অভদ্র_প্রেমিক পর্ব-২০

0
3188

#অভদ্র_প্রেমিক
#পর্বঃ২০
#Arshi_Ayat

তিহানের দাদু অসুস্থ বলে সে কুষ্টিয়া এসেছিলো।এখন মোটামুটি সুস্থ।তাই ও কাল ঢাকা ফিরবে।এই দুইদিনে বেশ কয়েকবার নিশাতের সাথে কথা হয়েছে।

একটু আগে রিয়াদ ফোন দিয়ে বলেছিলে বাসায় যেতে।তিহান ওর বাসায় যাওয়ার জন্যই বের হয়েছে।

সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি নেই।প্রকৃতির বাধ্য নিয়মে সূর্য পশ্চিম হেলে পড়েছে।পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নিড়ে।পুরো আকাশে একটা সোনালী আস্তরণ পড়েছে।দেখতে ভালোই লাগছে।মৃদু বাতাস বুঝিয়ে দিচ্ছে শীত এলে বোলে।নিশাতের দৃষ্টি দিগন্তে মিলিয়েছে।আনমনে কিছু একটা ভাবছে ছাদে দাড়িয়ে।দুদিন ধরে অস্থির অস্থির লাগছে বুকের ভেতরটা।কিসের এতো অস্থিরতা?কোনো এক অজানা কারণে ঘুমও হচ্ছে না।আসলেই কারণটা অজানা নাকি জেনেও না জানার প্রয়াস!!দু দিন ধরে ভার্সিটিতে যেতেও ইচ্ছে করছে না।কেনো যেনো মনে হচ্ছে সময়গুলো কাটতে চাইছে না।নিশাত ভাবছে আচ্ছা আমি যদি হারিয়ে যাই তবে তিহান ভাইয়া কি খুব কষ্ট পাবে?মানুষটা আমাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু আমি তার ভালোবাসার মূল্য দিতে পারলাম না।এগুলো ভেবেই এই সন্ধ্যার প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে চোখের পানি ফেললো।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে নিশাত নিজের ভাবনাগুলো আড়াল করে চোখ মুছলো তারপর রিসিভ করতেই অপাশ থেকে মেহের বলল”কেমন আছো নিশাত?”

“ভালো,তুমি?”

“আমিও ভালোই আছি।তিহান ভাইয়া এখন আমাদের বাসায়।কাল ফিরবে।”

“ও বলেছে আমাকে।”

“তারপর কি করবে ভাবলে?”

“কিছু না।”

“কিছু না মানে?তুমি তাকে ভালোবাসে বলতেও চেয়েছিলে কিন্তু বলতে পারো নি তখন।তো এখন বললে কি সমস্যা?তোমার উচিত বলে দেওয়া।”

“দেখি কি করা যায়।”

নিশাত এই কথা সেই কথা দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে নেয়।তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ছাঁদ থেকে নিচে নেমে ঘরে চলে যায়।

তিহান সকাল সকাল রওনা দিয়েছে।এই আরো কয়েকঘন্টা পরই নিশাতের সাথে দেখা হবে।দু’দিন খুব মিস করেছে।

নিশাত না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে।আজ খেতে ইচ্ছে করছে না কেনো জানি তাই আর জোর করে খায়ও নি।তবে তিহান থাকলে না খেয়ে এক পা ও বাইরে দেওয়া যেতো না।কিন্তু এখন তো তিহান নেই।তাই এগুলো খেয়াল করার মতো সময় বা মন ও কারো নেই।

ভার্সিটি এসে সোজা ক্লাসে চলে এলো নিশাত।একটু পর নিত্যও এলো।নিত্য ওর সাথে বকবক করছে কিন্তু নিশাত তেমন একটা উত্তর দিচ্ছে না।মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে তাতে নিশাত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।বারবারই মনে হচ্ছে আপন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।অসহ্য যন্ত্রণায় ভেতরটা বারবারই ছটপটিয়ে উঠছে।

ক্লাস শেষে নিশাত বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই দেখলো প্রান্ত সোফায় বসে আছে।ওকে দেখে উঠে দাড়িয়ে বলল”হাই,আমি প্রান্ত শাহরিয়ার।”

“জ্বি বাবার কাছে আপনার সম্পর্কে শুনেছি।আপনার কফি চলবে?”

