#অন্তহীন_বসন্ত~১০
লিখা- Sidratul Muntaz
এসএসসি শেষ হওয়ার পর বেশ অবসরে সময়গুলো কেটে যাচ্ছে অবন্তীর। কলেজে ভর্তি নিয়ে তার তেমন দুশ্চিন্তা নেই। সে পরীক্ষা ভালো দিয়েছে৷ রেজাল্টও ভালো করবে এই নিয়ে তার আত্মবিশ্বাস প্রবল। তার জেএসসি’ রেজাল্টও ভালো ছিল। ভালো রেজাল্ট করলে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া তেমন কঠিন ব্যাপার না। দিন-রাত মুভি সিরিজ দেখেই সময় কাটাচ্ছে সে। অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছে ঘুরতে যাওয়ার। এমন অবসর নাকি জীবনে আর কখনও আসে না। অবন্তীর কাজিন যে এবার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সে বলল,” ঘোরাঘুরি করার এখনি সময়। একবার কলেজে উঠে গেলে জীবন তামা তামা হয়ে যাবে। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত পাবি না। ইন্টারে এমনিতেও সময় কম। দেখবি ফার্স্ট ইয়ার শেষ হতে না হতেই নাকের ডগায় এইচএসসি এসে কড়া নাড়বে৷ আর এইচএসসি শেষ করেও শান্তি নেই। সাথে সাথেই এডমিশনের প্রিপারেশন নিতে হবে। নাহলে পাবলিকে পড়ার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর এমনিও কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাবি না। তাই এখনি বলছি, বেড়ানোর ইচ্ছে থাকলে এখনি ইচ্ছে পূরণ কর। জীবনের সব শখ-আহ্লাদ এখনি মিটিয়ে নে। এমন সুযোগ আর আসবে না।”
অবন্তী ইচ্ছে করে সাজেক যেতে। কক্সবাজারে সে একবার গিয়েছিল। সেন্ট মার্টিনে গিয়েছিল খুব ছোটবেলায়। সেই স্মৃতি তার মনে নেই। বিলকিসকে এই কথা জানানো হলেই কঠিন মুখ করে বলল,” চাকরি করে নিজের টাকায় ঘুরবি। তোর বাপের এতো টাকা নেই তোকে নিয়ে সাজেক ঘুরিয়ে আনবে।”
অবন্তী মায়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,” তোমার জায়গায় অন্য মা হলে বলতো বিয়ে হলে জামাই নিয়ে ঘুরবি। আর তুমি বলছো চাকরির কথা!”
” হ্যাঁ বলছি। জামাই নিয়ে ঘোরার আশ্বাস তোকে আমি দেব না। সবার সেই সৌভাগ্য হয় না। তোর বাপের সাথে সংসার করছি সতেরো বছর। জীবনে একটা রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। আবার সাজেক! সবার থেকে সবকিছু এক্সপেক্ট করা যায় না। তাই জামাইয়ের আশায় না থেকে নিজে সাবলম্বী হ আগে।”
অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মা যখন বাবা সম্পর্কে এই ধরণের কথা বলে তখন তার খুব মায়া লাগে। অবন্তীর কাছে তার বাবা দুনিয়ার সরলতম মানুষ। যাকে উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। মানুষটার শুধু একটাই দোষ। তার টাকা-পয়সা নেই। মা সবসময় এমনভাবে আফসোস করেন যেন অবন্তীর বাবাকে বিয়ে করে তিনি বিরাট ভুল করেছেন। বিলকিস প্রায়ই বলে,” এসব ভালোবাসা-টাসা কিছু না বুঝলি। সবই ধোঁকা। আসল জিনিস হচ্ছে টাকা। টাকা কখনও ধোঁকা দেয় না। টাকা থাকলে ভালোবাসা আসবে আর যাবে। জীবনের একটা সময় গিয়ে বুঝবি, দুনিয়ার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে টাকা।”
