#অন্তরালে_তুমি
#Part_21
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
ইহান ঘুমিয়ে ছিল এমন সময় কানে মধুর এক ধ্বনি কানে ভেসে আসে। সম্ভবত কোরান তিলাওয়াতের আওয়াজ। ধ্বনিটা প্রখর হতেই ইহানের ঘুমের ভাবটা কিছুটা কমে আসে। ইহান হাল্কা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে চারদিকে তাকায়। তারপর আরিহাকে দেখে তার চোখ চড়কগাছ। সে অবিশ্বাস্য নয়নে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিহা আজ কালো রঙের একটি কামিজ পড়েছে। মাথায় কালো ওড়না জড়ানো। এই প্রথম আরিহাকে সাদা বাদে অন্য কোন রঙ নিজের গায়ে জড়াতে দেখেছে সে। বেশ স্নিগ্ধই লাগছে আরিহাকে এই কালো রঙে। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা ঝল ঝল করে উঠেছে। এক আলাদাই নূরানী ভাব চেহেরায় ছেঁয়ে গিয়েছে। ইহান মুগ্ধ হয়ে আরিহাকে দেখছে আর কোরআন তিলাওয়াত শুনছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আরিহা তিলাওয়াত শেষে উঠে দাঁড়ায় পিছে ঘুরে ইহানকে এমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে সেই দিকে তাকায়। কিন্তু কিছুই বলে না। চুপচাপ কোরআন শরীফটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আরিহা বেড়িয়ে যেতেই ইহানের ধ্যান ভাঙ্গে। ইহান এইবার দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে আর রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। রুমের বাইরে গিয়ে দেখে আরিহা আর জিসান সোফার রুমে বসে আছে। কিন্তু জিসান আজ সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়েছে। ইহান এইবার ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। হুট করেই মনে প্রশ্ন জাগ্রত হয়ে শুরু করে যে,
— আজ কি কোন বিশেষ দিন? দুইজনই চেহেরায় এমন বিষন্নতা। তার উপর আজ আরিহার ব্যবহার কেমন উগ্র উগ্র লাগছে।
কিন্তু ইহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিসান ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ইহানকে অবাক করে দিয়ে সে ইহানের একহাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যায়। ইহান বিস্মিত নয়নে জিসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর তিক্ত গলায় বলে,
— ইহান তারাতারি সাদা এক পাঞ্জাবি পড়ে বাইরে চলে এসো।
ইহান এইবার আরও বিস্মিত নয়নে জিসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম জিসান ওর নাম ধরে ডাকছে। এইখানে আসার পর থেকে জিসান কখনো ওকে ওর নাম ধরে ডাকে নি। তাহলে আজ কি হলো? তার উপর জিসান সর্বদাই হাসিখুশি থাকে। ঠোঁটের কোনে সর্বদাই একটা হাসি ঝুলে থাকি কিন্তু আজ তা নেই। বরং মুখে এক রাশ কালো মেঘ ছেয়ে আছে। ইহান এইবার নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে উঠে,
— আজ কি কোন বিশেষ দিন জিসান? না মানে আরিহা আর তোমাকে আজ অন্য রকম লাগছে।
ইহানের এমন কথায় জিসান সরু চোখে ওর দিকে তাকায়। তার পর এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— হ্যাঁ আজ এক বিশেষ দিন। একজনের মৃত্যুবার্ষিকী।
ইহান এইবার চোখ পিটি পিটি করে তাকিয়ে বলে,
— কার?
