#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
দীর্ঘ দুইঘন্টা পানিতে ভেজার দরুণ সন্ধ্যা হতে না হতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর নামল মৃধার। মাথা ব্যাথায় যেন মাথা ছিড়ে যাবে এমন অনুভূতি হলো যেন। এই অসহ্য যন্ত্রনা নিয়েই মৃধা চাদর জড়িয়ে অনেকটা ক্ষন শুঁয়ে থাকল। কিন্তু ঘুম নামল না চোখে। উল্টো চোখ জ্বলছে। মৃধা অবশেষে জ্বরের উপরই বিরক্ত হয়ে শোয়া ছেড়ে উঠে বসল। তখনই চোখের সামনে দেখা মিলল লম্বা চওড়া নিশীথের। তার দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মৃধা নজর সরাল। তখন তার নাকে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর এখনই আবার মুখোমুখি হলো দুজনে। মৃধার এই পর্যায়ে হঠাৎ ই লজ্জা লাগল। আড়ষ্টতায় কেন জানিনা নিশীথের মুখোমুখি না হতে চেয়ে পুণরায় চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।মুহুর্তে বন্ধ করল চোখজোড়াও।যেন সে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে৷ নিশীথ হাসতে চেয়েও হাসল না যেন। শুনিয়ে শুনিয়ে শুধাল,
“ আমায় দেখে মানুষ আজকাল ঠাস করে ঘুমিয়েও পড়ছে! আশ্চর্য! আমি কি ঘুমের ঔষুধ হয়ে গেলাম নাকি ভাই? ”
মৃধা চোখ বুঝে থাকলেও কথাটা সম্পূর্ণই তার কানে গেল। মুহুর্তেই একটু আগের লজ্জা ভুলে গিয়ে ধপ করে জ্বলে উঠল যেন। চোখ জোড়া খুলে নিয়ে চঞ্চল গলায় বলে উঠল,
“ তোর মুখ দেখে ঘুম চলে আসার মতো কোন কারণ নেই ভাই! উল্টে ঘুম হারাম হয়ে গেলে সেটা নাহয় কথা হতো ভাই! ”
আবারও ভাই ডাক। নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে চাইল। সরাসরি প্রতিবাদ না করে বরং বেশ ভাব নিয়ে বলল এবারে,
“ এটাই তো! আমার মুখ এত সুন্দর যে মেয়েদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে বইন। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস। ”
‘বইন’ ডাকটা নিশীথ ভাই ডাকের বিপরীতেই শুধাল। অথচ তাতে কিচ্ছু আসল গেল না মৃধার। বরং মেয়েদের প্রসঙ্গে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শুধাল,
“ তো কি নাচব? নাকি ওদের গিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে আসব আমি?”
“ দিয়েও আসতে পারিস। বইন না তুই আমার? ”
মৃধা এবারেও বোন ডাকের প্রতিবাদ করল না। বরং বলল,
“ ওকে, এবার চোখের সামনে থেকে যা। ঘুমোতে দে। ”
নিশীথ হতাশ হয়ে শুধাল,
“ খাবার খেতে ডাকছে আম্মু আব্বু। খেতে আয়।”
মৃধা মুখচোখ কুঁচকাল। শরীর ভালো লাগছে। এই অবস্থায় খেতেও মন চাইছে না তার। এই নিয়ে নিবির নীলাদ্রী দুই তিনবার ডেকে গিয়েছে। মৃধা প্রতিবারই বলেছে সে খাবে না। একটু আগে নিশীথের মা কে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলেও এসেছে। তাই তো শুধাল,
