অন্তরালে তুমি পর্ব-৩৩

0
2417

#অন্তরালে_তুমি
#Part_33
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

? ৬ বছর পর ?

বাইরের আকাশ মেঘলা। মেঘের আবরণে ঢাকা পরে গিয়েছে সূর্যটি। দূর আকাশে ঝাপটা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিগুলো। বাইরে রি রি বাতাস বইছে। তার সাথে তাল মিলে অরণ্যরা খেলখেলিয়ে হেসে উঠছে আর হাল্কা দোলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো নেমে আসবে ঝুম বৃষ্টি। ধুয়ে নিয়ে যাবে সকল গ্লানি, কষ্ট, বেদনা। কিন্তু আদো কি চাইলে সকল কষ্ট, বেদনা ভুলা যায়? উত্তর মুখ ফুটে বেড়িয়ে না আসলেও বুক চিরে বেড়িয়ে আসে শুধু দীর্ঘশ্বাস।

ঢাকার একটি নাম করা রেডিও স্টেশনের ৭ নাম্বার ফ্লোরের মাঝারি আকার একটি রুমে RJ এর সিটে বসে আছে ইহান। কানে তার হেডফোন আর মুখের সামনে মাইক। হাতের বা পাশে থাকা টেবিলের উপর হাল্কা ধোঁয়া উঠা কফি কাপটি রাখা। ইহানের মুখে ছেঁয়ে আছে গুরুগম্ভীর ভাব। গ্লাসের অন্য পাশ দিয়ে সবাই অধীর আগ্রহে ইহানের পরবর্তী ঘটনাটি শুনার অপেক্ষা করছে। এইদিকে শত শত শ্রোতা বসে আছে পরবর্তী ঘটনাটা জানার আশায়। মুহূর্তের মধ্যেই হাজার হাজার মেসেজ ভির করেছে সফটওয়্যারে। সকলেই জানার জন্য বেকুল হয়ে গিয়েছে যে পরবর্তীতে কি হয়েছিল। আরিহাকে ওটি নেওয়ার পর কি হয়েছিল? কৌতূহলের চেয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে তারা। সাথে ঝেঁকে ধরেছে এক রাশ ভয়। এর সাথে শত শত প্রশ্নের পাহাড় জমে গিয়েছে তাদের মাঝে। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে কমন প্রশ্ন হচ্ছে, “কি হয়েছিল আরিহার সাথে? আরিহা কি বেঁচে আছে নাকি নেই? সেই বাচ্চাটির কি হলো? তারা বেঁচে থাকলে এখন তারা কই?”

কিন্তু ইহান কোন মেসেজেরই উত্তর দিচ্ছে না। সে স্থির হয়ে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে বা হাতটা দিয়ে মাথা চেপে বসে আছে সে। হয়তো নিজেকে সামলে নিচ্ছে। অতঃপর সে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মুখে হাসি টেনে নিয়ে বলে,

— সরি গাইস! আজকের শো এর টাইম শেষ। না চাওয়া সত্ত্বেও বিদায় নিতে হচ্ছে। জানি আপনাদের মনে হয়তো এতক্ষণে শত শত প্রশ্নের ঝুড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে। সকলের একটাই প্রশ্ন আরিহার সাথে কি হয়েছিল তাই তো? সে কি বেঁচে আছে নাকি নেই?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাদের নেক্সট এপিসোডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জানি এই অপেক্ষার প্রহর অনেক বেশি তিক্ততা বয়ে আনে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই আমি সময়ের হাতে আবদ্ধ। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে আপনাদের আশ্বস্ত করছি নেক্সট এপিসোডে আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন আর সেই সাথে নেক্সট এপিসোডই হবে “অন্তরালে তুমি” শো এর লাস্ট এপিসোড। টিল দ্যান টিউন উইথ এবিসি রেডিও, ৮৯. ০২ এফএম। গুড বাই গাইস!

