হে সখা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
202

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
চতুর্দশ পর্ব

সৈকত দাঁড়িয়ে আছে বসের কেবিনের বাইরে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবছে। বেশ কয়েকদিন ধরে বসের আলোচনা করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কোনো কারণে বসের মন-মেজাজ ভালো নেই। মুখ থমথমে করে অফিস আসে। সামান্য ভুল পেলেই সবাইকে ধমকায়। সারাটাদিন সবাইকে দৌড় করিয়ে তারপর শুকনো মুখে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। এসবের মাঝে কি আর সৈকত তার ব্যক্তিগত আলোচনা করার সাহস পায়!

লিতুন এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে বসের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলো। দরজার সামনে সৈকতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো৷
– সৈকত স্যার, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন?

হঠাৎ লিতুনকে দেখে সৈকত খানিকটা ভড়কে গেলেও নতুন আশা খুঁজে পেলো। সে ফিসফিসিয়ে লিতুনকে বললো,
– আচ্ছা লিতুন ম্যাম, স্যারের মেজাজ আজকে কি রকম?
– ভালোই। অন্যদিন যেমন থাকে।
– না মানে গত কয়েকদিন বেশ রাগারাগি করলো।
– তা করেছে। কিন্তু আজকে ঠিকঠাকই দেখলাম।
– কফি কি আপনি স্যারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন?
– হ্যাঁ। কেনো?
– স্যারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমাকে জানাবেন প্লিজ। স্যারের সাথে আমি খুব জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। এই সময় স্যারের ফুরফুরে মেজাজে থাকা খুব জরুরি।

লিতুন সৈকতকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। বেচারা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো এক্ষুনি কেঁদে দিবে।

– কি এমন কথা বলবেন?
– সে আপনাকে পরে বলবো৷ আগে আপনি ভেতরের আপডেট জানান আমাকে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দেখে এসে জানাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লিতুন কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। ওর থেকে পজেটিভ রেসপন্স পেয়ে সৈকত এসেছে তার বসের সাথে জরুরি কথা বলতে। স্বল্প বিবরণে যতোটুকু জানানো যায়, সেইটুকু বলার পর কার্ডটি বসের হাতে তুলে দিয়েছে। ওর বস এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে কার্ডের ভেতরে লেখাগুলো পড়ছে৷ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সৈকত খানিকটা সোজা হয়ে বসলো। টেনশনে গত কয়েকদিন বাথরুম হয়নি ঠিকঠাক। এখন মনে হচ্ছে প্রাণ পাখিটাও উড়ে যাবে। নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– আসলে স্যার হঠাৎ করে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো। পাত্রী দেখতে গিয়ে মায়ের এতো পছন্দ হয়ে গেলো যে আর দেরী করতে চাইলেন না। আমার নাকি বিয়ের বয়সও পেরিয়ে যাচ্ছে। মায়ের জোড়াজুড়িতে মাসখানেকের মধ্যে বিয়ের স্বল্প আয়োজনে বিয়েটা সেড়ে নিতে হচ্ছে। আপনি যদি পরিবারসহ উপস্থিত হতেন খুব খুশি হতাম। বেশিক্ষণ সময় দিতে হবে না স্যার। আপনার সুবিধামতো একটা সময় এসে দাওয়াত কবুল করে একটু দোয়া দিয়ে যাবেন।

রেহবার এতোক্ষণ কার্ডে উল্লেখিত বিয়ের তারিখ দেখছিলো। ৩০ নভেম্বর রিসেপশন। এর আগে গায়ে হলুদ, মেহেদী, আকদ, বিদায়, বৌ ভাত সবমিলিয়ে সপ্তাহ লেগে যাবে। অথচ সৈকত মাত্র চারদিনের ছুটির জন্য আবেদন করেছে। তাড়াহুড়োয় বিয়ে করে সে নিজে এখনো ভুগছে। আর কেউ এমন পরিস্থিতির স্বীকার হোক, এটা অন্তত সে চাইবে না। কার্ডটি টেবিলের উপর রেখে সৈকতকে বলল,

– সৈকত সাহেব, বিয়ে জীবনের একটু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে হয় না। চারদিনে বিয়ের আয়োজন ঠিকঠাকভাবে করতে পারবেন না। ছুটতে ছুটতে দিন কেটে যাবে। আপনাকে আমি সাতদিনের ছুটি দিচ্ছি। শুক্রবার সহ মোট আটদিন৷ বিয়ের সকল আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করুন। মন খুলে ইনজয় করুন। একবার বিয়ে হলে গেলে পরে আফসোস করলেও আর এমন দিন ফিরে পাবেন না।

সৈকত খুশিতে বাকহারা হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে এখানে ইয়াহু বলে একটা লাফ দিতে। কিন্তু চাইলেই তো বসের সামনে লাফিয়ে উঠা যায় না। দেখা যাবে বস তার ব্যাঙের মতো লাফানো দেখে বলল, সৈকত সাহেব আপনার চারদিনের ছুটির আবেদন না মঞ্জুর করা হলো। অফিস থেকে গিয়ে বিয়ে করবেন। বাসর করে আবার সকালে অফিসে হাজির হবেন। তাই মনের খুশি ধামাচাপা দিয়ে সে বিনয়ের সাথে বললো,
– অনেক ধন্যবাদ স্যার। স্যার, দাওয়াত কবুলের ব্যাপারটা?
– পরিবার বলতে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আর কেউ আপাতত সাথে নেই, সৈকত সাহেব। কোনো ঝামেলায় আটকে না গেলে ইনশাআল্লাহ যাবো।