জিসান মুখ ঘুরিয়ে বলে,
— আমার বাবার! এর চেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করো না আর না আরিহার সাথে আজ কথা বলার চেষ্টা করো। ওর মনের অবস্থা আজ একদমই ভালো না। তাই আজ ওর থেকে দূরেই থেক। আর এখন চুপচাপ পাঞ্জাবি পড়ে বেড়িয়ে এসো।
এই বলে জিসান আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। ইহান বুঝে উঠতে পারছে না জিসানের বাবার সাথে আরিহার কিসের নিবিড় সম্পর্ক। যার জন্য আরিহা আজ সম্পূর্ণ অন্য রুপ ধারণ করেছে। এর পিছে কি কোন অতীত আছে যা তিক্ততায় ঘেরা? ইহান এইসব ভাবতে ভাবতে রেডি হয়ে বেড়িয়ে আসে। বেড়িয়ে এসে দেখে রুমে আরিহা নেই। জিসান সোফায় বসে আছে আর তার অপর পাশে দুইজন হুজুর ধরনের লোক বসে আছে। পড়নে তাদের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। গাল ভর্তি পাকা দাড়ি আর মাথায় সাদা টুপি। জিসানের ইশারায় ইহান গিয়ে জিসানের পাশে বসে। অতঃপর হুজুর সাহেবগন দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে। ইহানের আর বুঝতে দেরি নি এইখানে মিলাদ পড়া হচ্ছে। ইহান আর কিছু না ভেবে মিলাদে অংশগ্রহণ করে।
মিলাদ শেষে হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। চারদিকের পরিবেশ কেমন থমথমে। ইহান কিছু যে বলবে সেই সাহস টুকু পাচ্ছে না। কেন না
আজ জিসান আর আরিহার কাউরোই মনের অবস্থা তেমন ভালো না। বেশকিছুক্ষণের মধ্যে জিসান আর আরিহা বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নেয়। তা দেখে ইহান জিজ্ঞেস করে,
— কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
ইহানের প্রশ্নে জিসান আর আরিহা থমকে দাঁড়ায়। আরিহা কিছুক্ষনের ইহানের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। জিসান তা দেখে বলে,
— অনাথ আশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রম।
ইহান এইবার চটজলদি বলে উঠে,
— আমিও যেতে চাই তোমাদের সাথে।
জিসান এইবার আড়চোখে আরিহার দিকে তাকায়। আরিহা কিছু না বলে হাঁটা দেয়। জিসান তা দেখে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— ওকে দ্যান কাম উইথ আস।
?
বিকেল নেমে এসেছে। গোধুলির শেষ প্রহর। সূর্যটাও আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশের অন্তরালে ডুবে যেতে শুরু করেছে। চার পাশে ইফতারে আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তা ঘাটে রোজাদার মানুষরা ইফতার কিনতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশে কিছু পথিক শিশু সেই দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে তাদের এক রাশ হতাশা। পেটের খিদে যেন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। বজ্রপাতের ন্যায় বার বার শব্দ করে উঠছে। কিন্ত এই খুদা নিবারণের যে তাদের টাকা নেই। যার ফলে নিরবে তারা ফেলছে দীর্ঘ শ্বাস।
কিন্তু এইসব দেখার সময় কার আছে? সকলেই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে ভাবতে। দামী দামী ইফতার কিনে কতক্ষণে এফবিতে পোস্ট দিবে আর ভাব দেখাবে তারা। কিভাবে অন্যদের জানাবে আজ তারা কত ভালো ইফতার করেছে। কেউ যদি কাউকে কিছু দানও করে তাহলে তার একটা ছবি তুলতে ভুলে না। বাহ! এফবিতে ছবি দিয়ে নিজেকে সমাজে ভালো মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে হবে?
কেউ এইভাবে ভাবে না যে আজ যা তারা খাচ্ছে তার এক ভাগও কাউরো ভাগ্যে জোটে না। অনেকের ইফতারে হরেক রকমের ভাজাপোড়া, দামী দামী খাবার থাকে না বরং থাকে শুধু এক গ্লাস পানি আর এক মুঠো মুড়ি। হাহ ভাগ্য!
