#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৭
আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম গর্জন। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। এ মুহূর্তেই বৃষ্টি নামবে যেন। তাহা বাজারে গিয়েছিল কোনো এক প্রয়োজনে। ফেরার পথেই এমন অবস্থা। গুড়গুড় করে বৃষ্টি নেমেও গেল। এখন বেশ জোরে জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। তাহা’র কাছে কোনো ছাতাও নেই। এই অবস্থায় সে বাড়ি ফিরতে পারবে না। তাই এখন কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়াকেই শ্রেয় ভাবছে তাহা। সাইকেলটা নিয়েই একটা চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে জামা-কাপড় থেকে অবশিষ্ট পানি ঝেড়ে ফেলে দেয়। দোকানে তাহা ছাড়াও আরো দু’জন মানুষ আছে। একজন দোকানদার, তিনি সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ। ফোকলা দাঁত দিয়ে তিনি তাহা’র দিকে তাকিয়ে হাসছেন। তাহা পাশে তাকিয়ে দেখে আহিরও তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে এখানকার তৃতীয় ব্যাক্তিটা হল আহির। তাহা আহিরকে কিছু না বলে দোকানের সামনের বেঞ্চটার এককোণে বসে পড়ে। আহির অন্যপাশে বসে ছিল। আহির কিছুক্ষণ তাহা’র দিকে তাকিয়ে থেকে উশখুশ করে বলে,
“চা খাবে তাহানিয়া?”
তাহা আড়চোখে একবার আহিরকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“খাওয়া যায়।”
আহির মুচকি হেসে দোকানদারকে দু’কাপ চা দিতে বলে।
“তাহানিয়া!”
তাহা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় আহিরের দিকে।
“একটা প্রশ্ন করি? উত্তর পাবো?”
“করুন আগে।”
আহির বাহিরে একবার তাকায়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। থামাথামির নাম নেই। কখন থামবে তাও বলা যায় না।
“কালকের ঘটনাটা নিয়ে বলতে চাইছিলাম। জানো আবিদ খুব ভেঙে পড়েছে। সাথীকে সে খুব ভালোবাসতো। ছেলেটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা, আমি জানতে চাইছিলাম। কালকে ওই সময় আদনান নামের ছেলেটা কিভাবে আসলো? আমার মনে হয় না সাথী বলেছে আসতে। তাহলে সে কিভাবে ওই সময়ই আসল?”
তাহা চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে বলে,
“সবটা যেহেতু আমিই করেছি। তখন এটুকু আমি বাদ রাখবো কেন?”
আহির নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“আচ্ছা তুমি এখন কোথা থেকে আসলে?”
“বাজারে গিয়েছিলাম। আসতে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল?”
“কলেজে কি যাও নিয়মিত? টেস্ট পরীক্ষা কবে?”
তাহা এবার চায়ের কাপটা বেঞ্চে রেখে দেয়। আহিরের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“এইতো আর কিছুদিন পর। কলেজে যাওয়া হয় নিয়মিত। আপনার খবর কি? চাকরি বাকরির কি খবর?”
“অনেকগুলো পরীক্ষাই দিয়েছি। রেজাল্ট বের হয়নি এখনো।”
তাহা ছোট্ট করে ওহ বলে চুপ করে থাকে। আহির একবার তাহা’র দিকে তাকায় একবার অন্যদিকে তাকায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কিছু বলবে। কিন্তু কোনো একটা কারণে বলতে পারছে না। তাহা বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“কিছু কি বলবেন?”
আহির এবার তাহা’র দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। কিছু বলতে যেয়েও আবার থেমে যায়। কোনো এক জড়তার জন্য কথাটা বলতে পারছে না। আহিরের আমতাআমতা করা দেখে তাহা অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে। আহির কবে থেকে এমন করা শুরু করলো? সবসময় স্ট্রেইট কথা বলা মানুষটা আজ আমতাআমতা করছে। বিষয়টা তাহা’র কাছে কেমন যেন আজব লাগলো।
“বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি এবার উঠি।”
তাহা উঠে যেতে নিলে আহির বলে ওঠে।
“তাহানিয়া তোমাকে কিছু বলার ছিল।”
তাহা আবারও নিজের জায়গায় বসে পড়ে। মাথা নাড়িয়ে আহিরের দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে ইশারা করে কথাটা বলতে। আহির এবার বলতে গিয়ে আবারও আমতাআমতা করা শুরু করে দেয়। আহির এবার মাথাচুলকে বলে,
“তেমন কিছু না। তুমি যাও।”
তাহা বিষয়টাকে আর ঘাঁটালো না। কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত কৌতূহল নেই তার। কথাটা যদি বিপরীতে থাকা মানুষের বলার মত হতো তাহলে সে বলতোই। যেহেতু বলতে পারবে না। তাই আর সে ঘাটায় না। তাহা মুচকি হেসে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়। আহির নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাহা’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল সে তাহা’কে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধার জন্য বলতে পারলো না। আচ্ছা তাহা’কে এসব বললে তাহা কেমন রিয়েক্ট করবে?
