#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা
১৯.
-তোমার জন্য একজন মেয়ের সম্মান চলে গেছে জানলে তোমার কেমন অনুভূতি হবে ত্রয়ী?আর এটা বুঝতে পারলে যে তুমি চাইলে নয়ত মেয়েটার সম্মান বেঁচে যেত।তখন তোমার কেমন অনুভূতি হবে?
সুপ্তের মাথায় আলতো ভাবে চলতে থাকা ত্রয়ীর হস্ত থেমে গেল সহসা।হঠাৎ আটকে উঠলো তার মন।সুপ্ত এবার সোজা হয়ে বসে।ত্রয়ী সুপ্তের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করে।জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে সুপ্তকে প্রশ্ন করে,
-মানে?আমার জন্য?
-উঁহু!আমার জন্য!
ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে সুপ্তের পানে তাকিয়ে রয়।সুপ্ত ত্রয়ীকে এভাবেই প্রশ্নে বিদ্ধ করে রেখে সাদা একটা শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।দশমিনিট পরে রুমে আসতেই ত্রয়ী বলে উঠে,
-আপনার জন্য কারো সম্মান..আমি বুঝলাম না সুপ্ত।
সুপ্ত শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে।মাথার ভেজা চুল মুছতে থাকা হস্ত থামে ত্রয়ীর প্রশ্নে।ত্রয়ীর পানে একপলক তাকিয়ে সে অন্ধকারাচ্ছন্ন বেলকনিতে এসে দাড়ায়।সুপ্তের এমন আচরণে ত্রয়ীর মনে কৌতুহলরা ঝেঁকে বসে।পলক না ফেলে একদন্ড তাকিয়ে রয় তার দিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে থাকা শুভ্র শার্টে মোড়ানো বলিষ্ঠ যুবকটি।ধ্যান ভাঙে মিউমিউ শব্দে।পিংকুর ঘুম ভেঙেছে।পরক্ষণেই আবার ঘুমানোর জন্য চোখ বুজেছে সে।ত্রয়ী দ্রুত সুপ্তের পাশে এসে দাড়ায়।দূরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সুপ্তের পানে তাকিয়ে সে বলে উঠে,
-আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেননি।
সুপ্ত একবার ত্রয়ীর দিকে তাকায়।তারপর বলে,
-নেশা করলে মানুষ ভুলভাল দেখে জানো।আরসালানের সাথেও এমনটা হয়েছে।
-ওই পাপীর নাম আসছে কেন এখানে?এটা তো আমার প্রশ্নের জবাব নয়!
-জবাব আমার কাছেও নেই।কিংবা সব অস্পষ্ট!
ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে ফিরে এবার বলে,
-কালকে রাতে যখন তুমি তন্দ্রার সাথে রিক্তের ওখানে গিয়েছিলে তখন আমার ফোনে একটা কল আসে।কলটা কে করেছিল জানো?আরসালান চৌধুরী!
সুপ্ত থামে।ত্রয়ীর মুখে রা নেই।সুপ্ত ফের বলতে শুরু করে,
-ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে একজন মেয়ের আকুতি ভরা কান্না,জঘন্য স্পর্শ থেকে নিস্তার পাওয়ার কান্না।নেশায় ডুবে থাকা আরসালান ওই মেয়েটাকে তুমি মনে করেছিল!আজকে সকালে যে ভদ্রলোক এলেন না উনার মেয়ে সেই মেয়েটি।আরসালান তাকে রেপ করে!
ত্রয়ী অনুভূতি শূন্য চোখে সুপ্তের দিকে তাকায়।বাইরের দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে যা দুজনকে।আচমকা বিদ্যুৎ চমকায়।বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে প্রকৃতি।কিছু মুহুর্তে বাদে সহস্র বৃষ্টির ফোঁটা বর্ষিত হয়।বৃষ্টির আওয়াজে মুখরিত হয় ধরিত্রী।
বেলকনিতে থাকায় তীব্র বাতাস আর বৃষ্টির ফোঁটা এসে আছড়ে পরতে থাকে দুজনের উপর।কিন্তু এতে ত্রয়ীর কোন হেলদোল নেই!সে ঠাঁই দাড়িয়ে রয়।সুপ্ত ত্রয়ীর বাহু চেপে বেলকনি থেকে রুমে আনতে গেলে ত্রয়ী বলে উঠে,
-আপনার জন্য ওই মেয়ের সাথে এমনটা হয়েছে সুপ্ত।আমার জন্য!
