অন্তরালে তুমি পর্ব-২৬

0
2160

#অন্তরালে_তুমি
#Part_26
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
হুট করেই ইহান বিনাবাক্যে দাঁড়িয়ে যায় আর রুমের দিকে অগ্রসর হয়। তা দেখে আরিহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। দূর আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দুই নয়ন বেয়ে না চাইতেও অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ছে। অতীতের সেই পাতাগুলো বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। তিক্ততার বেড়াজালে ডুবে যাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে এই দহন সহ্য করা দুষ্কর হয়ে উঠছে আরিহার জন্য। কষ্ট গুলো যেন বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অশান্ত করে তুলছে তাকে। আরিহা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। অতীতের তিক্ততাগুলো কিছুতেই মনে করতে চাচ্ছে না সে।
ঠিক এমন সময় কোথ থেকে ইহান দ্রুত গতিতে আরিহার সামনে এসে হাজির হয়। কিছু না বলেই হাটু গেড়ে বসে আর আরিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক এমন হওয়ায় আরিহা চমকে উঠে আর সাথে সাথে চোখ খুলে তাকায়। ঘটনাটা বুঝতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়। অতঃপর সব বুঝতে পেরে আরিহা বিষ্ময়কর নয়নে ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইহান সেই আগের ন্যায় আরিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

— আমার থেকে জবাব চাইছিলে না তুমি? জানতে চাইছিলে না তোমায় মেনে নিতে পারবো কিনা? আপন করে নিতে পারবো কিনা? তোমার কষ্টগুলোর দায়ভার নিতে পারবো কিনা? অন্তরালে তোমায় জায়গা দিতে পারবো কিনা?

তবে উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ পারবো। তোমায় মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। কেন না এইখানে আপত্তিজনক কোন ব্যাপার আছে বলে আমি মনে করি না। তুমি কলঙ্কিত না বরং পাথরের উপর ফুটে উঠা সে নিষ্পাপ ফুল। তাই তো তোমায় খুব গভীরভাবে আপন করে নিতে চাই। তোমার কষ্ট গুলোর দায়ভার নিতে চাই না বরং তোমার কষ্ট গুলো ভুলাতে তোমার পাশে থাকতে চাই। ভালবাসায় পরিপূর্ণ করতে চাই তোমায়। নিজের অন্তরালের রাণী বানাতে চাই তোমায়। সকলকে বলতে চাই আমার অন্তরালে তুমি। শুধুই তুমি!

সব শুনে আরিহা স্থির হয়ে যায়। সে মোটেও এইসব আশা করি নি। আরিহা ভেবেই রেখেছিল ইহান তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। মেনে নিবে না তাকে। কেন না কোন ধর্ষিতাকে আর যত যাই হোক বউ বলে পরিচয় দেওয়া যায় না। তাকে পবিত্র মানা যায় না। কাউরো অন্তরালে তো দূরে থাক এমনকি পৃথিবীর কোন স্থানেই তার জায়গা হয় না। সেখানে সবটা মেনে নিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগছে।
আরিহা ইহানকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরতে পারছে না। এক জড়তা বিরাজমান করছে তার মধ্যে। আরিহা এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

— ভেবে বলছো তো? সকলে না জানলেও তুমি জানো আমি ধর্ষিতা। একজন নির্যাতিত শোষিত নারী। যে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কলঙ্কের আবরণে ঘেরা। যার শরীরের প্রত্যেকটা অংশে ওই নিকৃষ্ট প্রাণীর স্পর্শগুলো এখনো বিদ্যমান। চেয়েও আমি এই স্পর্শগুলো মুছে ফেলতে পারবো না। পারবো না নিজের এই কলঙ্কিত চামড়াকে গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলতে। নিজে তো এই তিক্ততায় হ্রাস হয়েই যাব সাথে তুমিও হয়ে যাবে। অন্য কেউ তোমায় আমার ধর্ষিতা হওয়ার কথা মনে না করিয়ে দিলেও তোমার বিবেক ঠিকই তোমায় তা প্রতি নিয়ত মনে করিয়ে দিবে। তখন তোমার অন্তরই তিক্ততায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
হয়তো আমাকে নিয়ে সমাজে উঁচু করে বাঁচতে পারবে তুমি কিন্তু বিবেকের কাছে মাথা উঁচু করতে থাকতে পারবে তুমি? আমি পরিপূর্ণ হয়েও অপরিপূর্ণ। আমার অতীত জেনে আর যাই হোক ভালবাসা তো যায় না বরং সর্বোচ্চ করুণা করা যায়। আর আমি কখনো করুণার পাত্রী হতে চাই না। নিজে সব সময় যেভাবে মাথা উঁচু করে চলে এসেছি সেভাবেই বাঁচতে চাই।
তাই বলছি যাই করো না কেন করুণা করো না।তুমি যেতে চাইলে বাধা দিব না আমি বরং নিজ থেকেই ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে…..

