হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-২৫+২৬

0
644

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
দেখতে দেখতে আরও অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। প্রিয়াদের মিড২ পরীক্ষাও শেষ। জারিফ ও প্রিয়ার আনুষ্ঠানিক বিয়ের লগ্নও নিকটবর্তী। মাস খানেকের মত সময় অবশিষ্ট আছে। বিয়ের তোরজোরও চলছে সমানতালে। ইতোমধ্যে ভার্সিটিতে জারিফের কলিগরা সবাই জেনে গেছে প্রিয়া ও জারিফের সম্পর্কে। তারা জারিফকে এই নিয়ে কুমন্তব্য করেনি। অভিনন্দন জানিয়েছে। জারিফ প্রিয়ার পরীক্ষার খাতাও নিজে দেখেনি। দেখিয়েছে চেয়ারপার্সন স্যারকে দিয়ে। জারিফের এইসব কাজে অন্য কলিগরা মুগ্ধ হয়েছেন যদিও এসব কাজের কোনো প্রয়োজন ছিল না।

গতকাল রাতে প্রিয়া জারিফের কাছে একটা আবদার করেছে, তাকে নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে যেতে হবে। তার রিলেশনশিপে থাকা বান্ধুবীরা কতো ছবি স্টোরি দেয় আর সে বিবাহিতা হয়েও পারেনা। অভিমান নিয়েই জারিফকে বলেছিল কিন্তু জারিফ সেই অভিমান ভাঙাতে রাজী হলেও ছবি স্টোরি দেওয়াটা সমর্থন করলো না কারণ এখনও সবাই জানেনা প্রিয়া ও জারিফ স্বামী-স্ত্রী। প্রিয়া সেই থেকে মুখ গোমড়া করে আছে। জারিফ সকালে ভার্সিটিতে এসে প্রিয়াকে তার অফিসরুমে আসতে বলেছে আর প্রিয়া এখনও যাচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। নিশি, মিম, অর্ষারা বুঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

“যা দোস্ত। স্যার তো ঠিকই বলেছে তাই না? বুঝ একটু।”

“তোদের স্যার ভুলটা কখন বলে সেটা বল! এখন বান্ধুবী পর হয়ে গেলাম! আর এদিকে দেখ, শিফা রূপারা আমার একমাত্র বরের উপর ক্রা*শের উপর ক্রা*শ খেয়েই চলেছে। ওদের ব*দ নজরে আমার বরের যদি কিছু হয়! কালকেও রূপাকে ওসব বলতে শুনেছি। কতো কল্পনা ঝল্পনা তাদের আমার বর নিয়ে!”

প্রিয়ার দুঃখ ভরা বচন শুনেও ওদের মনে দুঃখের লেশমাত্র পরিলক্ষিত হলো না। তার বদলে সমস্বরে হাসির রেশ উঠলো। প্রিয়া ওদের হাসতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

“তোরা হাসছিস! কেমন ফ্রেন্ডরে তোরা! ধ্যাত! কেউ আমাকে পাত্তাই দেয় না।”

মিম বলে উঠে,
“ক্রা*শ যত ইচ্ছা ততো খাক! একমাস পরে সেই ক্রা*শ বাঁ*শে পরিণত হবে ওদের। তুই শুধু শুধু ইনসিকিউর হচ্ছিস। এখন যা স্যার কখন ডেকে পাঠিয়েছে।”

প্রিয়া উঠেই যাচ্ছিলো হুট করে আয়ানের দিকে নজর গেলো। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে ছেলেটা। দৃষ্টি নিচের দিকে। প্রিয়া আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আর আয়ান তুইও! সাজেক থেকে আসার পর থেকে আমার সাথে তোর একটা শব্দ বিনিময় হয়েছে বলে মনে পরছে না। মানলাম তুই কম কথা বলিস কিন্তু এতো কম! ভাই তুই কি ছ্যাঁ*কা খেয়েছিস নাকি? সাজেকে কোনো হৃদয়হরণীর দেখা পেয়েছিলি? তো কে সে? যার বিরহে তুই একদম মিইয়ে গেছিস! আমাদেরও বল।”

আয়ান প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো অতঃপর স্বল্প শব্দে বলল,
“সেরকম কিছু না। স্যার ডেকেছেন তুই যা।”