এই বলে মাইকটা অফ করে দেয় সে। তারপর আবার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে গলায় হেডফোন ঝুলিয়ে, ডান হাতে কফির কাপটি নিয়ে বেড়িয়ে আসে সে। চুল গুলো বেশ এলোমেলো। চোখ দুটো হাল্কা লাল। ঠোঁট দুটো একদম কালচে হয়ে আছে। মুখটা কেমন রক্তশূণ্য লাগছে।
বাইরে উপস্থিত সকলের দৃঢ় দৃষ্টি ইহানের দিকে। সকলের মুখে কৌতূহলী ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু কেউ ইহানকে প্রশ্ন করার সাহসটুকু পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে শত প্রচেষ্টা করলেও ইহান এখন মুখ খুলবে না। তাই মূহুর্তেই সকলের মুখে এক বিষাদ ছড়িয়ে যায়। এমন সময় রেডিও স্টেশনের মালিক মুজিব সাহেব এসে হাজির হন। সে ইহানের সামনে গিয়ে চড়া এক হাসি দেন। তারপর ইহানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

— ওয়েল ডান ইহান! তোমার এই “অন্তরালে তুমি” শো-টা যে কত হিট হয়েছে তা তোমার ভাবনার বাইরে। তোমার এই শো এর জন্যই আজ আমরা টপ ওয়ান রেংকিং এ জায়গা করতে পেরেছি।

ইহান কিছু না বলে স্মিত হাসে। মুজিব সাহেব হাল্কা হেসে বলে,
— তা পরের এপিসোডই কি লাস্ট এপিসোড করতে চাচ্ছো তুমি?

ইহান হাল্কা হেসে বলে,
— তাই তো বললাম মনে হয়।

মুজিব সাথে মুখ ছোট করে বলে,
— আর কয়েকটা এপিসোড এগানো যায় না?

ইহান কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলে,
— সব কিছুরই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আর সেই সীমাবদ্ধতা যতক্ষণ না লগ্ন হচ্ছে ততক্ষণ তার উপর এক ভালো লাগা, দৃঢ় মনোবল কাজ করে। যখনই সেই সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে যায় তখনই তার উপর বিরক্তি, অনিহা আর রুদ্ধ ভাব চলে আসে। আর সেটা ধীরে ধীরে তিক্ততায় পরিনত হয়। আশা করি কথাটা বুঝাতে পেরেছি।

মুজিব সাহেব হাল্কা হেসে বলে,
— এজ ইউর ইউস। তোমাকে জোর করার ক্ষমতা আমার নেই। সো তুমি যা মনে করো তাই করো।

এই বলে মুজিব সাহেব চলে যান। ইহান কিছুক্ষণ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমে চলে যায়। সেখানে থাকা স্পিনিং চেয়ারের মধ্যে বসে গা এলিয়ে দেয় সে। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের রিংটোন কানে যেতেই ইহানের ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়ে যায়। যে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের নাম্বারটা দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যায়। অতঃপর দ্রুত ফোন রিসিভ করে সে। ফোন রিসিভ করার পর যা শুনে তাতে তার চোখ মুখের রঙ বদলে যায়। শান্ত ইহানের চেহেরায় ফুটে উঠে ভয় আর আতঙ্কে সুক্ষ্ম রেখা। সে “আসছি” বলে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায় রেডিও স্টেশন থেকে৷ ইহানের এমন হতচ্ছাড়া ভাব দেখে সবাই কিছুটা বিচলিত হয়। কিন্তু তাও কেউ কিছু বললো না। যে যার মত কাজ করতে লাগলো।

________________________________________

ইহান বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাগলের মত অনাবরত কলিং বেল বাজাতে থাকে। ১ সেকেন্ডের দেরিও যেন ওর সহ্য হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরা এসে দরজা খুলে দেয়। নীরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহান এইদিক সেইদিক না তাকিয়ে সোজা রুমের দিকে হাঁটা দেয়। নীরা সেই দিকে তাকিয়ে নিরবে দীর্ঘ শ্বাস নেয়। ইহান দ্রুত রুমে এসে কাউকে না পেয়ে কিছুটা উঁচু গলায় কাউরো নাম ডাকতে থাকে,

— আহানা! আহানা!

বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দা থেকে ছোট ছোট পা ফেলে একটি ৬ বছর বয়সী মেয়ে বেড়িয়ে। পড়ণে তার সাদা গোল ফ্রক। গোলাপি ঠোঁটের কোনে হাল্কা হাসি। চোখ দুটোতে মায়া ভরা। ডান গালে ইহানের মতই ছোট একটা কুচকুচে কালো তিল। গায়ের রঙ আলতো হলুদ বর্ণে। লম্বা ঘন চুলগুলোতে উঁচু করে একটা ঝুঁটি করা। দেখতে একদম ছোট পরীর মত। সে ইহানের সামনে এসে দুই হাত কোমরে রেখে কিছুটা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলে,

— আমার নাম অনেক সুন্দর জানি। তাই বলে কি এতবার ডাক দিয়ে তা অন্যদেরকেও বুঝাতে হবে?

