#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৭.
রাগে দূঃখে প্রচন্ড শক্তিতে ফোন ফ্লোরে আছাড় মারে সুপ্ত।হাতে থাকা কোর্ট বিছানায় ছুড়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয় সে।ত্রয়ী ও তন্দ্রা সবে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে।গাড়ি থেকে বের হয়ে সদর দরজায় পা রাখতেই সুপ্তকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় ত্রয়ী।সুপ্তের পরনে কালো রঙের শার্ট ইন করা,কালো প্যান্ট।সবে বাড়িতে ফিরেছে তা স্পষ্ট!তবে উনি আবার এখন ব্যস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
নিজের কাছে প্রশ্ন করে ত্রয়ী ধীরে ধীরে সুপ্তের পানে এগোয়।সুপ্ত ক্রোধান্বিত মুখে ফোন হাতে কিছু করতে করতে হেঁটে আসছে।তখন যেটা ভেঙেছে সেটা বাটন ফোন ছিল!
ত্রয়ীর ফোনের লোকেশন বার বার চেক করার পরও বাড়ির লোকেশনই দেখাচ্ছে।সুপ্ত বিরক্তমুখে বার বার ত্রয়ীর লোকেশন বের করার চেষ্টা করছে।হঠাৎ নুপুরের আওয়াজ কানে আসতেই সুপ্তের হাটার গতি কমে।তড়াক করে সামনে তাকায় সে।
অতি মূল্যবান কোন জিনিস হারিয়ে যাওয়ার পর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে খুঁজে পেলে যেমন অনূভুতি হয় ঠিক তেমন ভাবে সুপ্তের হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসে।তবে সে দ্বিগুন রেগে উঠে এবার।দ্রুত ত্রয়ীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।কিছু বলবে তার আগেই পেছনে হেঁটে আসা তন্দ্রাকে নজরে আসে তার।ওর দিকে একবার তাকিয়ে ত্রয়ীর হাতে শক্ত করে ধরে সে।ত্রয়ী অবাক হয়ে তাকায়।সুপ্তের চোখে-মুখের ক্রোধাগ্নি দেখে মনে মনেই প্রশ্ন করে উঠে,
-উনি এত রেগে আছেন কেন?
সুপ্ত ত্রয়ীকে এক প্রকার টেনে নিয়েই সিঁড়ির দিকে রওনা হয়।সুপ্তের গায়ের জোরে ত্রয়ী অবলীলায় তার সাথে সাথে যেতে থাকে।সুপ্তের এমন আচরণের দরুন ত্রয়ীর চোখে-মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে।সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে ত্রয়ী পেছনে থাকা তন্দ্রার দিকে অবাক দৃষ্টিতে একবার ফিরে তাকায়।যা তন্দ্রার মনে জমতে থাকা ভয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেয়।সে তো ভেবেই নিয়েছে তারা যে রিক্তের বাসায় গিয়েছে সেটা সুপ্তকে বলে দিয়েছে রিক্ত।যেহেতু ত্রয়ী সাথে গেছে তাই সুপ্তের সমস্ত রাগ ত্রয়ীর উপর এসে পড়লো না তো?তন্দ্রা নিজের মতো ভেবে নিয়ে ভয়ে তটস্থ হতে থাকে।ভীতু
ও নরম মনের মানুষ তন্দ্রা ভয়ে ভয়ে রুম অবধি পৌঁছে দরজা লাগিয়ে দেয়।
এদিকে সুপ্ত ত্রয়ীকে রুমে এনে জোরে শব্দ করে দরজা লাগায়।সুপ্তের রাগি মুখ আর রাগের এমন বহিঃপ্রকাশে ত্রয়ীর পিলে চমকে উঠে।কোন রকমে সে সুপ্তকে জিজ্ঞেস করে,
-এতো রেগে আছেন কেন আপনি?এভাবে টানতে টানতে নিয়ে আসলেন,আশ্চর্য!
সুপ্ত ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।ত্রয়ীর অবাক মুখশ্রী!
-ডু ইউ হ্যাভ এনি কমনসেন্স ত্রয়ী?
সুপ্তের দাঁতে দাঁত চেপে বলা কথার সাথে সাথে ত্রয়ীর ধরে রাখা হাতে জোর পরে।ত্রয়ী সুক্ষ ব্যথায় অবুঝের ন্যায় কপাল কুঁচকে চায়।
-এমন প্রশ্নের মানে?
