অন্তরালে তুমি পর্ব-০৬

0
2187

#অন্তরালে_তুমি
#Part_06
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
” সকল মেয়েদের ক্রাশ ইহান মাহমুদ প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসা যেন অসীম।”
পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে লিখা হেডলাইনটি পড়ার সাথে সাথে ইহান বিষম খায়। আরিহা তা দেখে বাঁকা হেসে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। ইহান দ্রুত তা হাতে নিয়ে গটগট করে খেয়ে ফেলে। অতঃপর আরিহার দিকে তাকিয়ে বলে,

— এইসব কি?

আরিহা একদম না জানার করে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বলে,
— কোথায় কি দেখি। বাহ! তোমার আমার কত সুন্দর ছবি দেখি পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে এসেছে। দেখ তুমি কি পরম যত্নে আমায় কোলে নিয়ে হাটছো। ইশশ! আগে জানলে আরেকটু ভালো করে পোস দিতাম। মুচকি হেসে।

ইহানের আর বুঝতে দেরি নেই যে এইসবের পিছে আরিহার হাত। ইহান এইবার চেয়ার থেকে উঠে আরিহার বাহু দুটো চেপে ধরে আর চেঁচিয়ে বলে,

— এইসব তোমার কারসাজি তাই না? বার বার এইসব করে দুনিয়াকে কি বুঝাতে চাও আমি তোমায় ভালবাসি?
যত যাই করো আসল সত্যিটা তুমি বদলাতে পারবে না। একটা কথা শুনে রাখো আমার মনে তোমার জন্য ঘৃণা বাদে আর কিছু নেই। আই জাস্ট হেট ইউ ড্যাম ইট।

এই বলে আরিহাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আরিহা তখন মুচকি হেসে বলে,

— ভালবাসবে কি না সেটা তোমার ব্যপার কিন্তু তোমার অন্তরালে আমি থাকবো কিনা সেটা আমার ব্যাপার। ভালবাসার মানুষটিও হৃদয় হতে মুছে যায় কিন্তু অন্তরাল হতে কখনো কোন মানুষকে মুছে ফেলা যায় না। সে থাকুক আর না থাকুক সারাজীবন সে অন্তরালেই রয়ে যায়। যেমনটা ঠিক তোমার বেলায়ও হবে।

ইহান তখন হুংকার দিয়ে বলে,
— কখনো না। তোমাকে আমি শুরু থেকে ঘৃণা করেই এসেছি আর ঘৃণা করেই যাব।

আরিহা এইবার ইহানের কাছে এসে বলে,
— তোমার হৃদয়ে আমি কখনোই জায়গা চাই নি। কিন্তু তুমি না চাওয়া বসতো আমায় তোমার হৃদয়ে জায়গা দিয়ে দিলে। ভালবাসা যেমন হৃদয়ে থাকে তেমনেই ঘৃণা হৃদয়ের গহীনে থাকে। (শেষের বাণীতে মোহনা আপু)

এই বলে আরিহা ইহানের ঠোঁটে হাল্কা করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চলে যায়। আর ইহান মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে থাকে।

?

আরিহা নিজের কেবিনে বসে আছে। ইজি চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। তখনই আরিহার ফোনটা বেজে উঠে। মেসেঞ্জারে ভিডিও কলের রিংটোনটি বাজছে। আরিহা এইবার বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে। সাথে সাথে ওর মুখে থাকা বিরক্তিকর ভাব দূর হয়ে যায়। একদম শান্ত চোখে কতক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর ফোনটি তুলার সাথে সাথে একটু পুরুষালী কন্ঠ কানে ভেসে আসে,

— এত সময় লাগে ফোন তুলতে?

আরিহা এইবার পিটি পিটি চোখ করে বলে,
— হু লাগে। তাতে তোর কোন সমস্যা?

সেই যুবকটি এইবার তেতে উঠে বলে,
— সমস্যা মানে ঘোর সমস্যা। আমার ফোন দেরিতে উঠানোর মত দুঃসাহস দেখিয়েছিস তুই। এখন এর জন্য তোকে কঠোর হতে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

আরিহা এইবার মুচকি হেসে বলে,
— লেট মি গেস তুই আমাকে কি শাস্তি দিতে পারিস। তোর জন্য আমাকে একটা জামা ডিজাইন করতে হবে তাই তো।

সেই যুবকটি এইবার অবাক হয়ে বলে,
— তুই কেমনে জানলি? আর ইউ মাইন্ডরিডার বেবিগার্ল।

আরিহা এইবার হো হো করে হেসে উঠে বলে,
— তুই জীবনেও শুধরাবি না তাই না জিসান?