বসের কেবিন থেকে বেরিয়ে সৈকত সত্যি সত্যি একটা লাফ দিলো। সে ভাবেইনি স্যার তার রিসিপশনে যাওয়ার প্রস্তাবে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবেন। সে তো কোনো আশা ছাড়াই দাওয়াত করেছিলো। এভাবে সরাসরি তো ছুটি চাওয়া যায় না। বিয়ের দাওয়াতের সাথে ছুটির আবেদন করলে বস গোষ্ঠীর মানুষেরা না করতে পারে না। ছুটি চাওয়ায় মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখের উপরে না বলে দিতে উনাদের বিবেকে বাঁধে। তাই দেখা যায়, চারদিনের জায়গায় দুইদিন ছুটি মঞ্জুর করে বিদায় করে দেয়।

বেডরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুলিস্তা নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। আর বিছানায় বসে গালে হাত দিয়ে বসে স্ত্রীর কান্ডকারখানা দেখছে রেহবার। অন্য কোনো মেয়ে হলে এতোক্ষণে স্বামীকে প্রায় দশবার জিজ্ঞাসা করতো, এই আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? এই শাড়ির সাথে ইয়ার রিংটা মানিয়েছে? খোপা করবো নাকি চুল ছেড়ে দিবো? কুচিগুলো একটু ঠিক করে দেও।

গুলিস্তা এমন কোনো প্রশ্ন করেনি। রেহবারকে এসব টুকটাক কাজও করে দিতে হয়নি। কারন গুলিস্তা নিজেকে থেকে কোনো কিছুই চুজ করেনি।

রেহবারের এড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আউটডোর ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার সৈকত। ওর বিয়ের রিসিপশনে উপস্থিত থাকতে হবে, এই কথা যখন গুলিস্তাকে জানালো, তখন সেই সরলতার প্রতিমা তার সরল কন্ঠস্বরে সরল ভাবে জানতে চাইলো,
– কি পরে যাবো?

রেহবার ভাবলো, সত্যিই তো কি পরে যাবে?
বিয়ের পরে যা কেনাকাটা করা হয়েছিলো সেগুলো নিত্য ব্যবহারের জন্য। অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো গর্জিয়াস ড্রেস গুলিস্তার নেই। তাছাড়া যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে নতুন করে কেনাকাটা করা মেয়েদের অলিখিত অধিকার। ওয়ারড্রব ভর্তি পোষাক থাকলেও অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য পোশাকের সংকট দেখা দিবেই। অফিস থেকে ফিরে গুলিস্তাকে নিয়ে শপিংমলে গিয়ে রেহবার পরলো আরেক বিপদে৷ গুলিস্তা শুধু ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোনো কিছুতেই তার চোখ থমকে যাচ্ছে না। পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে মাথা নাড়ায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে রেহবারকেই মাঠে নামতে হলো।

শপিংমলে একটি ম্যানেকুইনের গায়ে রয়েল ব্লু রঙয়ের একটি শাড়ি পরানো ছিলো। ম্যানেকুইনের দিকে তাকিয়ে ওর জায়গায় রেহবার মনে মনে গুলিস্তাকে কল্পনা করে থমকে গেলো। রাতের আঁধারে বিয়ের অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল আলোতে গুলিস্তার সৌন্দর্য ঠিকরে পরছে।৷ ভাবতেই রেহবারের সারা দেহে শিহরণ ছড়িয়ে গেলো। নিজের পছন্দকৃত শাড়িটি প্যাক করার আগে গুলিস্তার রায় জানতে চাইলে সে এক বাক্যে সম্মতি জানিয়েছিলো।

এখন আয়নার সামনে সেই রয়েল ব্লু শাড়িটি পরে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে। মূলত সে নিজেকে সেই ম্যানেকুইনটির সাথে মিলানোর চেষ্টা করছে৷

ভি নেক রয়েল ব্লু রঙের ফুল স্লিভস ব্লাউজ, গলায় স্টোনের চিকন হার ও ম্যাচিং ইয়ার রিং। আলগা খোপায় একটি নকশা করা কাটা। এমনি তো ছিলো ম্যানেকুইনটির সাজসজ্জা। শাড়ির সাথে এসব ম্যাচিং করা ছিলো বলে রেহবার সেগুলোও নিয়ে নিয়েছে৷ এতে আলাদা করে অর্নামেন্স কেনার ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিন্তু হুবহু সেই ম্যানেকুইনটির মতো না সেজে নিজের পছন্দ মতো তো রেডি হওয়া যেতো। গুলিস্তার আবার নিজের পছন্দ! এই ভেবে নিজের ভাবনার কারনে নিজেকেই ধিক্কার জানিয়ে রেহবার বিছানা ছেড়ে উঠে গুলিস্তার পেছনে গিয়ে দাড়ালো। দু হাতে ওর কোমড় জড়িয়ে থুতনি ঠেকালো ঘাড়ে। আয়নায় ভেসে উঠা দুজন মানব মানবির মাঝে বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই। একে অপরের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। রেহবার আয়নায় ভেসে উঠা গুলিস্তার প্রতিবিম্বের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
– ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো দ্রুতি ছড়াচ্ছো৷ এই সামান্য আয়নার কি সাধ্য সেই সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে।

গুলিস্তা কিছু বুঝলো কিনা কে জানে! সে তাকিয়ে রইলো আয়নার ফুটে উঠা স্যুট-কোট পরা এক টগবগে যুবকের প্রতিবিম্বের দিকে। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাদকতা ছড়ানো।

চলবে..