অবন্তী এখনি বুঝতে পারে। তার কাছে টাকা নেই বলেই সে এতো অসুখী। যদি তার কাছে অনেক টাকা থাকতো, তাহলে নিঃসন্দেহে সে বিদেশে পড়তে যেতে পারতো। অন্যকোনো দেশ নয়, তার স্বপ্ন কানাডা। তার টাকা থাকলে রিমা আন্টিও তাকে অপছন্দ করতেন না। যখনি মন চাইতো সে অনায়াসে নিশান্তর সঙ্গে দেখা করতে পারতো। কাউকে ভয় পেতে হতো না। এইযে প্রায় তিনবছর হতে চললো, অবন্তীর আর দেখা হয়নি নিশান্তর সাথে। তারা নিশ্চয়ই আরও অনেকবার বাংলাদেশে এসেছে। অবন্তী সেই খবরও জানে না। মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস কখনও হয়নি। সে পুরোদমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সবকিছু ভুলে থাকার। নিশান্ত নামের কেউ ছিল, এই ব্যাপারটাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু দিনশেষে তার মনে হয় সে অভিনয় করছে। মন থেকে সব মুছে ফেলা এতো সহজ না। সে বুঝি একটা অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করছে।
কিছুদিন হলো অবন্তী হেলেনদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এই প্রথম সে একাই এসেছে। বিলকিসও আপত্তি করেনি। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। হেলেন বছর দেড়েক আগে ধানমন্ডিতে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। এখন আর শ্বশুরবাড়িতে সবার সঙ্গে থাকে না তারা। আলাদা হয়ে এসেছে। অবন্তীরা হেলেনের আলাদা ফ্ল্যাটে বেশ কয়েক বার এসেছে। কিন্তু এখানে অবন্তীর ভালো লাগে না। আগে হেলেন খালামণির বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলেই তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। আর এখন রীতিমতো বিরক্ত লাগে। এখানে গল্প করার মতো কেউ নেই। আগের বাড়িতে ঈশিতা ছিল। এই বাড়িতে অবন্তীর সমবয়সী কেউ নেই। হেলেন সারাক্ষণ সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। শাওন ছোটমানুষ। সে ব্যস্ত তার খেলা-ধুলা নিয়ে। জাকির আঙ্কেল থাকেন অফিসে। বিশাল ফ্ল্যাট থমথম করে। সেই থমথমে নীরব ফ্ল্যাট অবন্তীও বসে থাকে থমথমে হয়ে। একদিন সকালে হেলেন বলল,” আজকে আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াত আছে। অবন্তী, তুই কি যাবি?”
” অপরিচিত মানুষ বিয়েতে আমি গিয়ে কি করব?”
” তার মানে যাবি না? বাড়িতে একা থাকতে পারবি?”
” আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”
” আচ্ছা। দেখিস কিন্তু আবার। পরে ভয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিস না যেন!”
অবন্তী হেসে ফেলল। সে ভেবেছিল হেলেন খালামণি মজা করছে। কিন্তু বিকালে সত্যি সত্যি সবাই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল। অবন্তী থেকে গেল একা বাসায়। জাকির আঙ্কেল শুধু অবাক হয়ে একবার জিজ্ঞেস করলেন,” অবন্তী তুমি যাবে না?”
অবন্তী কিছু বলার আগেই হেলেন বলল,” না। অবন্তীর নাকি অপরিচিত মানুষের বিয়েতে যেতে ভালো লাগে না৷ তাই ভাবলাম আমরা যাই। ও একা থাকুক। কি অবন্তী, তোর একা থাকতে অসুবিধা নেই তো?”
