলো বলে শেষ করতেই তার নিশ্বাস থেমে গেল।তার দেহের প্রাণপাখি সবার চোখের আড়ালে পারি জমালো অন্য এক জগতে।শুধু পরে রইল নিষ্প্রাণ এক দেহ।
__________
ঘুমের ঘোরে নিজের দেহের ওপর কারো অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে। পিটপিট করে নয়নজোড়া মেলে তাকাল আরাবী।জোড়ে জোড়ে কয়েকটা শ্বাস নিলো।শক্তপোক্ত লম্বাটে দেহটা দেখেই বুঝার বাকি নেই লোকটা তার স্বামি তার জায়ান।আরাবীর ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে হাসি ফুটে উঠল।দূর্বল হাতজোড়া রাখল জায়ানের চুলের ভাজে।আলতোভাবে জায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।লোকটা কিভাবে তাকে ঝাপ্টে ধরে ঘুমোচ্ছে।যেন সে কোথাও পালিয়ে যাবে আর জায়ান তাই ওকে নিজের সাথে ধরে বেধে রেখে দিয়েছে।হঠাৎ করে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো মনে পরতেই আরাবীর ঠোঁটের হাসি উধাও হয়ে যায়।নিজের জীবনের তিক্ত কিছু সত্য আজ ও জেনে গিয়েছে।ওর মা…ওর মা আর বেঁচে নেই।আর..আর শামিম?শামিম সাহেবই কিনা ওর জন্মদাতা পিতা।এতো ভালো মানুষটা যে এতোটা জঘ’ন্য, এতোটা খারাপ হতে পারে কোনোদিন ভাবতেও পারিনি আরাবী।বিগত কয়েকটাদিনে এই লোকটার ভালো মানুষী দেখে মনে অনেক শ্রদ্ধা জমেছিল ওর মনে।আজ সেই শ্রাদ্ধার পাহার একনিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে।কিভাবে পারলো সে এমনটা করতে?কিভাবে ঠকালো তার মা’কে।কিভাবে পারলো নিজেরই ঔরসজাত সন্তানকে মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করতে।না চাইতেও আরাবী আর নিজের কষ্টটুক লুকিয়ে রাখতে পারলো না।দুহাতে জায়ানের পিঠ খামছে ধরে নিশব্দে কেঁদে উঠল।
এদিকে জায়ান বক্ষস্থলের মাঝে নরম তুলতুলে দেহের কাঁপতে থাকা অনুভব করতে পেরেই ধরফরিয়ে উঠে বসল জায়ান।জায়ান আরাবীর উপর থেকে উঠতেই আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে অন্য দিকে ফিরে গেল।জায়ান ব্যাথিত নয়নে আরাবীর দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দুহাতে জোড় করে টেনে আরাবীকে বুকে আগলে নিল।ব্যাকুল কণ্ঠে বলতে লাগল,’ কেঁদো না আরাবী।কাঁদে না তো।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।কেন বুঝো না। ‘

আরাবী দুহাতে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরল।জায়ানের বুকের মাঝে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো যতোটা পারা যায়। আরাবী কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ আমার ভাগ্যটাই এতো খারাপ কেন জায়ান?আমার সাথেই কেন এমন হয়।’

জায়ান অপরাধিস্বরে বলে,’ আমি সরি আরাবী।আমার জন্যেই তুমি এতো কষ্ট পেয়েছ।আমি যদি অতীত টেনে এনে তোমার সামনে দাঁড় না করাতাম তুমি এতো কষ্ট পেতে নাহ।’

‘ আপনার কোন দোষ নেই জায়ান।আপনিই তো আমাকে আমার আসল আমির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।আমার বাবা মায়ের পরিচয়পত্র এনে দিয়েছেন।আমি নিজেই তো আপনার কাছে আবদার করেছিলাম এটার জন্যে।আপনি আমার জন্যে কি তা আমি নিজেও বলে বুঝাতে পারবো নাহ।আপনার আগমনে আমার জীবন যেন নতুন রং খুঁজে পেয়েছে। সে রঙের মহিমায় আমি সব সময় উচ্ছ্বসিত থাকি। সে রং আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা যোগায়, আত্মবিশ্বাস দেয়।’

আরাবীর নাক মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।জায়ান কিছুতেই আরাবীর কান্না থামাতে পারছে না।জায়ান এইবার না পেরে আরাবীর দু গাল শক্ত করে ধরল।আরাবীর চোখের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাঢ় স্বরে বলে,’ এতো কাঁদো কেন?এতো কাঁদলে হবে?এখন তো তুমি একা নও।তোমার মাঝেও একজন আছে।তুমি কষ্ট পেলে তো তারও কষ্ট হবে।’

আরাবী নাক টেনে কান্না থামানোর চেষ্টা করল।ফ্যালফ্যাল করে জায়ানের দিকে তাকিয়ে জায়ানের কথাটা বোঝার চেষ্টা করল।বিষয়টা বুঝতে পেরেই চোখ বড় বড় করে তাকাল।তবে কি জায়ান জেনে গিয়েছে? কিন্তু কিভাবে জানল?আরাবী কাঁপা গলায় বলে,’ আপনি…মানে… আমি…!’

‘ হ্যা আরাবী আমাদের সন্তান আসতে চলেছে।তুমি মা আর আমি বাবা হবো আরাবী।আমাদের পুচকে একটা বেবি হবে।যার ছোটো ছোটো হাত পা হবে।মায়াবী,আদুরে মুখশ্রী হবে।আমাকে বাবা আর তোমাকে মা বলে ডাকবে আরাবী।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আরাবী আমাকে এই সুখের সাথে পরিচয় করার জন্যে।ভালোবাসি আরাবী।ভালোবাসি আমার কাঠগোলাপ।’
#চলবে___________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।