আরিহা আজ অনাথ আশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রমে সকলের জন্য ইফতারের আয়োজন করেছে। সব কিছু ঠিক মত গুছিয়ে দিয়ে সকলের মাঝে কিছু উপহার বিতরণ করে দেয়। বাচ্চারা তো উপহার পেয়ে মহা খুশি। সকল বাচ্চারা এসে জিসান আর আরিহাকে ঝাপটে ধরে আর তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। বৃদ্ধারা করে দোয়া। দোয়া করার সময় তাদের চোখের কোনে হাল্কা পানি চিকচিক করছিল। কেন না এইসব মানুষদের যে দেখার মত কেউ নেই। এমনি কি তাদের নিয়ে ভাবারও কাউরো সময় নি। যার ফলে ঈদের বা কোন উৎসবের সময় তাদের নতুন জামা পড়া হয় না। তারা পুরাতন ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়েই ঈদের খুশি উপভোগ করে। মুখে তাদের থাকে মলিন হাসি।
জিসান আরিহার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
— ভাগ্যের কি পরিহাস! অনাথ শিশুরা বাবা-মা পায় না আর বাকিরা বাবা-মা পেয়েও তাদের ছেড়ে দেয়। ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। একদিকে কেউ ভালবাসার জন্য কাতরায় আরেকদিকে কেউ ভালবাসতে না পেরে কাতরায়। কেউ বাচ্চা নেই বলে কাঁদে আর কেউ বাচ্চা থেকেও নেই বলে কাঁদে। সকলের মধ্যেই এক অপূর্ণতা রয়েই গিয়েছে। এত নিষ্ঠুর কেন এই ভাগ্য জিনিসটা।
আরিহা এইবার জিসানের দিকে তাকায়। জিসানের কন্ঠে এক চাঁপা কষ্ট স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কথা গুলো বলার সময় ওর গলা ধরে ধরে আসছিল। আরিহা এইবার জিসান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকায়। ইহান সকল বাচ্চাদের সাথে খেলছে। তাদের সাথে মিশার চেষ্টা করছে। বাচ্চারাও খুশি মনে খেলছে। আরিহা এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তারপর নিজের সাইড ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে জিসানের সামনে ধরে। জিসান তা হাতে পড়তে শুরু করে। পড়া শেষে ও বিস্মিত চোখে আরিহার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— আর ইউ সিরিয়াস আরু! তুই অনাথ আশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রম একত্রিত করছিস।
আরিহা কিছু না বলে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। জিসানের ঠোঁটের কোনে এইবার এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। সে বলে,
— তার মানে বাচ্চারাও এখন বাবা-মা বলার জন্য কাউকে পাবে আর বৃদ্ধারাও কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার অবলম্বন পাবে। এরাই বুঝবে একে অপরের আসল মর্ম। কিছুটা হলেও তাদের জীবনের অপূর্ণতা দূর হবে। এদের আর কাঁদতে হবে না আরু। দিস ওয়াস ইজ ইউর বেস্ট ডিসিশন আরু। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি আজ তোর উপর গর্বিত হতেন। বাবা ঠিক যেমন চেয়েছিল তুই ঠিক তেমনই হয়েছিস। বাবা মাস্ট বি প্রাউড অফ ইউ।
এই বলে জিসান আরিহাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। আরিহা নির্বাকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। তা দেখে জিসান আর ইহানও বেড়িয়ে আসে। আরিহা একটা পার্কের শেষ ভাগের একটি বেঞ্চে বসে পড়ে৷ আরিহার মনের মধ্যে চলছে ভয়াবহ এক ঝড়। সে মুখ ফুটে কিছু বলছে না ঠিকই কিন্তু তার অন্তর যে ভিতরে ভিতরে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। অতীতের তিক্ততা ঘিরে ধরছে তাকে। কোন মতে নিজে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে। দূর থেকে জিসান আর ইহান আরিহাকে দেখে এগিয়ে যায় ওর দিকে।
আরিহা মাথা নিচু করে বসে আছে এমন সময় আরিহা নিজের ওড়নায় টান অনুভব করে। আরিহা এইবার মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ৪-৫ বছর বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে। গায়ে ময়লা ছেঁড়া জামা-প্যান্ট, চুল গুলো ধুলোয় উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। শরীরে ময়লা লেগে আছে। নাক দিয়ে হাল্কা পানি পড়ছে। বাচ্চাটা আরিহার ওড়না টানতে টানতে বলে,
— আপা আপা কিছু খাইতে দেন না। খুব খুদা লাগসে।
বাচ্চাটির কন্ঠে এক তীব্র অনুরোধ ভেসে উঠে। চোখে ভেসে উঠে এক রাশ মায়া। আরিহার চোখ হুট করেই নরম হয়ে আসে। গলা ধরে আসতে থাকে। আরিহা এইবার কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে বলে,
— কি খাবে বল?