প্রিয়া কিছু সেকেন্ড আয়ানের দিকে তাকিয়েও ব্যাপারটা বুঝে উঠলো না। হাঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করে উঠলে প্রিয়া ফোনে জারিফের মেসেজ “তুমি কি আসছ?” দেখে জলদি করে ওদেরকে হাতের ইশারাতে বলে করিডোরের দিকে দৌঁড় দিলো। প্রিয়া যেতেই আয়ানের হুট করে এতোদিন পর পিহুর কথা মনে পরে গেলো। মেয়েটার কথা মনে পরার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ও অর্থ নিজের মনে খুঁজে পেলো না সে। কারণ ছাড়াই হেসে উঠলো। রাদ ও সাদ আয়ানকে হাসতে দেখে মলিন হাসলো।

______

“তোমার অভিমান কি কিছুটা হলেও কমেছে? কমে থাকলে আমি তোমায় কিছু বলতাম।”

জারিফের আদুরে স্বরে প্রিয়া আঁড়নজরে তাকালো। জারিফের অফিসরুমে এসে সে কয়েকমিনিট মুখ ঘুরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিল। এবার জারিফের কথাতে সে চোখের ইশারায় সায় দেয়। জারিফ বলে,

“এখন আমরা যেখানেই ঘুরব তার সব ছবি একমাস পরে সুন্দর একটা ভিডিও বানিয়ে স্টোরি দিতে পারো। রিক্রিয়েট দ্যা মোমোরি। আইডিয়াটা কেমন?”

প্রিয়া কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলে,
“আচ্ছা। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে।”

“বলো।”

“আপনি কাল থেকে শিফা, রূপাদেরকে ক্লাসে একদম পাত্তা দিবেন না। ওদের সাথে রুডলি কথা বলবেন। ওদের সামনে হাসবেন না। চুলে হাত বুলাবেন না। পকেটে হাত গুঁজবেন না।”

জারিফ ভ্যাবলার মতো প্রিয়ার মুখপানে চেয়ে আছে আর প্রিয়া খুব সুন্দর করে মুচকি হাসিতে তাকিয়ে আছে। কিয়ৎক্ষণ পর জারিফ হালকা কেশে বলে,

“স্টুডেন্ট হিসেবে তারা প্রশ্ন করে আমি উত্তর দেই। এইতো!”

“না এইতো না। ওরা আপনাকে নিয়ে কী ভাবে আমি জানি। ওই চু*রা*য়েল গুলোকে আমি নর্দ*মাতে চু*বাবো! ওদের আমি রুফটপে নিয়ে ফেলে দিবো!”

জারিফ চোখ বড়ো বড়ো করে আতর্কিত হয়ে বলে,
“হেই রিল্যাক্স! যে যা খুশি ভাবুক। ওদিকে তোমার ভাবার দরকার নেই। ক্রা*শ এখন অহরহ মানুষ খায়। সো রিল্যাক্স।”

প্রিয়া আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলো। জারিফ হতাশ কন্ঠে বলে,
“আমাকে আমার প্রফেশনের জন্য রুডনেসটা আনা যাবে না। ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ক্লাসের পর ওয়েট করবে। রবীন্দ্র সরোবরে যাবো। এখন তোমার ক্লাস আছে না?”

প্রিয়া জবাব না দিয়ে জারিফের দিকে অভিমানী নজরে তাকিয়ে চলে গেলো। প্রিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেলে জারিফ ঘার নুইয়ে হাসে। বাহিরে গিয়ে প্রিয়াও মুখে হাত দিয়ে হাসে। সে তো এতক্ষণ জারিফের সাথে অভিমান করার অভিনয় করছিল। জারিফকে এই সামান্য পেরেশান হতে দেখে প্রিয়ার কেনো জানি জারিফের কেয়ারিং ভাবটা অনুভব হচ্ছিলো।

————-

ক্লাস শেষে প্রিয়াকে নিয়ে জারিফ রবীন্দ্র সরোবরে যায়। সেখানে গিয়ে প্রিয়া নিজে জারিফের হাত ধরে হাঁটছিল। জারিফের হাতের দিকে তাকালে প্রিয়া ফিসফিস করে বলে,

“এখানে সব কাপলরা হাত ধরেই হাঁটছে দেখেছেন? আমরা হাত ধরে না হাঁটলে কেমন দেখায় না?”

