হৃদয়ে লাগিল দোলা পর্ব-২০+২১

0
247

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২০

বৃষ্টির তোড় থেমেছে এখন কিছুটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপাত হচ্ছে শুধু। মাঝেমধ্যে আশপাশ থেকে ভেসে আসছে বিকট আওয়াজের মেঘ গর্জন। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে এসব উপভোগ করছি আমি। আর একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছি আর টিস্যু দিয়ে নাক মুছচ্ছি। খানিক সময়ের ব্যবধানেই শরীরের মাঝে কেমন উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে আমার। হয়তো জ্বর এসেছে! সিজেনাল বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বর এসে পড়ে আর সেখানে তো অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজেছি। জ্বর তো আসবেই! ঠিক এই কারণেই আদ্রিশ ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করে আমায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বৃষ্টি দেখলেই আমার ভিজতে মন চায়। আর প্রতিবারই এমন জ্বরের কবলে পড়তে হয় সেইসাথে আদ্রিশ ভাইয়ার বকুনি তো ফ্রি।

ধীর পায়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করল আদ্রিশ ভাইয়া। ঘরের মৃদু বাল্বের আলোতে তার অবয়ব স্পষ্ট! তার ভাবগতি বোঝার জন্য আমি চেয়ে রইলাম তার পানে। একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে এসে ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল সে।

ধীর গলায় সে বলে উঠল

-‘ ঘুমিয়ে পড়েছিস মেহুপাখি?

আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেভাবেই শুয়ে রইলাম। মাথা ধরেছে ভীষণ তাই কথা বলার ইচ্ছে নেই এ মুহুর্তে।

তপ্ত শ্বাস ফেলে আদ্রিশ ভাইয়া পুনরায় বলল

-‘ আমি জানি তুই এখনো ঘুমাসনি। তোর মতো বিচ্ছু এতো সকাল সকাল কখনোই ঘুমাবেনা। না খেয়ে এভাবে শুয়ে থাকার কি কোনো মানে আছে আদৌও? চল ওঠ। খেতে যাবি আমাদের সঙ্গে। তোর জন্য আমরা কেউ খাইনি এখনো। তুই গেলেই আমরা সবাই খেতে বসব।

এতোটুকু বলে থামল আদ্রিশ ভাইয়া। মুখ নাড়িয়ে আমি যে একটু কথা বলব, তার শক্তিটুকুও পেলাম না। শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে আমার। বৃষ্টিতে মনে হয় অতিরিক্তই ভেজা হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে এমন জ্বরে পড়ে কাহিল হয়ে পড়েছি আমি।

আমি হতে কোনো জবাব না পাওয়ায় আদ্রিশ ভাইয়া কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে, আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকিয়ে চমকে উঠল। উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল

-‘ তোর তো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে মেহু! এই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে আমি বারবার করে নিষেধ করেছিলাম তোকে। তবুও তো শুনলিনা। আর এখন সেই জ্বর বাঁধিয়ে ফেললি! এখনের জ্বরও তো ভালো না! তোকে নিয়ে আমি সত্যিই আর পারিনা মেহরুন। মানুষ এতোটা কমনসেন্সেহীন হয় কিভাবে?

কথাটা বলতে বলতে ঘরের বাতি জ্বালায় আদ্রিশ ভাইয়া। তড়িঘড়ি করে একটা কাপড় আর বাটিতে পানি নিয়ে আবারও আমার পাশে এসে বসে। বাটিতে থাকা পানিতে কাপড়টা ডুবিয়ে, পানি ঝরিয়ে আমার কপালের উপর রাখে। জলপট্টি দেওয়াতে এখন কিছুটা ভালো লাগছে আমার। এতোক্ষণ চোখের মধ্যে জ্বালা পোড়া করছিল। এখন শীতলতা অনুভুত হচ্ছে।

নিভু নিভু দৃষ্টিতে আমি একবার চাইলাম আদ্রিশ ভাইয়ার পানে। তার চোখমুখে বিষন্নতা আর উদ্বিগ্নতায় ছেয়ে আছে কেমন! সামান্য একটু জ্বর এসেছে বলে এতোটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সে! তাহলে আমি সেদিন যে ভয়ানক স্বপ্নটা দেখেছিলাম, সেটা যদি বাস্তবে ঘটত তবে কি হতো আদ্রিশ ভাইয়ার? উনি তো মনে হয় পাগল-ই হয়ে যেত! একটা মানুষ এতোটা ভালো কিভাবে বাসতে পারে!

আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদ্রিশ ভাইয়া শীতল কন্ঠে বলল

-‘ মেহু তোর জন্য স্যুপ বানিয়ে আনব? স্যুপ খেলে একটু বেটার ফিল হবে।

কথাটা বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে যেতে নেয়, আমি হাত ধরে আটকে দিলাম তাকে। আদ্রিশ ভাইয়া পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করল

-‘ কিছু বলবি?

আমি মাথা নাড়ালাম। ধীর গলায় বললাম

-‘ আমার জন্য কষ্ট করে কিছু বানাতে হবে না ভাইয়া।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার কিছুটা বিরক্তির সহিত বলল

-‘ শেষ হয়েছে তোর কথা, এবার আমি আমার কাজে যাই? তুই এতো বেশি বুঝিস কেন, বল তো? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর তো বাঁধিয়েছিস, সেইসাথে আমার রাতের ঘুমও হারাম করেছিস। এমনিতেও তোর জন্য আমার ঠিক মতো ঘুম হয়না। তার উপর আবার তুই অসুস্থ। শোন, চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি এই যাব আর আসব।

যাওয়ার আগে রিশতাকে বলে গেল, ‘আমার খেয়াল রাখতে আর জলপট্টি দিয়ে দিতে।’

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা মতো রিশতা আমার পাশে এসে বসে জলপট্টি দিতে দিতে আক্ষেপের সুরে বলল

-‘ ইশ মেহু, তোর যে এভাবে জ্বর চলে আসবে, এ জানলে তোকে আমার সাথেই নিতাম না।

আমি হালকা হেসে ভাঙা গলায় বললাম

-‘ আরে সামান্য জ্বরে কেউ ম’রেনা রে পাগল! আদ্রিশ ভাইয়া একটু অতিরিক্তই করছে।

-‘ তুই চুপ কর তো মেহু। আদ্রিশ ভাইয়া যা করছে তোর ভালোর জন্যই করছে। তুই অসুস্থ আর সে কি বসে থাকবে নাকি? ঠিকই আছে বর বউয়ের অসুস্থতায় সেবা যত্ন করছে! আহা দেখেও শান্তি!

কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসল রিশতা। এসব কিছু হয়েছে তার জন্যই। রিশতা একটা কাজের কাজ করেছে বলে নিজেকে নিজে বাহবা দিতে থাকে। সে-ই তো আদ্রিশকে গিয়ে সব বলে দিয়েছিল। মেহরুনের মন খারাপ দেখে রিশতারও মন খারাপ হয় ভীষণ। চোখের সামনে তার বোনকে এমন মনমরা হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ভাল লাগে না তার। আর এজন্যই তো আদ্রিশের কাছে ছুটে যায় রিশতা। যদিও এসবের কিছুই জানেনা মেহরুন।

আদ্রিশ রান্নাঘরে গিয়েছে মেহরুনের জন্য স্যুপ বানাতে। ছেলে হলেও টুকটাক রান্না সে পারে। মেডিকেলে পড়াকালীন সময়টাতে সে নিজের রান্না নিজে করেই খেত। রান্না খুব বেশি ভালো না হলেও কোনোরকম চলে আরকি!