অবন্তী তখন মাথা নেড়ে বলল, “অসুবিধা নেই।” কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার পর একা বাড়িতে অবন্তীর খুব ভয় হচ্ছে। তার উপর সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গেল। প্রবল বাতাস বইছে চারদিকে। যে কোনো সময় আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে। যদি সত্যি বৃষ্টি নামে তাহলে সর্বনাশ। কারেন্ট আসতে দেরি হবে। ভয়ে অবন্তীর হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার যোগাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। একা বাড়িতে অবন্তীর অসম্ভব ভয় লাগছে। সে একমনে বৃষ্টির দোয়া পড়তে লাগল,” আল্লাহুম্মা সাইয়্যিবান নাফিয়ান।” এর মাঝে হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। অবন্তী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সবাই বোধ হয় চলে এসেছে। বোকার মতো লুকিং গ্লাসে না তাকিয়েই দরজা খুলে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে একটা বজ্রপাত হলো। আকাশে নয়, বজ্রপাত হয়েছে অবন্তীর মস্তিষ্কে। কারণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশান্ত। তার শরীর ভিজে একাকার। হাত দিয়ে ভেজা চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,” আরে অবন্তী, তুমি? ”
তার বিস্মিত হওয়ার মাত্রা দেখে মনে হলো এই বাড়িতে অবন্তীর উপস্থিতি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ঘটার মতো কোনো ব্যাপার। অবন্তী নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” বেড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে?”
নিশান্ত তার জুতোগুলো ঝেড়ে স্ট্যান্ডে উঠিয়ে রাখল। অবন্তীকে পাশ কাটিয়ে ঝট করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। অকপটে বলল,” আমিও বেড়াতে এসেছিলাম। আরে, বাড়িতে কেউ নেই নাকি? এতো অন্ধকার কেন?”
অবন্তীর বুকের ভেতর রীতিমতো দামামা বাজছে। কি অপ্রীতিকর অবস্থা! এতোবড় একটা ফ্ল্যাটে সে আর নিশান্ত একা। তার উপর কারেন্ট নেই। পুরো বাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধু ড্রয়িংরুমে একটা মোমবাতি জ্বলছে। যে-কোনো সময় সেটাও নিভে যেতে পারে। অবন্তী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,” সবাই বেড়াতে গেছে। আর কারেন্ট নেই তাই অন্ধকার।”
নিশান্ত হাসল। খুব মজা পেয়েছে এমনভাবে বলল,” বাহ, চমৎকার ব্যাপার। তুমিও বেড়াতে এসেছো। আমিও বেড়াতে এসেছি। আবার ওরাও বেড়াতে গেছে। আজকে কি সবার বেড়াতে যাওয়ার দিন?”
অবন্তী কথা খুঁজে পাচ্ছে না। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। এর মাঝে নিশান্তর রসিকতা মোটেও মজা লাগল না। চোখেমুখে সে একটা গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,” তুমি এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে এইখানে কেন এসেছো?”
নিশান্ত ভ্রু কুচকে সোফায় বসল। অবন্তীর প্রশ্ন করার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টির রাতে কারো বাড়িতে আসা ভয়ানক অপরাধ। সে শ্রাগ করে বলল,” আমি ঝড়-বৃষ্টির রাতে আসিনি। আমি যখন আসব বলে ঠিক করেছি তখনি ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ এটা কি আমার দোষ? ”
অবন্তী অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল,” তারা যে বাড়িতে নেই এটা কি তুমি জানতে না?”
” আরে আমি জানব কি করে? জানলে কি এখানে আসতাম? আমাকে কি বোকা মনে হয়?”
” তোমরা বাংলাদেশে কবে এসেছো?”
” গতকাল রাতের ফ্লাইটে এসেছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল সকালের ফ্লাইটেই আবার চলে যাবো।”
অবন্তী বিস্মিত গলায় বলল,” মাত্র একদিনের জন্য তোমরা বাংলাদেশে এসেছো?”
