অভদ্র_প্রেমিক পর্ব-১৬

0
2642

#অভদ্র_প্রেমিক
#পর্বঃ১৬
#Arshi_Ayat

কথায় আছে অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।নিশাতেরও সেই অবস্থা।একটু আগে ফোনে শোনা কথাগুলো শুনে নিশাত যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে।পাথর হয়ে বসে আছে।পাশে ফোনটা পড়ে আছে।উচু থেকে পড়ায় গ্লাস ফেটে ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।মৃদু বাতাসে টেবিলের ওপর মোমবাতি গুলো কাঁপছে।সাথে নিশাতের খোলা চুলও নড়ছে।নিশাত একধ্যানে কতক্ষণ বসে রইলো তার জানা নেই।হুশ ফিরলো তখন যখন তনয় এসে নিশাতকে ধাক্কা দিলো।তনয়ের ধাক্কায় নিশাত ওর দিকে তাকালো।নিশাতের দৃষ্টি শুভ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না।তনয় ওর সামনে বসে বলল”কি হইছে তোর?এভাবে বসে আছিস কেনো?ভাইয়া কিন্তু একটু পরই চলে আসবে।”

নিশাত তনয়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল”আমার মা মারা গেছে।”

নিশাতের কথায় তনয় হকচকিয়ে বলল”এ..এই তুই কি বলছিস?মানে কি?”

নিশাত কিচ্ছু বলল না।উঠে দাড়িয়ে তনয়কে পাশ কাটিয়ে গটগট করে নিচে নেমে এলো।নিচে তিতির খানকে দেখতে পেয়ে তার সামনে গিয়ে বলল”খালামনি আমার মা মারা গেছে।”

নিশাতের এমন কথায় তিতির খান চমকে উঠে অবিশ্বাসের সুরে বলল”নিশু কি বলছিস এগুলো?কি হইছে তোর?”

তিতির খানের প্রশ্নের মাঝেই ফোন বেজে উঠলো।স্ক্রিনে লেখা “নিশুর বাবা” তিতির খান তড়িৎ গতিতে ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই যা শুনলেন তাতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।ওপাশ থেকে আসাদ সাহেবের আর কোনে কথা তিতির খানের কানে গেলো না।তিনি ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।কাপড়ের আচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন।আর নিশাত নিজের রুমে গিয়ে মুর্তির মতো বসে রইলো।তনয় ছাদ থেকে এসে নিশাতের কথা আর নিজের মায়ের কান্না দেখে সবটা বুঝে গেলো।পকেট থেকে ফোনটা বের করে তিহানকে কল দিলো।তিহান কল রিসিভ করতেই বলল”ভাইয়া কই তুমি?”

“রিয়াদের গাড়ি নিয়ে আসছি।তুই মাকে আর নিশাতকে একটু সামলা।”

তিহানের কথায় স্পষ্ট যে তিহানও খবর পেয়ে গেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিহান গাড়ি নিয়ে চলে আসলো।তারপর চারজন মিলে রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।তিহান ড্রাইভ করছে।পাশের সিটে তনয়।আর পিছনের সিটে তিতির খান আর নিশাত বসে আছে।তিতির খান ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলেও নিশাত টু শব্দও করছে না।পাথরের মতো বসে আছে।যেনো নিঃশ্বাসও ফেলছে না।তনয়,তিহানও চুপ।তিহান অনুভব করতে না পারলেও বুঝতে পারছে নিশাতের কষ্টটা কারণ সেও বাবা হারা।আর আজ নিশাত পৃথিবীর বুকে অনেক নিঃসঙ্গ।ছোটবেলায় বাবা আর আজ মা।নিশাতের সাথেই কেনো এমন হলো?এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই।হয়তো অদৃষ্টের লিখনে এটাই ছিলো!

নিশাতদের বাড়ির ছাদে জ্বালানো মোমবাতিগুলো নিভে গেছে।কেকটা ওইখানে পড়ে আছে।টেবিলের নিচে আংটিটা আর নিশাতের ভাঙা ফোনটাও পড়ে আছে।কি হওয়ার কথাছিলো আর কি হলো?আসলেই জীবন ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়।আমরা যা চাই অনেক সময় তা পাই না।কেনো পাই না তা বিধাতা ই ভালো জানেন।তিহান কি কখনো জানতে পারবে নিশাতের মনের কথা?তার ভালোবাসার কথা!তার এতো সুন্দর সারপ্রাইজের কথা!কি জানি হয়তো পারবে নয়তো কোনো এক দীর্ঘশ্বাসের নিচে চাপা পড়ে যাবে।

