অভদ্র_প্রেমিক পর্ব-১৯

0
3509

#অভদ্র_প্রেমিক
#পর্বঃ১৯
#Arshi_Ayat

নিশাতের হাতে শিকল পড়ানো আর সেটা খাটের পায়ার সাথে তালা দিয়ে আটকানো।নিশাত বুঝতে পারলো কাজটা কার।এখন খেতে যেতে হলে তিহানকে ফোন দিতে হবে।অথচ নিশাত ভেবেছিলো চুপিচুপি গিয়ে খেয়ে আসবে।হলো না।নিশাত খাটের ওপর থম মেরে বসে পড়লো।এইমুহুর্তে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে।রাগে সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে।ক্ষুধায় পেট ব্যাথা করছে।সারাদিন না খেয়ে থাকা ভিষণ কষ্টের।নিশাত ফোনটা হাতে নিলো তিহানকে কল দেওয়ার জন্য।কিন্তু ফোন করতে লজ্জা লাগছে।এতো রাতে তাও খাওয়ার জন্য ফোন করবে।ব্যাপারটা কতোটা বেখাপ্পা!কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় তো আর থাকা যাচ্ছে না।হঠাৎ নিশাত মাথা চুলকে একটা চিকন ক্লিপ পেলো।নিশাত ভাবলো কতো মুভিতেই তো দেখলাম ক্লিপ দিয়ে তালা খোলে আমিও একটু ট্রাই করি যদি খুলে যায় তাহলে তো ভাগ্য ভালো।নিশাত ক্লিপটা তালায় ঢুকিয়ে চেষ্টা করছে খোলার কিন্তু তালা খোলার নামই নেই।

হঠাৎ দরজার কাছ থেকে একটা হাসির শব্দ আসতেই নিশাত মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো তিহান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল”তুই নিজেকে কি সিনেমার নায়িকা ভাবিস যে তোর চুলের ক্লিপ দিয়ে তালা খুলে যাবে।”

এটা বলে আবার হাসতে লাগলো।আর নিশাত রাগে ক্লিপটা ছুড়ে মারলো।আসলে তিহানও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।আর নিশাতের মতো ওর ও ক্ষুধার জন্যই ঘুম ভেঙে গেলো।তাই উঠে এলো নিশাতের কি অবস্থা দেখার জন্য।এসে নিশাতের কান্ড দেখে আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না।

তিহান হাসতে হাসতেই খেয়াল করলো নিশাত কাঁদছে।তিহান হাসি থামিয়ে দিয়ে ছুটে এসে ওর শিকলের তালা খুলে দিয়ে এক কান ধরে বলল”সরি,সরি।চল খেয়ে আসি।”

নিশাত রাগে বলল”না খাওয়া লাগবে না।”

তিহান বাঁকা হেসে বলল”ওকে না খেলে নাই।আমি খেয়ে আসি।”

এটা শোনার পর জিদ ভুলে নিশাত বলেই ফেললো”আমিও খাবো।”

তিহান যেতে যেতে বলল”তুই বস।আমি আসছি।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিহান খাবার নিয়ে এলো।নিশাত ফ্রেশ হয়ে এসে খাবারে হাত দিতে নিলেই তিহান ওর হাত ধরে ফেললো।নিশাত ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধন দৃষ্টিতে তাকাতেই তিহান বলল”আমি খাইয়ে দিবো।তাই তুই চুপচাপ বস।”

নিশাত বসে পড়লো।তিহান মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো।নিশাত যতো চাইছে ওকে এভোয়েড করতে ততই যেনো ও আরো কাছাকাছি চলে আসছে।খাওয়াতে খাওয়াতে তিহান বলল”তোকে কিছু কথা বলবো।শুনবি?”

“বলো।” নিশাত শান্ত কন্ঠে তিহানের চোখে চেয়ে বলল।

তিহান শুরু করলো”তুই তো জানিসই প্রত্যেক মানুষই মরণশীল।কেউ আজীবন বাঁচবে না।মানুষের জন্ম যেহেতু হয়েছে সেহেতু মৃত্যু হতেই হবে।এটা নিয়ম।এই যে আমি তুই আমরা আজকে আছি কালকে নেই।আমাদের কখন আয়ু ফুরাবে আমরা জানি না।তেমনই খালামনির আয়ু ফুরিয়েছিলো তাই খালমনি চলে গেছেন।আমাদেরও একদিন এভাবেই যেতে হবে।তাই উচিত দুনিয়ায় যতদিন বাঁচি সবাইকে নিয়ে হেসে খেলে বাঁচি।তাতেই জীবন স্বার্থক।আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুঃখ দেন তারপর তিনিই পরিত্রাণ করেন আমাদের শুধু ধৈর্য ধরে তাকে স্মরণ করতে হয়।কিন্তু অনেকেই আছে যারা ধৈর্য ধরতে পারে না।তারা আত্নহত্যার মতো হুটহাট ভয়ানক ডিসিশন নিয়ে নেয়।অথচ আল্লাহ কিন্তু বলেছেন আত্মহত্যা মহাপাপ।শুধু আমাদের ধর্মে না সব ধর্মেই আত্মহত্যা নিষিদ্ধ।তারাই আত্মহত্যা করে যারা আল্লাহকে মানে না।যদি মানতো তবে অবশ্যই ধৈর্য ধরতো।অপেক্ষা করতো পরিত্রাণের।কিন্তু তারা এগুলো করে না।তাই তোর কাছে অনুরোধ করছি তুই এই কাজটা করবি না।”