” সবাই আসেনি। শুধু আমি একা।”
” তুমি একা একা চলে আসলে? আর এসেছোই যখন এতো দ্রুত চলে যাচ্ছো কেন?” অবন্তীর বিস্ময় যেন কাটছে না।
নিশান্ত শান্ত গলায় বলল,” যে কাজের জন্য এসেছিলাম সেই কাজ শেষ। তাহলে থেকে কি করব? ”
অবন্তী আর কোনো প্রশ্ন করল না। চুপচাপ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। নিশান্ত হঠাৎ বলল,” দরজাটা লাগাও। যে-কোনো সময় কেউ ঢুকে পড়তে পারে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে কিন্তু ডাকাতের উপদ্রব বেশি হয়।”
অবন্তী ভয়ে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল। নিশান্ত তার ভয় পাওয়া দেশে হেসে ফেলল। অবন্তীর এখন ভয়ের পাশাপাশি অস্বস্তিও লাগছে। সবাই কখন আসবে? ইশ, মা যদি কোনোভাবে জানতে পারে নিশান্ত এখানে এসেছে তাহলে খুবই রাগ করবে।
” কেউ বাড়িতে এলে তাকে চা-কফি অফার করতে হয়। অথচ তুমি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছো যেন মস্তবড় কোনো বিপদে পড়ে গেছো৷ আমি এসে কি তোমাকে খুব ঝামেলায় ফেলে দিলাম? ”
অবন্তী জবাব দিল না। সে তো আসলেই ঝামেলায় পড়ে গেছে। নিশান্ত যেন তার মনের কথা বুঝতে পারল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”
অবন্তী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললক্স” সত্যি চলে যাবে?”
নিশান্ত গম্ভীরমুখে বলল,” কি আর করব? তোমার তো মনে হয় আমার এখানে বসে থাকাটাই ভালো লাগছে না। তার চেয়ে ভালো নিচে গিয়ে অপেক্ষা করি। মামা-মামী এলে তাদের সঙ্গেই উপরে আসব।”
” ওমা, এটা আবার কেমন কথা?” অবন্তী যেন একটু লজ্জাই পেল এবার। মাথা নিচু করে বলল,” আচ্ছা থাক বসো। আমি তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসছি৷ তুমি কি খাবে? চা না কফি?”
নিশান্ত সাথে সাথে আরাম করে সোফায় বসে বলল,” কফি অবশ্যই।” তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আনন্দিত বোধ করছে। আমুদে ভঙ্গিতে পা নাড়াচ্ছে। এদিকে অবন্তীর অবস্থা ভয়ে কাহিল। আচ্ছা, রিমা আন্টি যদি এখন এখানে চলে আসে তাহলে কি হবে? প্রত্যেকবারের মতো এবারও কি তিনি অবন্তীর দোষ খুঁজে বের করতে চাইবেন? অবন্তীর মনে হচ্ছে কঠিন একজোড়া দৃষ্টি তাকে দূর থেকে শাসাচ্ছে। ‘ আমার ছেলের থেকে দূরে থাকো মেয়ে।’ সেই দৃষ্টি নিঃসন্দেহে রিমা আন্টির। অবন্তী মোমবাতি হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। চা-কফি বানানোর অভ্যাস তার নেই। তাদের বাড়িতে কেউই চা-কফি খায় না। তবে এই কয়েকদিনে হেলেনকে দেখে সে একটু-আধটু কফি বানানো শিখেছে। অন্ধকারে সেটাই চেষ্টা করতে লাগল। ঠিক সেই সময়ই ষোলকলা পূর্ণ করতে আকাশে একটা বিকট বজ্রপাত হলো আর ফট করে মোমবাতিটা নিভে গেল।
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~১১
লিখা- Sidratul Muntaz
অবন্তী ভয়ে জড়োসড়ো। চোখমুখ কুচকে দুই হাত দিয়ে কান চেপে রেখেছে। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। নিশান্ত নিচু গলায় ডাকল,” অবন্তী।”
অবন্তী চমকে উঠল। নিশান্ত দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজায়। অন্ধকারে শুধু তার অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অবন্তীর গা শিউরে উঠল। তার মনে হচ্ছে দরজার কাছে লম্বা কোনো অশরীরী দাঁড়িয়ে। নিশান্ত পকেট থেকে ফোন বের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল। সহজ করে হেসে বলল,” বজ্রপাতের শব্দ শুনে মনে হলো তুমি ভয় পেয়েছো। তাই দেখতে এসেছিলাম৷ মনে হচ্ছে সত্যিই অনেক ভয় পেয়েছো।”
নিশান্তর হাসি দেখেও অবন্তীর গা ছমছম করতে লাগল। হাসলে তাকে ভয়ানক সুন্দর দেখায়। অবন্তী বলল,” আমি ভয় পাইনি। কিন্তু চমকে উঠেছিলাম।”
এই কথা বলে চুলার আগুনে আবার মোমবাতিটা জ্বালল সে। তারপর কফি প্রস্তুত করতে করতে বলল,” তোমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। ভেতরে গিয়ে বসো।”
নিশান্ত ভেতরে গেল না। বরং আরও কাছে এগিয়ে এলো। অবন্তীর হাত-পা কাঁপছে। নিশ্বাসে অস্বাভাবিকতা। সে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাল।
” কি ব্যাপার?”