ত্রয়ীর কন্ঠ কেমন বিবশ,অনুভূতি শূন্য।চোখে মুখে অপরাধীর ছাপ ছেয়ে গেছে।সুপ্ত করুন চোখে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ত্রয়ী বলে উঠে,
-আসলেই কি আমি অলক্ষুণে?
.
-ভাই ওই মেয়েটা আপনার নামে কেস করে দিয়েছে!
কথাটা শোনার পরও আরসালানের মাঝে কোন হেলদোল দেখা যায় না।সে দিব্যি সিগারেট টানছে।কিছু সময় পার হবার পর তার তরফ থেকে প্রশ্ন আসে,
-কোন মেয়েটা?
-ওইযে কালকের আগের রাতে আপনি যাকে..
কথা সমাপ্ত হতে না হতেই আরসালান বলে উঠে,
-ওহ আচ্ছা।কিন্তু আমি তো বলেছিলাম টাকা দিয়ে বিষয়টা মিটিয়ে দিতে!
-মেয়ের বাবা টিচার ভাই।টাকা তো নেয় নি উল্টো বলে গেছে তোমায় ছাড়বে না।
আরসালান বিদঘুটে হেসে উঠে।যেন সর্বকালের কোন মজার কৌতুক বলা হয়েছে তার সামনে।কিছুক্ষণ হেসে নিজেকে সামলে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-আদো কোন উকিল পেয়েছে?
-জ্বি ভাই।এডভোকেট সুপ্ত রেহনেওয়াজ..
সুপ্তের নাম শুনলেই আরসালান তীক্ষ্ণ নজরে তাকায় বার্তা দিতে থাকা লোকটির দিকে।আরসালানের চাহনি দেখে শুকনো একটা ঢোক গিয়ে লোকটি বলে,
-সুপ্ত রেহনেওয়াজ কেসটা লড়ছে।আর তুমি তো জানোই সে কতটা তুখোড় ওকালতি করে।আগেরবারের কথা মনে তো আছে নিশ্চয়ই।
আরসালান এবার গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবে।সত্যিই আগেরবার সুপ্ত তাকে এমনভাবে ফাঁদে ফেলে মুখ থেকে সত্য উগলে নিয়েছিল যা আজও ভুলেনি সে।
আরসালান দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দুই ভ্রু এর মাঝখানে চেপে চোখ বদ্ধ করে কিছু ভাবে।তার ভাবনায় কারো সম্মান,কারো জীবন কারো কিচ্ছু যায় আসে না।কিচ্ছু নাহ!
*
-কেয়ার(মেয়েটি) শরীরে যে ডিএনএ পাওয়া গেছে সেটার সাথে আরসালানের ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে মিস্টার সুপ্ত।
ডক্টরের কথা শোনার পর সুপ্ত গোপনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।খুশি মনে তার পাশে থাকা তার এসিস্ট্যান্ট নিঝুমের দিকে তাকাতেই দেখে তার কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পেরেছে।সুপ্ত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-এনিথিং রং মিস নিঝুম?
তৎক্ষণাৎ খানিক চমকে সুপ্তের পানে তাকায় নিঝুম।হেসে বলে উঠে,
-নো স্যার।এটা তো ভালো খবর।আরসালান চৌধুরীর অপরাধ ধরা পরবে।কালকে কোর্টে নিশ্চয়ই আপনিই জিতবেন স্যার।
নিঝুমের কথার বিপরীতে সুপ্ত কিছু বলে না।তার মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগে।তবে সেটাকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না সে।
রিপোর্টটা নিয়ে নিঝুম আর সে অফিসে আসে।তারপর লকারে সেটা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে সুপ্ত। বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুপ্ত যেন তার মাথা থেকে অনুশোচনার ন্যায় বড়সড় কিছু নামতে চলেছে।মেয়েটাকে ন্যায় প্রদান করতে পারবে সে।সুপ্ত গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়িতে ফেরে।
এখনো বিকেল শেষ হয়নি।চারপাশে রোদের ঝলক,হলুদ আভা ছড়িয়েছে।সুপ্ত রুমে ঢুকে ত্রয়ীকে রুমেই পায়।পড়ার টেবিলে বসে গালে হাত দিয়ে কিছু ভাবছে।কালকে থেকে মনের কোণে মেঘের আনাগোনা তার।সুপ্ত কিছু একটা ভেবে তার পাশে এসে দাড়ায়।
-বেড়াতে যাবে ত্রয়ী?