আদ্রিশকে রান্নাঘরে দেখে ভ্রু কুচকে যায় আদ্রিশের মায়ের। ছেলের কাছে এসে তিনি জানতে চাইলেন, ‘হঠাৎ রান্নাঘরে আসার কারণ।’

আদ্রিশ থমথমে গলায় জবাব দিল,

-‘ তোমার গুণধর কন্যার জ্বর এসেছে আম্মু। তাই স্যুপ বানাতে এসেছি মহারানীর জন্য।

তিনি বুঝলেন, ছেলেটা ক্ষেপে আছে ভীষণ। তবে মেহরুনের জ্বর এসেছে শুনে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। ফলে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠেন

-‘ তুই মেহুর কাছে যা। আমি স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসছি।

আদ্রিশ ফিরে তাকায় তার মায়ের দিকে। শান্ত স্বরে বলে উঠল

-‘ তুমি আর ছোটমা, সারাদিনই তো অনেক খাটাখাটনি করো। এখন না হয় আমিই রান্নাটা করি। আর তাছাড়া আমার রান্না এতো খারাপ নয় যে মুখে তুলতে পারবেনা কেউ!

আদ্রিশের কথার পিঠে তিনিও আর কথা বাড়ালেন না। ছেলে যা করতে চাইছে করুক। এতো তিনি কোনো হস্তক্ষেপ করতে চান না। মেহরুনের জন্য ইতোমধ্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন তিনি। হাজার হোক বংশের একটামাত্র মেয়ে মেহরুন। মেয়েটাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। নিজের একটা মেয়ে নেই বলে এই মেয়েটাকেই তো তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। এমনকি সারাজীবন নিজের কাছে রাখবেন বলে ছেলে বউ করে রেখে দিতে চান এ বাড়িতে। আর তাই বিলম্ব না করে ব্যাকুল মন নিয়ে ওর ঘরের পথে পা বাড়ান তিনি। তার ছেলের এমন কেয়ারিং মনোভাব দেখে হালকা হেসে ফেলেন তিনি। যাক ছেলেটা তবে ওর বাবার মতো হয়নি। তার দেওয়া আদর্শ শিক্ষায় নিজেকে গড়ে তুলেছে আদ্রিশ। ছেলের জন্যে প্রাণ ভরে দোয়া করেন তিনি। ভালো থাকুক ছেলে মেয়ে দুটো।

মায়ের প্রস্থানের দিকে একবার চেয়ে, পুনরায় নিজের কাজে মনোনিবেশ করে আদ্রিশ। মেহরুনের জন্য সে এখন থাই স্যুপ বানাচ্ছে। মেয়েটা কর্ণ স্যুপ খেতে পারেনা। তার নাকি গন্ধ লাগে। একবার খেয়ে তো ব’মি করেছিল। সেই থেকে তার কর্ণ স্যুপের প্রতি অনিহা।

আলতো করে চোখের পাতা মেলে তাকালাম। শিয়রের কাছে বসে আলতো হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মামনি। আমায় চোখ মেলতে দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন

-‘ খুব বেশি খারাপ লাগছে মা? এভাবে বৃষ্টিতে ভেজা উচিত হয়নি তোর। এই সময়ের জ্বর তো ভালো না!

আমি আর কোনো জবাব দিলাম না। শরীর ভালো নেই খুব একটা। কথা বলতে গেলেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকে মাথাটাও বেশ ধরেছে।

এরই মাঝে স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে প্রবেশ করল আদ্রিশ ভাইয়া। বেড সাইড টেবিলে বাটিটা রেখে, আমার পাশে বসল। আমার দিকে ফিরে থমথমে গলায় বলল

-‘ একা একা উঠতে পারবি নাকি আমি সাহায্য করব তোকে?

আমি একা একা ওঠার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেই ব্যর্থই হতে হলো। শরীর ভীষণ ম্যাজম্যাজ করছে। আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো বুঝল আমার অবস্থা। আমায় ধরে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল।

চোখ মুখ কুঁচকে ভাঙা গলায় আমি বলে উঠলাম

-‘ আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না ভাইয়া।

স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে, এক চামচ উঠিয়ে ফুঁ দিতে দিতে থমথমে গলায় বলল

-‘ চিন্তা নেই, আমি তোকে খাইয়ে দিব। তবে গরম গরম স্যুপ ঝটপট করে খেয়ে ফেলবি। দ্যান ওষুধ খেয়ে নিবি। এখনের জ্বর ভালো না। জ্বরকে প্রশ্রয় দিলে জেঁকে বসবে। সো দ্রুত সেরে ওঠার জন্য আমার কথামতো চলবি। খবরদার আমার কথার যেন কোনো নড়চড় না হয়।