নিশান্ত দুইহাতে মোমবাতি আগলে ধরে বলল,” বাতাসে এটা যে-কোনো সময় নিভে যেতে পারে। তখন তো তুমি আবার ভয় পাবে। তার চেয়ে ভালো আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি কাজ করো।”
অবন্তী মনে মনে বলল,” আমার ভয়ের একমাত্র কারণ তুমি। তুমি এখান থেকে চলে গেলেই আমার সব ভয় কেটে যাবে।”
কফি বানানো শেষ করে দু’জনে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসল। তখনি চারদিক ঝলমল করে আলো জ্বলে উঠল। কারেন্ট চলে এসেছে। অবন্তী অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো। নিশান্ত কফির কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলল,” শুধু এক কাপ কেন?”
” আমি কফি খাই না। কফি খেলে আমার ঘুম হয় না।”
নিশান্ত নিশ্চুপ হয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। অবন্তী উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইল,” কফি কেমন হয়েছে?”
নিশান্ত বলল,” অনেক ভালো। দারুণ।”
অবন্তী বোকার মতো সেটা বিশ্বাস করে খুশি হলো। কিন্তু সত্যি বলতে কফি একদমই ভালো হয়নি। মনে হচ্ছে যেন চিনির শরবত। মুখে নেওয়ার সাথে সাথেই ,’ ওয়াক থু’ বলে ফেলে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু নিশান্ত ফেলতে পারছে না। সে জোর করে গিলছে। কিভাবে গিলছে তা সে নিজেও জানে না। অনেক কষ্ট করে কফি খাওয়া শেষ করল। অবন্তী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি বরং খালামণিকে একটা ফোন করে আসি।”
” আচ্ছা করো।”
তাদের ওখানে মনে হয় নেটওয়ার্ক প্রবলেম। সব কথা অস্পষ্ট, ভাসা-ভাসা শোনাচ্ছে। এর মাঝে অবন্তী যা শুনল তার সারমর্ম এই- হেলেনরা আজরাতে আসবে না। ঝড়-বৃষ্টির কারণে তাদের সেখানেই থেকে যেতে হবে। তারা যে অঞ্চলে আছে সেখানে প্রবল ঝড়।
হেলেন ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,” একা থাকতে তোর কি কোনো অসুবিধা আছে? ভয় পাবি না তো?”
অবন্তী বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলল,” খালামণি, ঘরে নিশান্ত এসেছে। সে তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছে! আমি তাকে কি বলব?”
” কি বলছিস? তোর কথা বুঝতে পারছি না।”
” বাসায় নিশান্ত এসেছে।”
হেলেন ভীষণ অবাক হলো,” নিশান্ত এসেছে মানে? সে এইসময় কেন আসবে?”
” আমি জানি না।”
” কখন এসেছে?”