ওদের পৌঁছুতে সকাল সাতটা বাজলো।বাড়ির সামনে অনেক মানুষ।ওদের ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলো ওরা চারজন।বসার ঘরের একপাশে নিহিতা বেগমের লাশটা শোয়ানো।আসাদ সাহেব সোফায় বসে কাদছে।চারপাশের পরিবেশ থমথমে।সবার বলাবলিতে জানা গেলো নিহিতা বেগমের ঘুমের মধ্যে ব্রেন স্টোক করেছেন।কেউ কেউ কাঁদছে বিলাপ করে আবার কেউ নিঃশব্দে।তিতির খান বোনের পাশে বসে মুখে হাত বুলিয়ে কান্না করতে লাগলো।আর নিশাত নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো।তিহান ওর ঘরের সামনে এসে বলল”নিশু বাইরে আয়।খালামনিকে এখন নিয়ে যাবে।একবার দেখে যা।”

নিশাত দরজা খুললে তিহান ওর হাত ধরে টেনে লাশের সামনে এনে বসালো নিশাতকে।নিশাত এক হাত দিয়ে মায়ের মুখ স্পর্শ করলো।মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল”চলে যাচ্ছো মা?আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছো?কেনো যাচ্ছো?আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না।ভালোবাসলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে না।ও মা মা আমাকেও নিয়ে যাও।আমিও তোমার সাথে যাবো।নিয়ে যাও না প্লিজ।”

এগুলো বলতে বলতে নিশাত কেঁদে দিলো।আর ওর কথায় সবাই নিঃশব্দে চোখের জল ফেললো।তিহান আর তনয় দুজনেই বাম হাত দিয়ে চোখে মুছলো।নিশাতকে তিতির খান বুকে জড়িয়ে নিলো।নিশাত কাঁদতে অনেক কিছুই বলছে কিন্তু এটা স্পষ্ট না।

নিহিতা বেগমকে গোসল করানো হলো।এখন জানাজা দেওয়া হবে।খাটিয়ার সামনের দুইদিকে তিহান আর আসাদ সাহেন ধরলো আর পিছনে তনয় আর আরেকটা ছেলে ধরলে।খাটিয়া টা তুলতেই নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।ভেতরটা হু হু করে উঠলো।আজ এক মায়ের খাটিয়া তুললো।কোনোদিন না যেনো আরেক মায়ের খাটিয়া তুলতে হয়।যখন কারো খাটিয়া তোলা হয় তখন যারা তোলে তারা যদি মৃত ব্যক্তির আপন কেউ হয় তখন তারাই বোঝে এর কষ্ট কতোটা।সামনে চারজন মিলে খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে আর পিছনে অনেক মুসুল্লি আসছে জানাজায় উপস্থিত হতে।

তিতির খান নিশাতকে গোসল করিয়ে সাদা একটা থ্রি পিছ পরিয়ে দিলো তারপর নিজেও গোসল করে সাদা কাপড় পড়লো।নিচে মহিলারা বসে দোয়া দুরুদ পড়ছে।তাদের সাথে তিতির খানও এসে যোগ দিয়েছেন।দোয়া মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।কান্না দলা পাকিয়ে আসছে তিতির খানের।তিনি নিশাতকেও ডেকেছিলো তাদের সাথে দোয়া পড়তে কিন্তু নিশাত আসে নি।দরজা বন্ধ করে দিলো নিজের রুমের।দরজা বন্ধ করে মায়ের একটা ছবি বুকে জড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

জানাজার নামাজ শেষে লাশ নামানো হলো কবরে।তারপর দাফন কার্য শেষ করে যে যার মতো চলে যেতে লাগলো।আসাদ সাহেবের কিছু বন্ধু আবার বাসায় আসলো তাদের সাথে।তিহান বাসায় ফিরে নিশাতের ঘরের সামনে গিয়ে বলল”নিশু দরজাটা খোল।”

ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না।তিহান পাশের জানালা দিয়ে দেখলো নিশাত হাটু মুড়ে বসে কান্না করছে।তিহান আর কিছু বলল না।এখন সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা তিহানের জানা নেই।তারচেয়ে বরং নিশাত কাঁদুক।

বাইরে থেকে নাস্তা আনা হয়েছে।বাসার সবাইকে নাস্তা দেওয়া হয়েছে।তিহান নিশাতের জন্য নাস্তা নিয়ে ওর রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে বলল”নিশু একটু দরজাটা খোল।”

এভাবে আরো কয়েকবার ডাকার পরও যখন নিশাত দরজা খুলছিলো না তখন তিহান জানালার সামনে আসতেই যা দেখতে পেলো তাতে তিহানের রুহ কেঁপে উঠলো।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)