সুপ্তকে খেয়াল না করায় সামান্য চমকে উঠে ত্রয়ী।তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে স্কাই ব্লু শার্টে মোড়ানো যুবকে দেখে শুষ্ক হাসে।বইয়ে চোখ রেখে বলে,
-ভালো লাগছে না।
-ঘুরলে মন ভালো হবে না?
-কি জানি।
সুপ্ত একটা শাড়ি এনে ত্রয়ীর সামনে রাখে।ত্রয়ী চোখ বুলায় সেথায়।নীল রঙের শাড়ি,পাড়ে সোনালি রঙের ছোঁয়া।দেখে বেশ দামি মনে হচ্ছে।
সুপ্ত ত্রয়ীর হাতে শাড়িটা দিয়ে বলে,
-ওয়াশরুমে যাচ্ছি আমি।তুমি এটা পরে নাও।কুইক!
ত্রয়ীকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে সুপ্ত।
বিয়ের পর এই প্রথম সুপ্ত ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছে।মনে মনে বেশ খুশি হয় ত্রয়ী।প্রসন্ন চিত্তে শাড়ি পরে নেয় সে।
ঘন্টা খানেকের মাঝে সুপ্তের গাড়ি এসে কাশবনে থামে।গোধূলি মুহুর্ত আরম্ভ হতে আরো কিছুক্ষণ বাকি।প্রকৃতি এই সময়ে তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে বিরাজ মান থাকে।ত্রয়ীর দুহাতে সাদা বেলি ফুলের মালা।চুলগুলো বেনি করে একসাইডে এনে রেখেছে।কানে মাঝারি সাইজের ঝুমকো।ব্যাস কেবল এতটুকুই সাজে সেজেছে মিসেস এডভোকেট।ত্রয়ী অবাক হয়ে সাদা শার্ট পরিহিত সুপ্তের পানে তাকায়।অবাক কন্ঠে বলে,
-আপনি কিভাবে জানেন আমি মন খারাপ থাকলে এখানে আসতাম।
-তোমার ব্যাপারে আমি অনেক কিছুই জানি যা তুমি জানো না।
সুপ্ত গাড়ির দরজায় হাত দিলে ত্রয়ীও বেরিয়ে আসে।কাশবন থেকে একটু সামনে এগোলেই নদী পাড়।
গাড়ি থেকে বেরোতেই সতেজ হাওয়া এসে গায়ে লাগে।সুপ্ত বলে উঠে,
-আমি জানি এবার তুমি কোথায় যাবে।
সুপ্ত ত্রয়ীর হাত ধরে নদী পাড়ে নিয়ে আসে।দমকা হাওয়া ছুঁয়ে যায় দুজনকে।সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে তাকায় গাঢ় ভাবে।বাতাসে উড়ছে ত্রয়ীর শাড়ির আঁচল,কানের পিঠ থেকে বেরিয়ে থাকা এলোচুল।দুলছে কানের ঝুমকো।নাকের ছোট পাথরটা শোভা বাড়াচ্ছে স্বর্ণাভ বরনের।ত্রয়ী প্রফুল্ল চিত্তে সুপ্তের পানে তাকাতেই দেখে সুপ্ত তার দিকেই তাকিয়ে।গাঢ়,অন্যরকম চাহনিতে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে ত্রয়ীর কপোল।
সুপ্ত মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলে উঠে,
-ত্রয়ী নামক শুভ্র পুষ্পের মনে জমে থাকা সকল মেঘ আকাশের ওই মেঘ হয়ে উঠুক।আপনার মনে কেবল আধিপত্য ছড়াক কেবল মাত্র আমার ভালোবাসা।
চলবে..
#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২০.
সূর্য অস্তমিত হওয়ার শেষ মুহুর্ত।গোধূলির আকাশের লাল আভা ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে আঁধার ছেয়ে যাচ্ছে বিশাল আকাশ জুড়ে।
হাতে একগুচ্ছ কাশফুল নিয়ে দোলাচ্ছে ত্রয়ী।প্লবনের তোড়ে উড়ে যাচ্ছে সাদা সাদা পেজা তুলোর মতো অংশ।সুপ্ত অনিমেষ চেয়ে অর্ধাঙ্গিনীর উল্লাসিত মুখশ্রীর পানে।অপলক সে চাহনি!
