হৈমন্তীকা পর্ব-৩২+৩৩

0
552

হৈমন্তীকা

৩২.
বাতাসের এলোমেলো ঝাপটায় ঘুমন্ত তুষারের ঝাঁকড়া চুলগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। নবজাত শিশুর ন্যায় আদুরে ভঙ্গিতে ঠোঁট হালকা উঁচিয়ে রেখেছে সে। হৈমন্তী দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কোলে থাকা তুষারের মাথাটা সাবধানে নামিয়ে দিতে চাইলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। তুষার কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পরেছে। আরেকটু নিবিড় হয়েছে হৈমন্তীর সঙ্গে। হাতের বাঁধনও আগের চেয়ে শক্ত, সূগভীর। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাল ছেড়ে দেয়। একপাশে পরে থাকা কর্মহীন হাতটা উঠিয়ে তুষারের ঝাঁকড়া চুলের ভাঁজে নিয়ে যায়। কিছু পলক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয় সুদর্শন মুখপানে। হাত বাড়ায়। ঘন পাঁপড়ি গুচ্ছ ছুঁয়ে দেয় আনমনে। ভাবে, তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। যেন ভাঁজা মাছটাও উলটে খেতে পারে না। অথচ কে বলবে, এই ছেলেটাই একটু আগে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল। মাঝরাতে কোত্থেকে বারান্দায় এসে চমকে দিয়েছিল হৈমন্তীকে। হৈমন্তী ভড়কানো গলায় প্রশ্ন করেছিল, “আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন তুষার?”

ওপাশ থেকে তার ক্রোধে ভরা উত্তর ছিল, “আপনাকে নাকি নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছিল? আংটি পরিয়েছে? দেখি! হাত বাড়ান।”

হতভম্ব হৈমন্তী আকস্মিক প্রশ্নের রেশ ধরতে পারলো না। বিমূঢ়, বিহ্বল, বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো তুষারের মুখশ্রীর দিকে। জবাব না পেয়ে রাগ যেন ক্ষীণ বাড়লো তার। নিজেই হাত টেনে নিলো। ডান হাতের অনামিকা আঙুলে সোনার আংটিটি নজরে আসতেই ধমকের সুরে বললো,
— “আংটি এখনো খুলেন নি কেন? নাকি বিয়েতে রাজী আছেন আপনি?”
হৈমন্তী থতমত গলায় বললো,
— “ম—মনে ছিল না। এক্ষুণি খুলতাম।”

তুষার প্রতুত্তর হীন এবার। একপলক হৈমন্তীর পানে চাইলো মাত্র। হৈমন্তীর বক্ষস্থল ভারি হয়ে উঠল। তুষারের চোখের সাদা অংশ লাল শিরা-উপশিরায় ভর্তি। নাক, ঠোঁট, গাল, কান কেমন ভয়ংকর রক্তিম লাল। অগোছালো চুলে অস্বাভাবিক লাগছে তাকে। আঙুল থেকে আংটিটা বের করতে করতে তুষারের গম্ভীর গলা শোনা গেল,
— “বিয়ে করেও শান্তি নেই। বউ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে আমি কোথায় রেখে শান্তি পাবো হৈমন্তীকা? বুকের ভেতরটায় থাকতে পারবেন না আপনি?”

বলতে বলতে আংটিটা ছুঁড়ে মারলো বারান্দার বাহিরে। হৈমন্তী আঁতকে উঠলো। বড় বড় চোখে তাকালো। কঠর গলায় কিছু বলবে, তার পূর্বেই তাকে বারান্দার মেঝেতে বসিয়ে দিলো তুষার। নিজে শুলো হৈমন্তীর কোলে মাথা রেখে। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “ঘুমাবো হৈমন্তীকা। বিরক্ত করবেন না।”

তুষারের ক্লান্ত মুখমণ্ডল দেখে হৈমন্তীর মনও সায় দিলো না কিছু বলতে। সে চেয়ে রইলো, বসে রইলো, নির্ঘুম রাত্রির নিশাচর হয়ে।