-তোমার কোন আইডিয়া আছে আমি কতটা চিন্তায় ছিলাম!বার বার তোমার ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করার পরও যখন এই বাড়ির লোকেশনই দেখাচ্ছিল তখন কতটা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম এ ব্যাপারে তোমার কেন ধারণা আছে?
না বলে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
ত্রয়ী অবাক চোখে সবকিছু শুনলো।কিন্তু তখনই হাতে ব্যথায় সুক্ষ্ম আর্তনাদ করে উঠে সে।মিহি স্বরে বলে উঠে,
-হাত ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি।
-আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
-জানানোর মত কোথাও যায়নি তাই জানাইনি।আর আমার জন্য আপনার কেন চিন্তা হবে?
সুপ্ত এখনো হাতে শক্ত করে ধরে থাকায় শেষাক্ত বাক্যখানা ত্রয়ী তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে।সুপ্তের শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-বিকজ ইউ আর মাই ওয়াইফ!
ত্রয়ী হাত মুচড়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।তা দেখে সুপ্ত হাতের বাধন ঢিলে করে কিন্তু মুঠোয় বন্দিই থাকে ত্রয়ীর নরম হাত।
ত্রয়ী সুপ্তের চোখের পানে তাকায়।ভেজা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-আমি আপনার ওয়াইফ এটাই আপনার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পাগলপ্রায় হওয়ার কারণ?স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একে অপরের অনুপস্থিতির দরুন চিন্তা হওয়ার কারণ একে অপরের প্রতি টান,ভালোবাসা।আপনার আমাকে নিয়ে চিন্তা কেন হবে?আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
সুপ্ত ত্রয়ীর ভেজা দৃষ্টিতে তাকায় নিবিড়ভাবে।ত্রয়ীর চোখে অশ্রুদের অস্তিত্ব বোঝা গেলেও মুখশ্রী শক্ত দেখা যাচ্ছে।
সুপ্ত ত্রয়ীর কোমড়ে হাত রেখে নিজেদের মাঝে থাকা সমস্ত দূরত্বের অবশান ঘটায়।আকস্মিক সুপ্তের টান সামলাতে কাঁধের শার্টে খামচে ধরে ত্রয়ী।ত্রয়ীর পেটে বলিষ্ঠ হাত পেচিয়ে চোখে চোখ রেখে সুপ্ত অতি শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-তোমার অগ্নিদৃষ্টি অন্তর ভেদ করে হৃদয়ে দ্রোহ চালায়!তোমার নুপুরের আওয়াজ কানে ভেসে আসলে আমার শান্তি অনুভব হয়!তোমার শক্তপোক্ত কথার বাণ হৃদয়ে এসে বিঁধে!তোমার দিকে কেউ অসম্মানের সহিত তাকালে তার প্রাননাশ করার অভিপ্রায় জাগে!তোমার ভেজা চোখের দৃষ্টি এইযে আমার ভেতরটাকে আন্দোলিত করছে,হৃদয় নামক অঙ্গটাতে সুক্ষ নিপীড়ন চালাচ্ছে!
সুপ্ত থামে।সেই সাথে ছল ছল করে উঠে ত্রয়ীর নেত্রযুগল।সুপ্তের কাঁধে হাতের খামচি দৃঢ় হয়।
-এসব কি তোমার প্রতি আমার বিশুদ্ধ প্রেম নয়?অকৃত্রিম ভালোবাসা নয়?বলো মিসেস ত্রয়ী মেহরোজ!
ত্রয়ী আচমকা এক কান্ড করে বসে।সুপ্তের গলা জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে তাকে।সুপ্ত ত্রয়ীর এই কার্যের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
থমকে গিয়েছে সে।এই প্রথম ত্রয়ী সেচ্ছায় তাকে আলিঙ্গন করলো!ত্রয়ী কি বোঝালো?হ্যা এটাই প্রেম!ভালোবাসা!
সুপ্ত ত্রয়ীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলে কাঁধে অশ্রু অনুভব করে।কিছুটা ভ্রু কুঁচকায় সুপ্ত।তার সাথে ভেসে আছে ত্রয়ীর ক্রন্দনপূর্ণ কন্ঠ,
-এতটা ভালোবাসার জন্য মিসেস সুপ্তও আপনাকে অনেক ভালোবাসে এডভোকেট সাহেব!