“এসেছে সন্ধ্যাবেলা। আমি তো তোমরা আসবে বলে তাকে বসিয়ে রেখেছি। আবার কাল সকালে নাকি তার ফ্লাইট।”
“কি আশ্চর্য কথা! সে তো কখনও এভাবে না বলে-কয়ে আসে না। আমরা যে শুক্রবারে বাড়িতে থাকি না এটাও তো তার জানার কথা। আচ্ছা, দাঁড়া আমি আবার একটু পরে ফোন করছি।”
হেলেন ফোন কেটে দিল। অবন্তী ড্রয়িংরুমে এসে দেখল নিশান্ত তার জ্যাকেট গায়ে দিচ্ছে। চলে যাওয়ার প্রস্তুতি। অবন্তী সবিস্ময়ে বলল,” চলে যাচ্ছো নাকি?”
” হ্যাঁ। তোমাকে আর ঝামেলায় ফেলব না। এমনিতেও যথেষ্ট বিরক্ত করেছি।”
” এভাবে বলছো কেন? এটা তোমার মামাবাড়ি। তুমি চাইলে যতক্ষণ খুশি থাকতে পারো। তাছাড়া খালামণির সাথে কথা হয়েছে। তারা বলছিল আজরাতে আসতে পারবে না।”
” বলো কি? তুমি সারারাত একা থাকবে নাকি?”
” থাকতে হবে। কিন্তু তোমার কথা বলার পর খালামণি বলেছে একটু পর আবার ফোন করবে। মনে হয় সিদ্ধান্ত বদলাবে। হয়তো আজরাতেই চলে আসবে। তুমি না হয় আরও কিছুক্ষণ বসো।”
নিশান্ত চোখ বড় করে বলল,” আমি যে এখানে আছি এটা তুমি বলে দিয়েছো?”
অবন্তী চমকে উঠে বলল,” তো বলব না?”
নিশান্তর ফোন বাজছে। সে মোবাইল তুলে নিতে নিতে হাস্যমুখে বলল,” বলতে না বলতেই হেলেন মামীর ফোন চলে এসেছে।”
” হ্যালো মামী।”
” তুমি আমাদের বাড়িতে কি করছো নিশান্ত?”
” তেমন কিছু না… অবন্তীর সাথে আড্ডা মারছিলাম। সে আমাকে কফি খাওয়ালো। কিন্তু আমি তোমার হাতের বানানো কফি মিস করছি।”
” তুমি যে আসবে সেটা আগে থেকে জানালে না কেন?”
” আমি নিজেই জানতাম না। হঠাৎ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। ড্রাইভ করতে করতে চলে এসেছি।”
” কি আশ্চর্য ব্যাপার বলোতো! আমরা এখানে এমনভাবে আটকা পড়েছি যে ফেরার উপায় নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো বাবা। অবন্তী বেচারী একা আছে। ওকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। রাতটা ও ঈশিতার সঙ্গে থাকল। আমরা সকালে এসে ওকে নিয়ে যাবো।
নিশান্ত হাসছে। অবন্তী তাদের কথা-বার্তার বিষয়-বস্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বোকার মতো তাকিয়ে আছে। একটু পর নিশান্ত ফোন রাখতেই অবন্তী প্রশ্ন করল,” খালামণি কি বলেছে?”
” তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে বলেছে।”
” হোয়াট?” অবন্তী হকচকিয়ে গেল। নিশান্ত হেসে উঠে বলল,” মানে তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে বলেছে।”
” ও। তোমাদের বাড়িতে?”
” হুম। তারা সকালে এসে তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে যাবে।”
এই সিদ্ধান্তে অবন্তী খুশিই হলো। পুরো বাড়িতে একা থাকতে এমনিও ভালো লাগবে না তার। তাছাড়া রাতে যদি আবার লোডশেডিং হয়! অবন্তী বলল,” আমি কি আমার ব্যাগ নিয়ে যাবো?”