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
পঞ্চদশ পর্ব

ময়ূর কুঞ্জ কনভেনশন সেন্টারের লবি বেশ জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে। সাধারণত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে। তবে সৈকতের খোলামেলা জায়গা বেশি পছন্দ। তাই কর্তৃপক্ষকে লবিকে কেন্দ্র করে যাবতীয় আয়োজন করতে বলা হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে রঙিন আলোর পসরা সাজানো। নবদম্পতি বসে আছে মূল স্টেজের সাদা সোফাসেটে৷ হালকা গোলাপি থীম কালারের ডেকোরেশনে যুক্ত হয়েছে সাদা গোলাপ। তারই সামনে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। কালো বেন্ডউড চেয়ার, টেবিলের উপর সাদা কাভার। প্রতিটি টেবিলে ফুলদানিতে সুসজ্জিত সাদা অর্কিড। গুলিস্তাকে সাথে নিয়ে রেহবার যখন কনভেনশন সেন্টারে পৌছালো ততোক্ষণে অতিথিরা সবাই পৌছে গেছে। রেহবারকে দেখে সৈকত স্টেজ ছেড়ে নেমে এসেছে ওদের স্বাগত জানাতে।
– আজকের দিনটি আপনার জন্য বিশেষ। আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হবেন না৷

রেহবারের কথায় সৈকত নিজের স্থানে ফিরে গেলেও সৈকতের পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ রেহবার ও গুলিস্তার খাতিরযত্নে ব্যস্ত হয়ে গেলো৷ ছেলের অফিসের বস বলে কথা।
সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আপাতত রেহবার-গুলিস্তা জুটি৷ হঠাৎ করে বিয়ে করায় রেহবারের স্ত্রীকে এতোদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বিয়ের পর রেহবারের পক্ষ থেকে রিসিপশনের কোনো আয়োজন করা হয়নি৷ স্বল্প সময়ের মধ্যে মা ও ভাই বিদেশে পাড়ি জমানোর পরে রেহবার নিজেও আর এসবে আগ্রহে খুজে পায়নি৷
সৈকতের বিয়েতে অফিসের প্রায় সকল কলিগ উপস্থিত৷ তারা একঝলক বসের স্ত্রীকে দেখার জন্য এগিয়ে এলো। চতুর্দিকে মানুষজন, কোলাহল, ভীড় এসবের মাঝে গুলিস্তার ভীষণ হাসফাস লাগছে। সে রেহবারের হাতে হাত জড়িয়ে ধরে অস্বস্তিতে গাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রেহবার সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে, কুশল বিনিময় করছে।
– মাশাআল্লাহ, ম্যাম দেখতে ভীষণ সুন্দর।

উত্তরে গুলিস্তা কিছু বললো না৷ ওর হাত পা রীতিমতো কাঁপছে৷ কেউ কোনো কমপ্লিমেন্ট দিলে অনেক কষ্টে একটুখানি হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। রেহবার ওর হাতে একটু চাপ দিয়ে আশস্ত করে বললো,
– থ্যাঙ্কিউ।
– স্যার বুঝি এজন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন এতোদিন! আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন না।
– বিয়েটা বেশ তাড়াহুড়ো করেই হয়েছে। এরপর আর সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি৷ এখন তো বিয়ের অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। পুরনো কাপলদের কি আর রিসিপশনের আয়োজন সাজে!

পেছনে থেকে কেউ একজন সজোরে বলে উঠলো,
– বিয়ে শুধু প্রথমদিনেই মজা লাগে। এরপর থেকে শুরু হয় যন্ত্রণা।
– বিয়ে করে পস্তায়নি এমন পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ আফসোস বেশিরভাগ মেয়েরাই করে, কেনো যে তোমাকে বিয়ে করলাম! বিয়ে করে আমার জীবনটাই ধ্বংস হয়ে গেলো।
– আরে মেয়েরা বললে দোষ নেই। আমরা ছেলেরা শুধু একবার এই কথা উচ্চারণ করে দেখি। সাথে সাথে বউ ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। তখন আবার বউকে ফিরিয়ে আনতে আরেক হ্যাপা সামলাও।

ভীড়ের মাঝে পুরুষ-মহিলা সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। গুলিস্তা শুধু অবাক চোখে সবার দিকে চেয়ে আছে। পাশ থেকে লিতুন বললো,
– ছেলেরা একখানে হলে এভাবেই মেয়েদের ক্রিটিসাইজ করতে থাকে। আমরা নম্র-ভদ্র বলে আর তর্কে গেলাম না। না হলে আমাদের কাছেও অভিযোগ করার অনেক কিছু আছে।
– সে তো মেয়েদের কাছে সবসময় থাকে। অভিযোগ করতে মেয়েরা সর্বদা সেরা। কেউ তাদের হারাতে পারবে না।

এ মুখ ও মুখ হতে যুক্তি তর্ক বাড়তেই থাকলো। লিতুন এগিয়ে এসে গুলিস্তাকে বললো,
– পুরুষ মানুষের এই আলোচনা চলতেই থাকবে। আপনি বোর হয়ে যাবেন। আমরা মেয়েরা ওপাশের টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আপনি আমাদের জয়েন করতে পারেন, ম্যাম।

রেহবার তাকালো গুলিস্তার দিকে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে দম আটকে বসে আছে। খুব শীঘ্রই খোলা বাতাস দরকার। না হলে দম আটকে মরে যাবে। রেহবার, লিতুন দুজনে ওর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। তাই গুলিস্তা তার রিনরিনে কন্ঠস্বরে জানতে চাইলো,
– আলাদা টেবিল? কোনদিকে?

