#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_২৩(অন্তিম)
বিষণ্ণ রজনী। সবদিকটায় ঘোলাটে অনুভূতি। চারদিক বিষাক্ত লাগছে তাহা’র কাছে। তাহা’র ছোট মেয়েটা পাশে ঘুমিয়ে আছে। সারাদিন ক্লান্তি নিয়ে এখন ঘুমোতে এসেছে তাহা। আহির বাড়ি নেই অনেকদিন হলো। প্রায় দু’সপ্তাহ হয়ে গেছে। আহিরের অন্য জায়গায় বদলি হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখন তাহা এবং আহিরের বিয়ের ছ’বছর চলছে। তাদের মেয়েটার এখন তিন বছর হতে চললো। মেয়েটা প্রচুর দুষ্টু। সারাদিন জ্বালিয়ে মারে মাকে। কিন্তু বাবার সাথে যে সে কি ভাব! তাহা এখন কেমন যেন বড় হয়ে গেছে। বিয়ের দুই তিন বছরের তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। কিন্তু মেয়েটা জন্ম নেওয়ার পরই তাহা’র মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আস্তে আস্তে পালটে গেছে তাহা। সে যে মা হয়েছে এখন। কথাগুলো ভেবে মৃদু হেসে তাহা। আস্তে করে মেয়ের কপালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বসে। গ্রিলের ওপর মাথা রেখে বাহিরে আনমনা হয়ে তাকায়। অন্ধকার রাস্তায় জনমানবের ছায়াও নেই। তাহা’র হঠাৎ করে মা’য়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনেকদিন হলো মা’য়ের সাথে কথা হয়নি। সেই যে কবে নানুবাড়ি গেল এখনও আসেনি। বলেছে যতদিন নানা-নানু আছে ততদিন সেখানেই থাকবে। সাথীরও বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে। সাথী আর সাথীর মা সাথীর নানুবাড়িতেই থাকে। তাহা’দের বড় বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত হয়ে আছে। কেউ থাকে না এখন আর সেখানে।
“আম্মু! ঘুমাও না তুমি এখনও?”
তাহিয়ার কথা শুনে তাহা গ্রিল থেকে মাথা সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“তুমি জেগে গেছো কেন আম্মু? ঘুমাও তুমি। এসো আম্মুর সাথে ঘুমিয়ে পড়ো।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাহা হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর মোবাইল বের করে সময় দেখে নেয়। এখন রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই।
__________
“এই বাচ্চা! আর একবার কাঁদবি তো ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবো। আমার কানের মাথা খাচ্ছে খালি কান্না করে করে। এই চুপ! একদম চুপ!”
মায়ের ধমক খেয়ে আহিয়া জোরে জোরে কান্না করে দেয়। মেয়ের কান্না শুনে আহির বাথরুম থেকে দৌঁড়ে চলে আসে। পুরো গায়ে সাবান মাখা। বেচারা গোসলটাও ঠিকমত করতে পারলো না বউ বাচ্চার জ্বালায়।
“কি হয়েছে আবার? তুমি ওকে বকছো কেন? তু..”
অনেকটা রেগে গিয়ে প্রশ্ন করে আহির। কন্ঠে তার রাগের আভাস। কিন্তু তাহা’র দিকে একনজর তাকিয়েই তার কথা গলায় আটকে যায়। তাহা অগ্নীদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহিরের দিকে। তাহা এবার বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আহিরের হাতে খাবারের থালাটা তুলে দেয়।
“নিন। এইবার আপনার এই মেয়েকে আপনিই খাওয়ান। খাইয়ে দাইয়ে তারপর আমাকে রাগ দেখাতে আসবেন। তার আগে রাগ দেখাতে আসলে ঠ্যাং ভেঙে গলায় জুলিয়ে রেখে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
বউয়ের এমন ধমক শুনে আহিরের কলিজা ছোট হয়ে গেল। কোন অলক্ষণে যে এই মেয়েকে বিয়ে করতে গেল সে? সেতো জানতো মেয়েটা এমনই। একেবারে গুণ্ডি মেয়ে! কথায় কথায় মেরে হাত পা ভেঙে ফেলার হুমকি দেবে। আগের সব পরিবর্তন হলেও আহিরের সাথে এধরনের ব্যবহারগুলো পরিবর্তন হয়নি। অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে আহির। যে জায়গায় বদলি হয়েছে সেখানে তাহা আর মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে এবার। বাবা-মা নাকি এখন যাবেন না। তারা আরও পরে যাবেন। আহির তাই আর জোর করেনি। পরে না হয় বাবা-মা যাবে। কিন্তু তাহা এতে নারাজ। সে বাবা-মাকে ছাড়া যাবে না। আহিরের অনুরোধ, বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে শেষে রাজি হয়েছে।
“বাবা! কি ভাবছো তুমি? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি তোমাকে?”