ইহান আহানাকে দেখে সাথে সাথে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। দুই হাতের কুনোই আর হাটু দেখতে থাকে। তারপর অস্পষ্ট সুরে বলে,

— তোমার কোথায় লেগেছে মামুনি? সকালে বলে তুমি পরে গিয়েছিলে। বেশি ব্যথা পাও নি তো? দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছ।

আহানা এইবার তার ছোট ছোট ভ্রু দুটি কুচকিয়ে বলে,
— আমি ব্যথা পাই নি।

ইহান এইবার চোখ ছোট ছোট করে বলে,
— কিন্তু নীরা যে বললো তুমি ব্যথা পেয়েছ?

আহানা ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
— নীরা মাম্মামকে আমি বলেছিলাম এইটা বলতে।

ইহান বলে,
— কেন? এতে কতটা ভয়ে গেছিলাম জানো তুমি? সব ছেড়ে ছুটে চলে এসেছি তোমার কাছে।

আহানা এইবার ইনোসেন্ট একটা ফেস করে বলে,
— সরি বাবাই! আর এমন করবো না।

ইহান আস্তে করে আহানার গালে চুমু খেয়ে বলে,
— ইট ইজ ওকে মামনি। তা তুমি কেন এমন করে শুনি?

আহানা মুখটা ছোট করে বলে,
–তোমার সাথে ঘুরতে যাব তাই। কত দিন হলো তুমি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাও না।

ইহান এইবার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলে,
— ওই তোমাকে না আমি কালকে বিকেলেই আইস্ক্রিম খাওয়ানোর জন্য বাইরে নিয়ে গেলাম আর ঘুরিয়ে আনলাম।

আহানা এইবার ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,
— সেটা তো কালকে নিয়ে গিয়েছ আজ তো আর নাও নি। এখন কালকে ভাত খেয়েছি বলে আজকে ভাত খাব নাকি।

ইহান এইবার ফিক করে হেসে আহানার নাক টেনে বলে,
— বেশ তো কথা বলেছ শিখেছ। তা এত কথা কে শিখালো শুনি।

আহানা দাঁত বের করে হাসি বলে,
— জিসান মামু!

ইহান কিছু না বলে হাল্কা হেসে আহানাকে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। এসে দেখে নীরা সোফায় বসে নিশানকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু নিশান খাইতে চাচ্ছে না। নিশানের বয়স ২ বছর ৭ মাস। আদো আদো কন্ঠে কথা বলতে পারে সে। সেই আদো আদো কন্ঠে বলছে,

— পাপা! পাপা!

নীরা এইবার অসহায় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে জিসানকে কয়েকটা বকা দেয়। তা দেখে ইহান গলাটা ঝেড়ে বলে,

— কি খাচ্ছে না?

নীরা এইবার অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে,
— না! খালি কখন থেকে “পাপা পাপা” করে চলেছে। জিসান ছেলেটাকে একদম পাপাভক্ত বানিয়েছে। পাপা ছাড়া ছেলেটা কিছুই বুঝে না। কি যে করি ভাইয়া বলুন। আচ্ছা ঝামেলায় পড়েছি এদেরকে নিয়ে।

ইহান নীরার কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসা শুরু করে। এর মধ্যেই আহানা বলে উঠে,
— নীরা মাম্মাম ও এইভাবে খাবে না। তুমি বরং ওকে জিসান মামুর ওই বানানো ওই ভিডিওটা ছেড়ে দাও। ওই দেখলে ও চুপ হয়ে যাবে আর চুপ খেয়ে ফেলবে।

আহানার কথা শুনেই নীরার মুখ চকচক করে উঠে। সে খুশি হয়ে বলে,
— আরেহ আহানা সোনা আমার ভিডিও এর কথাটা মনেই ছিল না৷ ইশশ! তুমি না থাকলে যে আমার কি হতো?