বাচ্চাটা এইবার ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— যা দেন। পেটে কিছু একটা পড়লেই হলো।
আরিহা তখন বলে,
— তোমার সাথে আর কেউ নেই?
বাচ্চাটা বলে,
— আসে তো। ওইদিকে বাকিরা দাড়াইয়া আসে।
আরিহা এইবার বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
— চল।
পিছন থেকে ইহান সবই দেখলো। সে বিস্মিত নয়নে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সাধারণত এমন বিধস্ত আর নোংরা বাচ্চার সংস্পর্শ কেউ পছন্দ করে না। বরং তাকে দেখলেই নাক ছিটকে দূরে স্বরে দাঁড়ায় আর দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। ইহানও মাঝে মধ্যে এমনই করে।অথচ আরিহা নির্দ্বিধায় বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল। ইহানের কেন জানি নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত বোধ করলো।
আরিহা বাচ্চা মেয়েটির বলা জায়গায় গিয়ে দেখে বিভিন্ন বয়সী বাচ্চারা রাস্তার পাশে ভিক্ষা করছে। অনেকে রাস্তার পাশে ভাজা ইফতারের দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে দুই একটা ঢোক গিলছে। কিছুলোক সেখানে দাঁড়িয়ে ইফতার কিনছে। তা দেখে একটা বাচ্চা এগিয়ে যায় আর একজনের সামনে হাত পেতে বলে,
— আল্লাহর নামে কিছু দেন না। খুব খিদা পাইছে।
লোকটি শুনেও না শুনার ভান করে রইলো। এইবার বাচ্চাটা সেই লোকের পাঞ্জাবি ধরে টান দিতেই সেই লোকটি রেগে উঠে আর তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে যায়। ধাক্কাটা জোরে হওয়ায় বাচ্চাটা রাস্তায় পড়ে যায় আর তার বা হাতের কুনোইটা ছিলে যায়। বাচ্চাটা ছলছল চোখে সেই লোকটির দিকে তাকায়। লোকটির বাচ্চার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সে তো ব্যস্ত তার পাঞ্জাবি ঝাড়তে। বাচ্চাটি কিছু না বলে নিরবে উঠে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে অন্য বাচ্চাদের সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। আরিহা এইবার ওইদিকে এগিয়ে যায়। তারপর নিজের কোল থেকে বাচ্চা মেয়েটিকে নামিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
— অনেক খুদে পেয়েছি বুঝি?
সকলেই মাথা নাড়ে। আরিহা এইবার হাল্কা হেসে বলে,
— আচ্ছা তাহলে আমার সাথে চল।
আরিহা সকলকে নিয়ে একটা বিরিয়ানি হাউজের সামনে যায় তারপর সকলকে সিটে বসিয়ে দিয়ে সকলের জন্য বিরিয়ানি আর বোরহানি ওর্ডার দেয়। বাচ্চারা তো খুশিতে লাফিয়ে উঠে। বিরিয়ানি আসতেই সকলেই হামলে পড়ে তার উপর। সাধারণত এইসব খাবার তাদের ভাগ্যে ঝুটে না। কেন না তাদের ভাষ্যমতে এইগুলা বড়লোকি খাবার। এইগুলা তাদের জন্য না। যার জন্যই আজ তারা এই খাবারটি পেয়ে বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। আরিহা খেয়াল করলো একটা মেয়ে খাচ্ছে না। চুপচাপ খাবারে দিকে তাকিয়ে আছে। আরিহা সেইদিকে এগিয়ে ওই বাচ্চা মেয়েটির সামনে যায়। তারপর তার মাথায় হাত রেখে বলে,
— খাচ্ছ না কেন? খাবার মজা না বুঝি?
