অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৯

0
199

#অন্তহীন_বসন্ত~৯
লিখা- Sidratul Muntaz

তখন অবন্তীর জেএসসি’র মডেল টেস্ট চলছে। রাত জেগে পড়াশুনা করে সকালে স্কুলে যায়। টেবিল জুড়ে বইয়ের স্তুপ। বিলকিস টেবিল গুছাতে গিয়ে একটা গোলাপী ডায়েরী খুঁজে পেল। কিছুদিন আগে ডায়েরীটি অবন্তী বান্ধবীর কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার পেয়েছিল। আজ-কাল সে এই ডায়েরীতে নিজের অনেক গোপন কথা লেখে। মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। সেদিনও কি যেন লিখছিল সে। বিলকিস ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরী লুকিয়ে ফেলল। ব্যাপারটা খেয়াল করেও বিলকিস কিছু বলেনি। আজ সে কৌতুহলবশত ডায়েরীটা খুলল। বাহ, অবন্তীর হাতের লেখার বেশ উন্নতি হয়েছে। নাকি ব্যক্তিগত ডায়েরী বলেই লাল-নীল কালি দিয়ে যত্ন করে লেখে? কিছু লেখা পড়ে বিলকিসের হাসি পেল। কিন্তু যত সে গভীরে যেতে লাগল ততই তার চেহারা গম্ভীর হতে শুরু করল। একসময় ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে গেল তার চেহারা। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। গায়ের র/ক্তচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে ফার্মেসীতে গিয়ে প্রেশার মেপে এলো।

অবন্তী স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরে ভাত খেতে বসল। খুব আগ্রহ নিয়ে মজার একটা গল্প শুরু করল।

” জানো মা, আজকে স্কুলে একটা মেয়ে আমার থেকে দেখে লিখতে নিয়ে ধরা খেয়েছে। আমার ল্যুজশিট ছিল তার কাছে। গার্ডের স্যার হঠাৎ বললেন, এটা কার খাতা? তুমি কি দেখে লিখছো? আমি তো খুব থতমত খেলাম। কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা…”

অবন্তীর কথা কিছুই বিলকিসের মাথায় ঢুকছে না। সে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছে। অবন্তী মায়ের এই অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে বলল,” মা, তোমার কি হয়েছে? আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো?”

বিলকিস চিন্তার ঘোর কাটিয়ে জবাব দিল,” হ্যাঁ। দ্রুত খাওয়া শেষ কর। তোর সাথে আমার কয়টা জরুরী কথা আছে।”

” কি জরুরী কথা? এখনি বলো!”

বিলকিস শীতল গলায় বলল,” এখন না। খাওয়া শেষ করে তুই আমার ঘরে আসবি।”

অবন্তী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। মা কি এমন বলতে চায় যেটা এখন বলা যাবে না? আয়োজন করে ঘরে ডাকতে হবে? অবন্তীর শরীর খুব ক্লান্ত। খাওয়া শেষ করে একটা দারুণ ঘুম দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে। অবন্তী মায়ের ঘরে ঢুকল। বিলকিস আলমারী থেকে পুরনো এলবাম বের করেছে। চেহারা অত্যন্ত মলিন। যেন সে খুব দুঃখের সংবাদ শোনাতে যাচ্ছে। একটা ছবি বের করে অবন্তীর দিকে বাড়িয়ে বলল,” দ্যাখ, একে চিনতে পারছিস?”

অবন্তী ছবিটি হাতে নিয়ে দেখল, একজন যুবক। বেশ সুদর্শন। হাসি-খুশি চেহারা। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” এটা মুরাদ আঙ্কেল না?”

বিলকিস একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,” হুম৷”

” হঠাৎ উনার ছবি দেখাচ্ছো কেন? কি হয়েছে উনার? মারা-টারা গেছে নাকি?”

বিলকিস আলতো হেসে বলল,” মারা যাবে কেন? বউ-সংসার নিয়ে সুখেই আছে হয়তো। এটা যদি রূপকথার গল্প হতো তাহলে আজকে তার বউয়ের জায়গায় আমি থাকতাম তার পাশে। প্রফেসর স্বামীকে নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতাম৷ কিন্তু আমার কপালে তোর বাবাই ছিল। তাই আজ আমি এখানে। সারাদিন চাকরানির মতো খেঁটে মরছি। জীবন নিয়ে আমার অভিযোগ নেই। কিন্তু বিয়ের আগে আমি যত স্বপ্ন দেখতাম, তার কিছুই পূরণ হয়নি। সাধ্যের বাইরে গিয়ে কখনও স্বপ্ন দেখা উচিৎ না অবন্তী। দিবাস্বপ্ন শুধু আফসোস বাড়ায় কখনও শান্তি দেয় না।”

অবন্তী ছবিটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। এতো ভারী কথা নিশ্চয়ই তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। বিলকিস বলল,” তোকে এসব বলার একটাই কারণ৷ তুই আমার মতো ভুল করিস না মা।”

অবন্তী কেঁপে উঠল সামান্য। বিলকিস খুব কঠোর ভঙ্গিতে বলল,” জীবনটা কোনো রূপকথার গল্প না। আর তুইও সিনড্রেলা না। বিয়ে নিয়ে সব মেয়েদেরই স্বপ্ন থাকে। কিন্তু তুই যে স্বপ্ন দেখছিস সেটা অসম্ভব।”

অবন্তী অস্বস্তিভরা কণ্ঠে বলল,” মা, আমার ঘুম পাচ্ছে।”

বিলকিস কাঁদছিল। অবন্তীর কথা শুনে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” আচ্ছা যা ঘুমা। কিন্তু আমি যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো মনে রাখিস সবসময়। নয়তো একদিন অনেক আফসোস করতে হবে।”

অবন্তী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বিলকিস ছবিগুলো গুছিয়ে রেখে আলমারি তালাবদ্ধ করল। তার নিজেরও অশান্তি লাগছে। এই সর্বনাশের ইঙ্গিত সে আরও আগেই টের পেয়েছিল। কিন্তু তখন বোঝেনি ব্যাপারটা এতো গাঢ় আকার ধারণ করবে। ভালোই হয়েছে যে নিশান্তরা কানাডা চলে গেছে। তারা বাংলাদেশে এলে বিলকিস আর অবন্তীকে নিয়ে ওই বাড়িতে যাবে না। যত তাদের দূরত্বে রাখা যায় ততই ভালো। তারা দু’জন এখনও খুব ছোট। তাই চাইলেই এই সমস্যার সমাধান সহজভাবে করা যায়। তাছাড়া ব্যাপারটা একপাক্ষিক বলেই মনে হয় বিলকিসের। নিশান্তের মতো ছেলে নিশ্চয়ই অবন্তীকে নিয়ে কিছু ভাববে না৷ তাও সাবধানে থাকা উচিৎ। সারাদিন এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিলকিসের মাথা ধরে গেছে। সে এক কাপ চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে এসেই চমকে উঠল।

অবন্তী দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরে। সে তার ডায়েরীর কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে৷ তার চোখে পানি। সে একহাতে চোখ মুছছে। বিলকিস অসহনীয় একটা যন্ত্রণা অনুভব করল বুকের ভেতর। দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইল কষ্টে৷ কিন্তু কিছুই করার নেই৷ গরীবের ঘরে জন্ম নিলে এটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকতেই হয়।

চলবে