অন্তরালে তুমি পর্ব-২৩

0
1978

#অন্তরালে_তুমি
#Part_23
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

?
আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ। সাথে ভ্যপ্সা গরম। আজকে যেন বাতাসের ছিটে ফোটাও নেই কোথাও। গাছের পাতাগুলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে। দূর থেকে কাকের কর্কশ কন্ঠ কানে আসছে। বুঝাই যাচ্ছে এই গরম হতে আজ সেও অতিষ্ঠ। রাস্তার এক পাশের দেয়ালের ছাউনি পেয়ে একটি কুকুর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ব্যস্তকর্মী মানুষ জন। ঘামে নেয়ে একাকার হওয়া সত্ত্বেও ছুটে চলেছে দূর-দূরান্তে। চারদিকে উড়ে চলেছে ধুলোবালি। কেমন এক অসহ্যকর পরিবেশ আজ।
ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে জিসান এইসবই খুব নিখুঁতভাবে খেয়াল করে চলেছে। এইসব সাধারণ জিনিসের মধ্যেও যেন সে কিছু অসাধারণ জিনিস খুঁজে চলেছে। কিন্তু সেটা কি তা তার জানা নেই। জিসানের স্বভাবই এইটা যখনই অবসর সময় পায় সে তার আশে পাশের জিনিসগুলো খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এতে কেমন জানি এক শান্তি অনুভব করে সে।
ইহানের ডাকে জিসান নিজের ভাবনা জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে। পিছে ঘুরে দাঁড়াতেই ইহানের কৌতূহলপূর্ণ চেহারা ভেসে উঠে ওর সামনে। জিসান ইহানের কৌতূহলটা বুঝতে পেরে ওকে চোখের ইশারায় পাশে এসে দাঁড়াতে বলে। ইহানও নির্দ্বিধায় জিসানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ দুইজনের মাঝে এক নিরবতা কাজ করে। অতঃপর নিরবতা পেড়িয়ে জিসানই প্রথম কথা শুরু করে,

— আরিহাকে নিয়ে তোমার অনেক কৌতূহল তাই তো। ও এমন কেন? এত কঠোর কেন?

ইহান মাথা দুলায়। জিসান তা দেখে এক দীর্ঘশ্বাস নেয়। আকাশের পানে তাকিয়ে বলে,
— উত্তরটা আমি নয় বরং উত্তরটা তোমায় আরিহাই দিবে। আমি শুধু তোমায় দিক নির্দেশনা গুলো দিব।
একটা কথা নিশ্চয়ই জানো, সকল মানুষেরই অতীতে একটা না একটা তিক্ত অধ্যায় থাকে। পার্থক্য শুধু এইটাই যে কয়েকজনের টা হয় কালো অধ্যায় আর কয়েকজনের টা হয় কলঙ্কিত অধ্যায়। আরিহারও তেমনই এক অধ্যায় নিজের মনে বয়ে বেড়াচ্ছে।

ইহান এইবার জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকায়। জিসান সেই আগের ন্যায় আকাশের পানে তাকিয়ে থেকে বলে,
— ছোট থেকেই আরিহা ভালবাসার কাঙ্গাল। যদি ওকে নিজের করতে চাওয়া তাহলে প্রতিটা মূহুর্ত ওকে ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে হবে। ওর উপর অধিকার খাটাতে হবে। ও না চাওয়া সত্ত্বেও ওর সকল জিনিসের খেয়াল তোমায় রাখতে হবে। ওর কষ্টে ভাগ বসাবে। ওর অন্তরালে পুরোপুরি ভাবে নিজের বসবাস স্থাপন করবে। তার জন্য তোমায় যা করা প্রয়োজন তুমি তাই করবে। এর জন্য যদি নিজের নামের পাশে সাইকো উপাদ্ধিও লাগাতে হয় তাহলে তাই হোক।

ইহান এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
— আরিহাকে মেনেজ করা এত সহজ নয়। তোমার সাথে ও ফ্রি। তোমার বাধ্য ও। তাই তুমি ওকে ইজিলি হ্যান্ডেল করতে পারো কিন্তু আমি তা পারবো কি না আদো সন্দেহজনক। আরিহা কি আদো আমায় চায় কি না তা নিয়েই আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বতে ভুগছি। সেখানে এইসব তো..

আর কিছু বললো না ইহান। দূর আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো। তা দেখে জিসান মুচকি হেসে বলে,
— সবকিছুরই একটা না একটা শুরু থাকে। আর সকল শুরু যে ভালো হয় তা কিন্তু না। বেশির ভাগ শুরুই হয় তিক্ততায় ঘেরা। এর পরে আস্তে আস্তে গিয়েই তা হয় মধুর। যেমনটা আমার বেলায়ও হয়েছিল।
একটা সময় ছিল যখন আরিহা আমায় সহ্যই করতে পারতো না। আমার ছাঁয়া দেখলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত চিল্লা পাল্লা করতো, কান্না করতো। জিনিস ছুঁড়ে মারতো আমার দিকে।

এই বলে জিসান চুপ হয়ে যায়। তারপর নিজের গেঞ্জির হাতাটা হাল্কা উপরে উঠাতেই অতি কালচে হয়ে যাওয়া কাঁটার দাগ ফুটে উঠে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এইটি অতি পুরানো জখম। ইহান জিসানের দিকে তাকাতেই জিসান বলে,