____________
তাহা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে। ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে দেখে আফসানা বেগম আর সাথী বসে আছে। সাথীকে উঠতে বসতে তাহা কিছু না কিছু বলবেই। আফসানা বেগমের দিকে একবার তাকায় তাহা। সাথীর সাথে সাথে উনিও কান্না করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। ইব্রাহীম খলিল বলে দিয়েছেন সাথী যেন এ বাড়িতে না থাকে। এককথার মানুষ উনি। তাহা এবার ওনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আপনার মেয়ে এখনো আমাদের বাড়িতে কি করছে? ওকেতো ওর পাতানো বাবা বাড়ি ছাড়তে বলেছে।”
তাহা নির্লিপ্তভাবে কথাটা বলে আফসানা বেগমের দিকে তাকায়। আফসানা বেগম সাথীর পাশে বসে আছেন। সাথী ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করছে। ইব্রাহীম খলিল আরো একবার এসে বলে গেছেন যেন সাথী এ বাড়ি থেকে বিদায় নেয়। সাথী ওনার পায়ে অব্দি পড়েছে। সে তার বাবার কাছে যেতে চায় না। ওই লোকটা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। তার জীবনটা এতদিন কেমন ছিল ওখানে গেলে কেমন হয়ে যাবে? এমন লাক্সারিয়াস জীবন রেখে কেই বা ওই মদখোরের কাছে যেতে চাইবে?
“তুই কাজটা একদম ঠিক করিস নি তাহা।”
সাথীর কথা শুনে তাহা মশা তাড়ানোর মত হাতটাকে ডানেবামে নাড়ায়। সাথী আর আফসানা বেগমের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“কার কাজটা ঠিক আর কার কাজটা ভুল এটা সবাই-ই জানে। তাই তোর এসব ফাও কথা বাদ দে। আমি তোকে আর তোর মাকে যতবার দেখি ততবারই অবাক হচ্ছি। তোদের মধ্যে কোনো লজ্জাশরমের বালাই-ই নেই। এতকিছুর পরেও এ বাড়িতে পড়ে আছিস। তোদের আর বিড়ালের মাঝে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।”
তাহা’র কথায় সাথী রাগে ফুসলেও আফসানা বেগম মাথা নিচু করেন রাখেন। কিছুই বলার নেই ওনার। তার মেয়ের কাণ্ডে এখন আর কিছু বলারই মুখ নেই তার।
______________
তাহা আহিরদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে। এখানে আফিয়া, আহিরের মা, আরহামের মা, আরহাম এবং আহিরও আছে। ড্রয়িংরুমের এককোণে একটা অচেনা মেয়েও বসে আছে। তাহা সোফার এককোণে বসে রয়েছে। তাহা বসে বসে সবাইকে অবলোকন করছে। এখানে এসে শুনতে পেল, শহর থেকে কোনো এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এসেছে আরহাম। তাহা ফাতেমা বেগমের কাছে এসেছিল। এসেই দেখে এই ঘটনা। তাহা এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা বেশ সুন্দরী। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। লম্বাও বেশ। তবে খুব রোগা। নাকটা সরু নয় কিছুটা বোঁচা। তবে এসব ছাপিয়ে মেয়েটাকে দেখতে বেশ লাগছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তাহা একবার নিজের দিকে তাকায়। মেয়েটার সামনে নিজেকে অনেকটা বেমানান লাগছে। তাহা একটা কথা ভেবে বেশ অবাক হচ্ছে। এতদিন আরহাম তার পিছনে পড়ে ছিল। তাহা’র কাছে পাত্তা পায়নি বলে এখন শহর থেকে মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। এটা নিয়ে এখন খুব ক্ষেপে আছেন আরহামের মা। আরহামের বড় ভাই-ই এখনও বিয়ে করেনি। সেখানে আরহাম এমনটা করেছে। সে বলছে তৃষা নামের এই মেয়েটাকেই সে বিয়ে করবে। আরহামের মা মার্জিয়া বেগম বারবার সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। কখন আরহামের বাবা এবং আহিরের বাবা বাড়ি আসবেন। এখন ওনারা এসে এসবের সমাধান করবেন। তাহা জানে আরহাম কত মেয়ের সাথে সম্পর্কে ছিল। শেষ পর্যন্ত একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েই চলে আসলো। এগুলো মনে মনে ভেবে তাহা বিড়বিড়িয়ে বলে, “শালা চরিত্রহীন!”