” তোমার ইচ্ছা।”
” আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা থাক, এভাবেই যাই৷ একটা রাতেরই তো ব্যাপার।”
নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” হুম। মাত্র একটা রাত।”
তারা ঘর তালা মেরে বের হতে হতে হেলেন আরেকবার ফোন করল,” অবন্তী।”
” হ্যাঁ বলো খালামণি।”
” নিশান্তর সঙ্গে তুই আমার শ্বশুরবাড়ি চলে যা বুঝলি? সেখানে সবাই আছে, তোর অসুবিধা হবে না।”
” আচ্ছা।”
” বের হওয়ার সময় দরজা ভালো করে লক করিস। লাইট, ফ্যান, টিভির সুইচ বন্ধ করতে ভুলবি না। আর গ্যাসের চুলা খোলা নাকি চেক করে নিস। নাহলে কিন্তু সর্বনাশ।”
” তুমি এতো চিন্তা কোরো না খালামণি। সব দেখে নিয়েছি। ”
” আচ্ছা। আমরা সকালে এসে তোকে নিয়ে যাব। সাবধানে থাকিস।”
” ওকে।”
নিশান্ত যে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে সেটা তার বাবার পুরনো গাড়ি। বাংলাদেশে এলে তারা এই গাড়ি ব্যবহার করে। অন্যান্য সময় গাড়িটা গ্যারেজে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে জরুরী প্রয়োজনে দুয়েকবার বের হয়।গাড়িতে উঠেই জানালা খুলে দিল অবন্তী। বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। শরীর অর্ধেক ভিজে যাচ্ছে। নিশান্ত ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” এটা কেমন পাগলামি? জানালা বন্ধ করো অবন্তী।”
” উহুঁ। আমার খুব ভালো লাগছে।”
অবন্তী জানালার বাইরে মুখ দিয়ে স্নিগ্ধ বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিল। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। হালকা ফোঁটা এলোমেলোভাবে মুখে এসে লাগছে। কি সুখ! অবন্তীর নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। যদি তার পাশে নিশান্তর জায়গায় অন্যকেউ থাকতো তাহলে কি জীবনে পেতো এই সুখ?
আচমকা গাড়ি থেমে গেল। অবন্তী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,” গাড়ি থামালে কেন?”
নিশান্ত রেগে বলল,” আমি কি ইচ্ছে করে থামিয়েছি? হঠাৎ থেমে গেল।”
” বলো কি? গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে?”
” হতে পারে।”
” তাহলে এখন আমরা কি করব?”
” বৃষ্টিতে ভিজব।”
” এর মানে?” অবন্তীর চোখ থেকে বিস্ময় ঠিকরে বের হচ্ছে। নিশান্ত ঠান্ডা গলায় বলল,” গাড়ি গ্যারেজে নিতে হবে। গ্যারেজ কোথায় আছে জানি না। খোঁজ নেওয়ার জন্য গাড়ি থেকে বের হতে হবে। বাইরে বৃষ্টি। গাড়ি থেকে বের হলে বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে।”
অবন্তীর মুখ চুপসে গেল। এইটা কেমন বিপদ!
” যদি গ্যারেজ না পাই তখন কি হবে?”
নিশান্ত অকপটে বলল,” কি আর হবে? গাড়িতে রাত কাটাতে হবে!”
” আল্লাহ!” অবন্তী বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। নিশান্ত বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন?”
” ভয় পাওয়ার মতো ব্যাপার, আমি ভয় পাবো না?”
” এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি।”
” তাহলে কি আনন্দিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেছে?”