মেয়ে মাথা দুলায় যার অর্থ এই যে, “খাবার অনেক মজা।” আরিহা এইবার কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— তাহলে খাচ্ছ না কেন?
মেয়েটি এইবার ইতস্তত কন্ঠে বলে,
— বাইতে আব্বা-আম্মাও না খাইয়া আসে। তাদের রাইখা আমি কেমনে একা একা খাই?
কথা শুনার সাথে সাথে সকল বাচ্চারা খাওয়া বন্ধ করে দেয় আর একেক জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। হয়তো তাদের মাথায় এতক্ষণ এই কথা আসি নি বলে। আরিহা এইবার দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে বলে,
— তোমরা এখন খাও যাওয়ার সময় তোমাদের বাবা-মার জন্যও আমি খাবার দিয়েও দিব নে।
এইবার সকলেই খুশি হয়ে উঠে আর খুশি মনে খেতে শুরু করে। সেই বাচ্চা মেয়েটিও এইবার খুশি হয়ে খেতে শুরু করে। আরিহা স্থির চোখে সকলকে দেখে চলেছে। তাদের তৃপ্তি দেখে আরিহার মনটা শান্ত হতে থাকে।
আরিহা যখন বিল পে করতে যায় তখন জানতে পারে আগেই বিল পে করা হয়ে গিয়েছে। আরিহা এইবার কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলে কে। তখন লোকটা হাতের ইশারায় একজনকে দেখিয়ে দেয়। আরিহা সেইদিকে তাকিয়ে দেখে ইহান ওর দিকে এগিয়ে আসছে হাতে তার কয়েকটি ব্যাগ। পিছেই জিসান আরও কিছু ব্যাগ নিয়ে আসছে। ইহান আর জিসান এসেই সকল বাচ্চাগুলোর মাঝে তাদের কেনা কিছু খেলনা আর চকলেট বিলিয়ে দিল। অতঃপর ইহান আরিহার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
— স্বামীকে স্ত্রীর সকল দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু তুমি তো আর আমায় পুরো দায়িত্বটা দিবে না তাই এতে সামান্য ভাগ নেওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করলাম। এতদিন তো তুমি একাই করে এলে এইবার না হয় ভাগাভাগি করে সব করি। একটা সুযোগ তো দিতেই পারো তাই না?
আরিহা কিছু না বলে ইহানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারছে না সে। কোথাও এক জড়তা এসে বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু সেটা কি তা আরিহার অজানা।
?
আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। খোলা আকাশে তারাগুলো ঝলঝল করে উঠছে। মাঝে সুতার মত অতি চিকন একটি চাঁদের রেখা ঘাপটি মেরে বসে আছে। হাল্কা বাতাস বইছে বাইরে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে গাছের পাতাগুলো অলস ভঙ্গিতে নড়ে নড়ে উঠছে। পরিবেশটা একদম নিস্তব্ধ। মাঝে মধ্যে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করতেই দূর থেকে একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। ছাদের কোনে একটি বেলিফুলের গাছ চুপচাপ বসে আছে আর চারদিকটাতে বেলিফুলের সুগন্ধটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেমন এক ঘোর লাগা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। ছাদে অবস্থিত সুইমিংপুলে আরিহা আর জিসান পা ভিজিয়ে বসে আছে। দুইজনের হাতেই দুইটি সফট ডিংক্সের বোতল। ক্ষণে ক্ষণে তারা তাতে চুমুক দিচ্ছে। দুইজনের মধ্যে পিন পিন নিরবতা। এই নিরবতা পেড়িয়েই জিসান আরিহাকে প্রশ্ন করে উঠে,
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি আরু?
আরিহা আকাশের পানে তাকিয়ে আনমনে ছোট করে বলে,
— হুম।
জিসান এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— তুই কি ইহানকে ভালবাসিস?
#চলবে