“তাহা আমার সাথে একটু আমার রুমে আসবি?”
আফিয়া তাহা’কে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলে। তাহা মাথা নাড়িয়ে আফিয়ার সাথে উঠে দাঁড়ায়। তাহা আফিয়ার রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আহির আসে। আহির তাহা’কে ডাক দিয়ে বলে,
“তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।”
তাহা সাবলিলভাবে বলে,
“হুম বলুন।”
আহির এবার আফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটু বাহিরে যাতো। তাহানিয়ার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।”
আফিয়ার ভ্রুঁ কুঁচকালেও কিছু বললো না। বিনাবাক্যে রুম থেকে চলে যায়।
“আমি তোমায় কিছু বলতে চাই তাহানিয়া।”
তাহা চারদিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“বলুন। কি বলবেন?”
আহির চোখ বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বস ফেলে। তারপর চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই বলে,
“আমি তোমায় ভালোবাসি তাহানিয়া। আমি তোমায় ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। এতদিন বুঝতে পারিনি তোমার জন্য অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো। এতদিন জানতে পারিনি আহিরের সর্বাঙ্গ জুড়ে তাহানিয়ার বসবাস। এখন উপলব্ধি করলাম, আমিও তোমায় ভালোবাসি। তুমি আমার অবেলার ভালোবাসা। আমি অবেলায় ভালোবাসি তোমায়। জানো কখনো ভাবিনি আমি কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসবো। কারণ আমি যেমন মানুষকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইতাম। তেমনটা তুমি নও। কিন্তু কেন যেন তোমার মত এই অগোছালো মেয়েটাকেই আমি ভালোবেসে ফেললাম। আজ দ্বিধা ছাড়াই বলছি তাহা, এই মানুষটা তোমায় ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে।”
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ
#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৮
আহির মনের কথাটুকু শেষ করে চোখ খুলে তাহা’র দিকে তাকায়। তাহা আহিরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে। তাহা’র মুখের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে আহিরের কথার মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছে না। বিষয়টা অবলোকন করে আহির এবার তাহা’কে ডাক দেয়।
“তাহানিয়া!”
আহিরের ডাকে তাহা সম্ভিত ফিরে পায়। দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে আবার আহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে।
“আপনি এসব কি বলছেন? আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। দয়া করে কি আমাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলবেন?”
তাহা’র কথা শুনে আহির মুখে হাত দিয়ে শুকনো কাঁশি দেয়। কত সাহস সঞ্চার করে এই ড্যাঞ্জারাস মেয়েটাকে নিজের মনের কথা বলতে পেরেছিল। এখন এই মেয়ে আবার বুঝিয়ে বলতে বলছে। আহির টি-টেবিলের ওপরে রাখা জগ থেকে ডগডগ করে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। গ্লাসে ঢালার মত অত সময় এখন নেই।
“আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আমি তোমায় জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। আমায় বিয়ে করবে তাহা?”