সুপ্ত স্মিত হেসে ত্রয়ীর গলায় তার ওষ্ঠ স্পর্শ করে।সুপ্তকে জোরেসোরে আঁকড়ে ধরে ত্রয়ী।এবার সুপ্তের মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরে।সেই কান্নারত মেয়েটি কে ছিল তবে?আরসালানের কোন কৃতদাসী?অবশ্যই তাই হবে।নিশ্চয়ই সুপ্তকে কোনভাবে ফাঁসানোর ফাঁদ ছিল!আরসালান যে বেশ ধূর্ত তা ভালো করেই জানে সুপ্ত। সুপ্ত মনে মনে রাগে ফুঁসে উঠলেও মুখে তা ফুটিয়ে তুলে না।বউয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে ডুবিয়ে ফেলতে থাকে তা সত্তাকে!
.
ফজরের নামাজ কানে আসতেই আরসালানের ঘুম ছুটে যায়।কপাল,ভ্রু কুঁচকে বিছানায় উঠে বসে সে।ঘরজুড়ে তীব্র আলো আনাচে-কানাচে স্পষ্ট!আরসালান নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে একটুও অবাক হয় না।বরং পরম স্বাভাবিকতার সাথে উঠে প্যান্ট পরিধান করে নেয়।তারপর বিশাল বেডের দিকে তাকালেই একজন মেয়েকে চাদরে আচ্ছাদিত অবস্থায় নজরে আসে তার।বিজয়ের কুটিল হাসি ফুটে উঠে আরসালানের ওষ্ঠজুড়ে।মেয়েটা তার বিপরীত মুখী হয়ে শুয়ে আছে।মূলত অজ্ঞান হয়ে আছে সে।আরসালান ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি নিয়ে মেয়েটির পানে এগোয়।তার খেয়ালে ত্রয়ীর মুখ দর্শনের আশায়!
আরসালান ঘুরে বেডের কিনারায় চলে আসে।ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠে মেয়েটির মুখ।আরসালানের মুখের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।গোলগাল আদলের একটা ফর্সা মুখশ্রী।মেয়েটার চেহারার দ্যুতি লীন হয়ে কলঙ্কের অমাবস্যা ছেয়েছে।আরসালানের চেহারার ভাব বদলে আসে।
সে অচেনা একজন মেয়ের সম্মান লুটেছে বলে নয় সুপ্তের স্ত্রী ত্রয়ীর বদলে অন্য একজন কে দেখে!
আরসালান কাছে থাকা টেবিলে লাথি মেরে দুরে সরিয়ে দেয়।মেয়েটাকে উগ্রভাবে ডাকার পরেও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পালস চেক করে সে।পালস চলছে!
আরসালান গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে রুম থেকে বের হয়ে আসে।তারপর তার সহচরীদের বলে মেয়েটির ফোন চেক করে বাড়ির নাম্বারে কল করতে।তবে অতীব সাবধানের সাথে বিষয়টা হ্যান্ডেলও করতে বলে দেয়।যদি না মানে তবে যেন মোটা অংকের ক্যাশ প্রদান করে!
চেয়ারে বাবু হয়ে বসে আছে ত্রয়ী।পরনে কলাপাতা রঙের সুতির শাড়ি।আজ তার মেডিকেলে যাওয়া হবেনা।সুপ্তের কড়া নিষেধ!ত্রয়ীর যদিও এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে ঘাড় ত্যারামি করে কলেজে যেতে পরক্ষণেই আবার ভাবছে থাক মানুষটাকে এত অতিষ্ঠ করে তোলা ঠিক হবে না।
তাই সে বসে বসে সুপ্তের রেডি হওয়া দেখছে।ত্রয়ীর আধভেজা চুল থেকে অনেক সময় পরপর এক ফোঁটা করে পানি পরছে মেঝেতে।ত্রয়ী আসন ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে একটা টেবিল ফ্যান এসে ড্রেসিং টেবিলে রাখে তারপর তা চেয়ারের দিকে সেট করে পুনরায় চেয়ারে এসে বাবু হয়ে বসে।ফ্যানের বাতাসে তার খোলা চুল উড়তে থাকে কোন বাধা ছাড়াই।
সুপ্ত একবার তাকে দেখে নেয়।ত্রয়ী মনোযোগ দিয়ে সুপ্তকে খেয়াল করছে।
স্কাই ব্লু রঙের শার্ট ও কালো প্যান্ট পরনে।হাতে এক্সপেনসিভ ওয়াচ।চুল আছড়ে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে সুপ্ত বলে উঠে,
-তুমি একটুও লজ্জা পাচ্ছো না বউ?কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো!কালকের কথা স্মরণে নেই?