চলতে চলতে জারিফ আলতো হেসে বলে,
“দুইদিন ধরে তুমি উইয়ার্ড বিহেভ করছো না? জাস্ট আস্কিং। নাকি জেলাসির কারণে?”

প্রিয়া জারিফের হাত ছেড়ে দিয়ে কোমড়ে হাত গুঁজে জারিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে সতর্ক স্বরে বলে,

“কী বললেন আপনি? যান যাবোই না আপনার সাথে। হুহ্!”

প্রিয়া এই বলে একা একাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জারিফ কপাল চাঁ*পড়ে প্রিয়ার পেছোনে ছুটতে থাকে। শেষে এক ফুল বিক্রেতাকে দেখে তার কাছ থেকে টকটকে লাল গোলাপ ও একটা কাঠগোলাপের গাজরা নিয়ে প্রিয়ার অভিমান ভাঙাতে উদ্ধত হলো।

“কাঠগোলাপের স্নিগ্ধ শুভ্রতায় আকর্ষিত হয়ে,
আমার ভালোবাসার রঙে রাঙানো
গোলাপ তোমার জন্য হৃদপ্রিয়া!”

জারিফের বলা ছন্দে প্রিয়ার অধরে ব্রীড়া মিশ্রিত হাসির ঝিলিক ফুটলো। প্রিয়া গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে জারিফের দিকে পেছোন ঘুরে ঘার ঘুরিয়ে বলে,

“পরিয়ে দিন।”

জারিফ হালকা হেসে প্রিয়া খোলা চুলে ক্লিপের সাহায্যে কাঠগোলাপের গাজরাটা পরিয়ে দেয়। প্রিয়া এবার জারিফের দিকে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আপনি দিনদিন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছেন জানেন স্যার? ভাইয়া বলেছিল, আপনি প্রেম-ভালোবাসা বুঝেন না। তবে আপনার প্রেমিক হৃদয়ের সাথে সাক্ষাত আমার হয়েছে।”

জারিফ বিনিময়ে হাসলো। এবার নিজেই প্রিয়ার হাত মুঠোবন্ধি করে গোধূলি উপভোগ করছে। প্রিয়া লাজুকলতার ন্যায় লাজরাঙা হয়।

_______

আঁধার অম্বরে একফালি বাঁকা চাঁদের দিকে আয়ান হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। আজ তার পিহুর কথা মনে পরছে। সাজেকে ঘটা প্রতিটা ঘটনাচক্র অক্ষিপটে ভেসে উঠছে। আচ্ছা! মেয়েটা কী তার জন্য অপেক্ষা করেছিল? জানিয়ে আসা হয়নি তো। ছটফটে মেয়েটার কী মন খারাপ হয়েছিল? ভেবেই আয়ান আরেকদফা নিরব হাসে। আয়ান ভেবেছে সে সেমিস্টার ফাইনালের পর খাগড়াছড়ি যাবে। তন্নতন্ন করে হলেও খুঁজে বের করবে উড়নচ*ণ্ডীকে! তারপর বলবে,

“সরি না বলে চলে যাওয়ার জন্য। তাই বলতে এলাম!”

আপনমনেই হাসে আয়ান। কীসব ভাবছে সে! মেয়েটার কথাবার্তাগুলো চমৎকার। আয়ানের মন ভালো করে দিয়েছিল।

এদিকে পিহু সেদিনের পর থেকে মুখ ভাড় করে থাকে প্রায় সময়। ওর বাবা ওকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কারণ তখন পিহু এইচএসসির পর ঢাকা গিয়ে কোচিং করার ইচ্ছা পোষণ করে। পিহু মোটামোটি লেভেলের স্টুডেন্ট। তাই সে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার আশাও রাখেনা। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়লে আয়ান যেখানে পড়ে সেটাতে পড়তে চায়। তার বাবাকে সেই ভার্সিটির নামটাও বলেছে। একমাত্র আদুরে কন্যার আবদার ফেলতে পারেননি পিহুর বাবা। এমনেতেও তিনি পিহুকে প্রাইভেট ভার্সিটিতেই পড়াতেন কিন্তু অতোদূরে মেয়েকে ছেড়ে থাকতে তাদেরও কস্ট হবে। পিহু সেই থেকে আয়ানের সাথে আবারও এক নতুন শহরে নতুন করে দেখা হওয়ার আশায় বুক বাঁধে। তার হৃদয়ে লুকানো প্রেমের মঞ্জিল সে হাসিল করবেই।