আহির অন্যদিকে ফিরে তাকায়। বুকে একবার হাত রেখে সাহস সঞ্চার করে বলে কথাগুলো। আহিরের কথা শুনে তাহা’র এবার মুখ হা হয়ে যায়। আগেরবার ভেবেছিল সে হয়তো শুনতে ভুল করেছে তাই আহিরকে বিষয়টা ক্লিয়ার করতে বলেছে কিন্তু আহির এখন এসব কি বলছে? তাকে বিয়ে করতে চায়। এই ছেলের মাথা গেছে নির্ঘাত।
“আরহাম আপনার বয়সে ছোট হয়েও বউ নিয়ে এসেছে তাই বড়ভাই হয়ে ব্যাপারটায় আপনার খুব ইগো হার্ট হয়েছে। তাই না? তাইতো এমন উলটোপালটা বলছেন।”
“তাহা আমি সিরিয়াস। আমি এখানে কোনো উলটাপালটা কিছু বলছি না। আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি। আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই তাহা। আমার আম্মুও তোমায় ছেলের বউ হিসেবে খুব পছন্দ করেন।”
তাহা এদিক সেদিক তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করে। বারকয়েক চোখের পাতা ফেলে। আহিরকে যে এখন কিছু বলবে, তার জন্যে শব্দভাণ্ডারে তেমন কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
“আমি তোমায় সময় দিচ্ছি তাহা। তুমি এসব নিয়ে ভাববার সময় অবশ্যই পাবে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে এসে উত্তরটা আমায় দিতে হবে তাহা। উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আমার চাইতে খুশি কেউ হবে না। তবে উত্তর যদি না হয় তাহলে তার যথাযথ কারণ আমাকে তোমার দেখাতে হবে। এখন যাও তুমি তোমার কাজে। এসব নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। সামনে তোমার পরীক্ষা। পড়াশোনায় ভালোভাবে ফোকাস করো। আর খুব শীঘ্রই আমাকে উত্তরটা দেওয়ার চেষ্টা করো। যাও।”
আহির তাহা’কে কথাগুলো বলে মুচকি হাসে। তাহা আহিরের দিকে একবারও তাকায় না। সোজা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আফিয়াকে দেখে পেছন থেকে চুলগুলো টেনে ধরে। আকস্মিক আক্রমণে আফিয়া মৃদু চিৎকার করে ওঠে। আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাহা’কে দেখে জোরে এক চিৎকার দিয়ে উঠে সে। হঠাৎ করে চিৎকার দেওয়ায় তাহা আফিয়ার মুখ চেপে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“চিল্লাস কেন ছেমড়ি? আর তুই এইখানে কি করিস? লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথা শুনিছিলিস?”
তাহা আফিয়ার মুখটা ছেড়ে দিলে আফিয়া তাহা’র দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
“শুনবো না? ভাই আমার হবু ভাবিকে প্রোপোজ করতেছে। আমাকেতো শুনতেই হবে।”
“এই তোর ভাবি কে?”
“কেন তুই!”
আফিয়ার একরোখা জবাবে তাহা চোখ ছোটছোট করে তাকায় তার দিকে।
“এই একদম আমায় ভাবি বলবি না। তোর ওই পেঁচামুখো ভাইকে আমি বিয়ে করছি না। তোর ভাই বললেই হলো? ওনাকে আমি বিয়ে করবো না। দুনিয়া উলটিয়ে গেলেও না।”
আফিয়া মুখটিপে হেসে বলে,
“তাতো দেখতেই পাবো।”
তাহা বিনিময়ে লজ্জামাখা দৃষ্টি নিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
_______
আহিরের বাড়ির সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আরহাম যেহেতু সবার ছোট। তার বড় দুই ভাই এখনও বিয়ে করেনি। তাই আগে তাদের বিয়ে দিয়ে তারপর আরহামের বিয়ে হবে। মেয়েটাকে বলা হয়েছে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা আরহাম মানতে নারাজ। সে এখনই বিয়ে করবে মানে এখনই করবে। যদি পরিবার থেকে মেনে না নেয়। তাহলে সে মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়বে। আরহামের একরোখা কথায় তার বাবা, জেঠা ক্ষেপে গেলেও পরবর্তীতে পরিবারের মানসম্মানের কথা তারা একটা সিদ্ধান্ত নেন। আরহামের বড় ভাইয়ের নাকি মেয়ে পছন্দ করা আছে। তাই সেই মেয়ের সঙ্গেই তার বিয়ে দেওয়া হবে। সেদিনই আরহামের সাথে মেয়েটার বিয়ে হবে। দুইভাইয়ের একসঙ্গে বিয়ে হবে। অনেক চেঁচামেচির পর আরহাম এই বিষয়টা মেনে নিয়েছে। তার মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে আহিরের বিয়ে নিয়ে। আহির সরাসরি বলে দিয়েছে সে এখন বিয়েশাদীর চক্করে পড়ছে না। বেচারা এখনও চাকরি-ই পেল না। আবার বিয়ে করবে! মোটকথা, তাহানিয়াইতো এখনও কিছু বললো না। আগে মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে রাজি হোক। তারপর বিয়েশাদী নিয়ে ভাবা যাবে।