ত্রয়ী দুহাতে মুখ ঢেকে সুপ্তের লাগাম ছাড়া কথার রিয়েকশন প্রকাশ করে।ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে সুপ্ত।ত্রয়ীর দিকে যেই একটু এগোবে ওমনি দরজায় নক করে কেউ।সুপ্ত কে বলে জিজ্ঞেস করলে মিনির গলা ভেসে আসে।সুপ্ত পুনরায় আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে মিনিকে ভেতরে আসতে বলে।
মিনি ভেতরে এসে খবর দেয়,
-ভাইয়া একজন লোক তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।খুবই জরুরি কেস মনে হচ্ছে!
চলবে…
#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৮.
-শুনুন!আপনার কি আজকেও ফিরতে দেরি হবে?
সুপ্ত দরজার কাছে আসতেই ত্রয়ী প্রশ্ন করে।সুপ্ত একবার ত্রয়ীর দিকে ফিরে তাকায়।বলে,
-আমি সঠিক বলতে পারব না।ভদ্রলোক হয়ত কোন কেস নিয়ে এসেছে।সেটা নিয়ে দেরি হতে পারে।
ত্রয়ী মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলে,
-আচ্ছা।
সুপ্ত ভ্রু কুঁচকে কিছু ভেবে বলে,
-তোমার কিছু লাগবে?আসার সময় কিছু নিয়ে আসব?
ত্রয়ী দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।সুপ্ত দরজা থেকে ত্রয়ীর নিকটে আসে।তারপর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ত্রয়ীর দিকে গাঢ় চোখে তাকায়।ত্রয়ীর দৃষ্টি লাজে মেঝেতে ঠেকেছে।ওষ্ঠকোণে ছড়িয়েছে মিষ্টি হাসি।সুপ্ত গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
-আজকে একদম ভালো বউদের মতো লজ্জা পাচ্ছো!নয়ত তোমার জবান!উফ!
ত্রয়ী মুখ তুলে চোখ রাঙিয়ে তাকায়।সুপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলে,
-আসি।তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব আর আসার সময় কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করব,কেমন?
ত্রয়ী ইশারায় ঠিক আছে বোঝায়।সুপ্ত আরো কিছুক্ষন ত্রয়ীর মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে বাইরে আসে।সে চলে যেতেই আরশিতে একবার নিজেকে দেখে নেয় ত্রয়ী।তারপর রুমের বেলকনির উদ্দেশ্য হাঁটছে হাঁটছে সুর তোলে,
‘কিসমাত সে হামে আপ হামদাম মিল গায়ে
যেসে এক দোয়া কো আলফাস মিলগায়ে!
ছোচা যো নাহি ও হাসিল হো গায়া
চাহু ওর কিয়া, দে খোদা দে আপ মুঝে!
সুপ্ত বাড়ির সদর দরজা পার করতেই এক ভদ্রলোককে দেখতে পায়।স্বাস্থ্যবান শরীরে শুষ্ক মুখ,দেখে মনে হচ্ছে কান্না করেছেন তিনি।সুপ্ত ভদ্রলোকটির কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে উনার কি সমস্যা তা জানতে চান।মেয়ের কেস নিয়ে এসেছেন তিনি।
-আপনি আমার সাথে আমার অফিসে আসুন।তারপর আপনার কথা শুনছি।
ভদ্রলোক রাজি হয়।সুপ্ত অফিসে পৌঁছে ভদ্রলোকটিকে তার কথা আরম্ভ করতে বলে।ভদ্রলোকটির নাম সুলায়মান।তিনি বলতে শুরু করেন,
-আমি একজন স্কুল টিচার।কালকে রাতে আমার মেয়ে একাই শপিং করতে গিয়েছিল।ও প্রায় একাই যায়।কিন্তু কাল..!