বাবার পা ধরে ধরে ডাকে আহিয়া। আহির ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়। তারপর মেয়েকে একটু বসতে বলে ছট করে বাথরুমে গিয়ে গোসলটা সেরে আসে। এসেই মেয়েকে দু’হাতে ধরে কোলে উঠিয়ে নেয়। মেয়ের কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলে,
“আম্মু তুমি খাচ্ছো না কেন? তোমার মাকে কেন জ্বালাচ্ছো? চলো চলো খেতে চলো।”
আহিয়াও বাবার ন্যায় বাবার কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলে,
“না বাবা। আমি খাবো না এখন।”
আহির মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“দুষ্টুমি করে না আম্মু। চলো। তুমি আর আমি একসাথে খাবো। তারপর দু’জন মিলে ঘুরতে যাবো। আহিয়ার আম্মুকে একদম নিবো না। দু’জনে চুপিচুপি চলে যাবো ঘুরতে।”
বাবার কথায় আহিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“না। আম্মুকে নিয়ে যাবো। না হলে আম্মু তোমার চুল ছিঁড়ে দেবে।”
____________
“আচ্ছা! আমি এতটা জ্বালাই আপনাকে তাও আপনি আমার ওপর বিরক্তবোধ করেন না কেন?”
আহির তাহা’র দিকে ফিরে তাকায়। বারান্দায় বসে আছে দু’জনে। তাদের মেয়েটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। সেখানে একবার তাকিয়ে আহির তাহা’র মাথাটা নিজের বক্ষে আবদ্ধ করে বলে,
“আমিতো তোমার এই বাচ্চামোগুলোকেই ভালোবাসি তাহা। তবে মাঝেমধ্যে একটু আধটু তো বিরক্ত হয়েই যাই। মানুষ তো আমরা তাই কখন যে কি করে ফেলি? মেজাজতো সবসময় এক রকম থাকে না। তখন আবার তোমায় বকেও দিই। তাও তো তুমি আমার সাথে রাগ করো না। হ্যাঁ কিছুক্ষণ অভিমান করে থাকো পরে তো আর বেশিক্ষণ থাকতে পারো না।”
তাহা মুচকি হেসে বলে,
“আমিও তো আপনায় ভালোবাসি। তাই!”
কিছুক্ষণ দু’জনে চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ তাহা বলে ওঠে,
“এই আমি এখন চিপস খাবো। আমার জন্য চিপস এনে দিন।”
আহির অবাক হয়ে বলে,
“এসব কি বলছো তাহা? এখন রাত দশটা বাজে। এখন আমি চিপস আনতে যাবো? আচ্ছা তুমি যাও এখন ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে আমি অফিসে রওয়ানা হওয়ার আগেই তোমাকে চিপস এনে দেবো।”
তাহা একরোখাভাবে বলে,
“না। আমি এখনই চিপস খাবো।”
আহির তাও মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে,
“পারবো না এখন। আমি এখন ঘুমোবো। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে এনে দেবো। আর কোনো জেদ নয়। যাও ঘুমাতে যাও।”
তাহা এবার রেগে যায়। রেগেমেগে বলে,
“লাগবে না আপনার চিপস। আমি কালকেই মেয়েকে নিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো। থাকবো না আপনার সংসারে। আপনি-ই থাকুন।”
আহির বুঝে গেছে বউ এবার রেগে গেছে। সামান্য কিছু নিয়েও মেয়েটা রেগে যায়। মেয়েটা আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে একেবারে আলাদা। রেগে গেলে একেবারে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়ে এ মেয়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আহির তাহা’কে একহাতে ধরে বলে,
“আচ্ছা আমি এখনই এনে দিচ্ছি। এত রাগ করার কি আছে? যাও তুমি মেয়ের কাছে যাও। আমি তোমায় চিপস এনে দিচ্ছি। একেবারে একবস্তা এনে দেবো। এবার খুশি? তুমি আর রেগে নেই তো আমার ওপর?”
তাহা’র রাগ এবারে গলে জল হয়ে যায়। আহিরের গাল টিপে দিয়ে বলে,
“উঁহু! আর নেই। আপনি তাড়াতাড়ি যান।”
তাহা হাসতে হাসতে রুমের ভিতরে চলে যায়। আহির গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে ওঠে। তারপর কি ভেবে যেন আহির বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এই মেয়েটাকে কোন কুক্ষণে যে ভালোবাসতে গেলাম? আমার জীবনটাই পুরো তেজপাতা বানিয়ে ফেললো। তাও এই মেয়েটাকে ছাড়া আমি একমুহূর্তও ভাবতে পারি না। এই মেয়েটা আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার অস্তিত্বে মিশে আছে তাহানিয়া। তাকে ছাড়া আমার একমুহূর্তও চলবে না। একেবারেই না।”
“সমাপ্ত”