অনুভূতিহীন পর্ব-২১

0
501

#অনুভূতিহীন (পর্ব ২১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

নির্জনের এমন ভয়ঙ্কর চাহুনিতে রীতিমতো সারা শরির কাপতে লাগলো আমার। এক পা এক পা করে পিছিয়ে আমি দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। ভয় ও কাঁপুনি তে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা আমার।
লেপটপ হাতে সোফায় বসে ছিলো রিদ ভাই। লেপটপ টা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। দৌড়ে নিচে নামে হুট করে সে সামনে পরায় জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সারা শরির কাঁপছে আমার। কথাও বলতে পারছিনা ঠোঁট দুটুও কাঁপছে খুব।
আমার এমন অবস্থায় সে কপির টপিক বাদ দিয়ে আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আমায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে দুই গালে হাত রেখে বললো,
– এমন করছো কেন, কি হয়েছে তোমার?
আমি হাত দিয়ে ছাদের দিকে ইশারায় দেখিয়ে বললাম,,
– ছা ছা ছাদে,,,
সে আরো উত্তেজিত হয়ে বললো,
– ছাদে কি?
– স স সে আমাকে মে/রে ফেলতে চেয়েছিলো।
সে এবার আমার দুই কাধে হাত রেখে ঝাকিয়ে বললো,
– আগে শান্ত হও তুমি। দেখ আমি তোমার সামনে, কেও কিচ্ছু করতে পারবে না তোমাকে।

তার এমন আশ্বাসে একটু ভরসা পেলাম আমি। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেও সারা শরির এখনো কাঁপছে। এর মাঝে গর গর করে তাকে বলে দিলাম,
– নি নির্জন ভাই আমাকে ছাদে গু/লি করে মে/রে ফেলতে চেয়েছিলো।
আমার কথায় এবার ভুবন কাপিয়ে হো হো করে হেসে উঠে তিনি। হাসতে হাসতে আমার দিকে চেয়ে বললো,
– আর ইউ সিরিয়াস? কিন্তু কিভাবে? গত দুই দিন ধরে তো নির্জন ঢাকার বাইরে। মানে তুমি দিনেও জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখ আরশি?
বলেই ওনি আবারও হাসতে লাগলেন।
আমি আবারও তাকে করুন গলায় বলতে লাগলাম,
– বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? আমি নিজ চোখে তাকে দেখেছি। মাথায় লম্বা লম্বা কালো চুল, গালে খোচা খোচা দাড়ি, চোখ দুটু হালকা নীলচে রঙের আর ডান চোখের নিচ বরাবর গালে একটা কা/টা দাগ আছে। ও এখনো ছাদে আছে, বিশ্বাস না হলে চলুন আমার সাথে।
আমার এমন বর্ণনায় ওনার হাসি মুখ টায় এবার একটু চিন্তার ছাপ ভেষে উঠলো। আমার হাত ধরে ছাদের দিকে হাটা ধরলো সে। আমিও তার সাথে যাচ্ছি ভয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে। ছাদে আসতেই আমি ওনার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে হাটতে লাগলাম।
কিন্তু ছাদ পুরোপুরি স্বাভাবিক। রিদ ভাই আমায় নিয়ে পুরোটা ছাট হেটে দেখালো। কারো কোনো অস্তিত্ব নেই ছাদে।
আমার সন্দেহ ভাঙছে না দেখে রিদ ভাই ফোন বের করে নির্জনকে ফোন দিলো। একবার রিং হতেই রিসিভ করলো। আর রিদ ভাইয়া স্পিকার অন করে দিলো যেন আমিও শুনতে পাই।
– হ্যা নির্জন কোথায় তুমি?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
– কেন আপনি জানেন না? দুই দিন আগে অফিসের কাজে চট্টগ্রাম এসেছি আমি। আগামি কাল সকালেই ঢাকায় ব্যাক করবো।

রিদ ভাইয়া আমার দিয়ে চেয়ে চোখ নাচিয়ে উঠলো, যার অর্থ ‘কি বুঝলে?’
কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি বিশ্বাস যোগ্য নয়। কারণ নির্জনকে আমি নিজের চোখে দেখেছি ছাদে। আমি এগিয়ে গেলাম যেখানে নির্জন দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। নিশ্চই ওখানে সিগারেটের কোনো ছাই পাওয়া যাবে।
ওই কর্নারে গিয়ে পায়ের উপর ভর করে বসলাম আমি। তৃক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম, কোনো ছাইয়ের চিহ্ন পাওয়া যায় কি না। কিন্তু না, আশে পাশে এমন কোনো চিহ্ন চোখে পরেনি আমার। নিরাশ হলাম আমি। তৃক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ নির্জন। গেলো গেলো সব প্রমান মুছে দিয়ে গেলো।