চলবে ইনশাআল্লাহ্,

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রিয়াকে নিয়ে জারিফের মা এসেছেন জুয়েলারির ডিজাইন পছন্দ করতে। পছন্দ হলে বানাতে দিবেন। প্রিয়া আসতে চায়নি কিন্তু তামান্না ও তরুণীমা বেগমের অতি উৎসাহতে মানা করতে পারেনি। তাদের মতে, বিয়ে তোমার পরবেও তুমি তো পছন্দও তোমার হওয়া উচিত। কিছুটা সময় নিয়ে জুয়েলারির ডিজাইন পছন্দ করার পর পুরোনো চেনা কারিগরকে ডিজাইন দেখিয়ে ফিরে এসেছে।

বসন্ত ঋতুর বিদায় প্রহর আসন্ন। এপ্রিল মাসের আজ প্রথম দিন। সামনে প্রিয়াদের ফাইনাল পরীক্ষা আসছে। দিনগুলো খুব দ্রুতই পেরিয়ে যাচ্ছে। সেমিস্টার ফাইনালটা এপ্রিলের শেষ অর্ধে। নিশি, মিমরা প্রিয়ার বিয়েতে কী কী করবে ভেবে ফেলেছে। জারিফের শ্যালিকা হিসেবে তখন জারিফকে নাকা*নিচো*বানি খাওয়ানোর দায়িত্ব ওদের। প্রিয়া ওদের পরিকল্পনা শুনে নিজেও এক্সাইটেড!

“আরে ইয়ার! আমিও তোদের সাথে জয়েন হবো। উনার এক্সপ্রেশন কেনো মিস করব বল! কিভাবে না*কা*নিচো*বানি খায় তা দেখব না? উফ জোস হবে!”

প্রিয়ার এক্সাইটমেন্ট দেখে নিশি, মিমরা হেসে লুটোপুটি খাওয়ার দশা। সাদ রম্যস্বরে বলে উঠে,

“ওকে দোস্ত। তুই বউ সাঁজে আমাদের সাথে গেইট ধরবি। টাকা না দিলে আমরা বান্ধুবী দিবো না। স্লোগান হবে!”

আরেকদফা হাসির রোল। ওদের এই হাসি আড্ডা চলতেই থাকে। ফাইনালের সময় এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, কুইজ, ল্যাব সবকিছুর একটা এক্সট্রা প্যারা থাকে। এতো ব্যাস্ততার মধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মনে খানিকটা প্রশান্তির হাওয়া বয়।

______

এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে পহেলা এপ্রিল থেকে। মুন্নির চারটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সে সেই যে জারিফদের বাড়ি থেকে এসেছে তারপর এইচএসসি পরীক্ষার আগেরদিন তার মামা-মামিকে ফোন করে দোয়া চেয়ে আর কথা বাড়ায়নি। জাবেদ সাহেব তার বোনকে বলেছিলেন বিয়ের ডেটটা ওদের জন্যই মে মাসের প্রথম সপ্তাহের পর রাখছ । ততোদিনে মুন্নির প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা বাদে অন্য সব পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু মুন্নি বিয়েতে আসতে চায় না সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সে কিছুতেই বিয়েতে আসবে না। সে বিয়েতে আসলে আবার যদি পা*গলামি করে কোনো ব্যাঘাত ঘটায়? এই ভয় নিয়ে মুন্নি মানা করে দিয়েছে তার জন্য বিয়ের তারিখে দেরি করতে। ওদের সুবিধাজনক সময়ে বিয়েটা হয়ে যাক। তাই এখন বিয়ের তারিখ মে মাসের প্রথম কয়েকদিনেই।