আহানা তখন ভাব নিয়ে বলে,
— কি আর হতো আলু ভর্তা হতো।

এই কথা শুনে ইহান হো হো করে হেসে দেয় আর নীরা বিভ্রান্তি ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর ইহান নীরাকে বলে আহানাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে।

________________________________________

পার্কের মধ্যে বসে আছে আহানা। হাতে তার বড় একটি কেডবেরি ডেইরি মিল্কের প্যাকেট। সে খুব আয়েশ করে ইহানের কোলে চড়ে বসে চকলেটটা খাচ্ছে। ইহান আহানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মাঝে মধ্যে হাল্কা করে আহানার গাল টেনে দিচ্ছে। গাল টানার ফলে আহানা চোখ গরম তাকাচ্ছে। যার অর্থ এই যে ইহান তাকে চকলেট খাওয়ার টাইম ডিস্টার্ব করছে। কিন্তু ইহান এইসব বেশ উপভোগ করছে। আহানা চকলেট খেতে খেতে সামনে তাকিয়ে দেখে একটা ওর বয়সী বাচ্চা তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার ময়লা পেন্ট আর ধুলোয় মাখা সাদা গেঞ্জি। চুলগুলোতে ধুলোর আবরণ তৈরি হয়ে ধূসর হয়ে আছে। গায়ে কেমন শুকিয়ে যাওয়া ছিলে ও কাঁটার দাগ। পায়ে জুতো নেই। বা হাতে একটা ময়লার ব্যাগ। তাতে প্লাস্টিক জাতীয় কিছু রাখা। সে লোভাতুর দৃষ্টিতে আহানার চকলেটটির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো খেতে ইচ্ছে করছে তার। আহানা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চকলেট এর দিকে তাকায়। তারপর ইহানের কোলে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে নামার জন্য। তা দেখে ইহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— কি হয়েছে এমন করছো কেন মামনি?

আহানা তখন মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,
— আমি নামবো। আমাকে নামাও। আর কোন প্রশ্ন করবে না।

ইহান জানে এখন কিছু বললেও সে উত্তর দিবে না। একদম ঘাড়ত্যাড়া হয়েছে ঠিক আরিহার মত। ইহান এক দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আহানাকে নামিয়ে দেয়। আহানা ছাড়া পেয়েই দৌঁড়ে সেই বাচ্চাটির কাছে চলে যায়। বাচ্চাটি আহানাকে এইভাবে আসতে দেখে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে যায়। তা দেখে আহানা মুচকি হেসে নিজের হাতে থাকা চকলেটের উপরে মুখ লাগানো অংশটুকু ভেঙ্গে নেয়। তারপর পুরো পেকেটটাই সেই বাচ্চাটির সামনে এগিয়ে দেয়। আর মিষ্টি হাসি বলে,

— নাও খাও অনেক মজা।

বাচ্চাটা অবিশ্বাস্য চোখে আহানার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
— পুরো পেকেটটাই আমারে দিতাসেন?

আহানা মাথা দুলিয়ে “হ্যাঁ” বলে। বাচ্চাটি যেন এইবার একটু আশ্বস্ত হয়। সে আলতো হাতে চকলেটটা নেয়। আহানা আস্তে বলে,

— খাও!!

ছেলেটা এইবার চকলেট খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার পর চোখে মুখে হাসি ফুটেছে ওর। আহানা তা দেখে হেসে সেখান থেকে ইহানের কাছে চলে আসে। ইহান বেঞ্চে বসে মুগ্ধ নয়বে সবই দেখছিল। আহানা ইহানের সামনে এসে হাত এগিয়ে দেয়। ইহান মুচকি হেসে ওকে কোলে তুলে নেয়। আহানা ইহানের কোলে বসে হাতে থাকা সেই ছোট টুকরো চকলেটটা খেয়ে ফেলে। ইহান হেসে বলে,

— এইটা এটো ছিল বলে ওকে দাও নি বুঝি?

আহানা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
— হুহ!

ইহান হাল্কা হেসে বলে,
— তুমি কি জানো তোমার সকল জিনিস একজনের সাথে মিলে। তুমি একদম..

কথাটা শেষ না করতে দিয়ে আহানা বলে উঠে,
— আমি একদম মা এর মত হয়েছি তাই তো। হুহ! বলতে হবে না। আমি জানি আমি মা এর মত হয়েছি। আমি হচ্ছি আরিহা আহমুদ এর ছোট ভার্সন আহানা আহমুদ বুঝলে।

ইহান আহানার নাক টান দিয়ে বলে,
— আরিহা আহমুদ না মাহমুদ হবে। আর তুমিও আহানা আহমুদ না বরং মাহমুদ।

আহানা মুখ ছোট ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
— সবই একই লাগে।

ইহান হো হো করে হেসে উঠে। তারপর ওকে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে যায় পার্ক থেকে।

?