“ খাব না নিশীথ। আন্টিকে বলে এসেছি আমি।”
“ কিন্তু আব্বু মানবে না। আসতে বলেছে মানে তোকে খাবার খেতেই হবে। ”
“ ঠিকাছে। আমি আঙ্কেলকে বলে আসি। ”
কথাটা বলেই মৃধা এক মুহুর্ত ব্যয় না করে রুম ছেড়ে বের হলো। পরমুহুর্তেই মাহমুদ সাহেবকে কি না কি বুঝিয়ে এসে পুণরায় এসে বসল বিছানায়। নিশীথ সরু চাহনি ফেলে চেয়ে থাকল। মৃধা তা দেখে হাসল। চাদর টেনে বিছানায় হেলান দিতে দিতে বলল,
“ খাব না বলে এসেছি।শোন, তোর কম্বল নেই? এই চাদরে শীত মানছে না তো। ”
“ আছে। আগে বল, আব্বু কি বলেছে? ”
মৃধা হেসে শুধাল,
“ আমি আঙ্কেলকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে এসেছি। অর্থ্যাৎ, না খেলেও কিছু হবে না।”
নিশীথ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“বাহ! গুড গার্ল! ওদিকে তোর বাপ মায় যদি বলে আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে না খাইয়ে মেরে ফেলছে। ”
মৃধা আনমনে বলে উঠল উত্তরে,
” তুই তো ইচ্ছে করে আনিসনি নিশীথ। তোর উপর আমার বাবা মা আর আঙ্কেল মিলে তুলে দিয়েছে দায়িত্বটা। তাই তোকে দোষারোপ করার প্রশ্নই আসে না। তুই নিশ্চিন্তে থাক। ”
উত্তরটা কেন জানিনা পছন্দ হলো না নিশীথের। কন্ঠটা গম্ভীর হলো আগের থেকে। উত্তরে জবাব দিল দৃঢ় আওয়াজে,
“ উঠে বস, খাবার আনছি মৃধা। ”
মৃধা ফের উত্তরে বললাম,
“ খাব না তো। ”
“ কেন খাবি না? ”
“ ইচ্ছে হচ্ছে না তাই। ”
নিশীথের বোধহয় রাগ হলো। এক টানে মৃধার হাতটা ধরে সোজা করে বসাতে বসাতেই বলল,
“ ঢং করবি না, উঠ বলছি! ”
কথাটা বলতে বলতেই খেয়াল হলো মৃধার শরীর গরম। তাপমাত্রা বেড়েছে বোধহয়। নিশীথ পরখ করে দেখার জন্য পরমুহুর্তেই কপালে হাত রাখল। উষ্ণতা বোঝার চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠল,
“ জ্বর তোর? শরীর গরম তো। ”
মৃধা নরম স্বরে বলল,
” ঐ একটু এসেছে আরকি। ”
নিশীথ এবারে ত্যাড়া স্বর প্রয়োগ করল,
“ একদম ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি। দীর্ঘ দুই ঘন্টা যাবৎ যে আমার বাসার পানি অপচয় করলি তার শাস্তি! ”
“ তুই কি অভিশাপ দিয়েছিলি তখন?”
কাঠকাঠ স্বরে উত্তর এল,
“ তোর মতো না আমি। ”
মৃধার বোকার মতো তাকাল। ভাবল সে যদি বিছানায় ঘুমায় নিশীথ কোথায় ঘুমোবে? প্রশ্ন জিজ্ঞেসের উদ্দেশ্যে ডাকল,
“ নিশীথ? ”
“ বল।”
“ আমি কোথায় ঘুমাব বুঝে উঠছি না। কাল রাতে জিজ্ঞেস করব ভেবেও জিজ্ঞেস করা হয়নি তোকে।তাই বেলকনিতে গিয়েছিলাম।”
নিশীথের এই উত্তরটাও পছন্দ হলো না।গম্ভীর কন্ঠে জানাল,
“ ভালো তো। ”
মৃধা অসহায়ের মতো তাকাল। আজ কোথায় এই প্রশ্নটাই করতে চাইছিল। তাই আবারও বলল,
“ কিন্তু আজ? ”
নিশীথ ফের গম্ভীর গলায় বলল,