মুন্নিকে এখন আর আগের মতো হাসতে দেখে না ওর বাবা-মা। মেয়ের মনের বিষাদ তাদেরকেও আচ্ছন্ন করে তোলে। মুন্নি মনম*রা হয়ে বিকেলের সময়টা ছাদে বসে থাকে। ওদের বাড়িটা দুইতলা আর নিচের তলায় যেই দুই পরিবার থাকে তারা স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকে চাকুরী করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা চাকুরী তাদের। তাই ছুটির দিন ব্যাতিত অন্যসব দিন ছাদে কেউ উঠে না। মুন্নি একাই উঠে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিন মুন্নিদের বাড়িতে ওর বাবার খুব কাছের বন্ধুর বড়োভাইয়ের ছেলে এসেছে চাকরিসূত্রে একমাসের জন্য থাকবে বলে। এক মাস পর মেসে উঠবে। ছেলেটার নাম রাদিফ। সে একজন মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার। রাজশাহী থেকে দিনাজপুর এসেছে। রাদিফ প্রতিদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ছাদে একটা মেয়েকে খোলা চুলে বসে থাকতে দেখে। সে কেবল মেয়েটির মুখের একাংশই দেখে। মেয়েটি কখনও আকাশের দিকে আবার কখনও অদূরে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। আজ এতোদিন হলো এই বাড়িতে এসেছে সে, সেই প্রথমদিন রাতে খাবারের সময় মিরাজ সাহেব তার একমাত্র মেয়েকে ডেকে এনেছিলেন। সেদিনই প্রথম মুন্নিকে দেখে ও পরিচিত হয় রাদিফ। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মুন্নির সাথে আর দেখাও হয়নি। ছাদে প্রতিদিন বসে থাকা উদাসী মেয়েটা মুন্নি কিনা সেই ব্যাপারেও সন্দিহান রাদিফ। প্রতিটাদিন দেখে মেয়েটাকে। আজ ভাবলো একবার সেই খোলা চুলের রমণীকে সামনাসামনি দেখতে ছাদে উঠবে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে ছাদে উঠলো রাদিফ।

সূর্য অস্ত গেছে এই মাত্র। পশ্চিমাকাশে রক্তিম গোধূলি শেষ আভা ছড়াচ্ছে। ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাদিফ সেই গোধূলির রক্তিম আলোয় এলোকেশীকে দেখছে। আর মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে কায়নাত মুখরিত হবে। রাদিফ ধীর পায়ের ছাদে প্রবেশ করলো তারপর নিঃশব্দে মুন্নির থেকে এক হাত দূরত্বে দাঁড়ালো। রাদিফ কয়েক সেকেন্ড মুন্নিকে অবলোকন করে বুঝলো মুন্নির ধ্যান নেই এখানে। সে অন্য কোনো অপার্থিব বা সম্মোহিত হয়ে আছে। রাদিফ কিছুটা ধীর কন্ঠে বলল,

“এই সন্ধ্যেবেলায় খোলাচুলে থাকতে হয় না। জানেন না?”

নিরবতার মাঝে কারও কন্ঠস্বরে সজ্ঞানে ফিরল মুন্নি। পাশ ঘুরে এক ঝাপসা পুরুষ অবয়ব দেখল। ঝাপসা দেখার কারণ নিরন্তর আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থীর করে রাখাতে এখন সবকিছু অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। মুন্নি চোখ হাত দিয়ে মুছে নেয় তারপর খানিক চোখ বুজে নিয়ে আবার খুলে। রাদিফ মুন্নির থেকে জবাব না পেয়ে আবারও বলে,

“আর কয়েক মিনিট পর আজান পরবে। এই সময় ছাদে আছেন আবার চুলও এলোমেলো করে খোলা। সময়টা কিন্তু তেনাদের ঘোরাফেরার সময়। এখানরার পরিবেশটাও গাছ-গাছালিতে ঘেরা। এসব জায়গা তেনাদের পছন্দ এমনিতেই।”

মুন্নি এবার রাদিফকে খেয়াল করলো। মস্তিস্কে একটু জোর দিয়ে মনে করতে পারলো রাদিফ তার বাবার বন্ধুর ভাতিজা। মুন্নি মলিন হেসে হেয়ালি করে বলে,

“তেনাদের বলতে যাদের বুঝিয়েছেন, তারা আমার উপর ভর করবে না। এমনিতেই আমার মন-মস্তিষ্কে যা ভর করে আছে তা তেনাদের থেকেও ভয়ংকর।”

রাদিফ বেশ মজা পেলো মুন্নির হেয়ালিপূর্ণ কথায়। রাদিফ ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে আরেক কদম সামনের পাশে এগিয়ে বলল,

“তেনারা ভর করলে তখন বুঝতেন। তখন আর এসব বলতেন না। কিছু আবার প্রেমিকও আছে! যারা রূপবতী কন্যাদের উপর নিজেদের নজর বহাল রাখে চিরকাল। তাই এসময় দাদী-নানীদের কাছে শুনেছি, চুল খোলা রাখলেও মাথায় কাপড় রাখতে হয়।”

মুন্নি হেসে উড়না টেনে মাথায় দিলো। রাদিফও নিঃশব্দে হাসলো। রাদিফ জিজ্ঞেস করে,

“আপনার তো এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। কেমন হচ্ছে পরীক্ষা?”