জিসান এইবার কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
— আবার জিগায়! আমি বদলালে তোর মুখে হাসি কে ফুটাবে শুনি?

আরিহা এইবার মুচকি হাসি হেসে বলে,
— আই নো৷

জিসান এইবার একটু গাম্ভীর্য ভাব এনে অভিমানী সুরে বলে,
— শুনেছি তুই নাকি বিয়ে করেছিস। বাই দ্যা আমি কিন্তু সব জানি। তা আমি কিন্তু একটুও অবাক হয়নি। তুই যদি ১০ টা বাচ্চার মাও হয়ে যেতি না তাও আমি অবাক হতাম না। কেন না তুই যে বিশ্ব হারামি আমি জানি। মরে যাবি তাও তোর মুখ দিয়ে কথা ফুটবে না।

আরিহা এইবার শান্ত কন্ঠে বলে,
— জানিস যখন তখন এত পেঁচাল পারিস কেন?

জিসান এইবার কেবলা হাসি দিয়ে বলে,
— বিকোস আই এম আ বাঁচাল পোলা। শুনেসনি এই গানটা, ” বাঁচাল পোলা! বাঁচাল পোলা! ভেরি ভেরি হট। ”

আরিহা এইবার হাসি থামাতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠে। আর বলে,
— ওইটা “বাঁচাল পোলা” না। “ঢাকার পোলা” হবে। তুই পারিসও বটে।

জিসান এইবার মুচকি হেসে বলে,
— অবশেষে আমি বাদে তোর অন্তরালে অন্যের আগমন তো হলো। হৃদয়ের গহীনে কেউতো জায়গা পেল। আচ্ছা আরু তুই খুশি আছিস তো?

আরিহা এইবার স্মিত হেসে বলে,
— তোর কি মনে হয়?

জিসান এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— নিজেকে একটু খোলা বইয়ের মত করে তুলে ধরিস তার সামনে। নিজেকে জানার সামান্যটুকু অধিকার দিস তাকে। দেখবি তোর সকল কষ্টের অর্ধেক ভার সে নিয়ে নিবে।

আরিহা এইবার গম্ভীর গলায় বলে উঠে,
— তোর কি কষ্ট হচ্ছে আমার কষ্টের ভার গুলো উঠাতে? হলে বল আজকেই তোর উপর থেকে সকল ভার তুলে নেই। সকলের মত তোকেও মুক্ত করে দেই এই আমি নামক মানুষটি থেকে।

জিসান এইবার রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
— থাপড়াইয়া গাল লাল করে ফেলবো। বেয়াদব মেয়ে জানি কথাকার। দ্বারা আমি একবার বাংলাদেশে এসে নি তোকে পিটিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো। সবসময় এক ডিগ্রি বেশি বুঝে। আমি কি বলেছি এইসব? এত বছরে এই চিনলি আমায়?

আরিহা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— তুই বাদে আমি আজ পর্যন্ত কাউকে আমার কষ্টের ভাগ নেওয়ার অনুমতি দেই নি আর না দিব। তাই এইসব বলে লাভ নেই।
বাদ দে! এখন বল লন্ডনে সব ঠিক আছে তো? তোর ডাক্তারি ডিগ্রি নেওয়া শেষ হলো?

জিসান সন্দেহ চোখে আরিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— সবই জিগাইলি কিন্তু আমি কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করলি না কেন? আমার কি কোন ভেলু নাই নাকি? বাই দ্যা সব ভালোই আছে আর ভালোই চলছে।

আরিহা এইবার হেসে বলে,
— তুই সবসময় ভালোই থাকস তা আমি জানি। তাই নতুন করে জিজ্ঞেস করলাম না।

জিসান এইবার কঠোর গলায় বলে,
— এই তোর মুখ এমন হয়ে আছে কেন? তোর মাথা আর ঘাড় ব্যথা করছিল তাই না? নিশ্চয়ই সকালে কিছু খাস নি প্লাস মেডিসিনও নিস নি। এমনেই তোর লো প্রেসার তার উপর তোর নিজের প্রতি এত অনিহা। নিজের শরীরে বড় কোন রোগ না বাঁধানো পর্যন্ত দম নিবি না তুই তাই না?
আমি এখনই পিওন চাচাকে ফোন করে বলছি তোর কেবিনে খাবার পাঠাতে। চুপচাপ সেইগুলা খাবি আর মেডিসিন নিবি। তা না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

আরিহা এইবার এক বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বলে,
— সত্যি তুই বাঁচাল। এত কথা কিভাবে বলিস বলতো? তার উপর হুকুমের উপর হুকুম। উফফ!!