লিতুন হাতের ইশারায় একপাশের ড্রিংকস কর্ণারের দিকে দেখিয়ে দিলো। গেস্টদের উপচে পরা ভীড় সেখানে। যে যার পছন্দমতো ড্রিংকস নিচ্ছে। তারই পাশে দুটো টেবিল একখানে করে বসেছে মহিলাদের আড্ডার আসর। কয়েকজন সেখানে বসে উচ্চস্বরে হেসে চলেছে। সেদিকে একনজর তাকিয়ে গুলিস্তা ভীত চোখে তাকালো রেহবারের দিকে। দুপাশে মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানালো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেহবার দ্রুত বলল,
– আমরা মাত্র এলাম। এখনো ব্রাইটের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। আগে স্টেজ থেকে ঘুরে আসি।

লিতুন সায় দিয়ে চলে গেলো।
স্টেজে বর বধূর সাথে কুশল বিনিময় করে ফটো সেশন শেষ করে একটি টেবিলে বসলো রেহবার ও গুলিস্তা। এমন অনুষ্টানে স্বভাবই অনেক বিজনেসম্যান উপস্থিত হয়েছে৷ রেহবারের সাথে আলাপচারিতার সুযোগ খুঁজছে অনেকেই। রেহবার নিজেও প্রয়োজনবোধ করছে। কিন্তু গুলিস্তা এসবে অভ্যস্ত নয়। রেহবার ওকে সাথে নিতে পারছে না, আবার এখানে একা বসিয়েও রাখতে পারছে না।
তবুও ওকে টেবিলে বসিয়ে রেখে খাবার আনতে গেলো। গুলিস্তার থেকে দূরে গেলেও রেহবার সেখান থেকে গুলিস্তাকে লক্ষ্য করছে। কয়েকজন মেয়ে ওর সাথে কথা বলছে কিন্তু গুলিস্তা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে রেহবারকে খুঁজছে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে ফেলবে। রেহবার দ্রুত ফিরে এলো। টেবিলে খাবার রেখে মেয়েদের উদ্দেশ্যে অমায়িক হেসে বললো,
– হ্যালো লেডিস।

স্কাই ব্লু কালারের ফরমাল শার্টের উপর মিডনাইট কালারের স্যুট প্যান্টে বলিষ্ট দেহের রেহবারকে দেখে মেয়েগুলো কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলো।কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে রেহবার সামান্য কেশে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে আবারও জিজ্ঞাসা করলো,
– কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো জানতে পারি?

ওদের মধ্যে একজন মেয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো ,
– আপনার ওয়াইফ?
রেহবার মাথা দুলিয়ে সায় জানাতেই পাশের মেয়েটি বলে উঠলো,
– হাউ স্যাড!

মনে মনে বলতে চেয়েছিলো হয়তো। মনের ভাবনা জোরে বলে ফেলায় সাথীদের নিকট হতে কনুইয়ের গুতাও খেতে হলো। মেয়েগুলোর বয়স খুব বেশি নয়। বড়জোর সতোর কিংবা আঠারো হবে। ওদের কান্ড দেখে রেহবার নিজেও হেসে ফেললো। পরিস্থিতি সামাল দিতে আরেকজন হড়বড়িয়ে বললো,
– উনার গায়ের শাড়িটা ভীষণ সুন্দর। কোথা থেকে নিয়েছে, প্রাইজ কেমন ডিটেইলস জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি কিছু বলছেন না। যাই জিজ্ঞাসা করি, বলছেন ‘আমি আসলে জানি না।’

রেহবার তাকালো গুলিস্তার দিকে। মেয়েটির কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে আছে। রেহবার হাত বাড়িয়ে ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরলো।
– আমি গিফট করেছি, তাই ও জানে না।
– ওয়াও! আপনার পছন্দ দারুণ।

রেহবার নিজেই শাড়িটির ডিটেইলস মেয়েগুলোর সাথে শেয়ার করলো।
রেহবারের একদম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কন্ঠে খানিকটা মাদকতা মিশিয়ে জানতে চাইলো,
– আপনার পারফিউমটি কোন ব্র‍্যান্ডের? কী দারুণ ঘ্রাণ!

আকস্মিক ব্যক্তিগত প্রশ্নে রেহবার খুকখুক করে কেশে উঠলো। গুলিস্তা নিজেও চোখজোড়া গোল গোল করে মেয়েটির দিকে তাকালো।
– মেল পারফিউমের ডিটেইলস জানার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। বিয়েশাদি করো, তারপর স্বামীর এর থেকে মেল পারফিউম এর অনেক নাম জানতে পারবে।

মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। কিশোরী বয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা। খানিক কথাতে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। এরা একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পরে হাসতে পারে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই। ওরা চলে যেতেই রেহবার খাবার প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
– চলো খেয়ে নেই৷

গুলিস্তা প্লেটের দিকে তাকিয়ে আবার রেহবারের দিকে তাকালো। রেহবার কিছু বুঝতে না পেরে শুধালো,
– কি?
গুলিস্তা উত্তর দিলো না৷ রেহবারের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড়ের কাছে মুখ দিয়ে ঘ্রাণ নিলো৷
তারপর সোজা হয়ে নিজের টেবিলে বসে খাবারের প্লেট নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বললো,
– একদম বাজে ঘ্রাণ।

খাওয়া দাওয়া শেষে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ওরা অনুষ্ঠান উপভোগ করলো। স্টেজে কেউ নাচছে, কেউ গাইছে। তরুণ-তরুণীদের কন্ঠে উত্তাল ময়ূর কুঞ্জ। গুলিস্তা কিছুক্ষণ সেগুলো উপভোগ করলেও এখন একটু পরপর আশেপাশে তাকাচ্ছে। বিষয়টি লক্ষ্য করে রেহবার প্রশ্ন করলো,
– হোয়াটস রং?
– ওয়াশরুমে যাবো।