নিভু নিভু দৃষ্টিতে আমি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তার পানে। খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও এই লোকের পাল্লায় পড়ে ঠিকই খেয়ে নিতে হবে। অগত্যা আমিও আর দ্বিমত না করে খেয়েই নিলাম। জীবনের প্রথম আদ্রিশ ভাইয়ার রান্না করা খাবার খেতে চলেছি। না জানি কেমন না কেমন স্বাদ হয়ে এইজন্যই মোচরামোচরি করছিলাম। কিন্তু না যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম, খাওয়ার পর তেমন একটা খারাপ লাগছেনা। ভালোই হয়েছে। লক্ষ্মি মেয়ের মতো তাই চুপটি করে আদ্রিশ ভাইয়ার হাতে খেয়ে নিলাম।

নিমিষেই পুরো খাবার টুকু খাওয়া হয়ে গেল আমার। তারপর ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিল আদ্রিশ ভাইয়া। মামনিও চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগেই। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে আদ্রিশ ভাইয়া বলল

-‘ খাবারটা কেমন ছিল?

চোখ বুঁজে অধরের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে ছাড়া ছাড়া ভাবে বললাম

-‘ খুব ভালো ছিল।

আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বলা হয়নি আর। যে মানুষটা আমায় ভালোবেসে আমার জন্য এতোকিছু করেছে, তার রান্না খারাপ হয় কিভাবে? আমার কাছে অমৃত ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।

আদ্রিশ ভাইয়া পুনরায় ফিসফিস করে বলল

-‘ ঘুমিয়ে পড় মেহুপাখি। চিন্তা নেই আমি আছি তোর পাশে। তবে আমার রাতের ঘুম যে কেড়ে নিয়েছিস, এর হিসেব কিন্তু আমি সুধে উশুলে নিয়ে নিব। প্রতি রাতে যদি তোমার ঘুম না উড়িয়েছি তাহলে আমার নামও আদ্রিশ খান নয়। একবার শুধু আমার বউ হয়ে নাও, তারপর বউ আর আমি দুজনের প্রচেষ্টায় প্রতিরাতই নির্ঘুম কাটবে আমাদের।

শেষোক্ত কথাটা বলেই বাঁকা হাসল সে। ততক্ষণে মেহরুন ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে বলে হয়তো শুনতে পায়নি। শুনলে নির্ঘাত লজ্জায় নুইয়ে পড়ত।

পেছন থেকে রিশতা এসে ফিচালো হেসে বলে উঠল

-‘ মেহুর দিকে আর এতো নজর দিয়েন না তো ভাইয়া। যত দেখার সব বিয়ের পর দেইখেন। এখন বেচারিকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেন।

পেছনে ফিরে রিশতার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে সে বলল

-‘ বড্ড বেশি বড় হয়ে গিয়েছিস রিশতা! বড় ভাইয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তবে তোর উপর আমি সত্যিই প্লিজড, তুই যা করলি আমার জন্য। তোর জন্যই আমার বদ্ধমূল ধারণাটা ভেঙেছে। তোর মতো বোন সবার ঘরে ঘরে হোক।

#চলবে~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২১

কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে আদ্রিশ। দুই নেত্রের মাঝে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই বললে চলে। গুরুগম্ভীর মুখশ্রীতে তার লেপ্টে রয়েছে একরাশ বিষণ্ণতা! মেহরুনের জ্বর বেড়ে ১০৪ এ গিয়ে ঠেকেছে। জ্বরের ঘোরে কিসব প্রলাপ বকছে সে। আদ্রিশ আর সেসব শোনার চেষ্টা করেনি অবশ্য। খানিক আগেই ওকে দেখে এসে নিজের কক্ষে চলে এসেছিল সে। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় নেত্রের মাঝে ঘুমের ঠাঁই মিলল না আর।