জিসান এইবার ম্লান হেসে বলে,
— আমি বাদে তোর সবকিছুর খবর রাখে কে বল? তোর গার্ডিয়ানও আমি, তোর ফ্রেন্ডও আমি, তোর বড় ভাইও আমি। তো একসাথে সব রোল পে করতে একটু তো বাঁচাল হতেই হয়। এখন যা যা বলেছি তা যেন মনে থাকে। এখন আমার ক্লাস আছে আমি গেলাম। বায়!

এই বলে জিসান ফোন রেখে দেয়। ছোট হতে জিসানের সাথেই বেড়ে উঠেছে আরিহা। আরিহাকে যদি কেউ সবচেয়ে ভালো করে চিনে তাহলে সে হচ্ছে জিসান। জিসান সবসময় ছায়ার মত আরিহার পাশে ছিল আর ওকে আগলে রেখেছিল। জিসান সম্পর্কে আরিহার ফুপাতো ভাই হলেও তারা বেস্ট ফ্রেন্ডের মত। জিসানই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা আরিহার সকল কষ্টকে ভাগ করতে সাহায্য করে।
আরিহা এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। মাথাটা সত্যি খুব ব্যথা করছে। এখন একটা ঘুম দিতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো কিন্তু এত কাজ রেখে ঘুমানোটা নিতান্তই ফাঁকিবাজি বাদে কিছু না।

?

ইহান নিজের স্টুডিও- এর দিকে যাচ্ছিল ঠিক এমন সময় মাঝ রাস্তায় তার গাড়িটা বন্ধ হয়ে যায়। ইহান খেয়াল করে দেখে তার গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে এসেছে যার জন্য গাড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইহান এইবার গাড়ি থেকে নেমে স্বজোরে গাড়িতে একটা লাথি মারে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। এক তো সকালের ঘটনায় মাথাটা গরম হয়ে আছে তার উপর এখন এইসব। ইহান বেশ বিরক্তি নিয়ে দাড়ায়। রাস্তাঘাটে বেশ গাড়ি চলাচল করছে। ইহান এইবার ফোন বের করে একটা উবার ডাকে। আর নিজের পরিচিত এক লোককে ফোন করে আর বলে সে যেন নীলক্ষেত হতে গাড়িটা নিয়ে গেরাজে দিয়ে আসে।
ইহান এইবার রাস্তায় দাড়িয়েই মোবাইল স্ক্রোল করতে থাকে এমন সময় বেশ কিছু মেয়ে ওক চিনতে পেরে ওর সামনে এসে দাড়ায় আর ছবি তুলে যায়। দেখতে দেখতে অনেক জনই এসে ওর সামনে ভীড় জমায়। ইহান বেশ বিরক্ত হওয়া সত্তেও মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তুলে তাদের সাথে ছবি তুলে। এমন সময় প্রচন্ড শব্দে ফোনটা বেজে উঠে। ইহান দেখে উবার ফোন দিয়েছে। ফোন তুলতেই সে জানান দেয় যে সে এসে পড়েছে। সে রাস্তার ও পারে আছে ইহান যেন দ্রুত আসে।
ইহান এইবার সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা পার হতে নেয়। আশে পাশে কোন ওভারব্রীজ না থাকায় সে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে। এমন সময় একজন ফ্যান ইহান বলে চেঁচিয়ে উঠে। ইহান সেই দিকে তাকাতেই কোথ থেকে একটি গাড়ি ফুল স্প্রীডে ইহানের দিকে এগিয়ে আসে। গাড়ি চালক ইহানকে দেখে কষে ব্রেক মারে কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে যায়। গাড়িটা ইহানের সাথে ধাক্কা খেয়ে যায় আর ইহান নিজের জায়গা থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে। মুহুর্তেই পিচঢালাই করা রাস্তাটিতে রক্তের সরু ধারা বইতে শুরু করে।

#চলবে