“ সন্ধ্যা থেকে যেহেতু এখানেই আছিস তো এখানেই থাক৷ ”
“ তুই? ”
“ এক বিছানায় ঘুমালেই যে তোর সাথে খারাপ কিছু করে ফেলব আমি এমনটা ভাবার কারণ নেই। ”
মৃধা চাপাশ্বাস ফেলল। সে মোটেই এমনকিছু ভাবে নি। বিপরীতে বলল,
“ না, মানে তোর তো ঘুম হবে না পাশে মেয়ে ঘুমালে। ”
নিশীথ এবার হাসল মৃদু। বলল,
“ অনেক সময় ঘুম হওয়ার থেকে ঘুম না হওয়া ভালো! ”
কথাটা নিশীথ ওয়াশরুমে যেতে যেতেই বলল। মৃধা সেদিক পানে তাকিয়ে চাপাশ্বাস ফেলল। পরমুহুর্তে মনে হলো তার মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব করে। মাকে সে মিস করছে। তাইতো দেরি না করে কল লাগাল মাকে। শুধাল,
“ ঘুম আসছে না আমার আম্মু! আমার শীত করছে প্রচুর। জ্বরে মাথা ব্যাথা করছে। তোমার হাতে লেবু চা টা প্রয়োজন ছিল আম্মু!আই মিস ইউ আম্মু! আই মিস ইউ! ”
কথাগুলো অবশ্য ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর নিশীথের কানেও গেল। তারপর মা মেয়ের কথা আর না শুনে চলে গেল রান্নাঘরে। তার মাকে জিজ্ঞেস করল লেবু চা কি করে বানায়। তারপর কোনদিন কোনকিছু রান্না না করলেও আজ কাঁচা হাতে লেবু চা বানানোর চেষ্টা করল সে। অবশেষে বানাল ও। তারপর কাপে করে চা নিয়ে পা এগোল মৃধার উদ্দেশ্যে। গিয়ে চায়র কাপটা এগিয়ে ধরে বলল,
“ লেবু চা বানিয়েছি। খেয়ে দেখ তো একটু মৃধা। ”
মৃধা অবাক হলো! তার জানামতে নিশীথ রান্না পারে না। এমনকি কখনো এককাপ চাও বানায়নি। তাহলে? ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“ তোকে কি আম্মু বলেছে কল দিয়ে? ”
“ না! ”
মৃধা ততক্ষনে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিয়েছে। পরমুহুর্তেই বলে উঠল,
“ ইইইই! এত টক! তুই কি পুরো লেবুটাই দিয়ে দিয়েছিস নিশীথের বাচ্চা নিশীথ? ”
নিশীথ খুব আশা নিয়ে ছিল তার বানানো চা টা ভালো হবে। কিন্তু হলো না এটা ভেবে নিরস হলো। গম্ভীর স্বরে জানাল,
“ আমি আসলে আগে কখনো বানায়নি। ”
মৃধা হেসে বলল,
“ জানি আমি। তবুও অন্য কোন স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রে হলে আমি বলতাম, হাও কিউট! কিন্তু এটাতে বলব না। ”
“এক্ষেত্রে বিষয়টা কিউট লাগলে তো তোর মহা অপরাধ হয়ে যাবে। ”
মৃধা এবারে তর্ক করল না। উল্টো ঐ টক হয়ে যাওয়া চাতেই আরামে চুমুক দিতে দিতে বলল,
“ আম্মুকেও বলেছি। আম্মু বলেছে এক ফ্লাক্স চা বানিয়ে আনবে এক্ষুনি। ”
নিশীথ জানে মৃধার মা মৃধার জন্য কতোটা পাগল। তাই বলল
“ জানি। তোর আম্মু এক লাফ মেরে চলে আসবে এখন। ”
মৃধা আবারও হাসল। শুধাল,
“ আম্মু বলেছে আমাকে আম্মুর সাথে নিয়ে যাবে। তাহলে আর আমাদের অসুবিধাও হবে না ঘুমানো নিয়ে। কি বলিস দোস্ত?”
নিশীথ হতবাক চাহনি ফেলে চাইল যেন। বিরবির করে বলল,
“ সর্বনাশ!”
#চলবে…..