আর বলতে পারলো না আরিহা। ইহান স্বজোরে আরিহার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আরিহা এইবার যেন অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সে মোটেও এইটা আশা করে নি। আরিহা মুখ তুলে ইহানের দিকে তাকাতেই কিছুটা স্থির হয়ে যায়। আবছা আলোয় ইহানের রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহেরাটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চোয়াল শক্ত করে আছে সে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের শিখা ঝরে পড়ছে। নাকটা একদম টুকটুকে লাল হয়ে আছে। আরিহা এইবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহান আরিহাকে নিজের খুব কাছে টেনে নিল। কিছু বুঝার আগেই আরিহা ঘারের পিছে হাত ঠেকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। আরিহা এইবার যেন অবাকের সপ্তম আকাশ পেড়িয়ে গেল। সবই ওর কাছে ধোঁয়াশা মনে হতে শুরু করলো। মনের ভিতরে এক শীতল অনুভূতি বয়ে যেতে শুরু করলো। মূহুর্তেই এক দামকা হাওয়া এসে যেন সব উলোটপালোট করে দিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর ইহান সরে আসে। আলতো করে আরিহার মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। নিজের রাগটা সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলো। অতঃপর তিক্ত গলায় বলে,

— সবসময় এক ডিগ্রি বেশি বুঝলে হয় না? সব কিছু কি স্বাভাবিকভাবে নেওয়া যায় না? বার বার কি লাগিয়ে দিয়েছ যে তুমি ধর্ষিতা, তুমি নির্যাতিত শোষিত নারী? আচ্ছা এইখানে কি তোমার দোষ ছিল? কোন অপরাধ ছিল? ছিল না তাহলে তুমি বার বার কেন নিজেকে আমার সামনে ছোট করে তুলে ধরছো?
পুরুষরা কি নির্যাতিত হয় না? তারা কি অন্যের দ্বারা শোষিত হয় না? তাহলে তাদের বেলায় কেন এই শব্দ গুলো উচ্চারণ হয় না? কেন কেউ বলে না একজন পুরুষ অমুক দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে? কেন তাদের বেলায় কোন দোষ ধরা হয় না? খুঁত ধরা হয় না?
অনেকেই বলবে এর মূল কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু আমি বলবো না। এইখানে পুরোপুরি ভাবে সমাজের দোষ না। এর মুখ্য কারণ হচ্ছে আমাদের চিন্তাভাবনা। আমরা সময় নারীদেরকেই দোষী ভাবি। তাদের জন্যই নির্যাতিত শব্দটা ব্যবহার করি। ধর্ষিত নারীদের মনে রাখি অথচ ধর্ষককে নয়। খুঁতও ধরি এক ধর্ষিতার যে তার এই কারণে আজ তার এমন দোষা। তাকেই বাজে মন্তব্য করি। কেন করি আমরা এমন? আমাদের এই চিন্তা ভাবনার জন্য। একবারও কি আমরা এইটা ভাবি যে ওই মেয়েটার উপর দিয়ে কি গিয়েছে? কি সহ্য করেছে সে? বরাবর সকল জায়গায় একজন ধর্ষিতাকে লজ্জিত হতে হয়, লাঞ্চিত হতে হয়। কেন হতে হয়? তার দোষ কোথায় এইখানে? সে কেন লজ্জা পাবে। তার তো মাথা উঁচু করে চলার কথা কেন না সে তো কোন ভুল করে নি। বরং যে ভুল করেছে তাকে লজ্জিত হওয়া উচিৎ। লাঞ্চিত হওয়া উচিৎ। তাকে এই সমাজ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করা উচিৎ।
নির্যাতিত, শোষিত শব্দগুলো আমরা শুধু মাত্র নারীদের জন্যই ব্যবহার করি। আর তা আজ থেকে না বরং সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই৷ যেন এই দুইটি শব্দ শুধু মাত্র মেয়েদের জন্য নির্ধারিত। তুমি এই বলো এই শব্দটি কেন শুধুমাত্র নারীদের জন্যই ব্যবহৃত হবে। পুরুষদের বেলায় কেন এই শব্দ গুলো ব্যবহৃত হয় না। নারী আর পুরুষ উভয়ের বেলায় এইটি প্রযোজ্য। তাই উভয়ের বেলায় এই শব্দটি ব্যবহৃত করতে হবে। তা না হলে এই ইচ্ছাকৃতভাবে বানানো স্ত্রীবাচক শব্দগুলোই বাংলা সাহিত্য হতে তুলে ফেলতে হবে।

এই বলে দম নেয় ইহান। আরিহা ছলছল করা দুটো চোখ বন্ধ করে রাখে। যার ফলে চোখের ফ্রেমে বন্দী থাকা অশ্রুগুলো গান বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইহান একটু শ্বাস নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