_____

নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে পূর্ব দিক থেকে জেগে উঠছে সূর্য। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে তীব্র মাত্রায়। আঁখিপল্লবে তেজি কিরণের ছোঁয়া লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল হৈমন্তীর। পিটপিট দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো সে। চোখ কচলাল। উদরে ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই সেদিকে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের গভীর তন্দ্রায় লেপ্টে থাকা মুখখানি ভেসে উঠল সামনে। হৈমন্তী আনমনে মুচকি হাসলো। কপালের মসৃণ চুলগুলো আলতো করে স্পর্শ করলো। নড়েচড়ে উঠল তুষার। ঘুমে কাতর চোখ জোড়া মেলে প্রথমেই তাকালো হৈমন্তীর দিকে। ঢিমে যাওয়া স্বরে শুধালো, “শুভ সকাল হৈমন্তীকা।”

ঠোঁটের হাসিটুকু আরেকটু বাড়ালো হৈমন্তী, “শুভ সকাল।”

হৈমন্তীর উত্তর শুনে আবারও চোখ বুজে নিলো তুষার। ছোট্ট একটা হামি দিলো। বলা যায়, আবারও ঘুমানোর পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সে। হৈমন্তী হকচকালো, ভড়কালো। রুমে উঁকি দিতেই দেখল, ঘড়িতে পাঁচটা বেজে বাইশ মিনিট।
তুষারের বুকে আলতো ধাক্কা দিলো সে। তাড়া দিয়ে বললো,
— “ঘুমাচ্ছেন কেন তুষার? উঠুন। উঠছেন না কেন?”

তুষার জবাব দিলো না। শুনলোই না যেন। হৈমন্তী আবারও বললো,
— “পাঁচটা বাজছে তুষার। একটু পর মা,বাবা জেগে যাবেন। কেন এমন করছেন? উঠুন না!”

তুষার চোখ মেলল। রোষপূর্ণ চাহনিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,
— “আমার শান্তি কি আপনার সহ্য হয় না হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তীর চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “বাজে বকছেন কেন? উঠুন জলদি।”

একঝাঁক অনিচ্ছা নিয়ে উঠে বসলো তুষার। হৈমন্তীর ওড়না দিয়ে নিজের তৈলাক্ত মুখশ্রী মুছলো। কিছুসময় নির্নিমেষ, নিভৃতে চেয়ে রইলো হৈমন্তীর দিকে। হিম শীতল কণ্ঠে বললো,
— “আপনি দিন দিন সুন্দর হয়ে উঠছেন হৈমন্তীকা। আমার ঘুম হারাম করে দিচ্ছেন।”

এটুকু বলে আর বসলো না তুষার। তৎক্ষণাৎ উঠে বারান্দা বেয়ে নিচে নেমে গেল। হৈমন্তী রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্পলক দেখতে লাগল কৌশলে নিচে নেমে যাওয়া তুষারকে।

_____

দিন গড়ালো। আকাশে নেমে এলো অন্ধকার। রাবেয়া রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে উঠলেন,
— “হেমন্ত? বাপ দেখ তো কে এসেছে।”

হেমন্ত সোফায় বসে আলু ভাঁজা খাচ্ছিলো। মায়ের কথায় প্লেট-টা সোফায় রাখলো। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই গম্ভীর মুখো আসরাফ সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। হেমন্ত দৌঁড়ে চলে গেল আবার। জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলেন আসরাফ সাহেব। মনে মনে প্রচন্ড রাগে ফুঁসছেন তিনি। কোনোমতে ড্রইংরুমে এসে জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে হৈমন্তীকে ডাকলেন।

হৈমন্তী বিছানা গুছাচ্ছিল। বাবার এহেন ডাকে ভড়কে গেল সে। ভয় পেল। দ্রুত ওড়না মাথায় টেনে ড্রইংরুমের দিকে এগোলো। ততক্ষণে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে রাবেয়াও চলে এসেছেন সেখানে। হৈমন্তী বাবার দিকে ভীতু নয়নে চেয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা?”

তিনি ক্ষিপ্ত চোখে হৈমন্তীর হাতের দিকে তাকালেন। ধমকের সুরে বললেন,
— “তোর হাতের আংটি কোথায়?”