ওয়াশরুম বিল্ডিং এর ভেতরে হওয়ায় রেহবার ওকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু তখুনি ওদের দিকে এগিয়ে এলো এসএম কো. এর সিইও সাইফুল ইসলাম। সিলেট শহরের তুখোড় বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন। তিনি নিজে থেকে রেহবারের সাথে কথ বলতে এসেছেন। উনাকে তো এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অপেক্ষা করানো সম্ভব নয়। রেহবার উপায় না দেখে ওয়েডিং ম্যানেজমেন্ট টিমের একটি মেয়েকে ডেকে বললো,
– ক্যান ইউ এসিস্ট হার?
– শিওর। দিজ ওয়ে প্লিজ।

মেয়েটি বিনয়ের সঙ্গে গুলিস্তাকে পথ দেখালো। গুলিস্তা একবার রেহবারের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখশ্রীতে খানিকটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে ভিতরে চলে গেলো।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ষষ্ঠদশ পর্ব

প্রফিট, টার্গেট, পার্সেন্টেজ, সেলস ইত্যাদি শব্দগুলোর প্রতি রেহবারের আগ্রহ ছিলো অনেক। কিন্তু এই মুহুর্তে সাইফুল ইসলামের সাথে বিজনেস আলোচনায় এই শব্দগুলোই যেনো রেহবারের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোরাচোখে বারকয়েক হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়েছে। প্রায় আধাঘন্টা হতে চললো, গুলিস্তা ফিরে আসেনি। ম্যানেজমেন্ট টিমের সেই মেয়েটিকেও দেখা যাচ্ছে না। চিন্তার সুক্ষ্ম রেখা রেহবারের কপালজুড়ে। এর মধ্যে আরও কয়েকজন বিজনেসম্যান এগিয়ে এসে আড্ডায় যুক্ত হলো। এই ফাঁকে রেহবার সবার থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত পা ফেলে রেস্টরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
পথিমধ্যে দেখা হলো সেই মেয়েটির সাথে। রেহবার দ্রুত জানতে চাইলো,
– হোয়ার ইজ শি?
– ম্যাম এখনো ওয়াশরুমেই আছেন। আমি উনার বের হওয়ার অপেক্ষা করছি।

লেডিস ওয়াশরুমের দিকে যেতে ইতস্ততবোধ হচ্ছে ঠিকই তবুও যেতে হচ্ছে। ওয়াশরুমের সামনে আসতেই রেহবারের পায়ের গতি ধীর হলো। বেশ কয়েকজন নারী ওয়াশরুম হতে বের হওয়ার পথে রেহবারকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রেহবার ভেতরে প্রবেশ করলো।
বেসিনের সামনে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে গুলিস্তা। ওর সামনে অচেনা একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। উচ্চ স্বরে কিছু একটা বলছে। সেসব রেহবারের কর্ণগোচর হলো না। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে গুলিস্তার সামনে দাঁড়ালো। গুলিস্তার চোখে মুখে খানিকটা আতংক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি শক্ত করে গুলিস্তার ডান হাতের কব্জি ধরে রেখেছেন। রেহবারের মনে পরলো সপ্তাহখানিক আগেই একই স্থানে তার দ্বারা গুলিস্তা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। কালবিলম্ব না করে তার শক্তপোক্ত হাত দ্বারা মহিলাটির হাত থেকে গুলিস্তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। হঠাৎ আক্রমণে মহিলাটি অবাক চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
– কে আপনি? লেডিস ওয়াশরুমে কি করছেন?

ততোক্ষণে গুলিস্তাকে একহাতে আগলে নিয়েছে রেহবার। মহিলাটির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গুলিস্তার কাছে জানতে চাইলো,
– তুমি ঠিক আছো?

সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে আছে গুলিস্তার মুখ। রেহবারের বুকের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে মাথা দুলিয়ে বললো, হু।
ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মহিলাটির নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো৷ নিজের বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
– ওহ, আপনি ওর হাসবেন্ড! আপনাকেই তো খুঁজছিলাম।

রেহবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একজন ফিমেল গেস্ট ও ক্লিনিয়িং লেডি ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাছাড়া লেডিস ওয়াশরুমে ওর নিজেরও বেশিক্ষণ অবস্থান করা সমীচীন নয়।
– এনি প্রবলেম মিস? উই ক্যান গো আউটসাইড এন্ড টক।

মহিলাটির উত্তরের অপেক্ষা না করে গুলিস্তার হাতে হাত রেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।
খানিকটা নিরিবিলি জায়গা দেখে ওরা তিনজন দাঁড়ালো। গুলিস্তা এখনো খানিকটা কাঁপছে কিন্তু চোখে মুখে আতংকিত ভাবটা আর নেই। স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে আছে অচেনা নারীর দিকে। রেহবার ধীরে সুস্থে জানতে চাইলো,
– আপনার পরিচয়?
– আমি জেরিন। আপনার শ্বশুরবাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি।

মেয়েটি খুব উগ্র স্বভাবের নাকি সে কোনো কারনে রেগে আছে? ঠিক বুঝতে পারলো না রেহবার। কিন্তু জেরিনের কথাবার্তা খুবই রুঢ় সেই সাথে অমার্জিতও। কারো সাথে অকারণ বাজে আচরণ করার স্বভাব রেহবারের নেই। সে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে গুলিস্তার কাছে জানতে চাইলো,
– উনাকে চেনো?
– হু।