বাসায় আজ আয়োজন করা হচ্ছে। এই আয়োজনের অতি বিশেষ কেন না আজ আহানার জন্মদিন। তাই তো আজ দুপুরে সকলেই একত্রিত হবে বলে। রান্না ঘরে নীরা আর পুষ্পিতা রান্না করছে। মূলত আজ আয়োজন করা হচ্ছে বলেই পুষ্পিতা সকাল সকাল এসে পড়ে নীরার হেল্প করার জন্য। সার্ভেন্ট থাকা সত্ত্বেও তারা দুইজন ঠিক করেছে আজ তারা রান্না করবে। বাইরে সোফার রুমে ইহান, তীব্র, জিসান বসে আছে। তিনজন কথা বলছে। তাদের সামনের ফ্লোরে আহানা, নিশান আর তুষার খেলছে। তুষার হচ্ছে পুষ্পিতা আর তীব্রর ছেলে। ছেলেটির বয়স এইবার চারে গিয়ে পড়বে। বড্ড দুষ্টু স্বভাবের সে। তিনজন মিলেই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে।
হুট করে তীব্র ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

— আচ্ছা ইহান তুই কিভাবে এইসব একসাথে সামলাস শুনি? প্রথমত ফ্যাশন হাউজ তারপর আবার RJ এর কাজ, সাথে তোর বিজনেসও আবার ওকেও সময় দিস। এইগুলোই বাদ দে আহানাকে এত সময় দিস কিভাবে শুনি? আমি তো নরমাল জব করেই টাইম পাই না। এইসব এক সাথে মেনেজ কিভাবে করিস?

ইহান মুচকি হেসে বলে,
— কিছুটা সময়ের কাছ থেকে, কিছুটা নিজ থেকে, কিছুটা দায়িত্ববোধ থেকে আর কিছুটা আরিহার থেকে।
আর তার উপর ফ্যাশন হাউজ কি আমি একা চালাই? সাথে পুষ্পিতা আর নীরা আছেই। বিজনেসেও আমায় সোহেল হেল্প করে। আর RJ এর কাজ তো সপ্তাহে একদিন তাও আবার দেড় ঘন্টার জন্য। সময়ের অভাব তো দেখছি না।

জিসান এইবার মুখ ফুলিয়ে বলে,
— ভাই আমার ক্রেডিট দিলি না।

জিসানের কথায় ইহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
— কিসের ক্রেডিট?

জিসান অভিমানী সুরে বলে,
— আমি কিন্তু আহানাকে সামলাতে সাহায্য করি এই কথাটা কইলি না। আহা বুকটা কষ্টে ফাইট্টা যায়।

পাশ থেকে আহানা বলে উঠে,
— ফেভিকল এনে দেই তোমায় জিসান মামু। ফাটা জায়গা জোরা লাগিয়ে নাও।

আহানার কথা শুনে তীব্র আর ইহান হেসে উঠে। জিসান চুপসে গিয়ে বলে,
— আমার কথায় ফোঁড়ন না দিলে তোর পেটের ভাত হজম হয় না, তাই না!

আহানা ভাব নিয়ে বলে,
— কেয়া কারু ও মামু, ম্যায় আদাত সে মাজবুর।

তীব্র এইবার হেসে বলে,
— এই মেয়ে একদম তোদের মিক্সড কম্বিনেশন হইসে রে।

ইহান ভাব নিয়ে বলে,
— দেখতে হবে না কার মেয়ে।

আহানা পাশ থেকে দাঁত বের করে বলে উঠে,
— আরিহা মাহমুদের মেয়ে আমি। তাই না বাবাই?

ইহান মলিন হাসি হেসে বলে,
— হ্যাঁ!

বেশ কিছুক্ষণ পরেই কলিং বেজে উঠে। ইহান গিয়ে দরজা খুলতে দেখে সোহেল আর এরিনা দাঁড়িয়ে আছে। কোলে তাদের এক বছরের মেয়ে সোহানা। এরিনাকে দেখে ইহান ওকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর তারা ভিতরে আসতেই আহানা দৌঁড়ে এরিনা কাছে যায় আর বলে,

— ফুপিমনি তুমি এসেছ? জানো আমি কতক্ষণ ধরে তোমার আর সোহানার ওয়েট করছি। জলদি ওকে নিচে নামাও আমি দেখবো ওকে।

এরিনা মুচকি হেসে একটু নিচু হয়। আহানা সোহানার গাল হাল্কা টেনে দিয়ে ওর গালে টুপ করে চুমু খায়। সোহানা সাথে সাথে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। এরিনা আর সোহেল দুইজনেই আহানার সামনে এসে ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। তারপর হাতে থাকা গিফটরা ওকে দিয়ে দেয়। আহানা “থেংক ইউ” বলে গিফটি নেয়। অতঃপর সকল বাচ্চা পার্টি সোহানাকে ঘিরে ধরে। সোহানা সকলের ছোট বলে বাচ্চা পার্টিদের ওর প্রতি ঝোঁক একটু বেশি। এরিনা সব বাচ্চাদের নিয়ে চলে যায় রুমে। সোহেল তীব্রের পাশে বসে বলে,

— রাহুল কি খবর?