বিরক্ত হয়ে নিজের কক্ষে থাকত পারল না আদ্রিশ। মেহরুনকে দেখার জন্য মনটা কেমন যেন ছটফট করছে তার। আদ্রিশের কক্ষ থেকে অবশ্য মেহরুনের কক্ষ খুব একটা দূরে নয়। কয়েক কদম পা ফেলে তাই চলে এলো মেহরুনের কক্ষের সামনে। ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েও কি মনে করে আর করল না। আড়ালে দাঁড়িয়ে তাই নিজের প্রেয়সীকে এক ঝলক দেখে নেয় আদ্রিশ।

এতোরাতে একটা মেয়ের ঘরে যাওয়া উচিত হবে না বলে মনে করে আদ্রিশ। যতই সম্পর্কে সে চাচাতো বোন হোক না কেন! আজ বাদে কাল এ নিয়ে কথা উঠতে পারে। আদ্রিশ কখনোই চাইবেনা তার প্রেয়সীর সম্মানে কোনোভাবে আঘাত লাগুক। আর তাই তো এতো বছর ধরে নিজেকে সংযত রেখেছে সে। মেহরুনকে নিজ থেকে দূরে রাখার জন্য ধমক দিতে বিন্দুমাত্রও কার্পন্য করেনি সে। এজন্য অবশ্য সে গুমরে গুমরে মরেছে! যদিও এসব কথা একমাত্র রিশতা ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমনকি মেহরুনও সবটা জানেনা। জানতে দেয়নি আদ্রিশ।

-‘ মেহুকে এক ঝলক না দেখতে পেলে ঘুম আসছে না বুঝি, ভাইয়া?

কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে নিয়ে খানিকটা রসিকতার সহিত উক্ত কথাটা বলে উঠল রিশতা। অধরের কোণে লেপ্টে আছে তার ফিচালো হাসি।

আচমকা পেছন থেকে এমন বাক্য কর্ণকুহুরের ঠেকতেই চমকে যায় আদ্রিশ। চলে যাওয়ার পরিবর্তে ভ্রু কুচকে পেছন ফিরে তাকল সে।

তা দেখে একগাল হেসে রিশতা বলে ফেলল

-‘ আপনি কি আমার কথায় বিব্রত বোধ করেছেন ভাইয়া? না মানে একটু আধটু মশকরা করছিলাম আমি আপনার সাথে আরকি। ভাই বোন থেকে দুদিন পর শালী দুলাভাই হতে চলেছি, একটু মশকরা না করলে কি চলে বলেন তো?

আদ্রিশ মুখের ভাবভঙ্গিতে বুঝতে দিলনা যে রিশতার এমন কথায় সে সত্যিই বিব্রত হয়ে পড়েছিল একটু আগে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তাই গমগমে গলায় জবাব দিল

-‘ এখানে আবার বিব্রত বোধ করার মতো কি আছে? একজন ডাক্তার হিসেবে রোগীকে দেখতে আসাটা কি আমার দায়িত্বের কাতারে পড়ে না?

আদ্রিশের এহেন বাণিতে রিশতা বোকা বনে যায়। ভেবেছিল সুযোগ পেলেই লোকটাকে নিয়ে একটু মশকরা করে নিবে কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টে তাকাকেই বোকা বানিয়ে ছাড়ল যে। রিশতাও কম যায় না। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে, বাঁকা হেসে বলল

-‘ আমি কিন্তু আপনার ব্যাপারে সব জানি ভাইয়া। তারপরও সত্য গোপন করতে চাইছেন আপনি?

আদ্রিশ এবার কিছু সময় থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরবতা ভেঙে ধরা গলায় সে বলে উঠল

-‘ তো সব জানিস বিধায় কি এখন আমায় ব্ল্যাকমেইলও করতে চাইছিস? চাইলে করতে পারিস, সমস্যা নেই আমার তাতে। যেখানে নিজের বাবা-ই সব দায় আমার উপর বর্তাতে চায় সেখানে তুই তো সামান্য ব্ল্যাকমেইল-ই করেছিস।

আদ্রিশের কথাগুলো শুনে চোখটা ছলছল করে ওঠে রিশতার। সে তার বড় ভাই সমতুল্য মামাতো ভাইয়ের সাথে এতোক্ষণ যাবত মশকরা করছিল। এভাবে আঘাত দিয়ে তো সে কথা বলতে চায়নি। রিশতা করুণ গলায় বলে উঠল

-‘ ভাইয়া সরি! আমি আপনাকে আঘাত করে কথা বলতে চাইনি, বিশ্বাস করেন!