সুলায়মান সাহেবের কথা বেশ মার্জিত হলেও কন্ঠে একরাশ কষ্ট ছিল।উনি কথার মাঝে থেমে যাওয়াতে সুপ্তের আগ্রহ বাড়ে।সে অপেক্ষা করতে থাকে বাকি কথাটুকুর।সুলায়মান সাহেবের কন্ঠ ভিজে উঠে।জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে তিনি সুপ্তের দিকে করুন চোখে তাকায়।
-আমি শুনেছি আপনি অনেক অনেস্ট লয়্যার তাই আপনার কাছে আসা।আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে কথাটা বলব আপনাকে।
সুপ্ত সুলায়মান সাহেবের হাতের উপর এক হাত রাখে।তারপর নরম কন্ঠে বলে উঠে,
-আপনি আমাকে বাড়ির ছেলে মনে করে সব খুলে বলুন।
ভদ্রলোকটির নিচদিক তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
-কালকে রাতে ও বাড়ি ফিরিনি।আমরা পুলিশ ইনফর্ম করেও কোন লাভ হয় নি।তারপর আজ সকালে একটা কল আসে ওর নাম্বার থেকে।আমি তো জান ফিরে পেয়েছিলাম।কিন্তু কলটা আমার চিন্তা হ্রাস করেনি বরং সব..সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।আমার মেয়েকে রেপ করা হয়েছে!
সুপ্ত সবটা শুনে গোপন এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।উকিল হয়ে তাকে কত যে অন্যায়ের ব্যাখ্যা শুনতে হয়েছে!সুপ্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
-কে বা কারা ছিল তারা?
সুলায়মান সাহেবর কান্নারত কন্ঠ হঠাৎ ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠে।বেশ রাগ আর ঘৃণা নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন,
-আরসালান চৌধুরী!ফারহাদ চৌধুরীর রেপিস্ট ছেলে।ওই আমার মেয়ের জীবনটা শেষ করে দিলো!
সুপ্ত হঠাৎ থমকে তাকায়।মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে নানান চিন্তা একে একে জুড়তে শুরু করে।তাহলে কালকে রাতে শোনা মেয়েলী ক্রন্দন আরসালানের ভাড়া কোন মেয়ের ছিল না!একজন নিষ্পাপ মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলা হয়েছিল!সুপ্ত নিজের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙুলের সাহায্যে কপাল চেপে ধরে।অনুশোচনারা এসে গ্রাস করে তাকে।সে সুলায়মান সাহেবের দিকে তাকায়।ভদ্রলোক তার দিকে তার সম্মতি কিংবা ঋনাত্মক উত্তরের আশায় চেয়ে আছেন।কেননা এতক্ষণ শহরের যতজন উকিলের নিকট তিনি গিয়েছেন আরসালানের নাম শোনার পর সকলের উত্তর ছিল ‘না’!
সুপ্ত সুলায়মান সাহেবের পানে তাকায়।ভদ্রলোক প্রস্তুত হয়ে যান না শোনার জন্য।
-আমি আপনার কেসটা লড়ব,ইনশাআল্লাহ।
.
গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে অনামিশায় তলিয়েছে ধরিত্রী।শহরের প্রতিটি কোনায় কোনায় জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম আলো।বেলকনিতে দাড়িয়ে দূরের বিল্ডিংগুলোর একে একে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়ে উঠা অবলোকন করছে ত্রয়ী।বাইরে থেকে আসা সন্ধ্যের সতেজ বাতাসে কানের পাশ থেকে বেরিয়ে আসা এলোচুল উড়ছে বাধাহীন ভাবে।ত্রয়ীর ওষ্ঠকোণে হাসি লেপ্টে।দূর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সে।সুইচ টিপে আলোকিত করে এতক্ষণ আঁধারে ছেঁয়ে থাকা তাদের কক্ষটি।ত্রয়ী দূর থেকে আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।তার পরনে কলাপাতা রঙের সেই শাড়িটি।কৃষ্ণবর্ণের পাড়,তাতে সোনালি সুতোয় করা কাজ।ত্রয়ী খোঁপা করে রাখা চুল ছেড়ে দেয়।ফ্যানের বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়তে থাকে সেগুলো।ত্রয়ী দর্পনরে নিকটে এসে চেয়ার নিয়ে বসে।উজ্জ্বল আলোয় ফুটে উঠে তার হলদে শ্যামলা মুখশ্রী।নিজেকে বেশ ভালো করে দেখে ত্রয়ী।তারপর কাজল মাখে লোচনে,সুক্ষভাবে।ওষ্ঠে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়া লাগায়।আরশিতে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বলে,
-এই সামান্য সাজ আপনার জন্য ব্যারিস্টার সাহেব!