আমার কানের পাশে ভাও সুচক একটা শব্দ হতেই ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম আমি। আর বিপরিতে ভুবন কাপিয়ে হাসছে রিদ ভাই। মনে হচ্ছে হাসির শ্রষ্ঠ কৌতুক টি পড়েছে সে। আমি আবারও রিদ ভাইয়ের দিকে চেয়ে করুন গলায় বললাম,
– বিশ্বাস করুন, আমি ভুল কিছু দেখিনি। স্পষ্ট দেখেছি আমি।
আমার কথা শুনে রিদ ভাই আবারও হাসিতে গরাগড়ি খাচ্ছে। আমি এবার হাল ছেরে দিলাম। কারণ এখন একশ টা প্রমান তার সামনে হাজির করলেও সে বিশ্বাস করবে না। তবে আমি যা দেখেছি সেটাই সত্যি।
এর মাঝে রিদ ভাই এসে আমার দুই গালে আলতো করে হাত রেখে বললো,
– দেখো আরশি আমি বুঝতে পারছি যে খুব খারাপ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে তুমি সময় কাটাচ্ছে। তোমার উপর দিয়ে পর পর দুইটা ঝড় বয়ে যাওয়ায় নিজের মানসিক ভারসাম্যের ব্যঘাত ঘটছে। আর তুমি যা মনে মনে ভাবছো, তোমার মনে হচ্ছে সেগুলোই তোমার চোখের সামনে ভেষে উঠছে। এগুলো সবই তোমার দুঃশ্চিন্তার ফল। এখন তোমার এসব দুঃশ্চিতায় ভেঙে পরার সময় নয়। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়। যারা অন্যায় করেছে তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে। তুমি এখন তোমার মাঝে নেই, তোমার মাইন্ড রিফ্রেশ এর প্রয়োজন। এই কয়েকদিনের মাঝে আমি সময় বের করে তোমার পছন্দের জায়গায়ই ঘুরতে যাবো। তোমাকে এমন বিষণ্ন একধম মানায় না। আমি আমার সেই আগের দুষ্ট হাসিখুশি আরশিকেই চাই। সব সময় হাশিখুশি থেকে আমাকেও ভালো রেখো।

বলেই আমার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন সে। আমি এখনো নিজের দেখাকে অবিশ্বাস করতে পারিনি। যা দেখেছি একটুও ভুল দেখিনি আমি।

কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। আমি নিজে বিশ্বাস করি, নির্জনের ভিতর নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে। তা না হলে ওর চেহারা দেখায় ও আমাকে মে/রে ফেলতে চাইবে কেন?
গভির রাত, একপাশে কিছু রং পেন্সিল আর সামনে কিছু সাদা কাগজ নিয়ে বসে আছি। নির্জনের চেহারা টা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। হাতের পেন্সিন টা ঘুরাচ্ছি আর চেহারা মনে করে একটু একটু করে আঁকছি। আজ সারা রাত জেগে হলেও স্কেচ টা কমপ্লিট করবো আমি।

—————-

– আমার বয়স যখন ২০ বছর ছিলো তখন নির্জনকে বাবা আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলো। ইন্টার পাশ করেচিলো তখন সে। বাবাকে একদিন অফিস শেষে বাসায় আসছিলো। তখন কিছু চিনতাই কারি ধরে তার থেকে সব কিছু নিয়ে গিয়েছিলো। গাড়িটা অব্দি নিয়ে গেলো। আমাদের ড্রাইভারটাও ওই ছিনতাই কারিদের দলের একজন ছিলো। এর পর ওদের সাথে তাকেও আর খুজে পাওয়া যায় নি। বাবাকে মে/রে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলো। আর ওই দিন নির্জন বাবাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো।
ওখানেই তাদের পরিচয়। নির্জনের কেউ ছিলো না। এতিম সে, এর ওর কাজ করে ইন্টার অব্দি পড়েছে সে। এর পর নিজে চলার মতো সামর্থ ছিলো না। তাই বাবা তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। নির্জন আমার সমবয়সি ছিলো, বাট কখনো তার সাথে বন্ধু সুলভ সম্পর্ক তৈরি হয় নি। কারণ সে একা থাকতো খুব গম্ভির। এখনের মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখতো আগে থেকেই। বাবা চেয়েছিলো তার পর আমি তার বিজনেসের হাল ধরি। বাট আমার ওসবে কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হয়ে মানুষদের সেবা করা।
ধিরে ধিরে নির্জনকেও বাবা নিজের ছেলের মতো দেখতে শুরু করলো। বাবা নিজেই তাকে ভার্সিটি ভর্তি করালো। তার পড়ািলেখা শেষ করালো। ধিরে ধিরে নির্জন বাবার সাথে ব্যবসায় জড়িত হয়। বাবাও এখন মনে করে তার দুইটা ছেলে। এক ছেলে ডাক্তার আরেক ছিলে বিজনেস করে। নির্জনও আমার বাবাকে এখন মাঝে মাঝে বাবা বলে ডাকে।

এক নাগারে কথা গুলো বলে গেলো রিদ ভাই। আমি চুপচাপ বসে শুনছিলাম। তারপর আগ্রহ নিয়ে বললাম,
– আচ্ছা সে সব সময় নিজের চেহারা লুকিয়ে রাখে কেন?
– এটা আমিও জানিনা, অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু বলেনি। এর পর আমি ভাবলাম হয়তো এটা তার একটা অভ্যাস।
আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম,
– কিন্তু আমার তো তাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না।
আমার কথায় একটু হাসলো রিদ ভাই। তারপর বললো,
– এটা তোমার মনের ভুল। প্রথম প্রথম এমন দেখছো তো, তাই তোমার এমনটা মনে হচ্ছে। পরে দেখবে সব মানিয়ে নিতে পারবে।

আমি কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলাম। এই মানুষটাকে আমি যাই বলি কিচ্ছু বিশ্বাস করবে না সে। তাই চুপচাপ উঠে গেলাম, রুম থেকে বের হতে হতে বললাম,
– পথের যেদিন পথ শেষ হয়ে যায়, বি-পথ সেদিন হাসে।
তেমনি করে কিছু বিপদ ঘড়ির কাটার ন্যায় একই পথে ফিরে আসে।

To be continue……