এতো বড়ো একটা বক্তব্য দিয়ে তিহান থামলো তারপর আবার খাওয়াতে নিলে নিশাত আটকে দিয়ে বলল”ওয়াদা করলাম।কখনো এই কাজ করবো না।”

নিশাতের কথাশুনে তিহান হাসলো।তারপর আবার খাইয়ে দিয়ে বলল”আর সবসময় খালামনি আর খালুজানের জন্য দোয়া করবি।তার কবর জিয়ারত করবি।কারণ সন্তানের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।”

নিশাত ছলছল চোখে বলল”আচ্ছা তিহান ভাইয়া মা মারা গেলে কি বাবা পাল্টে যায়?আমার বাবা এখন আর আগের মতো কথা বলে না।অথচ তারই উচিত ছিলো এই সময়ে আমার পাশে থাকা।এইজন্যই কাল খুব খারাপ লেগেছিলো।আর আমি…”

বলতে বলতে নিশাত কান্না করে দিলো।তিহানও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে।বলতেও পারছে না আসাদ যে ওর বাবা না।কিন্তু এসময় বলাটাও ঠিক হবে না।তাই চেপে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আর চোখের পানি মুছে বলল”সব ঠিক হবে ধৈর্য ধর।”

নিশাত নাক টেনে চোখ মুছলো তারপর ভেজা গলায় বলল”তুমি খাবে না?”

“হুম খাবো তো কিন্তু জানিস ইদানীং নিজের হাত দিয়ে খেতে ইচ্ছে করে না।আহা!কেউ যদি খাইয়ে দিতো।”

নিশাত বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বলল” বিয়েশাদি করে নাও তাহলেই তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে।শোনো আমি আর খাবো না।তুমি খেয়ে নাও।”

তিহান মনে মনে হতাশ হলেও কিছু বলল না।তারপর নিজে খেয়ে নিলো।খাওয়া শেষে তিহান বলল”কফি চলবে তোর?”

“আচ্ছা দাও।আর একটা গান শুনাবা?তোমার গলায় গানটা খুব মানায়।”

তিহান হালকা হেসে বলল”ঠিকাছে।আমি আসছি।”

তিহান দুই কাপ কফি নিয়ে এলো।যেহেতু টখানে গিটার নেই তাই খালি গলায়ই শুরু করলো তিহান

Dil ko dil se kuchh hai kehna
Dil se ab na door rehna
Dil ki bas yehi ghuzarish hai

Dhadkanon ko ki sun’ne baatein
Jo labon se keh na paate
Dil ki bas yehi ghuzarish hai

Jab se mera dil tera hua
Poochho na mujhko mujhe kya hua
Ab teri baahon mein jeena mujhe
Warna hai mar jaana

গানটা যখন গাইছিলো নিশাত বুঝতে পারছে এই গানের প্রতিটি লাইন তার জন্য।নিশাত মনে মনে শান্তি পেলো যাক এমন কেউ তো আছে যে ওকে ভালোবাসে।
তারপর দুজনই কফি শেষ করে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

ভোরে আলো ফুটতে শুরু করেছে।নিশাত নামাজ পড়ে বারান্দায় দাড়িয়েছিলো অনেক্ক্ষণ।শান্তি শান্তি লাগছে মনে।মোনাজাতে অনেক্ক্ষণ মায়ের জন্য দোয়া করেছে সে।আসলেই নামাজ পড়লে যে মনে প্রশান্তি আসে এটা মিথ্যে নয়।নিশাত বারান্দা থেকে ঘরে এলো।আয়নার সামনে বসে নিজেকে একনজর দেখলো।এই একমাসে কত পরিবর্তন ঠিক মতো নিজের যত্নও নেওয়া হয় না।চিরুনীটা দিয়ে চুল আচড়ে তিহানের ঘরের দিকে পা বাড়ালে।গিয়ে দেখে তিহান হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।বিছানা চাদরের অবস্থা টাইট।বোঝাই যাচ্ছে বিছানার ওপর টর্নেডো গিয়েছে।আচ্ছা একটা মানুষ ঘুমিয়ে এতো গড়াগড়ি কিভাবে খায়!