ত্রয়ী দরজা খুলে বাইরে বের হতেই বেলাকে চোখে পরে।ত্রয়ীকে দেখে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে তার দৃষ্টি।বেলার যেন ত্রয়ীকে দেখে কোন মন্তব্য না করলেই নয়।সে ত্রয়ীকে আপাত মস্তক দেখে বলে,
-এত সাজগোছ!শ্যামলা বরন ঢেকে সুপ্তকে সবসময় বশে রাখার চেষ্টা।
ত্রয়ীর হাসি হাসি মুখশ্রী শক্ত হয়ে উঠে এবার।বেলার ন্যায় বহু মানুষ হয়ত তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষকে হারিয়েছে।কিন্তু এমন আচরণের শিকার একমাত্র ত্রয়ীই হচ্ছে হয়ত!
ত্রয়ী বুকে হাত গুঁজে বেলার দিকে গাঢ় চোখে তাকায়।বেলা নিঃসন্দেহে তার থেকে বেশ ফর্সা।
-তোমার না গায়ের বর্ণ নিয়ে অহংকার মানায় না বেলা।কেননা আমার থেকে উজ্জ্বল বরন থাকা সত্বেও কি হলো?তুমি তোমার বহু কাঙ্ক্ষিত পুরুষ সুপ্তকে পেলে না।
অপমানে মুখ ছোট হয়ে আসে বেলার সে।সে রাগত ভাবে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ত্রয়ী জোরে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-আর কিছু বলো না বেলা।আমি যেচে কারোর অপমান না করলেও আমাকে অপমান করে কষ্ট দিতে চাওয়া মানুষদেরকে অপমান করতে আমার বাঁধে না।সো আর কিছু বলে নিজের মুখে ঝামা ঘষে নিয়ো না।
ত্রয়ী বেলার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে আসে।নিচে নেমে সোজা রান্নাঘরে আসে সে।শাশুড়ীর রান্নায় হাত লাগায়।এতদিনে বেশ কিছু রান্নাও রপ্ত করে নিয়েছে সে।এখন শুধু রেঁধে নিজেকে পরীক্ষা করার পালা।
ত্রয়ী চলে যেতেই বেলা রাগে ধুপধাপ পা ফেলে নিকের রুমে গিয়ে দরজা আটকায়।ত্রয়ীর থেকে সমস্ত অপনামের বদলা একদিন সে নেবেই।
ঘড়িতে দশটা পেরিয়ে এগারোটা বাজতে চললো।এখনো সুপ্তের আসার খবর নেই।ত্রয়ী নিরাশ মুখে বিছানায় বসে একটা বালিশ কোলের উপর নেয়।চোখে ঘুমেরা আধিপত্য ছড়াচ্ছে দ্রুত।ঠিকড়ে বদ্ধ হয়ে আসতে চাইছে চোখের পাতা।ত্রয়ী চোখে বুজবে এমন সময়ই দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠে সে।তারপর অতি কাঙ্ক্ষিত যুবকটির দর্শন পেতেই ঘুমেরা প্রস্থান করে।ত্রয়ী হাসি হাসি মুখে সুপ্তের পানে তাকায়।সুপ্ত গাঢ় চোখে তাকায় স্ত্রীর পানে।তারপর এগিয়ে আসে ত্রয়ীর নিকটে।ত্রয়ীর কোল থেকে বালিশ ছড়িয়ে মাথা রাখে সেখানে।সমস্ত ক্লান্তি বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়।ত্রয়ীর দিকে মুখ উচিয়ে তাকায় সুপ্ত।এলোচুল গুঁজে দেয় কানের পিঠে।
তারপর ত্রয়ীর কোমড় জড়িয়ে মুখ গুঁজে রাখে ত্রয়ীর উদরে।শিহরিত হয়ে সুপ্তের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ত্রয়ী জিজ্ঞেস করে,
-এত ক্লান্তি!
-উঁহু,অনুশোচনা!
চলবে…