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল হৈমন্তীর। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। কণ্ঠ কাঁপতে লাগলো। কি জবাব দেবে হৈমন্তী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ালো গলায় মিথ্যে বললো সে,
— “খুলে রেখে দিয়েছি বাবা।”
— “কেন খুলে রেখেছিস? বিয়েটাকে কি ছেলেখেলা মনে হচ্ছে তোর? ইয়ারকি মনে হচ্ছে? নাওয়াজকে কি বলেছিস তুই? বিয়ে ভেঙ্গে দিতে? আর কত অসম্মান করবি আমার? একটু শান্তি দেয় আমাকে! একটু শান্তি দেয়!”

আসরাফ সাহেব থামলেন। বাবার সঙ্গে চোখে চোখ মেলানোর সাহস পেল না হৈমন্তী। স্বচ্ছ আঁখির কোটর হতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল মেঝেতে। থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠল। একটু পরেই হয়তো হিচকি সমেত কান্না উঠবে।
আসরাফ সাহেব রাবেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নিদারুণ কঠিন গলায় বললেন,
— “তোমার এই আত্মসম্মানহীন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেও বাঁধছে আমার। ওকে বলে দাও, ওই ছেলেকে যেন ফোন করে বলে বাসায় আসতে। এর একটা বিবিধ আমি করেই ছাড়বো। কি পেয়েছে ওই বাপ-ছেলে? আমাকে প্রতিনিয়ত ফোন করে অপমান করবে আর আমি চুপ থাকবো?”

__________________

চলবে~

হৈমন্তীকা

৩৩.
সিলিং ফ্যানের ভনভন শব্দ কাঁপিয়ে তুলছে পুরো রুম। ভ্যাপসা গরমের দরুণ শরীরে বাতাসের ছিটেফোটাও লাগছে না। রাবেয়াকে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিতে বললেন আসরাফ সাহেব। কপালের ঘামটুকু মুছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তুষারের দিকে। কেমন অভদ্র ছেলেটা। জড়তাহীন। ভয়, ভীতি ছাড়া কিভাবে বসে আছে উনার সামনে। তিনি গলা ঝেড়ে খুক খুক করে কাঁশলেন। গমগমে গলায় বললেন,
—“তোমাকে আমি কি জন্যে ডেকেছি সেটা নিশ্চই জানো?”
তুষার নম্র স্বরে ছোট্ট জবাব দিলো,
—“জি।”

আসরাফ সাহেব আবারও কেঁশে গলা পরিষ্কার করলেন। মেয়ের সম্পর্কে কথা বলতে কেমন জড়তা কাজ করছে উনার। চোখে মুখে তবুও কাঠিন্যতা বজায় রেখে তিনি বললেন,
—“তুমি আসলে চাচ্ছোটা কি? আমার মেয়ের পেছনে পরে আছো কেন?”
—“কারন আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি।”

নিঃসঙ্কোচ কথার জোড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। তিনি হকচকালেন, ভড়কালেন, চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তুষারের দিকে চেয়ে অবাক স্বরে বললেন,
—“ভারি নির্লজ্জ ছেলে তো তুমি! নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার? ভয় লাগছে না আমার সামনে এসব বলতে?”

তুষারের ভাব-ভঙ্গি অস্বাভাবিক শান্ত। কণ্ঠস্বর ভীষণ শীতল,
—“ভয় পেলে তো আপনার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখতাম না আঙ্কেল।”

সাথে সাথে উত্তর দেওয়ায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন আসরাফ সাহেব। তুষারকে যথেষ্ট ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে উনার। অন্তত তুষারের অভিব্যক্তি তো তা-ই জানান দিচ্ছে। টেবিলে থাকা মিষ্টির প্যাকেটগুলোর দিকে একবার তাকালেন আসরাফ সাহেব। কি ভেবে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
—“আমার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার এমনিতেও নেই। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের হতে পারি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ। এভাবে বাবার টাকা উড়িয়ে খাই না। আগে নিজ উপার্জ দিয়ে কিছু করো। তারপর যোগ্যতার কথা বলবে।”