আদ্রিশ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চোখ বুঁজে আলতো হেসে বলে

-‘ না না আমি কিছু মনে করিনি। এমনি বললাম আরকি।

দুজনের মাঝে আবারও পিনপতন নীরবতা। হুট করে আদ্রিশ এবার কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে উঠল

-‘ রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল! তুই ঘুমাবি না রিশতা? নিশাচর প্রাণী হয়েছিস নাকি? এমন চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। মেহুর পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড় যা।

রিশতা বাধ্য মেয়ের ন্যায় কক্ষে চলে যেতে নেয়। দু কদম এগিয়ে কি ভেবে আবারও পেছন ফিরে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল

-‘ আপনি ঘুমাবেন না ভাইয়া?

রিশতার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আদ্রিশ তাচ্ছিল্য হেসে বলল

-‘ আমার আর ঘুম!

আদ্রিশকে অনুরোধ করে রিশতা বলল

-‘ এমন করবেন না ভাইয়া। আপনি শুধু শুধু কেন নিজেকে এতো বেশি কষ্ট দিচ্ছেন। বাবা ছেলের মধ্যে ওমন একটু আধটু হয়, তাই বলে আপনি এমন করবেন! আপনি তো যথেষ্ট বুঝদার, তাহলে? আর আপনার কিছু হয়ে গেলে মেহুর কি হবে, একবার ভেবে দেখুন তো?

আদ্রিশের টনক নড়ে। রিশতা ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটাকে দেখলে তো ভোলা ভালা মনে হয়। অথচ এই মেয়ে কতোটা বুদ্ধি বহন করে চলে। আমরা আসলে মানুষকে বাইরে থেকে দেখে যেমনটা ভাবি, ভেতরে ভেতরে মানুষটা হয় একেবারেই ভিন্ন। যদিও সবার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। মানুষের ভেতরের সত্তাটা তো আর দেখা সম্ভব নয়। তবে সত্যি কথা বলতে কি যে যাকে যেমন ভাবে রিপ্রেজেন্ট করে আমরা তাকে তেমনই মনে করি আসলে। এই মেয়েটার প্রতি আদ্রিশ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তার জন্যই তো আদ্রিশের একটা বদ্ধমূল ধারণা ভেঙেছিল।

আদ্রিশের ধারণা ছিল, “সে যে মেহরুনকে ভালোবাসে এটা কোনোভাবে মেহরুন জানতে পারলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আকাশে উড়তে শুরু করবে, নিজের লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়বে, এমনকি পরবর্তীতে এ নিয়ে নানান রকম সমস্যারও উৎপত্তি ঘটতে পারে। এজন্য সে সবসময় মেহরুন হতে দূরে দূরে থাকত। তবে এতে যে হিতে বিপরীত হবে, মেহরুন কষ্ট পাবে। এটা কখনো ভাবেনি সে।” তার এই ধারণাটাই ভেঙেছিল রিশতা। মেহরুনকে নিয়ে হয়তো সবটা এভাবে আদ্রিশের সামনে উপস্থাপন না করলে আদ্রিশ জানতেই পারত না কখনো। আদ্রিশের ওমন আচরণের কারণে হয়তো মেহরুনকেও হারিয়ে ফেলত হতো চিরতরে। তাই তো আর বেশি ভণিতা না করে বৃষ্টির রাতেই মেহরুনকে চট করে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলে ফেলেছিল সে। যদিও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তার। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলেই দিয়েছিল সে। এর পরে আদ্রিশের বুকটা কেমন ধুকপুক করছিল। তবে পরবর্তীতে আর এমন মনে হয়নি, সকল অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখতে রাখতে আজকাল বড্ড হাঁপিয়ে উঠছে সে। এসব ভেবে রিশতার দিকে সে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়।