_________
তাহা আহিরের বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখে ওইদিনের মত আজও তার বাবা ওই গলিটা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। তাই বাবাকে অনুসরণ করে তাহাও আজ পেছন পেছন গলিটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। তাহা এই জায়গাটায় এর আগে কখনও আসেনি। জায়গাটা পরিত্যক্ত তাই জায়গাটায় মানুষের আনাগোনাও নেই। তাহা’র বাবা সামনে হাঁটতে হাঁটতে একটা পুরোনো দালানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দালানটা বেশ পুরোনো। সামনের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে রয়েছে। ইব্রাহীম খলিল সাবধানতার সহিত দালানের মূল দরজায় পা রাখেন। তাহাও খুব সন্তর্পণে বাবার পেছন পেছন গিয়ে দালানের দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি মারে। ভেতরটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই তাহা এবার ভেতরেই প্রবেশ করে। ভেতরে আরো একটা রুম আছে বলে মনে হচ্ছে। সেখানে আংশিক আলো দেখা যাচ্ছে। সেই রুমটাতেই ইব্রাহীম খলিল প্রবেশ করেছেন কিয়ৎক্ষণ আগে। তাহা সে রুমটার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে। সাথে সাথে তার দৃষ্টি সেখানেই স্থির হয়ে যায়। ভেতরে চার পাঁচজন লোক রয়েছে। সবাই রুমটার একপাশে ফ্লোরে বসে জুয়া খেলছে। আর অন্যপাশে চারজন মেয়েকে চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় দেখা গেল। মেয়েগুলো তাহা’র সমবয়সী বা তাহা’র চেয়ে ছোট। মেয়েগুলোকে দেখে তাহা’র মনে প্রশ্ন জাগলো মেয়েগুলো এখানে কেন? আচকমা তাহা’র ছোট মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে উঠলো, মেয়েগুলোকে পাচার করার জন্য এখানে আনা হয়নিতো আবার? বিষয়টা একবার ভেবেই ভয়ে তাহা’র সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। এরমধ্যে ইব্রাহীম খলিল ভেতরে গিয়ে কিছু লোককে জিজ্ঞেস করেন,
“কিরে মেয়েগুলোকে এখনও পাঠাস নি তোরা? বসে বসে এখানে জুয়া খেলা হচ্ছে। কি চাস কি তোরা? আমাকে ফাঁসাতে চাস? তাড়াতাড়ি নিজেদের কাজ কর। যা। মেয়েগুলোকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
ইব্রাহীম খলিলের কথার মধ্যেই একটা মেয়ে কিছু বলতে চাইলো। মুখ বাধাঁ বিধায় কথারা বাহিরে আসতে পারলো না। ইব্রাহীম খলিল বিষয়টা অবলোকন করে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বিশ্রী হাসি দিয়ে বলেন,
“কিছু বলবে তুমি সুন্দরী?”
বাবার মুখে এমন কথা শুনে তাহা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এই মানুষটাকে সে এতদিন ঘৃণা করে এসেছিল। ভেবেছিল লোকটা খারাপ কিন্তু তাহা কখনও এটা ভাবেনি যে লোকটা তাকে জন্ম দিল সে এতটা জঘন্য। বাবা নামক মানুষটা এতটা নিকৃষ্ট এটা তাহা স্বপ্নেও ভাবেনি। তাহা’র এখন নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা লাগছে। চরম আফসোস হচ্ছে মানুষরূপী এমন অমানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছে বলে। ইব্রাহীম খলিল এবার মেয়েটার মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলে মেয়েটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। অনেকক্ষণ ধরে মুখ বেঁধে রাখার ফলে নিঃশ্বাস নিতেও তার কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা খুব কষ্টে বলে ওঠে,
“আপনি আপনার পাপকর্মের শাস্তি পাবেন চেয়ারম্যান সাহেব। আল্লাহ এসব সইবে না। আপনাকে বিনাশ করার জন্য আল্লাহ অবশ্যই কাউকে পাঠাবে। আপ..”
মেয়েটার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইব্রাহীম খলিল মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরেন। যেন মেয়েটার চোয়াল ভেঙেই তিনি শান্ত হবেন। মেয়েটার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলেন,
“আমায় বিনাশ করতে কেউ আসবে না। আর না তোদের বাঁচাতে কেউ এখানে আসবে। এই সবার আগে এই সুন্দরীকে সাপ্লাই করবি। এর তেজ বেশি।”
“আপনি? আপনি এমন খারাপ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত?”
আকস্মিক অন্যকোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহীম খলিলের হাত আলগা হয়ে আসে।
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