গুলিস্তা স্বল্প ভাষায় সায় দিলো।
– চেনা পরিচিত হলে খুব ভালো কথা। তবে ওয়াশরুম আড্ডার উপযুক্ত স্থান নয়। আমি যদি ভুল না হই, তবে আপনি রীতিমতো ওর উপর চড়াও হচ্ছিলেন।
– এই মেয়ে ভদ্র আচরণে যোগ্যই নয়। আপনি নিশ্চয়ই কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে বিয়ে করেছেন। ওর সম্পর্কে একটু খোঁজ করলে আমি নিশ্চিত আপনি কখনোই এই মেয়েকে বিয়ে করতেন না।
– বিয়ে হয়ে গেছে এবং সে বর্তমানে আমার স্ত্রী। কেউ আমার স্ত্রীর সাথে রুঢ় আচরণ করবে এটা আমি টলারেট করবো না। আপনার কিছু বলার থাকলে ভদ্র ভাবে বলুন।
– যাকে নিয়ে এতো তেজ দেখাচ্ছেন, সেই মেয়ে আদোও এতোটা সম্মানের যোগ্য কিনা সেটা আগে শুনুন। কী রে, নিজের রঙলীলার কথা নিশ্চয়ই জামাইকে কিছু জানাসনি? সেসব আবার কেউ জানায় নাকি! তোর বাড়ির লোকজনও পাক্কা সেয়ানা। কেমন চুপেচাপে বিয়ে দিয়ে দিলো কেউ টেরও পেলো না। আমার ভাইয়ের জীবনটা নষ্ট করে ঠিকই নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছিস। স্বার্থপর, নষ্টা মেয়ে কোথাকার।
– ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট, মিস জেরিন।

কথার তালে জেরিনের কন্ঠস্বর জোরালো হয়ে গেছে। রেহবার নিজেও রেগে চাপা গলায় ধমকে উঠলে জেরিন নিজেকে সামলে নিলো। কাহিনী কিছু জানে না বলে, এই লোক বউয়ের হয়ে গলা বাজাচ্ছে। সব জানার পরে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না৷ পুরুষ মানুষকে জেরিনের ভালো করে চেনা আছে। যতো ভদ্র গোছের মানুষ হোক না কেনো, বউয়ের অতীত কেউ মেনে নিতে পারে না৷ বুকের ভেতর তীরের ফলার মতো বিঁধে থাকে। আর কখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠে না দাম্পত্য জীবন। জেরিনের বুকের ভেতর প্রতিশোধের আগুন দপদপ করে জ্বলছে। গুলিস্তার গায়ে দামী শাড়ি জড়ানো। গায়ে জ্বল জ্বল করছে গয়না। চোখে মুখে সুখের ঝলক। ওর এমন পরিতৃপ্ত চেহারা জেরিনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বালা ধরিয়ে দিলো।
– কথা বাড়ানোর ইচ্ছা আমারও নেই। যার জন্য এতো তেজ দেখাচ্ছেন, সেই মেয়েটার সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না৷ এই মেয়েটার চেহারা এমন বোকাবোকা, ভ্যাবলার মতো হলেও ও মোটেও সাধু সন্নাসী টাইপের কোনো মেয়ে নয়। আস্ত শয়তানী একটা মেয়ে। ওর এমন চেহারা দেখে আমরাও ভাবতাম ও ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। অথচ এই মেয়ে ভেজা বেড়াল গোছের মানুষ।

জেরিনের অযথা কথায় রেহবার ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। ওদিকে গুলিস্তাও নির্বিকার। আজব মেয়ে একটা। রেহবার না হয় মেয়ে মানুষের উপর রাগ দেখাতে পারছে না। জেরিনের জায়গায় কোনো ছেলে হলে এতোক্ষণে ঠাটিয়ে চড় মেরে দেওয়া যেতো৷ কিন্তু মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তোলা যায় না৷ কড়া কথা বলতে গেলেও মানহানীর মামলা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গুলিস্তা তো চাইলে এই মহিলাকে কিছু বলতে পারে। ওর সম্পর্কে একেক পর এক বাজে কথা বলে যাচ্ছে অথচ মেয়েটা শুধু তাকিয়ে দেখছে৷ ওর হাত ধরে পেছন ফিরে রেহবার বললো,
– চলো তো এখান থেকে। যতোসব উন্মাদ লোকজন।

ওরা এক কদম এগোতেই জেরিন সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। একদম গায়ে গা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। রেহবার দ্রুত পিছিয়ে গেলো।
– এটা কী ধরনের অসভ্যতা!
– পুরো কথা শেষ না করে তো আপনি যেতে পারবেন না৷ এই মেয়ে আমার ভাইয়ের জীবনটা ছারখার করে দিয়ে নিজে বিয়ে করে সুখে স্বামীর সংসার করবে, এটা তো আমি মেনে নিবো না।
– আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমাদের নেই। পথ ছাড়ুন।
– এখন তো ইচ্ছে হবে না৷ নতুন বিয়ে, সুন্দরী বউ রঙিন দুনিয়ায় ভাসছেন। কয়েকদিন পর আফসোস না করতে হয়৷ যখন ওর আসল চেহারা সামনে আসবে তখন আমাকে খুঁজলেও পাবেন না। আল্লাহ নিজেও এই অন্যায় মেনে নিতে পারছেন না বলেই তো আমাদের এভাবে দেখা হয়ে গেলো। না হলে পাড়ার কেউ তো ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি, কবে এই কলঙ্কিনী, নষ্টা মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো।
– আপনি আমার স্ত্রী সম্পর্কে এমন বাজে ভাবে কথা বলছেন, আবার আমার থেকে এটাও আশা করছেন, আমি যেনো আপনার কথা শুনি! আর এক মুহুর্ত আপনাকে টলারেট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
– রিসিপশনে এসেছেন তো? এখানে সবার সামনে আপনার এই স্ত্রীর গোমড় ফাঁস করে দিলে সেটা ভালো লাগবে আপনার? নেহাৎ আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই, আপনি আমার কোনো ক্ষতি করেননি বলে একান্তে জানাতে চেয়েছিলাম৷ ওর অতীত এখানে সবার সামনে এলে মান সম্মান আপনারই যাবে। ওই মেয়ের কিছু আসবেও না, যাবেও না। আপনাকে দেখে ভদ্র পরিবারের ছেলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনার দেখি আমার ভালোমানুষি সহ্য হচ্ছে না৷ ঠিক আছে সবার সামনে গিয়েই বলছি। তামাশা একটু হয়েই যাক। পরে কিন্তু পস্তানোর সুযোগ পাবেন না৷

রেহবার বুঝে গেলো, এই মহিলা ভালোই কুচক্রী। এমন মানুষের কথা কতোটা সত্যি হতে পারা, তা ধারণা করা যাচ্ছে৷ উনি বললেই সে কথা তো আর বিশ্বাস করে নিতে হচ্ছে না৷ নিজের স্ত্রী সম্পর্কে আরেকজনের মুখে বাজে কথা শুনতে একটু খারাপ লাগবে, রাগ হবে। ব্যাপার না, কিছুক্ষণ দাঁত মুখ চিপে সহ্য করাই যায়। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে রেহবার বললো,
– কোনো ভণিতা না করে দ্রুত কথা শেষ করে বিদায় হন। আপনাকে বেশিক্ষণ সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

জেরিন বাঁকা হেসে গুলিস্তার দিকে তাকালো। এখন গা ছাড়া ভাব নিয়ে জেরিনের কথা শুনতে চাইছে কিন্তু সব জানার পর নিজে থেকে আরও বিস্তারিত জানতে চাইবে৷ তখন জেরিনও তেজ দেখাবে৷
– এই মেয়ের কীর্তি পুরো পাড়ার লোকে জানে। ছোটো থেকে এমন ভ্যাবলার মতো ঘুরতো দেখে লোকে ওকে আধপাগল বলতো। কারো সাথে কথা বলে না। কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই। ঘরের কোণে একলা মানুষ হয়েছে। বাপ-মায়ের বুড়ো বয়সের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান। গর্ভধারণের খবর শুনে ওর মায়ের তো লজ্জায় নাক কাটা যায়। কতো ঔষধপত্র, কতো কবিরাজ! এই বাচ্চা রাখবে না। কিন্তু এই মেয়ে তো জন্ম থেকে গায়ে পরা স্বভাবের। ঠিকই বেঁচে গেলো। দুনিয়ায় আসার পরে ওর মায়ের জান নিয়ে টানাটানি। চাচী আম্মা সেই যে বিছানায় পরলো, তখন থেকে বেচারি অসুস্থ। এই অলুক্ষণে মেয়ে, জন্মের কয়েকদিন পর বাপটাকেও খেয়ে নিলো। আমরা তখনি বুঝে গেছিলাম, আকবর বংশে এক অপয়া জন্ম নিছে৷ আল্লাহ জান দিছে, মেরে তো আর ফেলা যায় না। সব মেনে নিয়ে ওর ভাইগুলা তাও মানুষ করছে ওরে৷ কিন্তু এই মেয়ে এমনভাবে চলাচল করতো যেনো সে এক জনম দুঃখী। পাড়ার কয়েকজন জনদরদীর দরদ উতলে উঠতো ওরে দেখলে। আহারে! জনম দুঃখী মাইয়াটা! মা-ভাইয়ে দেখতে পারে না৷ আমি তো আগে থেকে জানতাম, সব এই মেয়ের নাটক। মানুষের সিম্প্যেথি পাওয়ার ধান্দা। তখন আমার কথা অনেকের পছন্দ হয় নাই। কিছুক্ষণ আগে যেমন আপনার পছন্দ হচ্ছিলো না।

রেহবার কড়া দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে৷ একটা বাচ্চা মেয়ে অবহেলায় বড় হয়েছে, সেটা উনার নিকট সমস্যা মনে হচ্ছে না। উল্টো গুলিস্তার পরিবারকে সাপোর্ট করে কথা বলতেছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছুটে গিয়ে ও বলেই ফেললো,
– সে তো এখনো পছন্দ হচ্ছে না।