আদ্রিশকে আশ্বস্ত করে হালকা হেসে রিশতা বলে ফেলল

-‘ ভয় নেই, আপনার বউয়ের খেয়াল রাখার জন্য আপনার বোন এই রিশতাই কাফি হে। আপনার বউ আমাদের কাছে আমানত স্বরূপ, তাই ক্ষতির সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। সো চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়েন ভাইয়া। শুভরাত্রি ভাইয়া।

আদ্রিশ নিশ্চিন্ত মনে নিজের অবস্থান থেকে সরে পড়ে। তা দেখে আলতো হাসে রিশতা। মনে মনে আওড়াল,
“আর নয় দূরত্ব, তোমরা এবার একত্রিত হতে চলেছে। খুব বেশি দূরে নয় সেইদিনটা। আমি তোমাদের এক করেই ছাড়ব। দুজনকে একসাথে না দেখা অবধি কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না আমার।”

কথাটা মনে মনে বলতে বলতেই মেহরুনের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রিশতা। মেয়েটার জ্বর এখনো নামেনি। চিন্তা তারও বেশি বইকি কম হচ্ছেনা! ওর পাশেই ঘুমিয়ে আছে অরনী। সারারাত ধরে মেহরুনের মাথায় জ্বরপট্টি দিতে দিতে শেষরাতের দিকে চোখের পাতাটা একটু লেগে এসেছে। রিশতা তখন গিয়েছিল খাবার খেতে। পেটে দানাপানি পড়েনি বলে খিদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল তাই অরনীকে দায়িত্ব দিয়ে সে খেতে যায়। হুট করে মনে কামড় দিয়ে ওঠল তার, “আচ্ছা আদ্রিশ ভাইয়া কি খেয়েছিল? মেহুকে ফেলে তাকে তো শুধু নিজের ঘরেই যেতে দেখেছে, খাবার তো খেতে দেখল না! তবে কি সে খায়নি।” রিশতার চোখটা হঠাৎ ছলছল করে ওঠে। মেহরুনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল,

“মেহু, কখনো কষ্ট দিস না আমাদের আদ্রিশ ভাইয়াকে। এমনিতেও তার কষ্টের শেষ নাই। আদ্রিশ ভাইয়ার মতো তোকে এতোটা কেউ কখনো ভালোবাসবে না রে বইন!”

মেহরুনের কক্ষের সামনে থেকে এখনো যায়নি আদ্রিশ। মেহরুনকে রেখে নিজের কক্ষে গিয়েও দুদণ্ড শান্তি মিলছে না যেন তার। চোখ বুঁজলেই মেয়েটার অসুস্থ মুখশ্রী ভেসে উঠছে তার দুই নেত্রের মাঝে। আর ঐদিকে বাবার সাথে তার বিশাল কথা কাটাকাটি হয়েছে। সব মিলিয়ে একেবারে বিষিয়ে উঠেছে সবকিছু। মেহরুন ব্যতিত এখন আর কোনো কিছুতেই মন টানেনা তার। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় দুনিয়া ছেড়ে পালাতে পারলেই বোধহয় সে বেঁচে যেত! কিন্তু পরক্ষনেই মেহরুনের কথা মনে পড়তেই পুরো দুনিয়াই থমকে যায় যেন তার জন্যে।

-‘ কবে বড় হবি রে তুই? কবে বুঝবি আমায়? তোকে কবে নিজের করে নিব আমি? কবে কবে হবে এসব? সত্যিই আর ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না আমার। আই নিড ইউ ভেরি ব্যাডলি ইয়ার! কবে যে তোকে আমার মিসেস বানিয়ে নিজের ঘরে তুলবে রে মেহুরাণী?

অস্থির চিত্তে কথাগুলো আওড়ালেও খুবই করুণ শোনা যায় কথাগুলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে আদ্রিশ চলে যায় নিজের কক্ষে। অলক্ষ্যে তার নেত্র হতে দুফোঁটা দূর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ঝরে পড়ে যা সবার নজরে এড়িয়ে যায়!

#চলবে~