“জি আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো।”

রাদিফ আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
“আপনি সায়েন্স থেকে না?”

“জি।”

রাদিফ ঘার নাড়ালো। মুন্নি আসমানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“আমি তাহলে যাই। এখুনি আজান পরবে।”

“আমিও যাবো। চলুন।”

ওরা ছাদ থেকে নেমে গেলো। একসাথেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। মুন্নির মা ওদের দুজনকে একসাথে ঢুকতে দেখে একটু অন্য নজরে তাকালো বটে কিন্তু কিছুটা খুশিও হলো। রাদিফ ছেলেটাকে তার ভালোই লেগেছে। ছেলেটার ব্যাবহারও সুন্দর। মুন্নির সাথে যদি এই কয়েকদিনে একটু ভাব জমে তবে তিনি মুন্নির বাবাকে বলবেন রাদিফের কথা।

রাদিফ নিজের রুমে যেতে যেতে মুন্নিকে বলে,
“কিছু মনে না করলে বিকেলে আমরা একসাথে চায়ের আড্ডা বসাতে পারি। অ্যাই মিন কালকে আমার অফিস একটু জলদি ছুটি হবে। তখন একটা চায়ের আড্ডা তো হওয়াই যায়।”

মুন্নি চোখে হাসলো তারপর বলল,
“কালকে পর্যন্ত যদি অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয় তবেই।”

রাদিফের কাছে মুন্নির এই বলার ধরণও হেয়ালি লাগলো। মুন্নিতো নিজের রুমের দিকে চলে গেছে। রাদিফও নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

________

রাতে প্রিয়া একটা টপিক বুঝতে পারছে না। টপিকটা অন্য সাবজেক্টের তাও সে ভাবলো জারিফকে জিজ্ঞেস করবে। এখন জারিফ যদি কিছু মনে করে? সেই দোটানায় আছে। ফাইনাল পরীক্ষার আর সপ্তাহ খানেক আছে। এর মাঝে প্রিয়ার একদিন চোখে এলার্জির কারণে ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। সেদিনই সেই স্যার ওই টপিকটা পড়িয়েছে। প্রিয়া চাইলে আয়ানের থেকে বুঝে নিতে পারতো কিন্তু তার তো ভার্সিটিতে গেলে পড়া বোঝার কথা মনেই থাকে না। কিছুক্ষণ ভেবে পরে জারিফকে মেসেজই করলো। প্রিয়ার মেসেজ দেখে জারিফ হোয়াটসএপে কল দিলো। প্রিয়া সালাম দিয়ে বলে,

“আসলে অন্য একটা সাবজেক্টের একটা টপিকটা বুঝতে পারছি না। আপনি কি ফ্রি আছেন?”

“হ্যাঁ। মাত্রই কাজ শেষ করলাম। বলো।”

“ডিনার করেছেন?”

“করব। তুমি বলো।”

“না থাক। আগে ডিনার করে আসেন। তারপর আস্তে ধীরে বলব। যান যান ডিনার করে আসেন।”

জারিফ হেসে ফেলে অতঃপর বলে,
“তুমি ডিনার করেছো?”

প্রিয়া এবার অপ্রস্তুত হয়। কারণ সে তো ডিনার করেনি। সে সন্ধ্যায় নুডুলস আর কফি খেয়েছে। প্রিয়া আমতা আমতা করে বলে,

“রাতে খেয়েছি তো। যান আপনি খেয়ে আসেন। টাটা।”

দ্রুত ফোন কা*ট করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। পাশে থাকা কুকিজের বয়াম খুলে কুকিজ খেতে থাকে। এই চকোলেট কুকিজ তার অনেক পছন্দের।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,