ত্রয়ী কাশফুল দোলাতে দোলাতে সুপ্তের পানে তাকিয়ে বলে,
-আমি কখনো ভাবিও নি আপনার মতো একজনকে স্বামী হিসেবে পাবো!
-কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম।
ত্রয়ী সুপ্তের পানে দৃষ্টি আটকায়।হাত দোলানো বদ্ধ করে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-কি ভেবেছিলেন?
সুপ্ত ঘাসের উপর বসে পরে।ত্রয়ীও তার পাশে বসে উত্তরের অপেক্ষায় তার পানে তাকায়।মায়া ভর্তি চাহনি নিয়ে চোখ বুলায় সুপ্তের চাপ দাঁড়ি ঘেরা সুদর্শন মুখশ্রী।সুপ্ত তার দিকে তাকতেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে দুজনের।তবে চোখ সরানের তাড়া নেই দুজনের।সুপ্ত ত্রয়ীর সুশ্রী মুখশ্রীতে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে,
-সাদা এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে প্রতিদিন মেডিকেলের উদ্দেশ্যে ছোটা মিস ত্রয়ী মেহরোজকে খুব জলদিই মিসেস ত্রয়ী সুপ্ত রেহনেওয়াজ বানানো আবশ্যক।
.
পরদিন সকালে শাওয়ার নিয়ে রেডি হতে শুরু করে সুপ্ত।সাদা শার্ট ইন করে পরা আর কালো প্যান্ট।হাতে ব্রাউন কালার বেল্টের ঘড়ি।ত্রয়ী নিজেও তৈরি হচ্ছিল কলেজের জন্য।পরনে কালো রঙের গোল জামা।দীঘল কেশ ফ্রেঞ্চ বেনি করে নিয়েছে।এটা করতে তাকে বেশ সময় ব্যয় করতে হয়েছে সেহেতু লম্বা চুল।বেনি করার পর আয়নার সামনে দাড়িয়ে আড়চোখে সুপ্তকে দেখছিল ত্রয়ী।সুপ্তের চোখমুখ গম্ভীর। তার শার্টের হাতা ফোল্ট করা শেষ হলে ত্রয়ী বলে উঠে,
-একটা কথা বলি?
সুপ্ত ঘাড় ঘুড়িয়ে ত্রয়ীর পানে তাকায়।তারপর আবার আয়নায় তাকিয়ে ত্রয়ীকে দেখতে দেখতে বলে,
-হুম বলো।
-আমিও আপনার সাথে কোর্টে যাই?
সুপ্ত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ত্রয়ী তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,
-দ্বিতীয় বারের মত আপনার আরেকটা কেস জেতার সাক্ষ্য হই।
-দ্বিতীয় বার?আমি এখন অবধি ৭৮ টা কেস লড়েছি মিসেস।আর সবগুলোতেই জেতার তকমা লাগিয়েছি।
-আরেহ!আমি কি সেটা বলেছি নাকি।আমি সচক্ষে দ্বিতীয় বারের মত দেখব সেটার কথা বলেছি।যাই আপনার সাথে?
সুপ্ত ত্রয়ীর অনুরোধে পূর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-ঠিক আছে।আমি নিচে যাচ্ছি।তাড়াতাড়ি এসো।
সুপ্ত চলে যেতেই ত্রয়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত সম্পূর্ণ রেডি হয়ে নেয়।
কোর্টে যাওয়ার আগে অফিসে আসে সুপ্ত।চাবি ঘুরিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকতেই নিঝুমকে চোখে পরে তার।আচমকা সুপ্তকে এভানে দেখে চমকে উঠে নিঝুম।সুপ্তের ড্রয়ার থেকে সন্তর্পনে হাত সরিয়ে নিয়ে মেকি হেসে সুপ্তের পানে তাকায়।
-গুড মর্নিং স্যার।
-মর্নিং।
সুপ্তের গলার স্বর খুব গম্ভীর দেখে মনে মনে ভয় পায় সে।সুপ্ত নিঝুমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ড্রয়ারে কেয়ার রিপোর্টটা আছে কি না।রিপোর্টটা আছে দেখে নিঝুমের প্রতি সুপ্তের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে।নিঝুমের ঠোঁটের হাসি আরো গাঢ় হয়ে উঠে।পায়ের শব্দ পেয়ে পেছনে তাকাতেই একজন রমনী চোখে পরে তার।ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায় নিঝুম।
কালো জামা,সাদা ওড়না পরিহিতা রমনীর চেহারায় মেকাপ নামক প্রসাধনীর আস্তরণ না থাকা সত্বেও মুখশ্রী জুড়ে এক অনরকম সৌন্দর্য বিরাজমান।লাইটের আলোয় পাথুরে নোজপিন জ্বল জ্বল করছে।ঠোঁটে হালকা মেরুন রঙের লিপস্টিক আর চোখে সরু কাজলেই অসম্ভব স্নিগ্ধময়ী লাগছে তাকে।নিঝুমের বুঝতে দেরি হয় না এই মেয়েই সুপ্তের অর্ধাঙ্গিনী।সে সামান্য হেসে সুপ্তের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
-ইনি আপনার মিসেস স্যার?