তীব্র হেসে বলে,
— ও তো আপাতত ইউকে সেটেল আছে। বাচ্চা, বউ নিয়ে বেশ কাটচ্ছে ওর দিন।

সোহেল এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— তা ইহান আজকে যাবি সেখানে তাই না?

ইহান দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে বলে,
— হ্যাঁ! কিন্তু তার আগে রেডিও স্টেশন যেতে হবে। অসম্পূর্ণ কাহিনিটা শেষ করতে হবে তো।

জিসান ইহানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
— পুরানো ক্ষত কেন বার বার সতেজ করছ। কেন রাজী হলে এই শো-টা করার জন্য?

ইহান হেসে বলে,
— নিজের মেয়ের কথা কিভাবে ফেলি বল? যখন আমার জীবন কাহিনি একটি শো এর মাধ্যমে বলার জন্য অফার এলো তখন তো মানা করেই দিয়েছিলাম। অতঃপর আমাকে রাজি করাতে না পেরে ওরা আহানাকে খুঁজে বের করে ওকে রিকুয়েষ্ট করে। হয়তো বুঝতে পেরেছিল আহানাই এক মাত্র ব্যক্তি যার কথা আমি শুনবো। অতঃপর আহানাও চেয়েছিল আমি যাতে এই শো-টা করি। তো বল কিভাবে মানা করতাম আমি ওকে? আজ পর্যন্ত ওর কোন কথা ফেলতে পারি নি তাই এইটাও পারলাম না।

জিসান দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে বলে,
— পারবে তো আজকের দিনেই এইসব বলতে?

ইহান কিছু না বলে মলিন হাসে।

________________________________________

রেডিও স্টেশনে বসে আছে ইহান। ২ মিনিটের মাঝেই শো শুরু হবে। বাইরে আজ জিসান, নীরা, তীব্র, পুষ্পিতা, সোহেল, এরিনা, আহানা, নিশান, তুষার আর সোহানা সকলেই উপস্থিত। অফিসেরও অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ইহান এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে যেই না শো শুরু করতে যাবে তখনই ওর রুমে আহানা এসে হাজির হয়। আহানার পড়নে সাদা সেলোয়ার-কামিজ। ওরনা গলায় ঝুলানো। ঠোঁটের কোনে সেই মিষ্টি হাসি। চুল গুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। চোখ দুটো মায়া দিয়ে ভরা। আহানা যেন আজ আরিহার প্রতিবিম্ব। ইহানের মনে হচ্ছে ওর সামনে ছোট আরিহা দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে ইহানের চোখ ছলছল করে উঠে। সে কোন মতে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে আশা পানিটা মুছে ফেলে অতঃপর সে আহানাকে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগে আহানা অতি মিষ্টি সুরে বলে,

— আমি তোমার সাথে থাকি বাবাই?

ইহান আহানার কথাটা ফেলতে পারলো না। সে আহানা কে ইশারায় এগিয়ে আসতে বলে। আহানা চুপচাপ ওর সামনে যেতেই ইহানকে ওকে কোলে বসিয়ে নেয়। তারপর শো শুরু করে,

— আসসালামু আলাইকুম লিসেনার্স। সবাই কেমন আছেন? আশা করি সকলেই ভালো আছেন। আজ শেষবারের মত আপনাদের মাঝে হাজির হলাম আপনাদের প্রিয় শো “অন্তরালে তুমি”-কে নিয়ে। শেষবারের মত কেন বলছি তাই তো? এর মুখ্য কারণ হচ্ছে আজকেই আমি এই শো-টির ইতি টানবো।

এই বলে এক দীর্ঘ শ্বাস নেয় সে। তারপর বলতে শুরু করে,
— সকলের প্রশ্ন ছিল যে, “আরিহা কি আদো বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে? বেঁচে থাকলে কোথায়? আর ওর বাচ্চাটিরই বা কি হলো? ” তাই তো!
তো উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ আরিহা বেঁচে আছে।

#চলবে