— তাই বলছি যতক্ষণ না আমরা নিজেরদের চিন্তাভাবনা পবিত্র করছি, যতক্ষণ না সকলকে সমান চোখে দেখতে শুরু করছি ততোক্ষণ কিছুই বদলাবে না। তুমি তোমার চিন্তাভাবনা বদলাও সমাজ এইভাবেই বদলে যাবে। বরং তখন বদলাতে বাধ্য হবে।
আর তুমি যদি নিজের সম্মান নিজেই না করো তাহলে অন্যের থেকে কিভাবে আশা রাখো যে সে তোমায় সম্মান করবে। নিজে ছোট মনে করো না। তুমি কলঙ্কিত নও বরং ফুলের চাইতেও বেশি পবিত্র। কিভাবে জানো? কেন না তোমার অন্তর পবিত্র। তোমার চিন্তাভাবনা পবিত্র। সবচেয়ে বড় কথা তোমার মন পবিত্র।
তুমি হচ্ছো পাথরের মধ্যে ফুটে উঠা সেই বিশেষ পুষ্প যার সামনে সকল পুষ্প নেতিয়ে পড়ে। ইউ আর রেয়ার আরিহা এন্ড ইউ হ্যাভ টু বিলিভ দিস। আমি তোমার উপর কোন করুণা করছি না বরং তোমায় পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে আমি এমন রেয়ার একজনকে পেয়েছি। যার জায়গায় শুধুই এখন আমার অন্তরালে।

আরিহা ভাবতেও পারে নি ইহানের চিন্তাভাবনা এতটা সচ্ছ। এতটা বিশুদ্ধ ও উন্নত। ইহানের প্রত্যেকটা কথাই আরিহার চিন্তাভাবনার সাথে মিলে গিয়েছে। আরিহা তখন ইচ্ছাকৃত ভাবে সেই কথাগুলো ইহানকে বলেছিল যাতে সে ইহানের প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পারে। অনেক সময় আমরা কষ্টের কোন ঘটনা শুনে আবেগে ভেসে গিয়ে হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। ভবিষ্যতে চিন্তা করি না। অতঃপর পরে গিয়ে আমরা তা নিয়ে আফসোস করি। তাই আরিহা ভবিষ্যতের তিক্ততা ইহানের সামনে তুলে ধরে যাতে সে ইহান নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবে। কিন্তু ইহানের প্রতিক্রিয়া দেখে আরিহা বুঝেই গিয়েছে আর যাই হোক ইহান তাকে ফেলে দিবে না বরং সে যা বলেছে তাই করে দেখাবে। আজ মনে হচ্ছে এই প্রথমবার মনের কথাটা শুনে আরিহা জীবনের সব ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এইটি এক মাত্র সম্ভব হয়েছে জিসানের জন্য।
আরিহার যখন এইসব ভাবছে তখন ইহান ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর বলতে থাকে,

— ভালবাস কি না তা জানি না কিন্তু আমি বাসি।প্রচন্ড রকমের বাসি। তাই তো খুব করে চাই তোমায়। তোমার সাথে এই হাতটি ধরে সারাটা জীবন পারি দিতে চাই। তোমার অন্তরালে আমি হয়ে বসবাস করতে চাই। তোমার কষ্ট গুলো নিজের ভালবাসার চাদরে আবরণের নিচে পিষিয়ে ফেলতে চাই। খুব গভীরভাবে আপন করে নিতে চাই তোমায়। তোমাতেই আমি পরিপূর্ণ হতে চাই। আই লাভ ইউ আরিহা। আই লাভ ইউ আ লোট। উইল ইউ বি মাইন ফোর এভার?

আরিহা চোখ দুটো চিকচিক করছে। মনের মধ্যে আজ আলাদাই শান্তি বয়ে চলেছে। মন বার বার বলছে, ” সারাজীবনের জন্য ইহানের হয়ে যেতে। তাকে আঁকড়ে ধরেই ওর হয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে। নিজের কষ্ট গুলো ভুলে এগিয়ে যেতে।”

আজ আরিহা তার মনের কথাটা ফেলতে পারে নি। সে মুচকি হেসে ইহানকে জড়িয়ে ধরে আর এতেই ইহান তার উত্তর পেয়ে যায়। সে অতিনীরবে আরিহাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। আজ হয়তো তাদের রাতটা অতি মধুর হবে। হয়তো এইটি হবে ভালবাসার রাত। একজন পাবে নিজের ভালবাসার মানুষকে তো আরেকজন বেড়িয়ে আসবে নিজের তিক্ত অতীত থেকে। অতীতের সকল গ্লানি ভুলে এগিয়ে যাবে নতুন জীবনের উদ্দেশ্য।

#চলবে।❤️