নিশাত তিহানকে হালকা ডাকতেই তিহান উঠে পড়লো।তারপর বলল”কিছু বলবি?”

“আমার সাথে একটু যাবে?”

“কোথায়?”

“মায়ের কাছে যাবো।”

তিহান বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলটা ঠিক করে বলল”চল।”

তারপর দুজনই বেরিয়ে পড়লো।নিশাতের মায়ের কবর বেশিদূর না।দশ বারো মিনিট হাটলেই চলে আসা যায়।নিশাত আর তিহান কবর জিয়ারত করলো।জিয়ারত শেষে নিশাত কবরের সামনে বসে পড়লো তারপর কান্না করতে করতে বলল”মা,ও মা,শুনছো?আমি নিশাত।তোমার নিশাত।আমি তোমাকে ছাড়া ভালো নেই।খুব কষ্ট হয় আমার।ইচ্ছে করে তোমার কাছে চলে আসি।”

এতটুকু বলেই নিশাতের কান্নার বেগ বেড়ে যায়।আর নিশাত জ্ঞান হরায়।তিহান দ্রুত নিশাতকে ধরে ফেলে তারপর কোলে নিয়ে হেটে কবরস্থান থেকে বের হয়ে মেইনরোডে চলে আসে।ওকে কোলে নিয়ে এভাবে হাটা যাবে না।অনেক সময় লাগবে বাসায় পৌঁছাতে তাই তিহান রিকশা খুঁজতে লাগলো।কিন্তু একটা রিকশাও নাই।এদিকে পাঁচ মিনিট হতে চলল রিকশার নাম গন্ধও নেই আবার তিহানের হাতও ব্যাথা করছে।তিহান একটু সামনে এগিয়ে একটা রিকশা পেলো।কিন্তু ও যেতে যেতেই একজন রিকশায় উঠে পড়লো।রিকশা টান দেওয়ার আগেই দ্রুত পৌঁছে লোকটাকে বলল”ভাইয়া প্লিজ একটু রিকশাটা ছাড়বেন।ইমার্জেন্সি।”

তিহানের কোলে নিশাতকে দেখে লোকটার নেমে গেলো। তিহান নিশাতকে নিয়া রিকশায় উঠে লোকটাকে ধন্যবাদ দিলো।তারপর তাড়াতাড়ি বাসায় পৌছে তিহান মুখে পানি ছিটিয়ে নিশাতের জ্ঞান ফিরালো।জ্ঞান ফিরতেই নিশাত উঠে বসলো।তিহান ওর দিকে পানি এগিয়ে দিলো।নিশাত পানি খাওয়া শেষ করতেই তিহান বলল”এখন ঠিক আছিস?”

নিশাত মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।তারপর ওকে নিয়ে নাস্তা খেলো।আসাদ সাহেবের কোনো খবর নেই।কখন বাসায় আসে কখন যায় কেউ জানে না।

এভাবেই তিহানের শাসন মিশ্রিত ভালোবাসা,বকা,দুষ্টামি সব মিলিয়ে আট মাস পেরিয়ে গেলো।এই আটমাসে নিশাত পুরোপুরি স্বাভাবিক নাহলে মোটামুটি ঠিক আছে।এই আট মাসে দুজনই বুঝেছে যে ভালোবাসাটা আর নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এটা অপরপক্ষও জানে।কিন্তু জানলে কি হবে কেউই বলছে না।দুজনই ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।দেখা যাক এই নিশ্চুপ ভালোবাসা কতদূর গড়ায়।

কাল তিহান কুষ্টিয়া গেছে।দুইদিন পর ফিরবে।তিহান যাওয়ার পর থেকেই নিশাত ওকে মিস করা শুরু করেছে।এক সে ই তো যে ওকে ভালোবাসে।আসাদ সাহেব তো তেমন একটা কথা বলে না।

নিশাত রেডি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য।চুল আচড়াতে আচড়াতে খেয়াল করলো আসাদ সাহেব ওর ঘরে এসেছে।নিশাত চুল আচড়ানো অফ করে দিয়ে আসাদ সাহেবের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।ওর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আসাদ সাহেব করুণ গলায় বলল”মা রে,তোর মা মরে যাওয়ার পর একবারে ভেঙে পড়েছিলাম তাই তোকে আর সময় দিতে পারি নি।তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

আসাদ সাহেবের এমন করুণ গলা শুনে নিশাত গলে গেলো।তারপর এগিয়ে এসে আসাদ সাহেবের হাত ধরে বলল”তোমার ওপর আমার ক্ষোভ নেই বাবা।”

আসাদ সাহেব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল”আমার একটা কথা রাখবি?”

“কি?” নিশাত বলল।

নিশাতের প্রশ্নের জবাবের আসাদ সাহেব যা বলল তাতে নিশাত যেনো দ্বিতীয়বারের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলো।

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)