“হলে মন্দ হয় না।”

“ঠিকাছে বসুন।আমি বলে আসি।”

নিশাত রান্নাঘরে দুটো কফির কথা বলে এসে প্রান্তর মুখোমুখি সোফায় বসলো।তারপর মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল”আপনার সম্পর্কে বলুন।”

“আমার তেমন কোনো পরিচয় নেই।আমার নামতো জানেনই।এছাড়া আমার বাবা মা নেই।আমি একা।”

এভাবেই কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে কথা চলল।তারপর প্রান্ত কফি খেয়ে নিশাতের নাম্বারটা নিয়ে গেলো।প্রান্ত যাওয়ার আধঘন্টা পরই তিহান পৌঁছালো বাসায়।বাসায় এসেই সরাসরি নিশাতের রুমে এলো।নিশাত শুয়ে আছে দেখে আর ডাক দিলো না।নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলো।

ঘুম সন্ধ্যায় ভেঙেছে নিশাতের।তবুও আজানের আওয়াজ শুনে।ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে খাটে বসতেই তিহান হাজির হলো।তিহানকে দেখেই নিশাত প্রাণপণে চেষ্টা করলো স্বাভাবিক থাকতে।কিন্তু নিশাতকে দেখেই তিহান বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে যা নিশাত আড়াল করছে।এমন কি হতে পারে!!তবুও নিশাতকে বুঝতে না দিয়ে কিছু বলতে নিবে এই সময় নিশাতের ফোনটা বেজে উঠলো।আননোন নাম্বার।নিশাত রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে প্রান্তের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।নিশাত শান্ত কন্ঠে বলল”আমি একটু ব্যস্ত আছি।পরে ফোন করছি।”এটা বলে রেখে দিলো।নিশাত ফোন রাখতেই তিহান ওর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল”কে ছিলো?”

“একটা ফ্রেন্ড।”

“তো কথা তো বলতেই পারতি।কি এমন ব্যস্ত ছিলি যে ফোন কেটে দিলি?”

“এমনি।ভালো লাগছে না কথা বলতে।”

তিহান নিশাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল”কি হয়েছে?সোজাসাপ্টা বল।”

“কিছু না।” নিশাতের এই উত্তর তিহানকে শান্ত করতে পারলো না।তিহান আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসাদ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল”কি রে নিশাত প্রান্তর সাথে তোর কথা হয়েছে?”

আসাদের কথায় তিহান আর নিশাত দুজনই ঘুরে তাকালো তার দিকে।তিহানকে দেখে নিশাতের জবাবের প্রতীক্ষা না করেই আসাদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন”কখন এলে তিহান?”

“এইতো আরো ঘন্টাদুয়েক আগে।”

“ওহ!শোনো তোমাকে একটা গুড নিউজ দেই।নিশাতের বিয়ে ঠিক করেছি প্রান্তর সাথে।”

আসাদের কথায় মুহুর্তেই যেনো তিহানের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।বিয়ে ঠিক করেছে তাও প্রান্তের সাথে?প্রান্ত কি ওর সাথে ডাবল গেম খেললো?

ঠিক এই ভয়টাই নিশাত পাচ্ছিলো।ও তিহানকে কিছুতেই জানতে দিতে চাইছিলো না কিন্তু সব বেকার।শেষমেষ জেনেই গেলো।

আসাদ সাহেব বের হওয়ার পর তিহানও ঝড়ের গতিতে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো।আর নিশাত ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো।

“শু***বাচ্চা,তুই আমার সাথে গেম খেলছিস তাই না?আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো কুত্তার পেটে কুত্তাই হয়।তুইও তোর বাপের মতো।” এটা বলে প্রান্তকে হকিস্টিক দিয়ে আরো কয়েকবার মারলো।

আসাদ সাহেব বের হওয়ার পর তিহান প্রান্তের বাসায় এসেই ভাংচুর শুরু করেছিলো।তারপর এক কথায় দুই কথায় হাতাহাতি হয়।শেষে তিহান নিজের সাথে আনা হকিস্টিকটা দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকে প্রান্তকে। প্রান্তের অবস্থা পুরো কাহিল।ফ্লোরে পড়ে গোঙাচ্ছে।এতক্ষণ ধরে তিহান ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে।একবার ভেবেছিলো মেরেই ফেলবে কিন্তু পরে আর মারে নি।হকিস্টিকটা ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসলো।এতক্ষণ তিহানের ভয়ে কোনো চাকর না আসলেও তিহান যাওয়ার পর সবাই এসে প্রান্তকে ধরে তুললো।তারপর ডাক্তারকে কল করলো।