অবন্তীকে সামান্য বিরক্ত দেখালো। নিশান্ত চট করে বলল,” হ্যাঁ। খুব আনন্দের বিষয়। আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি নাচ দেখতে চাও? দেখতে চাইলে বলো। এখনি দেখাব।”
অবন্তী রাগান্বিত গলায় বলল,” ঠাট্টা কেন করছো নিশান্ত? এই ঝামেলা থেকে কিভাবে নিস্তার পাবো সেটা বলো।”
” আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমার আসলেই আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
নিশান্ত ফট করে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। অবন্তী বিস্ময় নিয়ে তার কান্ড দেখছে। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় সে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। তারপর হঠাৎ অবন্তীর জানালার কাছে এসে কাঁচে টোকা মারল। অবন্তী ভ্রু কুঁচকে বলল,” কি?”
” গাড়ি থেকে নামো।” নিশান্তর কণ্ঠে আবদার। অবন্তী ঝাঁজালো স্বরে বলল,” আমি কেন নামব?”
নিশান্ত ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল,” এতোক্ষণ তো জানালা খুলে একেবারে মাথা বের করে ভেজার চেষ্টা করছিলে। এখন সত্যি সত্যি ভেজার সুযোগ এসেছে তো বের হচ্ছো না কেন?”
” তুমি অদ্ভুত মানুষ। এইরকম বিপদের সময় আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজব? আমি কি পাগল?”
নিশান্ত হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” তোমাকে দেখলে আমার অবাক লাগে।”
” অবাক লাগার কি আছে?”
” একটা পাগল হঠাৎ করে সুস্থ হয়ে গেলে তার চারপাশের মানুষ কি তাকে দেখে অবাক হবে না?”
” হুম। হবে।”
” সেজন্য আমিও অবাক হচ্ছি।”
নিশান্ত এই কথা বলে জানালা থেকে সরে গেল। অবন্তী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই গলা উঁচিয়ে বলল,” এই, তার মানে তুমি বলতে চাও আমি আগে পাগল ছিলাম আর এখন সুস্থ হয়ে গেছি?”
নিশান্ত কোনো জবাব দিল না। গম্ভীরমুখে গাড়িতে এসে বসল। অবন্তীকে অবাক করে দিয়ে সে গাড়ি চালাতে শুরু করল। অবন্তীর রাগ পরিণত হলো বিস্ময়ে। আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,” গাড়ি তাহলে নষ্ট হয়নি?”
নিশান্ত এবারও কোনো উত্তর দিল না। অবন্তীর বড় বড় চোখ দেখতে ভালো লাগছে। সে আঁড়চোখে বার-বার অবন্তীর দিকে তাকাচ্ছে। তার হঠাৎ ইচ্ছে করল গাড়িটা থামিয়ে আচমকা অবন্তীর হাত টেনে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলতে,” শোনো অবন্তী, এইযে এখন যেমন আমার পাশে বসে আছো, আমি সবসময় এভাবেই তোমাকে আমার পাশে দেখতে চাই। তুমি কখনও আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না।”
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও নিশান্ত এই কাজ করতে পারবে না। সে যে শুধু অবন্তীকে দেখার জন্য এই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় ধানমন্ডি এসেছিল সেটাও সে বলতে পারেনি। অবন্তী হেলেনদের বাড়িতেই আছে এটা নিশান্ত জানতো। অথচ অবন্তীকে দেখার পর সে এমন একটা ভাব করল যেন খুব বিস্মিত হয়েছে। তিনবছর ধরে অবন্তীর সঙ্গে তার সেভাবে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। কিন্তু এই তিনবছরে নানা বাহানায় সে অসংখ্যবার বাংলাদেশে এসেছে। অবন্তীর স্কুল, কোচিং-এ ঢু মেরেছে। দূর থেকে অবন্তীকে দেখেই চলে এসেছে৷ একবারও তার সামনে যায়নি। ইশ, অবন্তী এতো বোকা কেন? তার জায়গায় অন্যকেউ হলে নিশান্ত কবেই ধরা খেয়ে যেতো! অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে। মাঝে মাঝে বোকা হওয়াও মঙ্গলজনক। ভাগ্যিস অবন্তী বোকা। সে বুদ্ধিমতী হলে দারুণ বিপদ ছিল।