আসরাফ সাহেব ভাবলেন, তুষার হয়তো চুপসে যাবে। কিংবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলবে। তবে তেমন কিছুই ঘটলো না। বরং তুষারকে আগের মতোই স্বাভাবিক দেখালো। গাঢ় স্বরে সে বললো,
—“মিষ্টিগুলো আমার বাবার টাকায় কেনা নয় আঙ্কেল। আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি। নিজের উপার্জনের টাকায়।”

আসরাফ সাহেব একটু থমকালেন। তুষারের মুখপানে গভীর পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাকালেন। ছেলেটা দেখতে, শুনতে খারাপ না। সুদর্শনই বলা চলে। আত্মবিশ্বাসও প্রখর। কিন্তু তাই বলে এমন ছোট ছেলেকে প্রশ্রয় দিতে পারছেন না তিনি। বিষয়টা এখানেই ধামাচাপা দিতে চাইছেন। কোনোরুপ ভণিতা ছাড়া আসরাফ সাহেব বললেন,
—“দেখ ছেলে, আমার মেয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর বিয়ে। ভালো হবে তুমি আমার মেয়ের পিছু ছেড়ে দাও। তোমার বয়স কম। আবেগে বশে কি করছ বুঝতে পারছ না। আমার মেয়েকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”

তুষারের মুখশ্রী গাম্ভীর্যে ভরে গেল। নাওয়াজের কথা মনে পরতেই মস্তিষ্ক গরম হয়ে উঠল। আসরাফ সাহেবের চোখে চোখ রাখলো সে। গম্ভীর আওয়াজে ভীষণ ভয়ংকর কথা বলে ফেলল, “হৈমন্তীকা আমার বিয়ে করা বউ আঙ্কেল। উনার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। সুতরাং আপনার কথায় উনাকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে।”

আসরাফ সাহেবের চোখে বিস্ময় স্পষ্ট। বিমূঢ়তায় কুঁচকে গেছে ভ্রু যুগল। কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
—“কি বলছো বুঝে শুনে বলছো তো? এমন কথা মুখে আনার সাহস কোথা থেকে পেলে তুমি?”
প্রতিউত্তরে তার একরোখা জবাব,
— “বিশ্বাস না হলে হৈমন্তীকাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

আসরাফ সাহেব মিনিট পাঁচেক কিছুই বলতে পারলেন না। থম মেরে রইলেন। কি যেন গভীর মনোযোগে ভাবলেন। চুপচাপ, নিশ্চুপ হয়ে। হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকলেন,
—“হৈমন্তী! এদিকে আয়।”

হৈমন্তী হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হলো। এক পলক ভীতু নয়নে তুষারের দিকে তাকিয়ে আবারও নতজানু হলো।
আসরাফ সাহেব আক্রোশে ফেটে উঠলেন। ক্রোধে জড়জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—“এই ছেলে কি বলছে হৈমন্তী? তুই বিয়ে করেছিস ওকে?”

হৈমন্তীর আত্মা কেঁপে উঠল যেন। পা অসাড় হতে শুরু করল। জবাবে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারলো না সে। আসরাফ সাহেব আরও তেঁতে উঠলেন। প্রচন্ড ঝংকার তুলে ধমক দিয়ে বললেন,
—“তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি হৈমন্তী? কথা বলছিস না কেন?”

হৈমন্তী ফুঁফিয়ে উঠল এবার। কণ্ঠ গলিয়ে একটা টু শব্দও বের করতে পারলো না। আসরাফ সাহেব পীড়াদায়ক এক দম ছাড়লেন। উঁচু কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ-ই মিলিয়ে গিয়ে একদম শান্ত শোনালো,
—“এমনটা কিভাবে করলি হৈমন্তী? বাবা মায়ের কথা একটুও ভাবলি না?”