জেরিন সে বিষয়ে কিছু না বলে বাঁকা হাসলো৷ নিজের উপর তার অগাধ বিশ্বাস আছে।
– যাক গে সেসব কথা! ওরে নিয়ে আমার সমস্যা ছিলো না, যদি না ও আমার শান্তশিষ্ট ভাইটার দিকে হাত বাড়াইতো৷ আকবররা এলাকার স্থানীয়, প্রতাপশালী পরিবার। ওদের সাথে ঝামেলা হয়ে গেলে দোষ তো আমাদের মতো গরীব ঘরের মানুষের দিকেই আসবে৷ এই সহজ কথাটা আমার বোকা ভাইটা বুঝে নাই৷ আমার চাঁদের মতো সুন্দর ভাইটার দিকে নজর পরছিলো এই ডাইনীর। জাহিদের পিছনে ঘুরঘুর করতো, কিন্তু জাহিদ পাত্তা দিতো না৷ অল্প বয়স হলেও আমার ভাই দায়িত্বের দিক থেকে সচেতন। আমাদের টানাটানির গরীব সংসার। জাহিদ তখন নিজের পায়ের দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রাণপণ। মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় কই! মন থেকে চেষ্টা করলে আল্লাহ ফেরায় না৷ জাহিদকেও খালি হাতে ফেরায়নি। আর্মিতে টিকে গেছিলো। কয়েকদিন পরেই ট্রেনিং। আমরা খুশিমনে ওরে বিদায়ের ব্যবস্থা করতেছিলাম। এই মেয়ের তখন মাথা খারাপ অবস্থা। জাহিদ ওর হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। জাহিদকে জোর করতেছিলো, বিয়ে করে যাইতে। শুনে তো জাহিদের মাথায় হাত। এতোদিন পিছে পিছে ঘুরে বিরক্ত করতো, এখন পুরোই উন্মাদ হয়ে গেছে৷ সেদিন বন্ধুদের সাথে দেখা
করে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরতে ছিলো। এই উন্মাদ মেয়েটা স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর দেখা পায়। আবার স্থান-কাল ভুলে জাহিদের সাথে জেদাজেদি শুরু৷ এতোটাই উন্মাদ হয়ে গেছিলো যে আশেপাশে যে মানুষজন আছে সেই খেয়াল তার নাই৷ আমাদ এখনো মন পরে সেইদিনের কথা। দুপুরবেলা আম্মা কতো শখ করে দেশী মুরগী কষায় ছেলের জন্য অপেক্ষা করতেছিলো৷ হঠাৎ বাড়িতে খবর আসলো, জাহিদকে নাকি আকবর বাড়ির মেয়ের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় স্কুলের পেছনে আটক করা হইছে। আমাদের তো মাথায় হাত৷ আমার আম্মা ভাতের হাড়ি চুলায় রেখে দৌড়। আব্বা-আম্মার কথা শোনার মতো কেউ নাই। টাকার জোরে মানুষ ন্যায় অন্যায় ভুলে যায়। আকবরদের অবস্থা আরও ভয়ানক। একে তো টাকার জোর, আরেকদিকে ঘরে চারটা জোয়ান ছেলে। আমার নির্দোষ ভাইটারে রাস্তায় ফেলে অমানুষের মতো মারছে৷ বিচার-সালিশের ধার ওরা ধারে নাই। আরও হাস্যকর ঘটনা শোনেন, চুপিচাপে যতোটুকু বিচারের আসর বসলো সেখানেও এই মেয়ে একটা কথা বলে নাই। হ্যাঁ, না কিচ্ছু না৷ অথচ দোষ আমার ভাইয়ের কাঁধেই এলো। জাহিদ নাকি ওকে বিরক্ত করছে। আমি তাও মনে ক্ষোভ রাখতাম না৷ আল্লাহর কাছে নালিশ করে চুপ থাকতাম। এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় টাকা নাই তো আপনার কথার কোনো দাম নাই। কিন্তু ওরা আমার ভাইটার ভবিষ্যত নষ্ট কর দিছে। ওরে এমনভাবে মারছে যে ডান হাতটা ভেঙে গেছে।এতোদিনের স্বপ্ন, এতো পরিশ্রম বৃথা হয়ে গেছে। ওর স্বপ্ন, ওর চাকরীটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। বেচারা ট্রেনিং এ যেতে পারে নাই। আমাদের পরিবারটা কতো কষ্টের দিন পার করছে আপনি ভাবতেও পারবেন না। অর্থ কষ্টে আমাদের কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। অথচ একই দায়ে দায়ী, এই মেয়েটার জীবনে কি পরিবর্তন হয়েছে ওকে জিজ্ঞাসা করুন৷ কয়েকদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ করে ঘরবন্দী থাকলো৷ আস্তে আস্তে পাড়ার মানুষজন ঘটনা ভুলে গেলো। এখন দেখেন, বিয়ে করে কী সুন্দর ঘর সংসার করতেছে! আমাদের পুরো পরিবারটা যার পাপে ভেসে গেলো, তার সুখ দেখে আমার হিংসা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? আমি সারাজীবন এই মেয়েকে অভিশাপ দিয়ে যাবো৷ দুনিয়ায় শাস্তি না পেলে, আখিরাতে দাবী নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবো। তবুও ওর শাস্তি আমি চাইবো।

জেরিন সেখানে আর দাঁড়ালো না। কান্নায় সিক্ত গাল মুছে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো। রেহবার মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জেরিন নামক মহিলাটিকে এখন আর ওতোটা খারাপ লাগছে না। উনার চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ, চোখ বেয়ে গড়ে পরা অশ্রু কখন যেনো রেহবারের হৃদয়ের তিক্ততা ধুয়ে মুছে দিয়েছে সে টেরও পায়নি। ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তা একজন পুরুষকে কতোখানি যন্ত্রণা দেয়, চিন্তায় রাখে, সে জানে। পড়াশোনা শেষ করে সে নিজেও তো হন্য হয়ে আয়ের পথ খুঁজছিলো৷ এমন নয় যে তাদের আর্থিক কষ্ট ছিলো। তবুও পড়াশোনা শেষ করার পর নিজস্ব আয়ের তাগিদ আপনা থেকেই এসে যায়। বাবার টাকায় জীবনযাপন করা ভীষণ বোঝা মনে হয়৷ আর্থিক স্বচ্ছলতার মাঝেও কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তায় রেহবারের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিলো, সেখানে পুরো পরিবারের দায়িত্ব যে ছেলেটির কাঁধে তার নিশ্চিত চাকরীটি হাতছাড়া হওয়ায় তার কেমন লেগেছিলো? জাহিদের সেই মরণ যন্ত্রণা অনুভব করে পেরে রেহবারের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করতে শুরু করলো। বগুড়ায় গুলিস্তার পরিবারকে যতোটুকু দেখেছে, তাদের মধ্যে উগ্রভাব লক্ষনীয়৷ সেখানে দাঁড়িয়েই অস্থির মস্তিষ্কে হিসাব মিলিয়ে ফেললো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো, গুলিস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলছে। তার চোখে নেমে আসছে রাজ্যের ঘুম। রেহবার অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো, সেই মেয়েটির দিকে যাকে ঘিরে এতো আয়োজন। অথচ সে যেনো এসব থেকে অনেক দূরে অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা।

(চলবে..)