-ইয়াহ।
নিঝুম ত্রয়ীর পানে তাকায়।তারপর তার আর ত্রয়ী গায়ের রঙের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
-গায়ের রং তো আমার থেকে একশেড কালো।তবুও এত হ্যান্ডসাম,ব্যাক্তিত্ববান,নামকরা এডভোকেটের বউ হতে পারলো!সবই ভাগ্য!
সুপ্তের আশেপাশে থাকার কারনে সুপ্তের উপর সাময়িক মোহিত হয়েছে সে।তাই থেকেই এমন ঈর্ষানিত চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে তার মনে।
সুপ্ত রিপোর্ট নিয়ে বেরোতেই ধরলেই নিঝুম বেরিয়ে আসে।ত্রয়ী আসে সুপ্তের সাথে সাথে।আড়চোখে একবার নিঝুমের পানে তাকায়।ফর্মাল শার্ট,প্যান্ট কোর্ট পরিহিতা এই রমনী সুপ্তের এসিস্ট্যান্ট!সুপ্তকে অনেকবার ফোনে নিঝুম নাম বলতে শুনেছে সে।সে ধরেই নিয়েছিল উনার এসিস্ট্যান্ট একজন ছেলে।
সুপ্ত গাড়ির কাছাকাছি এসে নিঝুমের উদ্দেশ্যে বলে,
-যেহেতু গন্তব্য এক আপনি আমাদের সাথেই আসুন মিস নিঝুম।
নিঝুম কোন প্রকার নাকোচ না দেখিয়ে সুপ্তদের সাথেই গাড়িতে আসে।
কোর্টে পৌঁছাতেই আরসালানকে কাঠ গোড়ায় দেখে ঘৃনিত দৃষ্টিতে একবার চায় ত্রয়ী।তারপর তাকায় তার প্রানপ্রিয় অর্ধাঙ্গের পানে।গায়ে কালো কোর্ট জড়ানো অবস্থাতেও কি মারাত্মক আকর্ষণীয় লাগছে উনাকে!
কেসে শুরু হয় জজ সাহেব কোর্টে আসার পর।প্রথমে কথা শুরু সুপ্ত।
-মিস্টার আরসালান চৌধুরী।দ্বিতীয় বারের মতো কাঠ গোড়ায় অপরাধীর স্থানে আপনাকে আমি আশা করিনি কেননা এখনো আপনার প্রথম কেসের সাজা শেষ হয়নি।যাই হোক!আপনি কেয়া নামের এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে ১০ তারিখ রাতে রেপ করেন এটা স্বীকার করাতে আদালতের সময় খুব একটা ব্যয় হবে না।
-অবজেকশন ইউর ওনার।মিস্টার সুপ্ত আমার ক্লাইন্টের উপর মিথ্যা অভিযোগ করছে।
সুপ্ত ডিফেন্স ল্যয়ার মিস্টার আহমেদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুফ মিস্টার আহমেদ?আপনি যা বলছেন তার সত্যতা কি?
-আমিও সেটাই বলছি মিস্টার সুপ্ত।ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুফ?
আমার ক্লাইন্ট মেয়েটি কে রেপ করেছে এটার কোন সাক্ষ্য কিংবা প্রমাণ আছে আপনার কাছে।
-জ্বি অবশ্যই।
সুপ্ত জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
-মিস কেয়ার মেডিকেল রিপোর্ট আপনার কাছে পেশ কাছে পেশ করা হ’য়েছে।দয়া করে সেটা দেখার অনুরোধ রইলো।সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে মিস কেয়ার দেহে যে বহিরাগত ডিএনএ পাওয়া গেছে সেটা অভিযুক্তের সাথে মিলে যায়।এ ব্যাপারে বলার জন্য আমি ডক্টর কিরনকে কাঠ গোড়ায় আনার অনুমতি চাইছি।
জজ সাহেব রিপোর্ট খুলতে খুলতে বলেন,
-গ্রান্টেড!