— আরিহার দেওয়াই আঘাত এইটা। এমন অসংখ্য আঘাত পেয়েছি আমি ওকে সামলাতে গিয়ে যার চিহ্ন সময়ের সাথে ফুরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই আঘাতটি চিহ্ন ফুরিয়ে যায় নি। হয়তো এই আঘাতটি দ্বারা কিছু তিক্ত আর মধুর স্মৃতি বহন করে তাই।
আরিহা আমার উপর জিনিস ছুঁড়ে মারতো ঠিকই কিন্তু তা যাতে আমি ওর কাছে না আসি। আমাকে আঘাত করার ওর কোন কালেই উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু সেইবার ভুল বসতো ও আমার দিকে ছুরি নিক্ষেপ করে। আর ছুরিটা গিয়ে লাগে আমার বা হাতে। ছোট ছিলাম তাই ব্যথাটা সহ্য করতে পারি নি। ব্যথায় সহ্য করতে না পেরে সেইখানেই মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলাম আর ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। হাত দিয়ে প্রচন্ড পরিমানে ব্লিডিং হচ্ছিল। তা দেখে হয়তো আরিহা খুব ভয় পেয়ে যায় আর দ্রুত আমার সামনে এসে আমায় ডাকতে থাকে। পরক্ষণেই ওর চেহেরায় আমার জন্য চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। সেইদিন ব্যথায় থাকা সত্ত্বেও মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল আমার এই ভেবে যে আরিহা এখন আর আমায় ভয় পাচ্ছে না। অতঃপর আওয়াজ শুনে বাবা দ্রুত রুমে ছুটে আসে আর আমার চিকিৎসা করায়।
সেইদিনের পর থেকে ও আমার সাথে একটু হলেও ফ্রি হয়ে ছিল। ভয় পেত না আমায়। আস্তে আস্তে আমরা বন্ধু হয়ে যাই। আর আজ দেখো ও আর আমি কেমন।

ইহান জিসানের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— আরিহা কি তোমার সাথে থাকতো? না মানে ওর তো বাবা মা আছে তাহলে ও তোমার সাথে কেন থাকতো? তোমার কথা অনুযায়ী ওর সাথে তোমার সাথে কোন বন্ধুত্বও ছিল না। পরবর্তীতে হয়েছে। তার উপর যতটুকু বুঝলাম ও কোন ট্রোমার মধ্যে ছিল। তাহলে ওই সময় ও তোমার কাছে কেন ছিল?

জিসান এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— আমাদের আরেকটা সম্পর্ক আছে। তা হলো ভাই বোনের সম্পর্ক। আপন না। আমি ওর ফুপাতো ভাই হই। আর ও আমার সাথে কেন ছিল তা আরিহার কাছ থেকে জেন। এখন শুধু এতটুকু জেনে রেখো আরিহার এমন শক্ত হওয়ার পিছে আমার বাবার অনেক বড় হাত আছে। আর আরিহাকে এমন ওর ভালোর জন্যই বানানো হয়েছে।

ইহান এইবার অধৈর্য্য হয়ে বলে,
— আমি আরিহার অতীত জানতে চাই। এখনই!

জিসান এইবার ঘুরে হাঁটা দেয়। সে যেতে যেতে বলে,
— অপেক্ষার ফল সবসময়ই মিষ্টি হয়। তাই অপেক্ষা করো। সব তোমায় আরিহাই বলবে কিন্তু তার জন্য তোমায় একটু কাঠখড় তো পুড়াতেই হবে। পথ আমি দেখিয়ে দিয়েছি বাকিটা পথ তোমায় একাই চলতে হবে মাই ডিয়ার সতীন মশাই। এই বলে হাল্কা হাসে সে।

হুট করেই দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায় জিসান। তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

— যাই করো না কেন আরিহার বাবা-মার কথা কখনো বলো না। বিশেষ করে ওর মার ব্যাপারে তো একদমই না। ভুলেও না। তা না হলে ও যে ঠিক কি করবে তা তুমি ভাবতেও পারবে না।

এই বলে জিসান আর এক মিনিটও দেরি না করে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। আর ইহান সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিভাবে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না সে। সে কি আদো আরিহাকে সামাল দিতে পারবে। ওর অন্তরালে কি সে জায়গায় করতে পারবে?

?

আরিহা নিজের কেবিনে বসে আছে। বা হাতটা মাথায় চেপে ধরে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে। ডান হাত দিয়ে পেপার হোল্ডার বলটি ঘুরাচ্ছে সে। মূলত কালকে রাতের জিসানের বলা কথাগুলোই ওকে ভাবাচ্ছে। ভীষণ ভাবাচ্ছে। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে কি করবে সে। ঠিক এমনই সময় কেউ হুর হুর করে আরিহার কেবিনে ঢুকে পড়ে। কাউরো উপস্থিতি অনুভব করতে পেরে আরিহা মাথা তুলে তাকায়। মাথা তুলে তাকানোর সাথে সাথেই ওর ভ্রু কুচকে আসে।

#চলবে