হৈমন্তীর ফুঁফানোর শব্দ বাড়লো। চোখে যেন কেউ মরিচ ডলে দিয়েছে। খুব জ্বলছে। কাঁপা স্বরে হৈমন্তী বলতে চাইল, “বাবা আমি–!”
আসরাফ সাহেব থামিয়ে দিলেন ওকে। রাগ না দেখিয়ে ম্লান স্বরে বললেন,
—“আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যা হৈমন্তী। এখানে তোর আর জায়গা হবে না।”

হৈমন্তী অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো অবিরাম নোনাজল। সে ডাকলো, “বাবা।”
আসরাফ সাহেব শুনলেন না। হেঁটে চলে গেলেন রুমে। যাওয়ার আগে রাবেয়াকে বললেন,
—“তোমার মেয়েকে যেন আমি আমার বাসায় আর না দেখি রাবেয়া।”

_____

কাজী অফিসে তেমন ভীড় নেই। সাধারণ কর্মরত কিছু সহকর্মীদের আনাগোনা ছোট্ট অফিসটায়। এক কি দু’জন বিয়ে করতে এসেছে। হৈমন্তী আর তুষার এক কোণের ক্ষীণ ভাঙ্গাচোরা চেয়ারে বসে আছে। হৈমন্তীর আঙুলগুলো তুষারের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে স্থির হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। তার দৃষ্টি কালসিটে মেঝের পানে। হঠাৎ একটা ছেলে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। হৈমন্তীর উদ্দেশ্যে ঠোঁট ভরে বিস্তর হাসলো,
—“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। আমি রওনক। তুষারের বন্ধু। কেমন আছেন?”

হৈমন্তী জবাব দেয় না। মাথা তুলে প্রাণহীন হাসে মাত্র। রওনকও কথা বাড়ায় না। তুষারকে বলে,
—“তোদের পালা এসেছে। কাজী ডাকছে। আয়।”
তুষার চোখে ইশারায় কি যেন বললো। ঠিক বোধগম্য হলো না হৈমন্তীর।

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। হৈমন্তী ক্লান্ত চোখে একবার আশপাশটা দেখল। তুষারের কিছু বন্ধু-বান্ধব সাক্ষী দিতে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশটায়। হৈ-হুল্লোড় করছে। মৃদু চেঁচামেচির শব্দে মেতে উঠছে কাজী অসিফ। অথচ হৈমন্তী নির্বিকার হয়ে বসে আছে। আজ তার বিয়ে। কিন্তু তার বাবাটাই যে ডান পাশটায় দাঁড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে এখানে নেই। হৈমন্তীর মনে হচ্ছে, তার ভেতরটা নিদারুণ কষ্টে জ্বলছে, পুড়ে যাচ্ছে। অথচ সেটা অনুভব করতে পারছে না সে। মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে, হৈমন্তীর কষ্ট হচ্ছে, কান্না আসছে। কিন্তু কোথায়? সে তো ভাবশূণ্য হয়ে বসে আছে। কান্না আসছে না একদমই। জোড় করেও না। তবে?
কাজীর ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার। কাজী তাকে বারবার কবুল বলতে বলছেন। সবার উৎসুক দৃষ্টি তার দিকেই। হৈমন্তী পিটপিট নয়নে পাশে তাকালো। গভীর চোখের চাহনিতে আটকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তুষার গাঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“কবুল বলবেন না হৈমন্তীকা?”

জবাবে আর সময় নিলো না হৈমন্তী। কাঁপা গলায় থেকে থেকে বললো,
—“কবুল, কবুল, কবুল।”

এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজী তুষারকে কবুল বলতে বললেই তুষার এক নিশ্বাসে তিনবার কবুল বলে ফেলল। মুহুর্তেই একদফা হাসাহাসি চললো সবার মাঝে। শুধু হাসলো না হৈমন্তীই। তুষার ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বললো না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাইকের কাছাকাছি এলো।
আকস্মিক হৈমন্তীর কোমড় জড়িয়ে তাকে উঁচু করে ধরল তুষার। মাটি থেকে পা দু’এক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল হৈমন্তীর। চমকে গিয়ে তুষারের কাঁধের শার্টটুকু খামচে ধরল সে। তুষার বাইকে বসিয়ে দিলো তাকে। হুট করে অধরে অধর ছুঁয়ালো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অনুরোধের সুরে বললো,
—“আপনি কাঁদুন হৈমন্তীকা। আমি অভিযোগ করবো না।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা