হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-২০

0
674

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২০
দেখতে দেখতে প্রিয়াদের মিড১ পরীক্ষা এসে পরেছে। সপ্তাহ খানেক চলবে পরীক্ষা। সপ্তাহ জুরে জারিফের সাবজেক্টের পরীক্ষা ছাড়া প্রিয়া আর জারিফের ভার্সিটিতে দেখাই হবে না। পরীক্ষা শেষ হলে সরাসরি বাড়ি ফিরবে কারণ টানা চারদিন পরীক্ষা। আগামীকাল পরীক্ষা আর প্রিয়া ফোন অফ করে পড়ছে। গত সেমিস্টারে সে মিড পরীক্ষাগুলোতে এতো পড়েনি কিন্তু এবার পড়ছে। বেচারির নাজেহাল অবস্থা। হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দ হলে প্রিয়া চি*ল্লিয়ে বলে,

“ডোন্ট ডিস্টার্ব। আমি পড়ছি।”

কিন্তু অপরপাশের ব্যাক্তিটি মনে হয় কথাটা আমলেই নিলো না! আবারও পালাক্রমে করাঘাত করেই যাচ্ছে। প্রিয়া বুঝে গেছে এটা তার গুনধর ভাইয়ের কাজ। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে প্রিয়া। প্রিয়াকে দরজা খুলতে দেখা মাত্রই প্রিয়ম দাঁত কে*লিয়ে নিজের ফোনটা প্রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়া চোখ বাঁকিয়ে তাকায়। প্রিয়ম গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,

“এই রাত বারোটায় তোর বরের তোর কথা বারবার মনে পরছে। নে কথা বল।”

প্রিয়া অবাক হয়। এতো রাতে জারিফ ফোনই বা করলো কেনো? প্রিয়ম আবারও বলে,

“পরীক্ষার আগেরদিন যতো পড়া তোর! ফোন-টোন অফ করে সে পড়ে উলটিয়ে ফেলতেছে। কই একটু ইশার সাথে কথা বলব! কিন্তু না। এখন ছোটোবোন ও বেস্টফ্রেন্ডের প্রেমালাপের বাহক হতে হচ্ছে!”

প্রিয়া প্রিয়মের কথা পাত্তা দিলো না। ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো। লম্বাশ্বাস নিয়ে প্রিয়া সালাম দেয়। অপরপাশ থেকে জারিফও সালামের প্রতিউত্তর করে তারপর জারিফ বলে,

“পড়া কতোদূর? সব রিভিশন শেষ?”

নিমিষেই প্রিয়ার মনে অভিমান জমলো। লোকটা ফোন করলে শুধু পড়াশোনা নিয়েই কথা বলে। হোক সে স্যার! সেটা ভার্সিটিতে। কিন্তু ফোনে কথা বলার সময় তো বর হিসেবেই কথা বলবে তাই না? জারিফ প্রিয়ার জবাব না পেয়ে বলল,

“কী হলো?”

প্রিয়া তাগদা দেখে জবাব দিলো,

“না কিছু না। এক দফা রিভিশন শেষ। আরেকদফা শুরু করেছি সেটা শেষ হলেই ঘুমাব। আপনি কী করেন? খেয়েছেন?”

জারিফ হালকা হেসে বলল,
“হ্যাঁ। আমি রাত দশটায় ডিনার করি। বেশি হলে সাড়ে দশটা। তুমি তো খাওনি। পরীক্ষার আগেররাতে কিছুটা খেতে হয়। তুমি তো খাও না। তোমার পছন্দের চকলেট হরলিক্সই নাহয় খেয়ে নেও।”

প্রিয়া আবারও অবাক হলো। লোকটা তবে ওকে খেতে বলা জন্য ফোন করেছে? নিশ্চয়ই এই তথ্য তার ভাই লোকটাকে দিয়েছে। প্রিয়া জারিফকে বুঝ দিতে বলে,

“আচ্ছা খেয়ে নিবো।”

“এটা ভেবো না যে প্রিয়ম আমাকে এখন জানিয়েছে!”

“তো জানলেন কী করে আমি খাইনি?”

জারিফের রহস্যময় কথার পিঠে প্রিয়ার অবাক কন্ঠ শুনে জারিফ হাসলো তারপর বলল,

“যখন কলেজে পড়তাম তখন পরীক্ষার আগ মূহুর্তে প্রিয়ম খাবার জিনিস যা সামনে দেখতো তাই খেতো আর একদিন বলেছিল, ‘আমার বোন পুরোই আমার বিপরীত। সে পরীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত এতোই টেনশনে থাকে যে তার খাওয়া উঠে যায় আর আমাকে দেখ! এতো খিদে পায় কী বলব!’ এবার বুঝেছো?”

প্রিয়ার ঠোঁটের কোনে অজান্তেই হাসি ফুটলো। সে বলল,
“অতো আগের কথা মনে রেখেছেন? আপনার স্মৃতিশক্তি তো মাশাআল্লাহ্ তুখড়! যাক বাচ্চারা আমার মতো ভোঁতা মস্তিষ্কের না হলেই হয়।”

জারিফ কিছুটা জোরেই হেসে ফেলল। তারপর বলে,
“পরীক্ষার চিন্তায় তোমার চিন্তা-ধারা অনেক ফার্স্ট হয়ে গেছে প্রিয়া। যাও কিছু খেয়ে পড়তে বসো তারপর জলদি ঘুমিয়ে যাও। বারোটার বেশি বাজে।”

জারিফ ফোন কে*টে দেয়। প্রিয়া চাইছিল আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে কিন্তু জারিফের শেষোক্ত কথায় তার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। প্রিয়মকে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে প্রিয়া চকলেট হরলিক্স বানিয়ে পড়তে বসে।

_______

সপ্তাহ জুরে মিড শেষে এবার স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলো প্রিয়া, মিমরা। পরীক্ষা শেষের খুশিতে একটু ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছে করছে তাই বন্ধুরা মিলে হাতিরঝিল চলে গেলো বোটে চড়তে। এদিকে জারিফ অনেকক্ষণ যাবত প্রিয়াকে মেসেজ করছে সাথে ফোনে ট্রাই করছে কিন্তু নট রিচেবল বলছে। জারিফ চেয়েছিল প্রিয়াকে নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে যাবে। গাড়ি নিয়ে অপেক্ষাও করছে। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে জারিফ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চলে যায়। এবার আর প্রিয়মকে জানালো না।

বাড়ি ফিরে মুন্নিকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে আসে জারিফের। মুন্নি রীতিমত হিঁচকি তুলে কাঁদছে। জারিফের ভাবী তামান্না জারিফকে ধীর কন্ঠে বলে,

“ভাই, এই মেয়ে আসছে পর থেকে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদেই চলেছে। তুমি যে এসেছ তা সে জানেনা। দেখলে না? কলিংবেল দেওয়ার আগেই আমি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম? ভাগ্যিস বারান্দায় তুতুলের জামা আনতে গিয়েছিলাম। এখন জলদি করে নিজের রুমে চলে যাও ভাই। যা মেয়ে! এমনভাবে কাঁদছে কখন জানি তোমার গলায় ঝুলে পরে!”

জারিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। যেই না জারিফ নিজের রুমে প্রবেশ করবে তখনি আচানক মুন্নি দৌঁড়ে এসে জারিফকে পেছোন থেকে জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক আক্রমনে জারিফ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে। মুন্নিকে নিজের থেকে ঝাড়া দিয়ে সরায়। মুন্নি তখনও কেঁদেই চলেছে। জারিফ নিজের শার্টের পেছোনে কাঁধের কাছে নজর দিয়ে দেখলো কিছু অংশ ভিজে গেছে। জারিফ কান্নারত মুন্নিকে বলে,

“তুমি বড়ো হয়েছ মুন্নি। এখন আর সেই ছোটো নেই যে বাছ-বিচার ছাড়া যা খুশি করবে। বিহেভ ইউরসেল্ফ। ইন ফিউচার যেনো এমন না হয়।”

মুন্নি জারিফের চেতাবনির তোয়াক্কা করলো না। কান্নারত ভেজা কন্ঠস্বরে বলল,

“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জারিফ ভাই। খুব খুব ভালোবাসি। আমার সাথে এমনটা করো না। আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিও না দয়া করে।”

জারিফ মুন্নির কাকুতিমিনতি করা চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,

“যাকে বোনের নজরে দেখি, তাকে অন্য নজরে কল্পনা করাও দুষ্কর। তোমাকে ছোটো থেকে বোনের নজরে দেখে এসেছি। আমার ও জায়ান ভাইয়ার ছোটো বোনের খুব শখ ছিল কিন্তু নেই। তাই কাজিন বোনদের আমরা বোনের নজরেই দেখি। তুমি ও ফিহা আমার কাছে ছোটোবোন। এখন তোমার মনের ভাবনা তো তুমি আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারো না। আমি এখন বিবাহিত। আশা করব এসব নিয়ে ঝামেলা করবে না।”

মুন্নির হৃদয়ের ক্ষত যেনো গভীর হলো। জারিফকে আরও কাকুতিমিনতি করেও জারিফের মন গলাতে পারলো না। জারিফ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে আর মুন্নি দরজার বাহিরে বসে কাঁদতে থাকে। মুন্নিকে কাঁদতে দেখে জমিলা আহমেদও কাঁদছেন। তিনি তরুণীমা বেগমকে বলেন,

“কেনো এমন করলেন ভাবী? বিয়েটা মুন্নির সাথে হয়ে গেলে কিছুদিন পর জারিফ এমনিতেই মেনে নিতো। আমার মেয়েটা এই দুই-তিন সপ্তাহ কিভাবে ছিল আমি দেখেছি। কাল না পারতে আমায় এসে বলেছে সে এখানে আসবে। মেয়েটা আমার জীবিত লা*শ হয়ে গেল।”

তরুণীমা বেগম ননদের কথায় খানিকটা ব্যাথিত হলেও নিজেকে সংযত করে বলেন,

“আমার ছেলের পছন্দ না তেমনি আমারও আত্মীয়র মধ্যে সম্বন্ধ করাটা পছন্দ না। যদি আমার ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইতো তবে আমি রাজি হতাম কিন্তু…!”

এদিকে তামান্না মুন্নিকে মেঝে থেকে জোর করে তুলে গেস্টরুমে নিয়ে যায় তারপর নিজেই ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে আচানক ঝর্ণা ছেড়ে দেয়। মুন্নি পানির স্পর্শে হুশে ফিরে। মুন্নিকে তামান্না শক্ত করে ঝর্ণার নিচে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। মুন্নি তামান্নার চোখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,

“তোমরা তো জানতে আমি জারিফ ভাইকে কতোটা ভালোবাসি। তাকে একবারের জন্য বলতে। এতো ভালোবাসা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু সে মূল্য দিলো না!”

তামান্না নরম স্বরে বলে,
“যার ভাগ্যে যে থাকে আর যার যাকে ভালো লাগে। তুমি জারিফ ভাইকে ভালোবাসো এটা সে জানে আর সে তোমাকে সেই নজরে দেখে না। নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক আর গুমোট করো না। নিজেকে গুছিয়ে নেও। এক মাস পর তোমার এইচএসসি পরীক্ষা। পড়ালেখায় মনোযোগ দেও আর ভুলে যেতে চেষ্টা করো, জারিফ নামক মানুষটাকে তুমি ভালোবাসো। জানি কস্টকর কিন্তু এটাই মঙ্গলজনক।”

মুন্নি ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে পরলো তারপর নিরবে ঝর্ণার পানির সাথে অশ্রুবিলাশ করছে। তামান্না হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে।

_________

সন্ধ্যার পর প্রিয়া বাড়ি ফিরে। বাসায় বলেই গিয়েছিল বলে কেউ কিছু বলল না। ফোনটাকে চার্জে বসিয়ে এই রাতেরবেলা কুসুম গরম পানি দিয়ে শাওয়ার সেরে নিলো। চার্জে থাকা অবস্থায় ফোনটা অন করে তার চোখ কপালে উঠার দশা! মেসেজ কতোগুলো আর হোয়াটসএপেও তিন-চারবার মিসডকল। সব জারিফের নাম্বার থেকে। প্রিয়া এক ছুটে তার ভাইয়ের রুমে উুঁকি দিলো। নাহ্! তার ভাই এখনও আসেনি। মায়ের ফোনটা এনে চেক করে দেখে প্রিয়মের নাম্বার থেকে সকালের পর আর ফোন আসেনি। প্রিয়া স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয়। ফোনটা আরেকটু চার্জ হওয়ার অপেক্ষা করে। তারপর জারিফকে ফোন করবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,