ডক্টর কিরন কাঠ গোড়ায় এসে উপস্থিত হতেই জজ সাহেব ভ্রু কুঁচকে বলে উঠেন,
-মিস্টার সুপ্ত আপনি বলেছেন অভিযুক্তের সাথে অভিযোগকারীর শরীরে পাওয়া ডিএনএ ম্যাচ করে বাট এই রিপোর্ট তো বলছে অভিযোগকারী অর্থাৎ মিস কেয়া স্টিল ভার্জিন!
সুপ্ত অবাক চোখে জজের দিকে তাকায়।ডক্টর কিরন বলেন,
-ইউর অনার,সরি ফর দ্যাট।মিস্টার সুপ্ত যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল।কেয়া মেয়েটির সতিত্ব হারায়নি।
-মিথ্যা!
আদালত থেকে একটা মেয়েলি প্রতিবাদী কন্ঠ ভেসে আসে।ত্রয়ী শব্দের উৎসের খোঁজে চোখ বুলায়।সুশ্রী চেহারার একজন রমনী ক্ষোভের সহিত বলে উঠে,
-এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ইউর অনার।এই আরসালান চৌধুরী আমায় রেপ করেছে!সতিত্ব নাশ করেছে আমার।অথচ আপনি আমাকে ভার্জিন বলে দাবি করছেন ডক্টর কিরন?
-মিস কেয়া আপনি কাঠ গোড়ায় এসে আপনার বক্তব্য দিন।
কেয়া কাঠ গোড়ায় এসে দাড়ালে ত্রয়ীর কাছে তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠে।গোলগাল বরনের শুভ্র চেহারায় যেন কলঙ্কের দাগ লেপ্টে।ত্রয়ী শুষ্ক চোখে অনুশোচনার অশ্রু জমতে শুরু করে।তারপর তাকায় সুপ্তের পানে।কিছুটা নির্জীব হয়ে সবটা দেখছে যেন!
কেয়া বিপরীত কাঠ গোড়ায় আয়েশ করে দাঁড়ানো আরসালানের দিকে চায়।তার দিকে একপলক তাকিয়ে অন্য দিকে তাকায় সে।ঘৃনায় রাগে কেয়ার নাকের পাটা ফুলে উঠে।আরসালানের পানে আঙুল তুলে ক্ষোভের সহিত বলতে শুরু করে,
-এই পাপী আমার সম্মান হরন করেছে জজ সাহেব।
-আপনি আমার ক্লায়েন্টের উপর মিথ্যা আরোপ করছেন মিস কেয়া।ইউর অনার এই মেয়েটা যে মিথ্যা বলছে তার সাইন্টিফিক প্রমাণ আপনার কাছে স্বয়ং তার ল্যয়ারই পেশ করেছেন।
-মিথ্যা!মিথ্যা কেন বলব আমি?একজন মেয়ে কেন তার রেপ হয়েছে বলে মিথ্যা বলবে?
কেয়ার ভেজা কন্ঠের কথা সমাপ্ত হতেই সুপ্ত বলে উঠে,
-একজেক্টলি ইউর অনার!কেন একজন মেয়ে এমন মিথ্যা বলবে?
-টাকা মিস্টার সুপ্ত,টাকা!
মিস্টার আহমেদের কথায় ভ্রু কুঁচকায় সুপ্ত।মিস্টার আহমেদ বলতে শুরু করে,
-এখানে স্পষ্ট ইউর অনার।মিস কেয়া টাকার জন্যই আমার ক্লাইন্টের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা করেছে।তাই আমি সবকিছু বিবেচনা করে আপনাকে আমার ক্লাইন্টকে এই দোষারোপ থেকে অব্যাহতি ও মিস কেয়া ও তার ফ্যামেলিকে মিথ্যা মামলা করে সকলের সময় নষ্ট ও সম্মানে আঘাত করার জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের অনুরোধ জানাচ্ছি।
মিস্টার আহমেদের কথা শুনে সুপ্তের মুখ থেকে বিস্ময়ের সহিত আপনা আপনি উচ্চারিত হয়,
-অবজেকশন ইউর অনার।
-অবজেকশন অভাররোল!
চলবে…
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।