এখন রাত এগারোটা।নিশাত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।কোথা থেক হুট করে তিহান ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।নিশাত ওকে দেখে আৎকে উঠলো।একদম স্বাভাবিক লাগছে না ওকে।চোখমুখ ফোলা,চুলগুলো আউলা ঝাউলা হয়ে আছে।মনে হচ্ছে ছোট খাটো একটা তুফান বয়ে গেছে।তিহান রুমের লাইট অফ করে দিতেই নিশাত পুনরায় কেঁপে উঠলো।আজ কিছু একটা হবে এটা নিশ্চিত!তিহান রুমের ড্রিম লাইট জ্বেলে দিলো।হলুদ আলোয় পুরো ঘর জ্বলজ্বল করছে।রুমের এককোনায় নিশাত দাড়িয়ে আরেক কোণায় তিহান।চারপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।নিশাতের এই মুহুর্তে তিহানকে ফেস করতে একদম ইচ্ছে করছে না কিন্তু উপায় নেই তিহান যে ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে তাতে নিশাত নিশ্চিত তিহান এমনি এমনি এখান থেকে যাবে না।তিহান এক পা দু পা করে নিশাতের দিকে এগুচ্ছে।চোখে মুখে ভালোবাসার আকুলতা।কিছু না বলা অনুভূতিরা উঁকি দিচ্ছে।

তিহান একবারে নিশাতের কাছাকাছি দাড়িয়ে আছে।আরো একপা এগিয়ে নিশাতকে নিজের সাথে চেপে ধরে ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে নিলো।আর অন্য হাত দিয়ে নিশাতের কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলল”তুই কি কিছু বুঝিস না?”

নিশাতের মুখে কথা নেই।চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।তিহান নিশাতের জবাব না পেয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়াতে নিলেই নিশাত ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।

তিহান বিষ্ময়ে নিয়ে নিশাতের দিকে তাকাতেই নিশাত অন্যদিকে ফিরে তাকালো।তিহান আবার এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই নিশাত বলল”চলে যাও তুমি।”

তিহান আবারও হতভম্ব হয়ে গেলো।নিশাত কি সত্যিই বুঝতে পারছে না কিছু?তিহান নিশাতের কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে বলল”তুই কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিস না?”

“না আমি কিছু বুঝতে পারছি না আর বুঝতে চাইও না।”

“কেনো এভাবে দূরে যাওয়ার মানে কি?”

“কিছু না।”

“নিশাত রাগ উঠাবি না সত্যি করে বল”

“বললাম তো কিছু না।” নিশাত জোরেশোরেই বলল।

এবার তিহানের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।নিশাতের বাহু চেপে ধরে বলল”তুই আমায় ভালোবাসিস না?”

“না” নিশাত নিচের দিকে চেয়ে বলল।

“আমার দিকে তাকিয়ে বল।” তিহান কঠোর গলায় বলল।

নিশাত ওর দিকে তাকিয়ে এক নিমিষেই “না” বলে অন্যদিকে তাকালে।

তিহান ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল”তাহলে সব কি মিথ্যা?”

“কোন সব?”

‘কুষ্টিয়ায় থাকতে আমাকে যে প্রপোজ করার প্ল্যানটা।”

নিশাত চমকে উঠলো।তার মানে তিহান সব জানে।তিহান নিশাতের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল”হ্যাঁ আমি সব জানতাম।যেদিন তুই এলবামটা ঘেটেছিলি সেদিনই আমি জানতে পারি।কারণ তোর এলবামটা প্রতিরাতেই আমি দেখি।তুই ধরা খেতি না কিন্তু পিছনের ছবিটা উল্টো করে রেখেছিস তাই ধরা খেয়ে গেলি।তারপর আমার ডায়েরি পড়া থেকে সব কিছু আমি জানি।তারপরও কি বলবি সব মিথ্যা?”

নিশাত কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে বলল”ভুলে যাও।আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

তিহান রাগে বেডসাইডের পানির গ্লাসটা হাতের চাপে ভেঙে ফেললো।কাচ ভেঙে হাতে ঢুকে যাওয়ার গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগলো।

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)